You are currently viewing অনশ্রু ঈশ্বর: কাজী লাবণ্য || শাহাব আহমেদ

অনশ্রু ঈশ্বর: কাজী লাবণ্য || শাহাব আহমেদ

অনশ্রু ঈশ্বর: কাজী লাবণ্য
শাহাব আহমেদ

ঈশ্বরের কি চোখ আছে যে অশ্রু থাকবে?
বইটি পড়ার সময়ে প্রশ্নটির চঞ্চু বার বার মগজে আঘাত হেনেছে এবং যখন মনে হয়েছে উত্তরটি আমি জানি মহৎ ভেল্কিবাজের মত কলমের খোঁচায় পুরো ডাইমেনশনটিকে পরিবর্তন করে লেখক বুঝিয়ে দিলেন অজানার জগতে আগের জানাটুকু ছিল অপূর্ণ, পরেরটুকু পূর্ণতর, মোদ্দা কথা হল তারপরেও জানা-অজানায় কিচ্ছু আসে যায় না, সমাজে যারা নিগৃহিত এবং যারা নিগ্রহ করে তাদের স্থান বদলায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিবর্তনের স্বপ্নটা মানুষের মন থেকে কখনই পরিপূর্ণভাবে উবে যায় না। যায় না বলেই নতুন নতুন গল্প বা উপন্যাসের জন্ম হয়।
“রুক্ষ কদর্যতা নিয়ে বিরাজ করে এখানকার আবহ। সবুজ, সতেজতার বড় অভাব, শুধু কি তাই, সব কিছুর অভাব। কেবল অভাবের অভাব নেই।”
কাজী লাবণ্যের ‘অনশ্রু ঈশ্বর’ উপন্যাসের শুরুর বাক্য এটি নয়, এর বিচিত্র ঘটনাবলী ও জীবন আলেখ্যের হৃৎপিণ্ডের কাছে কোথাও না কোথাও লুকিয়ে রয়েছে।
“সনাতন ধর্মমতে একদিন বিশ্বপিতা পথে হাঁটছিলেন, সামনে মানুষের বর্জ দেখে থেমে গেলেন। এখন এই নোংরা পরিস্কার করবে কে? তখন তিনি সেই নোংরা থেকে সেখানেই একজন মানুষ সৃষ্টি করে আদেশ দিলেন, ‘মাত্রক, সামনে মলগুলো পরিস্কার করে দে।’ এভাবেই সৃষ্টি হলো মেথর সম্প্রদায়ের।”
খুব বেশি লেখা হয়নি সমাজের সর্বনিম্নস্তরের এই মানুষগুলোকে নিয়ে, অন্তত আমার চোখে পড়েনি।
হরিশংকর জলদাসের অসামান্য উপন্যাস ‘রামগোলাম’ ও রাধিকার জীবন নাট্য পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আবার মুগ্ধ হলাম ‘অনশ্রু ঈশ্বর’ পড়ে।
এর নির্মেদ টান টান ভাষা, সাবলীল শব্দের প্রবাহের কারণে পড়তে সময় লেগেছে মাত্র একদিন, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিরতি দিতে হয়নি, কোথাও মনে হয়নি গল্প ঝুলে গেছে বা লেখক মনোযোগ হারিয়েছেন। গল্পের গাঁথুনিও অত্যন্ত পরিণত।
হরিজন সম্প্রদায়ের যদুলালের গৃহের পুত্রবধু যমুনা, বুদ্ধিমত্ত, সুধীর ও জীবনের কাছে পরাজয় মেনে নিতে অনাগ্রহী এক নারী, অন্যদিকে উচ্চপদে আসীন একজন অত্যাচারী, উদ্ধত ও বিবেকহীন ইন্জিনিয়ার স্বামীর স্ত্রী নীলু, যার ঘরে গুমোট অন্ধকার ও হতাশার রক্তক্ষরণ, তা সত্ত্বেও সে যমুনাকে মানব-বর্জ থেকে উদ্ভূত অচ্ছুৎ কোনো প্রাণি হিসেবে না দেখে দেখে মানুষ হিসেবে। সে তাকে স্নেহ করে, স্পর্শ করে, ঘরে ঢুকতে দেয় এমনকি থালাবাসন মাজতে দেয় যা সমাজে অগ্রহণযোগ্য। সমাজের দুই প্রান্তের দু’জন নারী এই গল্পের মূখ্য চরিত্র যাদের ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে উপন্যাসের কাহিনী।
লেখকের শক্তিশালী কলমে এমন কিছু বর্ণনা রয়েছে যা অনপনেয়।
যেমন মাতৃহীন সদা ক্ষুধার্ত কিশোর ‘মুল্লুক খাওয়া’ নাকে শুধু গরমভাতের ঘ্রাণ পায় এবং তার অন্য কিছুই করতে ইচ্ছে হয় না, শুধু খেতে ইচ্ছে হয়।
সহজ সাবলীল জীবনচিত্র, এখান নন্দনতত্ত্বের কিছু নেই, এটি কোনো চিত্রকল্প নয়, জটিল কোনো দর্শন নয়, রাজনীতি অর্থনীতি নয়, আসলে কিছুই নয়, শুধু রোম ওঠা কুকুরের পিঠের মত দগদগে বাস্তব জীবন।
অথবা কালো কুচকুচে বাকপ্রতিবন্ধী মেয়েটি মধুবালা, সভ্য সমাজে স্পর্শ করার জন্য যে ভীষণভাবে অচ্ছুৎ কিন্তু তার দেহটি অচ্ছুৎ নয় এবং সমাজের পাপ অথবা পূন্য তার জরায়ুতে ভ্রুণ হয়ে বাড়তে থাকে এবং তার পিতা লাঞ্ছিত বঞ্চিত মানবেতর জীবনের যদুলাল যখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তাকে মারতে থাকে এবং তার মা কাঁদে, সদ্য জননী হওয়া ভ্রাতৃবধু কাঁদে, পৃথিবী হাসে মিটি মিটি কারণ অনশ্রু ঈশ্বর সংসারের নাট্যমঞ্চে হাসির উপাদানের ঠাসবুনুনি হিসেবেই গেঁথে দিয়েছেন সমাজের নীচু স্তরের মানুষগুলোর জীবন ও সংসার।
মধুবালাদের মুক্তি কিসে?
জবরদস্ত মৃত্যুতে।
কারণ যারা অন্যায় করে সমাজ তাদের শুধু বাঁচিয়েই রাখে না, বাড়তে দেয় অ্যানোফ্লিস মশার মত যেন তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে অন্যায় ছড়িয়েই যেতে পারে। সমাজ ক্রিমিনালদের অনুপস্থিতি সইতে পারে না, যেমন সইতে পারে না সৎ মানুষের উপস্থিতি।
তাই মেথর পল্লীর যদুলাল, হীরালাল, মধুবালা, যমুনা ইত্যাদির জীবন জীবন নয়, সৃষ্টির আদিতে উদগত এক অব্যক্ত দীর্ঘশ্বাস। এই দীর্ঘশ্বাসটুকু না থাকলে পৃথিবীটা টাট্টিময় হয়ে উঠতো, ভদ্রলোকেদের হাঁটতে হতো নাকে রুমাল দিয়ে অথবা হাঁটার মত স্থানও খুঁজে পাওয়া যেতো না। কিন্তু তাদের অবদানের প্রতিদান হলো অবহেলা ও ঘৃণা, তাদের স্পর্শ থেকে যতদূর থাকা যায়, থাকা। কিন্তু নীলু তা মানতে রাজী নয়, ফলে সে সহ্য করে স্বামীর নিপীড়ন।
কিন্তু যমুনারও সমস্ত সত্তা বিদ্রোহ করে,
“হ্যাঁ, আমি তো ম্যাথরের বাচ্চাই। আমার বাপ মা ম্যাথর, আমার শ্বশুর ম্যাথর, আমার স্বামী ম্যাথর, আমার চৌদ্দ পুরুষ ম্যাথর, আমি নিজেও ম্যাথর।
কিন্তু হেই সাহেব, তুমি তো শিক্ষিত, তুমি তো আপিসের বড়ছার, তুমি আমারে কুত্তার মতন দূর দূর করে খেদায় দিলে তাতে আমার দু:খ নাই কিন্তু তুমি মেমসাহেবকে সকলের সামনে অপমান করলে! তাকে এতবড় আঘাত দিলে! সে তোমার স্ত্রী, তারে তুমি চেন না! এগিলা কি শিক্ষিত মাইনষের কাম! তার চাইতে তো আমার ম্যাথর স্বামীই ভালো, হাজার গুনে ভালো।’
সমাজে শিক্ষিত বলে পরিচিত যারা, এই হল তাদের চরিত্র। লেখক অত্যন্ত শক্তির সাথে যমুনার মুখ দিয়ে বলিয়েছেন সত্য কথাটি, ওই শিক্ষিত ইন্জিনিয়ারের চেয়ে তার অশিক্ষিত অস্পৃশ্য স্বামী হীরালাল অনেক ভালো কারণ সে তার স্ত্রীর অমর্যাদা করে না।
সুতরাং যে শিক্ষা আমাদের নীচু স্তরের ওই মানুষগুলোর থেকে পৃথক করে, উদ্ধত, অমানুষ ও বিবেকহীন করে সেই শিক্ষার প্রয়োজন আমাদের আছে কি? এই প্রশ্নটি যখন আমাদের মাথায় ঘুরতে থাকে তখনই আমরা অন্য এক প্রপঞ্চের মধ্যে হাবুডুবু খাই, মেথর পল্লীতে স্কুল স্থাপন করে নীলা ও যমুনা যে আলো ছড়ানোর মশাল জ্বালানোর চেষ্টা করে তা তো ওই একই শিক্ষা যা ইন্জিনিয়ারকে মানুষ করে না, ডাক্তারকে মানবিক করে না, শিক্ষককে সহানুভূতিশীল করে না এবং একজন আমলাকে বিবেকহীন, কেরানিকে ঘুষখোর এবং একজন হজরত আলীকে ধার্মিক লম্পটে পরিণত করে।
এই বইটির মধ্যে এমন বহুকিছু রয়েছে যা পাঠের পরেও আমাদের চিন্তায় ঘুরপাক খায়।
তবে বইটির দু’একটি জায়গায় বর্ণনার টান টান বুনন সামান্য শিথিল হয়েছে, লেখকের কিছুটা মনোযোগের বিক্ষেপন ঘটেছে বল মনে হল।
পৃ ৮৬ মধুর মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন না করাটাই ভালো হতো, কারণ মনোযোগী পাঠক লেখকের বর্ণনার নৈপুন্যে ইতিমধ্যেই বুঝে নিয়েছে কী ঘটছে মধুবালার সাথে। লেখক অসচেতনভাবে বলছেন মধুবালাকে হত্যা করেছে তার মা কিন্তু আসল হত্যাকারী সমাজ, মা তার অসহায়
ইন্স্ট্রুমেন্ট। মনে রাখতে হবে কখনও কখনও পাঠক লেখকের চেয়েও ধীমান এবং তার চিন্তার জায়গাটুকু পূর্ণ করে দেয়ার প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া
মধুর মৃত্যুর সময়ে যদুলালের মৃত্যুর আগাম খবরটা না দিলেও চলতো কারণ একটু পরেই যে বর্ণনা আসবে তা একটু আগের বর্ণনার সাথে ট্যাগ করা অপ্রয়োজনীয়।
একইভাবে ৯৩ পৃ টান বাজারের সুইপার সনু, পুজা ও মিনার প্রথম এসএসসি পাসের খবর এবং টনি মরিসনের বিলাভড উপন্যাসের সেথ এর প্রসঙ্গ এখানে প্রয়োজনাতিরিক্ত। উপন্যাসের লাভ কিছু হয়নি কিন্তু পাঠকের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করেছে।
তবে এই বিক্ষেপ খুবই সামান্য। লেখার সৌন্দর্য এবং পাঠের আনন্দ ক্ষুন্ন হয়নি। মনে হয়েছে বহুদিন পরে একটি ভালো বই পড়লাম, নিম্নবৃত্তের মানুষের জীবনের জঙলে লেখকের যে জার্নি আমিও দূরে থাকলাম না তার থেকে। একটি মহৎ বই এমনই অনুভূতি দিয়ে শেষ হয়। বিদ্যাপ্রকাশ থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত বইটির সুন্দর প্রচ্ছদ এঁকেছেন রাজীব দত্ত।

ওকালা
অক্টোবর ৭, ২০২৪

***************************************