You are currently viewing দ্বন্দ্ব || ইসরাত জাহান

দ্বন্দ্ব || ইসরাত জাহান

দ্বন্দ্ব

ইসরাত জাহান

নিশুতিরাত।

বাতাসের তাড়া খেয়ে হালকা, ভারী মেঘ গুলো উত্তর দিকের রূপালী থালাটাকে ঢেকে দিয়েছে। কুয়াশার লাজুক উপস্থিতি, চারপাশে হালকা শীতের আবহ। দুই চারবার মেঘের ঘোমটার নিচে থেকে রূপালী থালাটা উঁকি দেয়, আবারও লুকিয়ে যায়। থেকে থেকে ঝিঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায় আর শোনা যায় নালা দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির কলকল শব্দ। এই শব্দের মাঝে আরো একটি শব্দ শোনে জেগে থাকা কিছু মানুষ। সেগুলো কুকুর ও শিয়ালের।

শহরের চকচকে-ভেলভেট হাওয়া লেগে নয়াবাড়ি মফস্বলটা ধীরে ধীরে শহুরে হয়ে ওঠার পাঁয়তারা করছে, সাথে মানুষগুলো। রাজধানীর মতো ঝা-চকচকে এলইডি বাতির বাহুল্য না থাকলেও ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো এখন আর আগের মতো হলুদাভ নয়। রেলস্টেশন এলাকাটায় নতুন কর্ম উদ্যাগের প্রভাবে কয়দিন আগে বেশ ঝা-চকচকে হয়ে উঠেছে। অবশ্য স্টেশন থেকে নয়াবাড়ির দিকে আসতে আসতে সব উজ্জ্বলতা ফিকে হয়ে আসে। রাস্তাটা কিছু কিছু জায়গায় ভাঙা, কিছু ল্যাম্পপোস্টের বাতি নষ্ট। এখন তা পোকামাকড়ের নিশ্চিন্ত আবাসন। অমাবস্যার অন্ধকারে ডুবে আছে কিছু কিছু রাস্তা। আগে যাও রাস্তাগুলো কিছুটা ভালো ছিল, বন্যা পরবর্তী সময় আরো ক্ষয়েছে অনেকটুকু। রাস্তা ভরাটের কাজ শুরু হতে গিয়ে হয় না নেতাদের আঙুলের ইশারায়। রাস্তায় রিকশা টানতে কেমন কষ্ট হয় সেই কথা রিকশাওয়ালাকে কেউ জিজ্ঞেস করে না, তবে রিকশা আরোহীর কোমরে, পায়ে ব্যথা শুরু হয় রিকশা থেকে নেমে যাওয়ার পরে।

রাতে দোকানপাট গুলো খোলা থাকলে কিছু আলো আসে রাস্তায়। তবে রাত বারোটার পরে দোকানপাট বন্ধ হলে সেই আলোটুকু হারিয়ে যায়। সাড়াশব্দহীন রাস্তায় দুই একটা হ্যাংলা কুকুর মাঝে মাঝে চিৎকার করে ওঠে এখানে ওখানে। সেই হ্যাংলা কুকুরগুলোর সাথে হ্যাংলা কিছু মানুষ রাস্তায় অপেক্ষা করে বেঁচে থাকার তাগিদে। তাদের মঙ্গলকাব্যে যে ঘুটঘুটে আঁধারে মিশে আছে। এই অন্ধকারে, হাফহাতা শার্টের হাতাটা কনুই উপর গুটিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আকিল। পাড়ার সবার কাছে আকলু নামেই পরিচিত। তাছাড়া আরো একটা পরিচয় আছে সবার কাছে। অবশ্য সেটা গর্বের নয়, নিন্দার ও তিরস্কারের। আপনজনদের গালমন্দ।

আজ যেমন, সন্ধ্যায় ঘর থেকে বের হবার আগে ভাঙ্গা আয়নায় নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে আকলু খেয়াল করে ওর চেহারাটা অন্য আট দশজনের মতো নয়। বড্ড রুক্ষ, কোমলতার কোন ছোঁয়া নাই। কপালের ডান পাশে পোড়া দাগটার কারণে আরো বিশ্রী দেখায়। পাড়ার মেয়েগুলো সেকারণেই ওর দিকে দরকারেও তাকায় না। দুই বাড়ি পরে থাকত একটা মেয়ে-মুনা, তার কথা মনে পড়ে। মেয়েটা ওকে দেখলেই কপাল কুঁচকে তাকাত, সেই চাহনিতে থাকতো তাচ্ছিল্যতা। সেই মুখটা মনে পড়তেই বেশ শব্দ করে হেসে ওঠে আকলু। চিরুনিটা চুলের ভেতরে দেয়ার অবকাশে গুনগুনিয়ে গান করে ওঠে। বারান্দায় বসে ব্লাউজে হুক সেলাই করছিল ওর মা। ছেলের গান কানে আসা মাত্র তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন তিনি। ‘ভাদাইমা ‘ গালি দিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় নিজের কাজে। আকলু সেদিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটে। এইগুলো রোজকার অনুসঙ্গ। এসব এখন গায়ে মাখে না।

আকলু দাড়িয়ে আছে নয়াবাড়ি মোড়ে। আজ বেশ জরুরি একটা কাজে ওদের এখানে আসতে বলেছে আলতাফ হোসেন। সবাই দাঁড়িয়ে আছে শোনা মাত্র কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভঙ্গিতে। দলের জন্য নিজেকে কতটা বিলিয়ে দিতে পারে কর্মীরা,তার যেন পরীক্ষা নেবে আসনে বসে হুকুম দেয়া নেতারা। সবাই এমন একটা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে বহুকাল । আজ যদি কোন সুযোগ আচমকা এসে হাজির হয়। কিন্তু আকলুর শরীরটা ভালো না। একটু জিরিয়ে নিতে চায় শরীরটা, চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আসে। তারপরও আকলু দাঁড়িয়ে থাকে, অপেক্ষায় করে। আজ সকালে খানিক টুকু ঘুমানোর দরকার ছিল। ইচ্ছে থাকলেও সেটার সদ্ব্যবহারের সুযোগ পায়নি চব্বিশ বছরের হালকা পাতলা গড়নের ছেলেটা। পাশের ঘরে অসাড় বাপটা রাত-দিন অনবরত কাশে। খসখসে কাশির শব্দে চোখের পাতা দুটো এক করতে পারে না। ঘুমটা চোখেই আটকে থাকে। পাশের ঘরের ভাসা ভাসা ছড়ানো ছিটানো শব্দগুলোকে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই আকলুর। এক কামরার ঘরকে শক্ত হার্ডবোড দিয়ে দুটো কামরার ঘর করা হয়েছিল অনেকটা বছর আগে। তখন ওর বাবা সুস্থ ও সচল ছিল। জুট মিলে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা বাবার পক্ষে এর থেকে ভালো আর কোন আবাসনের বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয়নি। সবার অধিকার আদায় করতে করতে নিজের পরিবারের কথাই ভুলে গিয়েছিল একটা সময়। হঠাৎ একদিন মিটিংয়ে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আর কখনো নিজ পায়ের উঠে দাঁড়াতে পারে নাই। তখন আকলু বয়স তেরো। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে সপ্তম শ্রেণীতে  উঠেছে মাত্র। তারপরে শুরু হয় আকলুদের কষ্টের দিনলিপি। মা সারাদিন কাপড় সেলাই করে যা রোজগার করত, তা দিয়ে পেট চালানোই কঠিন হয়ে যায়। মায়ের আত্মীয় স্বজনের মুখাপেক্ষী হয়ে অনেকটা বছর কেটে গেছে। তখন থেকে আধমরা বাপটাকে সহ্য হয় না ওর।

‘শালার বাপটা মরেও না, পথও ছাড়ে না’- মনে মনে সারাক্ষণ বাপের মৃত্যু কামনা করে আকলু। মাঝেমধ্যে দানবাক্সে খুচরো এক টাকা দান করে। প্রায়সময় পাঁচ পয়সা ফেলে মানত করে যেন ওর বোবা স্বপ্নগুলো পূরণ হয়। এইভাবে দীর্ঘ দিন নিজের অগোচরে যাবতীয় বোবা ইচ্ছে গুলো বোতলে ছিপি দিয়ে আটকে রেখেছে আকলু। আগে মাথায় কত কিছুই না ঘুরত, পড়াশোনা করবে, বড় অফিসার হবে, একটা সুন্দর বাড়ি হবে। বাবা বিছানায় পড়ার সাথে সাথে স্বপ্নের ধারা পাল্টে গেছে । এখন আকলু নেতা হতে চায়৷ বিখ্যাত নেতা। যার কথায় সবাই এক সারিতে দাঁড়িয়ে থাকবে। আলতাফ হোসেনের মতো নেতা হতে চায় আকলু। পড়াশোনা বাদ দিয়েছে অষ্টম শ্রেনিতে ওঠার পরপরই। বেকার আকলু ধীরে ধীরে পাড়ার মাস্তানদের সাথে মেশা শুরু করে। প্রথমে শুধুই আড্ডা, তারপরে ছোটখাটো চুরি, ছিনতাইয়ে পা বাড়ায়। এখন সবাই ওকে ‘পাতি মাস্তান’ হিসেবে চেনে। মুখে কেউ কিছু বলে না, কিন্তু আড়ালে সবাই ভয় পায়। সেটা এলাকার উঠতি নেতা আলতাফের কারণে। এখন দলের দুঃসময়ে আলতাফের ডান ও বাম দুটো হাতই আকলু। আজকে আলতাফ কঠিন একটি দায়িত্ব দিয়েছে, আগামীকাল পত্রিকার পাতায় নতুন একটি গল্পের জন্ম হবে, আকলুর ছিঁচকে নামের অবসান হবে।

মধ্যরাত।

আকাশে আবছায়া আলো অন্ধকার। দেশে হঠাৎ গর্জে ওঠা কন্ঠের প্রতিধ্বনি চারপাশের পরিবেশটাকে থমথমে করে তুলেছে । সেকারণে আজ ট্রেন দু’ঘন্টা দেরিতে খুলনায় এসে পৌঁছেছে। মনে চাপা উত্তেজনা মাইমুনার, বাচ্চাটা কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। বোরখা পরিহিত তেইশ বছরের এই তরুনী কোলে বাচ্চা, সাথে দুটো ব্যাগ নিয়ে অনেক কষ্টে রেলের কামরা থেকে নেমেছে। এখন বসে আছে স্টেশনে, অপেক্ষা করছে আপনজনের। কিন্তু কারো দেখা নাই। কাছে পিঠের পরিচিত কাউকে পেলে স্টেশনের বাহিরে পা রাখার সাহস করতো। কিন্তু অনেকক্ষণ বসে থেকেও পরিচিত কোন স্বজনের দেখায় পায় না। সেই কঠিন দুঃসময়ে আপনজনের কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি। আজ গলার কাঁটা হয়ে ফিরছে। আসবে না সেটাই স্বাভাবিক। ব্যাগে বেশি টাকাও নাই। বিকাশে কিছু টাকা আছে, কিন্তু এই মধ্যরাতে সেটাও বেকার। পেটের তীব্র ক্ষুধা, সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বোঝায় মাইমুনা। ভেঙে পড়লে চলবে না। নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করতে হবে। কিন্তু শুরু কি করতে পারবে, মনের ভেতরে আকাশ পাতাল ভাবনা। এই তিন বছর কোনরকম ভাবনা ওর ধারেকাছে ক্ষনিকের জন্য আশ্রয় পায়নি। মাইমুনার বিয়ে হয়েছিল তিনবছর। বছর ঘুরতে না ঘুরতে কোলে ছেলে হেসে ওঠে।
স্বামীর সম্পদ ওকে একটি ভিন্ন জীবন, একটি উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কখনো কোনকিছুতে না শুনতে হয়নি৷ পরিবর্তে, এমন একটি জগতে বেঁধে রেখেছিল যেখানে তার কণ্ঠস্বর তার দাবির দ্বারা নিমজ্জিত হয়েছিল। কথায় আছে টাকা মানুষকে অমানুষ করে। মাইমুনার স্বামীকে করেছিল। ভদ্রবেশী লোকটা হারিয়ে যাবার পরে মাইমানুর কাছে তার আসলে পরিচয় বের হয়ে আসে। সেই পাপের
আঁচড় এখন মাইমুনার সারা গায়ে। সরল চোখের মেয়েটা এই কয়দিনে দেখেছে মানুষের নিঃসংশয়তা অপমান এবং হুমকি। আজ মনে হয়, ভুল করেছে জীবনে। আকলুর কথা মনে পড়ে।

কয়েক বছর আগের আকলু, প্রান্তের চারপাশে রুক্ষ কিন্তু সবসময় ওর জন্য দয়ার স্ফুলিঙ্গ ছিল। সে একবার তার ভালবাসার কথা স্বীকার বলেছিল পাড়ার এক শান্ত কোণে দাঁড়িয়ে প্রত্যাখ্যানের কষ্ট গায়ে জড়িয়ে আকুল ফিরেছিল। মুনা যুবক, সাদাসিধা আকলু চেয়ে অনেক বড় জীবনের স্বপ্ন দেখছিল। সে তাকে ঠান্ডা শব্দ দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিল। গভীরে দংশন দংশিত হয়েছিল মানুষটা।

মুনা রাস্তায় নেমে আসে। সাথে স্থানীয় একজন বড় ভাই। রাজনীতির হাওয়া বদলের কারণে এখন সামনের সারিতে। মুনা তাকে দেখে অনেকটা সাহস পায়। যেহেতু সেরকম আশ্বাস দেয়া হয়। ফাঁকা রাস্তায় ঘন অন্ধকারে মুনা চরিত্রের কালিমার ভয়ে এক রিকশায় ওঠার সাহস পায়না। স্থানীয় বড় ভাইও কিছুটা অনিহা প্রকাশ করে। দুটো রিকশা এগিয়ে যায় আগে পিছে কাছাকাছি। হঠাৎ মুনা সামনের ছায়ায় দেখে আলোড়িত হয়। স্ট্রিটলাইটের নিচে একটা লম্বা, চওড়া আকৃতির আবির্ভাব হল, আর মুনার শ্বাস তার গলায় আটকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিনতে পারে—আকলু।

দাঁড়িয়ে আছে, মুখে অপাঠ্য অভিব্যক্তি।

তার আগে ঘটে যায় অবিশ্বাস্য ঘটনাটি। স্বাক্ষী থাকে
“মুনা?”

চিৎকারের কণ্ঠস্বরে কর্কশতা, কিন্তু এতোটা বছর পর আকলুর কাছে পৌঁছায় স্নিগ্ধতা মোলায়েম হয়ে।
আকলুর শরীরটা হঠাৎ যেন জমে যায়। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। মুনার, চোখেমুখে ভয় আর হতাশার ছাপ।

“তুমি?” মুনা ফিসফিস করে বলে।

চারপাশের অন্ধকার যেন আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে। মুনার চোখের দিকে তাকিয়ে আকলুর বুকের ভেতরটা কেমন যেন শূন্য হয়ে যায়। কতদিন পরে সেই মুখখানি দেখছে। চোখের মুগ্ধতা হারিয়ে যায় ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে।

মুনার হৃৎপিণ্ড ধড়ফড় করে প্রতি পদক্ষেপে সে নেমে যায় আবছা আলোকিত রাস্তায়। পরিচিত রাস্তাগুলি রাতের শেষের মধ্যে অদ্ভুত অনুভব করেছিল, ঘন নীরবতায় মোড়ানো যা তাকে আঁকড়ে ধরেছে। মুনা ভেবেছিল, আজ বাড়ি ফিরে ছেলেটাকে মায়ের কাছে দিয়ে আরাম করে ঘুম দেবে। কিন্তু আজ রাতেই, আকলুর অপকর্মের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। স্বামীর সকল অনিয়ম অজান্তেই পাপী করেছে মুনাকে। আজকের পাপের প্রায়শ্চিত্ত কিভাবে করবে। আকলুর পিছনে বিশাল ছায়া। মুনার ছায়া ক্ষীণ হয়ে আসে।
হারিয়ে যাওয়া সমস্ত কিছুর অনুস্মারক হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। আবছা আলোকিত রাস্তায় ছেলে কোলে দাঁড়িয়ে থাকে মুনা, সামনে ছটফট করছে তাজা একটি প্রাণ । কি করবে মুনা! সত্যের সঙ্গী হবে নাকি মিথ্যায় আশ্রয় খুঁজবে।

*************************