মাইন্ডসেট
আলী সিদ্দিকী
মিনহাজ হাসান গত দু’দিন ধরে কারো সাথে কথা বলছেন না। ফোন ধরছেন না। সোস্যাল মিডিয়ায় থাকছেন না। অফিস যাচ্ছেন না। এমনকি শোয়ার ঘরেও যাচ্ছেন না। কারো হাতে কিছু খাচ্ছেন না। স্ত্রী শিরিনের সাথেও কথা বলছেন না। নিজের স্টাডি কাম রেস্টরুমে নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রেখেছেন। দরোজার হাতলে লাগিয়ে রেখেছেন, ডু নট ডিস্টার্ব।
জনপ্রিয় সামাজিক ব্যক্তিত্ব মিনহাজ হাসান নিজের পছন্দসই ও স্বহস্তে তিলে তিলে গড়ে তোলা সেলিব্রেটি ইমেজের আনন্দ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। এমন পরিস্থিতি তার পরিচিত জনদের কেউই প্রত্যাশা করেনি। সকলে বিস্মিত হয়েছে এই ভেবে যে, কি এমন ঘটেছে যার জন্যে জনাব হাসান নিজেকে এভাবে সবকিছু থেকে প্রত্যাহার করে নেবেন। একটি সমমনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আমন্ত্রণও বাতিল করেছেন। একটি চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধক হিসেবে যাবার ছিলো, ফোন করে অপারগতা জানিয়েছেন। অনেকদিন পর তার ভাই সস্ত্রীক আসার কথা ছিলো কিন্তু ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে গেলেন। তার এই স্বভাববিরুদ্ধ আচরণে কেউ কেউ মর্মাহত ও বিস্মিত হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। পরিষ্কার কারন বুঝতে না পারায় ঘনিষ্ঠ মহলে নানান অনুমানের ডালপালা গজাচ্ছে।
ষাটোর্ধ প্রখর ব্যক্তিত্ববান মিনহাজ হাসান বরাবরই ব্যক্তিগত বিষয়-আশয় নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন না। পারিবারিক বিষয়গুলো পরিবারের গন্ডীর মধ্যে কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখেন। স্ত্রী শিরিন একটু বেশিমাত্রায় মানুষ ঘেঁষা প্রকৃতির। কথা বলতে, প্রাণ খুলে গল্প করতে এবং মানুষের দরকারে ঝাঁপিয়ে পড়তে একটুও চিন্তা করবে না। মিনহাজ হাসান তা পছন্দ করেন না। বলেন, নিজেকে হালকা করে তোলার কি দরকার? কথা কম খরচ করলে ব্যক্তিত্ব বাড়ে বৈ কমে না।
‘লৌহ কঠিন ব্যক্তিত্ব দিয়ে আমি কি করবো, শিরিন সরল হাসে, কথা না বললে আমার বুকে ব্যথা করে!
মুখ ব্যাজার করেন মিনহাজ হাসান।
কিন্তু জানাশোনা মহলে ফিসফিসানি চলছেই। কেউ বলে, নিশ্চয় গুরুতর কিছু ঘটেছে। এটাও রটনায় আছে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবারও বিরোধী গ্রুপ বাগিয়ে নিয়েছে। তাই মিনহাজ হাসান মর্মাহত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন মিনহাজ হাসান পারিবারিক কোনো আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন যা আড়াল করতে নিজেকে আড়ালে নিয়ে গেছেন। কিন্তু সেটা কি কেউ তা পরিষ্কার বুঝতে পারছে না।
কেউ কেউ অনুমান করছেন এটা একান্তই পারিবারিক বিষয়। ইতিপূর্বেও মিনহাজ হাসান পারিবারিক ঝড় সামলাতে গিয়ে নিজেকে সবকিছু থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন। একজন জানালেন, একটা ইহুদী মেয়েকে বিয়ে করে ছেলে সিফাত হাসানের ফ্রান্সে চলে যাওয়া তিনি মেনে নিতে পারেন নি। বেশ কিছুদিন পারিবারিক অশান্তি মোকাবেলায় নিজেকে গৃহকোণে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন কিছুদিন। স্বভাবতই মানুষ ক’দিন পরেই সব ভুলে যায়। ভেসে যায় গড্ডালিকায়। মেতে ওঠে নতুন নতুন আলোচ্য বিষয়ে। মিনহাজ হাসানও ধীরে ধীরে নিজের বলয়ে ফিরে আসেন। কেউ কেউ ক্ষত চুলকে কাসুন্দি ঘাঁটতে অতি উৎসাহী হলেও তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে এড়িয়ে যান। মানুষও ভুলে যায়।
কমিউনিটির মানুষেরা একদিন টিভি ও পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলো যে, মিনহাজ হাসানের পুত্রবধু ইরিনা হাসানকে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনেকে ভাবলো মিনহাজ হাসানের ছেলে সিফাত হাসান হয়তো মুসলিম কোনো মেয়েকে বিয়ে করেছে। কিন্তু মিনহাজ হাসানের ঘনিষ্টজনদের কেউ কেউ পর্দা ফাঁস করে দেয়। এই ইরিনা হাসানই সিফাত হাসানের ইহুদী স্ত্রী, ফ্রান্সের নাগরিক। ইরিনা হাসান ফ্রান্স সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কালচারাল ফোরামের সভাপতি পদে মনোনীত হয়েছে। সেই কৃতিত্বের ভাগীদার হতেই মিনহাজ হাসান এই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। তাই বলো! রেস্টুরেন্টে যুৎ হয়ে একজন বলে, আসলে স্বার্থের জন্য ভোল পাল্টাতে মানুষ বিলম্ব করে না। এমনিতে সবাইকে বড় বড় উপদেশ দিতে ওস্তাদ, আরেকজন ফোঁড়ন কাটে, লোকটা ধুরন্ধর ও সুবিধাবাদী।
অনুষ্ঠানের দিন হলভর্তি মানুষ। মিনহাজ হাসান সস্ত্রীক সহাস্যে উপস্থিত হন। তিনি আগত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। এ সময় জটলা ভেতর থেকে এক লোক চিৎকার করে বলেন, হাসান সাহেব, আপনি কিভাবে একজন ইহুদীকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিলেন?
ইউ সাট আপ, মিনহাজ হাসান ক্ষেপে গিয়ে ভেতরে ঢুকে যান এবং বিশৃঙ্খলা এড়াতে পুলিশের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন।
মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। নিজের প্রভাব খাটিয়ে নির্বিঘেœ সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে সক্ষম হোন। কিন্তু মানুষের মুখবন্ধ করতে পারেন নি।
তাছাড়াও কমিউনিটির মানুষ মিনহাজ হাসানের স্বনির্বাসন নাটক আরো একবার দেখতে পেয়েছিলো। মিনহাজ হাসানের তিন সন্তান। বড় ছেলে সিফাত হাসান, বড় মেয়ে রওনক হাসান এবং ছোট মেয়ে রেখা হাসান। তাদের মনে পড়ে সিফাত হাসান সস্ত্রীক ফ্রান্সে চলে যাবার পরের ঘটনা ছিলো এটি। মেয়ে রওনক হাসান একদিন এক আফ্রিকান আমেরিকান যুবকের হাত ধরে ঘর ছাড়ে। বিষয়টি কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। নিজের ও পরিবারের বিষয়ে কথা বলতে অনিচ্ছুক মিনহাজ হাসানকে মানুষের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে সর্বত্র। আত্মদংশনে জর্জরিত মিনহাজ হাসান নিস্কৃতি পাওয়ার জন্য স্বনির্বাসনে চলে যান। আফ্রিকান আমেরিকান কোনো যুবক যে এই প্রথম বাঙালী মেয়েকে বিয়ে করেছে তাতো নয়। কিন্তু আত্মগর্বী মিনহাজ হাসান কোনো কালো পুরুষকে তার মেয়ের স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না। তিনি হাত কামড়াচ্ছেন, চুল ছিঁড়ছেন, পায়চারী করছেন, নিজেকে নিজেকে নিজেই গালাগাল দিচ্ছেন। চেহারা দেখে বোঝা যায় স্ত্রী শিরিনকেই তার সকল প্রতিক্রিয়ার বিষ হজম করে যেতে হয়। এবারও তারতম্য ঘটেনি। ছেলে সিফাত কান্ডের চেয়ে মেয়ে রওনকের ঘটনা যেনো শিরিনকে বেশি বিব্রত ও বিড়ম্বিত করছে। তারপরও তার সপ্রতিভ মন্তব্য, প্রত্যেক সাবালক মানুষের নিজস্ব পছন্দ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মিনহাজ হাসানের চোয়াল শক্ত। চোখজোড়া অগ্নিময়। কারো সাথে কথা বলছেন না। তাকাচ্ছেন না কারো দিকে। নিজেই বকবক করছেন, প্রজন্মের মধ্যে গরিলা ঢুকে গেলো! আমি মুখ দেখাবো কি করে সমাজে? অসভ্য, গোঁয়ারকে ঘরে জায়গা দিতে হবে? অসম্ভব! বুঝলে, ইটস ইম্পসিবল! টেল হার। আই নেভার এভার একসেপ্ট দিজ।
সবাই বোঝে, শিরিনও। এই ক্ষোভ শিরিনকেই শোনানোর জন্যই প্রকাশ করা। তার মানে মেয়ের এমন সিদ্ধান্তের দায় শিরিনও। কারণ মা হয়ে মেয়েকে সে পরিবারিক ও সামাজিক অপমানজনক সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি। শিরিনে ঠোঁটের কোণের ঈষৎ মুচকি হাসি যেন বলে, ছেলেকে তো তুমি ফেরাতে পারো নি। তাহলে? সবখানেই লিঙ্গবৈষম্যের চালবাজি।
মেয়ে রওনকের স্বামী হেক্টও ব্রাউনের কর্পোরেট সিও পদে পদোন্নতি সত্ত্বেও মিনহাজ হাসান কোনো সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন নি। এ ব্যাপারে এক ছিদ্রান্বেষী সংবাদকর্মী জানতে চান, ইহুদী পুত্রবধূকে সম্বর্ধনা দিলেন কিন্তু খ্রিস্টান জামাইকে বরণ না করার কারণ কি বর্ণবিদ্বেষ?
ইউ সাট আপ, মিনহাজ হাসান ক্ষেপে গিয়ে বলেন, সে ঘৃণারও অযোগ্য।
তাহলে তো আপনি বর্ণবাদী।
দ্যাটস আ লাই। মিনহাজ হাসান সটকে পড়েন।
মানুষেরা তার এমন দ্বৈতনীতিতে যেনো খুব মজা পায়। তারা সরবে ও নীরবে হেসে কুটিকুটি হয়।
এরপর বেশ কিছুদিন মিনহাজ হাসান নিজের ভাঙা ইমেজ পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত থাকেন। কমিউনিটির নানান অনুষ্ঠান উৎসবে তার সরব উপস্থিতি নতুন উদ্দীপনার জন্ম দেয়। তিনি নানামুখী কর্মসূচীর মাধ্যমে কমিউনিটিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন। স্থানীয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ সভাগুলোতে তার ডাক পড়ে। হাইকমিশনের বিভিন্ন হাইপ্রোফাইলের অনুষ্ঠানাদিতে তাকে সমাদৃত করা হয়। পত্রপত্রিকায় ও টিভিতে তার বিশেষ সাক্ষৎকার প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। মিনহাজ হাসান আবার ফর্মে চলে আসেন। আবার সম্ভাবনা দেখা দেয় দলীয় নেতৃত্বে উঠে আসার। এব্যাপারে পত্রিকায় ফ্ল্যাশিং নিউজও প্রকাশিত হয়।
শিরিন বলে, হাইকমান্ডের সাথে কমিউনিকেট করতে পারলে তোমার সম্ভাবনা সত্য হবে।
বলছো? মিনহাজ হাসান হাসেন, তাহলে লন্ডনী চ্যানেলকে কাজে লাগাতে হবে।
চলো ঘুরে আসি।
বলছো? একটু ভেবে বলেন মিনহাজ হাসান, চলো।
সফল লন্ডন অভিযান শেষে যেদিন মিনহাজ হাসান ও শিরিন আক্তার বাসায় এলেন সেদিন ভীষণ তুষারপাতে পুরো ইস্টকোস্ট জুড়ে অচলাবস্থা। জেএফকে থেকে বাসায় আসতে অনেক বেগ পেতে হলো। সন্ধ্যার অন্ধকার হাতড়ে বাড়ীতে ঢুকে প্রথমেই হিট অন করে বাথরুমে গেলেন মিনহাজ হাসান। শিরিন আক্তার তড়িগড়ি যৎসামান্য খাওয়ার আয়োজন করে ফেললেন। সকালে দু’জনেরই অফিস আছে।
দিনশেষে বাসায় ফিরে মেয়ে রেখার বিয়ের খবর পান মিনহাজ হাসান। ছোটো মেয়ে মিনহাজ হাসানের নয়নমণি। অত্যন্ত মেধাবী আর প্রাণপূর্ণ রেখা অনেকটাই মা শিরিনের মতো একেবারে দিলখোলা মানুষ। তার ভেতরে ভলান্টারিজমের জিন যেন গিজগিজ করছে। ছাত্রাবস্থা থেকেই জাতিসংঘের স্বেচ্ছাসেবী কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন দেশ ঘুরে এসেছে। তার লক্ষ্য হলো জাতিসংঘের স্বেচ্ছাসেবী কর্মসূচির সাথে আজীবন যুক্ত থাকা। সেক্ষেত্রে বাধা দেয়ার প্রশ্নই আসে না।
কিন্তু তাই বলে সমকামী বিয়ে! অনেকদিন ধরে সমকামী সাদা মেয়েটার সাথে মেলামেশার বিষয়ে মিনহাজ পরিবার অবগত ছিলো। বয়সের রোমান্টিকতা এবং সমকামী অধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন মানবিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ ছিলো স্বেচ্ছাসেবী কর্মসূচির অংশ। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কর্মসূচি উপলক্ষে রেখা ও গার্লফ্রেন্ড নেওমি গেছে মিনহাজ হাসানের সেখানে আপত্তি করার কিছু ছিলো না। তাই বলে ঘটা করে বিয়ে! মিনহাজ হাসান তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। আবারো তিনি স্বনির্বাসন গ্রহন করলেন। লকডাউন ঘোষণা করলেন নিজের উপর, বাড়ীর উপর। দরোজায় ডু নট ডিস্টার্ব লিখে শিরিন থেকেও নিজেকে বিচ্ছন্ন করে নিজের স্টাডি কাম রেস্টরুমে বন্দী করে ফেললেন।
মিনহাজ হাসান উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে ভুগছেন। ঔষুধ পথ্য ঠিকঠাক না নিলে শারিরীকভাবে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। তাই শিরিন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আপ্রাণ চেষ্টা করছেন যাতে মিনহাজ হাসান কোনোপ্রকার উত্যক্ত যেনো না হোন।
কমিউনিটির লোকজন, বন্ধুমহল ও দলের বিভিন্ন জনের ফোনকলের জবাব দিতে দিতে শিরিনও মহাবিরক্ত। আরে বাবা, আমাদেরকে আমাদের মতো থাকতে দিন। আমরা তো কারো বাড়া ভাতে ছাই দিই নি! অবস্থা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গেলে পুলিশ প্রটেকশন নেয়ার কথা ভেবে রাখলেন শিরিন।
কিন্তু বরাবরের মতোই সপ্তাহ খানেক পর মানুষ নিজেদের কাজকর্মে ও নতুন বিষয়ের আলোচনায় মগ্ন হয়ে গেলো। ধীরে ধীরে মিনহাজ হাসান স্বাভাবিক হয়ে এলেন এবং নরম হয়ে এলো তার শক্ত চোয়াল। নিজস্ব গতিধারায় ফিরে এসে মনোনিবেশ করলেন কমিউনিটির কাজে। কিছুদিন পর কমিউনিটির নতুন প্রজন্মের সদস্যরা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে কৃতিত্বের সাথে অবদান রাখার জন্য এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা হিসেবে মিনহাজ হাসান পুরো আর্থিক দায়িত্ব নিলেন। কমিউনিটিতে আবারো তার জয়জয়কার চতুর্দিকে। জাতীয় পর্যায়ের দলের একজন প্রভাবশালী নেতাকে প্রধান অতিথি করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ এক জাঁকজমকপূর্ণ কর্মসূচি ঘোষণা করা হলো। বৃহত্তর কমিউনিটিতে ব্যাপক উদ্দীপনার সঞ্চার হলো। কিন্তু যখনি পোস্টার ছাপা হলো এবং সেখানে রেখা হাসানের নাম দেখা গেলো অমনি কমিউনিটির মানুষের একটা ঢেউ ছলাৎ করে উঠলো। শুরু হয়ে গেলো ফিসফিসানি চারদিকে।
অ, বোঝবার পারছি, কমিউনিটি মসজিদে হালকা আলোচনায় একজন বলেন, মিনহাজ হাসান বড়ই ধড়িবাজ। খালি নিজের পাতে সব টাইন্যা লয়।
যেমন? কমিউনিটিতে কম পরিচিত একলোক জানতে চায়। উনি নিজের ইহুদি বউরে গ্রহন করেন নাই কিন্তু সম্বর্ধনা দিলেন, কমিউনিটির পরিচিত মুখ হারু মোল্লা বলে, ছোটো মেয়ে বেদাতি কাম করলো আর এখন তাকে সম্বর্ধনা দেয়া হচ্ছে!
কিন্তু বড় মেয়ে রওনকের স্বামীর এতো বড়ো অর্জন, মিনহাজ হাসান কিন্তু সে ব্যাপারে কিছু করেন নি, দেশী এক গ্রোসারির মালিক নুরলদীন মনে করিয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলেন।
আরে মিয়া, বোঝেন না কেন? হারু মোল্লা মুখ বাঁকায়, সে যে কালো মানুষ! মিনহাজ হাসান ইহুদী বউ আর সমকামী মেয়ের কৃতিত্বের ভাগীদার হলেন অথচ বড়ো মেয়ের স্বামীর কৃতিত্বে কোনো স্বীকারোক্তিমূলক উদ্যোগ নেন নি।
কেন? এই প্রশ্নটি এখন কমিউনিটিতে বেশ উচ্চারিত হচ্ছে। মিনহাজ হাসান নিজেকে বরাবরই একজন মুক্তচিন্তার মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেন খুবই গর্ব করে। আর কমিউনিটিতে তার ভাবমূর্তিও তিনি সেভাবে গড়ে তুলেছেন। কালোমানুষদের অধিকারের কথা তিনি জোর গলাতেই বলেন। অথচ নিজের মেয়ে যখন এক কালোকে বিয়ে করেছেন দেখে তিনি বিষয়টি চেপে গেছেন। এটা তার দ্বিচারিতা। ঠিক সেই প্রশ্নটি যখন একজন কমিউনিটি সাংবাদিক মিনহাজ হাসানকে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে করলেন তখন তিনি ক্ষেপে গিয়ে সাংবাদিককে বের করে দিতে বললেন।
থামুন, সাংবাদিক ভলান্টিয়ারদের থামিয়ে বলেন, আমি পারমিশন নিয়ে এসেছি এবং কমিউনিটির মানুষের এই প্রশ্নের উত্তর জানার অধিকার আছে।
তখন অনুষ্ঠানে উপস্থিত তরুণদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দেয়।
মাইক হাতে নিয়ে একজন বলেন, এটা কি আপনার মাইন্ডসেট নাকি ভন্ডামি?
মাইন্ডসেট! মাইন্ডসেট!!
সমস্বরে পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে একথাই উচ্চারিত হতে থাকে। আর তা যেন তীরের মতো এসে মিনহাজ হাসানের বুকে বিঁধতে থাকে। তার গা গুলিয়ে ওঠে এবং ঘামতে ঘামতে ঢলে পড়েন তিনি। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তাররা তার অবস্থা আশংকামুক্ত বলে জানানো হয় তবে মাইল্ডস্ট্রোকে তার ডানপাশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে।
শিরিন বাকরুদ্ধ হয়ে হাসপাতালের ওয়েটিংরুমে বসে আছেন রওনকের দুই ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরে। হ্যাক্টর একটু দূরত্বে বসে বৌ রওনককে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
**********************