চাঁদটাকে মাঠের ঠিক মাঝখানে এইভাবে গা এলিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে সে এতটাই ধাক্কা খায় যে তার তেমন অবাক হওয়ার কথাও আর মনে থাকে না। এতক্ষণ সে আকাশে চাঁদের অবস্থান দেখে দেখে দিক ঠিক করে পথ চলছিল। এই তো মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগে সিগারেট ধরানোর জন্য চাঁদ আর রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠিটার দিকে তাকিয়েছিল। সিগারেট ধরানো শেষ করে হাতের কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েই তার হাত স্থির হয়ে যায়। কারণ চোখ তুলেই সে দেখতে পেয়েছে যে চাঁদ ঠিক পথের পাশে ফসলকাটা মাঠের মধ্যে শুয়ে আছে। এবার সে আশ্চর্য হবার অনুভূতিটুকু ফেরত পায়। তখন একবার ভালো করে মাঠের দিকে তাকায়। তারপর তাকায় আকাশের দিকে। নাহ। সত্যিই চাঁদ আকাশে নেই। চাঁদটা যেখানে ছিল, আকাশের সেই জায়গাটাতে কেবল বিরাট একটা গর্ত। এবার সে নিঃসন্দেহ হয় যে তার সামনে যে জিনিসটা পড়ে আছে, সেটি চাঁদই বটে। তার মানে সে আর পথ চলতে পারবে না। চাঁদের আলো ছাড়া পথ চরবেই বা কীভাবে? সে তখন পথচলা বাদ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া মানুষের ভঙ্গিতে ‘যা হয় হোক’ মনোভাব নিয়ে বসে পড়ে চাঁদের পাশে। সিগারেটটাকে ঠোঁটে তুলে আনে। সিগারেটে কষে টান লাগাতেই কয়েকটা তামাককণা সিগারেট থেকে গায়ে আগুন নিয়ে স্ফুলিঙ্গের মতো একহাত ব্যাসার্ধের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। আর সেই আলোতে সে গা শিরশির করা আতঙ্ক নিয়ে দেখতে পায় চাঁদটা ধীরে ধীরে মলিন হয়ে যাচ্ছে। ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফেলছে। তাহলে চাঁদটা কী মরে যাচ্ছে! কাউকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় না। বরং সে নিজেই দেখতে পায় চাঁদটা মরে যাচ্ছে। এবং সাথে মারা যাচ্ছে সে নিজেও। মৃত্যুর হাতে নিজেকে সঁপে দিতে যায় সে। আর তখনই তার কানে আছড়ে পড়ে একটি শব্দ। ছন্দ আকুল হয়ে ডাকছে তাকে- বাবা! বাবা!
মুহূর্তে থমকে যায় মৃত্যু।
আবার ডাক আসে- ‘বাবা! বাবা!’
এবারের ডাকে আকুলতা নেই। তবে ডাকটা আসছে। সে সেই শব্দের দিকে নিজের মনোযোগকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়- কে?
চোখ খুলে দেখা যায় তার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটা লম্বা কাঠামো।
‘কী হলো!’ সে বিরক্তির সঙ্গে প্রশ্ন করে লম্বাটে কাঠামোটিকে।
বিরক্তি খুব প্রকট ছিল বলে মনে হয় না। তবু তা যেন ধাক্কার স্পর্শ করে লম্বা কাঠামোটিকে। তাকে একটু কুকড়ে যেতে দেখে সে। মনে মনে একটু লজ্জিত হয় নিজের কণ্ঠের রূঢ়তার জন্য। এতক্ষণে সে প্রায় পুরোপুরি ফিরে এসেছে না-ফিরতে-চাওয়া বাস্তবে। সে উঠে বসে। লম্বা কাঠামোর মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলে মোলায়েম স্বরে বলে- কী হয়েছে?
আপনের নাস্তা বাজান।
নাস্তা!
হ্যাঁ। হগলডির খাওয়া হয়্যা গ্যাছে বাজান। নাস্তার টাইম পেরায় শ্যাষ। আমি আপনের নাস্তা লইয়া বইসা রইছি বাবা।
এবার সে পুরোপুরি জেগে ওঠে। উঠে বসে তাকায় লোকটার দিকে। বলে- কী দরকার বসে থাকার? আমার খাওয়ার ইচ্ছা তেমন নাই।
লোকটা বলে- খাজা বাবার দরবারে একজন মানুষ না খাইয়া থাকপে সেইযা তো চলে না বাবা!
ভক্ত তো এমন কথাই বলবে। কিন্তু সে তো আর ভক্ত না। মুরিদ হওয়া তো দূরের কথা, পীরের সামনেই যায়নি কোনোদিন। কোনো পীরের সামনেই যায়নি।
কিন্তু সেসব কথা এখন বলার সময় নয়। সে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বলা চলে সেঁধিয়ে দিয়েছে নিজেকে। এবং কেউ তার এখানে থেকে যাওয়া নিয়ে কোনো প্রশ্নই করেনি। এমনকী এটাও জিজ্ঞেস করেনি যে সে কে? বা কোত্থেকে এসেছে? বোধহয় জিজ্ঞেস করার নিয়ম নেই। কারণ সবার জন্য পীর নিজের দরজা চিরদিন উন্মুক্ত রেখেছিলেন। আর তার পর্দা নেবার সময় সেই একই নিয়ম চালু থাকার ঘোষণা দিয়ে গেছেন। এই ‘পর্দা নেওয়া’ শব্দটা এখানে এসে শিখেছে সে। কেউ বলে না যে পীরের মৃত্যু হয়েছে। বা তিনি ইন্তেকাল করেছেন। বলে পর্দা নিয়েছেন। আমাদের দৃশ্যমান জগৎ থেকে আড়ালে চলে গেছেন। এখানে সবাই ঘুমায় মেঝেতে। মাজারে অনেক শোবার জায়গা। কে কোথায় শুচ্ছে তা নিয়ে মাজারের খেদমতে লেগে থাকা লোকদেরও কোনো মাথাব্যথা নাই। সবাই নিজের নিজের দায়িত্বে নিজের নিজের জায়গা পরিষ্কার রাখে। দিনে দুইবার খাওয়ার ঘণ্টা বাজে। একবার সকাল সাড়ে আটটায়। আরেকবার সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টায়। মাটির মালসায় ভাত, নিরামিষ আর ডাল দিয়ে দেওয়া হয়। মাটির মালসা নিয়ে দাঁড়াতে হয় প্রত্যেককে। হাতা দিয়ে ভাত তুলে দেয় একজন। তারপরের জন কাঠের হাতা দিয়ে তুলে দেয় নিরামিষ। পরের জন ডাল। চটের মাদুর পাতা আছে। সেখানে বসে খাওয়া যায়। আবার অন্য কোথাও বসতেও মানা নেই। খাওয়া শেষ হলে সেই একই মালসায় পানি খাওয়া। এই খাবারের লাইনে সে অনেক পরিচিত মুখকে দেখতে পেয়েছে। ঢাকার অনেক বড় ব্যবসায়ীকে দেখেছে, মিডিয়ার সিনিয়ার সাংবাদিকদের দেখেছে, রাজনীতিবিদদের দেখেছে, এমনকী টিভি-সিনেমার দুই-চারজন উঠতি তারকাকেও দেখেছে। এখানে এসে তারা অন্য সবার সাথে একই পংক্তিতে বসে যায়। পীরভক্তির কারণে? নাকি পীরভীতির কারণে? এখানে এলেই সবাই সকলের সমান হয়ে যায় যেন। আগে হয়তো পীরের চৌহদ্দিকে বলা হতো মাজার বা খানকা। এখন সবাই বলে দরবার। দেশ থেকে রাজা-বাদশার দরবরি উঠে গেছে। এখন আছে বঙ্গভবনের দরবারকক্ষ, বিজিবির দরবার হল, আর পীরের দরবার। দেশের দাম্ভিক মানুষগুলোকেও দেখা যায় এখানে এসে দীন-হীন আচরণের প্র্যাকটিস করতে। প্রাদো-নিশান-লেক্সাস-টয়োটা এসে দাঁড়ায় দরবারের মূল ফটকের বাইরে। সেখান থেকে নামে দাপুটে ব্যক্তিরা। পরনের কাপড় পাল্টে লুঙ্গি পরে, হ্যান্ডলুমের হাতাওয়ালা গেঞ্জি গায়ে দেয়, কাঁধের ওপর গামছা তুলে নেয়, আর খালি পায়ে ঢোকে দরবারের মাটিতে। দেখে বেশ হাসি লাগে তার। সে পরিষ্কার বোঝে, এরা এখানে আল্লার খোঁজে আসে না, ফানা-বাকার রাস্তা খুঁজতে আসে না। আসে নিতান্তই জাগতিক প্রয়োজনে। পীরের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে উপকৃত হয়েছে। কেউ হয়তো ভোটে জিতেছে, কেউ দলে বড় পদ পেয়েছে, কেউ সরকারি চাকরিতে প্রমোশন পেয়েছে, কেউ ব্যবসাতে বড় উল্লম্ফন দিয়ে কোটিপতি হয়ে গেছে। পীরের মৃত্যুর পরেও তারা আসে এখানে। কারণ জীবিত পীরের প্রতি তাদের ছিল ভক্তি। আর মৃত পীরের প্রতি রয়েছে ভীতি। যদি পীরের আত্মা অসন্তুষ্ট হয়, তাহলে সব হারাতে হবে তাদের। এই ভীতি থেকেই তাদের এই নিয়ম ধরে দরবারে আসা। দরবারে নজরানা পাঠানো। পীরের মাজারে এসে ধুলোতে লুটিয়ে কাঁদা। অথচ এই লোকেরাই অফিসে দুর্নীতির চূড়ান্ত করে ছাড়ে। পণ্যের মধ্যে ভেজাল মেশায়। একচেটিয়া আমদানির সুযোগ নিয়ে ইচ্ছামতো জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে চলে। এরা ভক্তদের মধ্যেও আবার উচ্চশ্রেণীর। যেহেতু এরা নজরানা পাঠায় অনেক বেশি। কোনো গ্রামবাসী ভক্ত হয়তো বছরে নজরানা দিতে পারে বাড়িতে পোষা একজোড়া মুরগি। বা বাড়ির গাছের এক হালি আম, অথবা জাংলায় ফলানো কুমড়া কিংবা লাউ। আর এই ভিআইপি ভক্তরা এক লটে পাঠিয়ে দেয় এক ট্রাক চাল, কিংবা সারা বছর যত সবজি লাগে মাজারের তবারক হিসাবে, সবটুকু হয়তো পাঠিয়ে দিচ্ছে একজনেই। পীরের কবরে গিলাফ চড়ায় এরা পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে। তাই যতই দরবারে খালি পায়ে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে চলাফেরা করুক না কেন, আরা এখানেও ভিআইপি। আবার দরবারের কর্মীদের মধ্যেও সবাই সমান নয়। উচ্চপদের খাদেমদের খাওয়া-দাওয়া তো বটেই, তাদের পানি পর্যন্ত আলাদা। তাদের সেবার জন্য অনেক মানুষ। বিনাপ্রশ্নে তাদের হুকুম তামিল করে শত শত কর্মী। তাদের দেখে চা বাগানের কথা মনে পড়ে তার। সেখানে উপরঅলার কথাই আইন। আর শ্রেণীবিভাগ এতই স্পষ্ট যে কাউকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিতে হয় না। এখানেও সেটাই মনে হয়।
এসব নিয়ে তার মাথা ঘামানোর কথা নয়। সে এসেছে কয়েকদিনের জন্য। শুধুমাত্র আশ্রয়ের আশায়। তার পরিচিত জীবনের পরিম-ল তার বুক থেকে এতটা রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে যে সে পালিয়ে এসেছে। এখানেই আসবে, এমন কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। হঠাৎ করেই এসে পড়া। এবং থেকে যাওয়া। সবচেয়ে ভালো লাগছে, কেউ তাকে কোনো প্রশ্ন তো করছেই না, এমনকী মাজারে দৈনন্দিন যেসব অনুষ্ঠান হয় সেগুলোতে অংশ নেবার জন্যেও কেউ তাকে বলতে আসছে না। তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়েছে, এমন একটি দৃষ্টির কথাও সে মনে করতে পারে না। সে সারাদিন মাজারের এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়, কখনো শুয়ে থাকে, কখনো স্রেফ বসে থাকে এককোণে। এমন জায়গা এই দেশে থাকতে পারে, ভাবতেই পারেনি সে কোনোদিন।
কিন্তু রাতগুলো তার এখনো বুকটাটানো রাত। রাতের বেলা উধাও হয়ে যায় তার চোখের সামনে থেকে এই মাজার, এই অন্যরকম জগৎ। আর সে ঠিকই ফিরে যায় তার রোজকার জীবনে। যে জীবন থেকে সে পালিয়ে এসেছে, সেই জীবন রাত এলেই তাকে দখল করে ফেলে আবার। প্রতিটি রাতেই উপলব্ধি করে সে আসলে আগের জীবন থেকে মোটেই পালিয়ে আসতে পারেনি। বরং পুরো জীবনটাকেই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। কাজেই এখানে বসবাস করলেও আসলে সে যাপন করছে আগের জীবনই।
উঠে বসে সে মালসা টেনে নেয় হাতে। যে লোকটা তার জন্য এতক্ষণ খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছিল, তার দিকে একবার দৃষ্টির কৃতজ্ঞতা নিক্ষেপ করে খেতে শুরু করে।
০২.
পঞ্চম দিনে টের পায় তাকে লক্ষ করা হচ্ছে।
তবে তাতে তার অস্বস্তি হয় না। সে যে এখানকার খাদেমদের নজরে পড়বে, তা জানাই ছিল। এখন নজরে পড়েছে যেহেতু, অবশ্যই তাকে কিছুটা জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সে আগ বাড়িয়ে নিজে থেকে কিছু করতে যায় না। শান্তভাবে অপেক্ষা করে।
বেলা এগারোটার দিকে তার সামনে এসে দাঁড়ায় একজন যুবক। পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে বয়স। সে তাকে দেখেছে এখানকার লাইব্রেরিতে। পীরের নসিহতগুলোর সংকলন বেরিয়েছে দরবারেই ব্যবস্থাপনায়। এখানে বিক্রি হয় বইগুলি। সে লাইব্রেরিতে গিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে এসেছে একদিন। সেদিনই দেখেছিল লাইব্রেরির ইন-চার্জ এই যুবককে। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা যুবকের। নাম সম্ভবত বাবুল বা এই রকম কিছু একটা হবে। বাবুলই। এই নামে তাকে ডাকতে শুনেছে সে অনেককে। দরবারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন সে।
তার দিকে তাকিয়ে খুবই পরিচিতের ভঙ্গিতে হাসে বাবুল। সে-ও পাল্টা হাসে একটু। তার পাশে এবার বসতে যায় বাবুল। বসতে বসতেই বলে- ক্যামন আছেন ভাই?
সে মাথা একদিকে কাত করে। মুখে বলে- ভালো।
ও! তা কোনো অসুবিধা হইতাছে না তো? অসুবিধা হইলে আমগোরে বইলেন। অবশ্যি আমাগেরই উচিত দরবারের সকল মেহমানের খোঁজখবর লওয়া। কিন্তু নানান কামের ঝামেলায় সবসময় পাইরা উঠি না। দ্যাখতাছেনই তো, কত মানুষ আসে-যায়, আর দরবারের এত কাম, হুজুর কেবলার রাইখা যাওয়া দায়িত্ব, সব সামলাইতে সামলাইতেই আমাগো দিন-রাত কাইটা যায়।
সে জানে যে বাবুল এসেছে মূলত তাকে ইনডাইরেক্ট জেরা করে তার সম্পর্কে সব তথ্য বের করে নেবার জন্য, সন্দেহ নিরসনের জন্য, হয়তো বা তাকে এখান থেকে বিদায় করে দেবার জন্যও, তবু ভালো লেগে যায় তার এই কাছাকাছি বয়সের যুবকটিকে।
এবার আসল প্রসঙ্গে আসে বাবুল- ভাইজান আইছেন কোত্থেকে? আপনার দেশ কই?
সে এড়িয়ে যাবার কোনো চেষ্টাই করে না। নিজের শহরের নাম বলে। জানে এবারের প্রশ্ন হবে এখানে কেন আসা।
কিন্তু সেটা সরাসরি আসে না। তার বদলে বাবুলকে কিছুটা চিন্তামগ্ন দেখায়। সে একটু দ্বিধা নিয়ে বলে- ভাইজান আপনে তো মুরিদ না। মুরিদ হওনের কোনো ইচ্ছাও বোধায় আপনের নাই। তা কয়দিন থাকতে চান?
ঠিক জানি না। এখানে কয়দিন থাকা যায়? কোনো নিয়ম আছে?
না। তেমন কোনো নিয়ম-নিষেধ নাই। যতদিন ইচ্ছা থাকে মানুষ। কেউ কেউ বচ্ছর ভইরা থাকে।
তাহলে?
কী তাহলে?
আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?
এবার একটু লজ্জিতই দেখায় বাবুলকে। বলে- দিনকাল পাল্টাইছে ভাইজান। আগে যে কেউ আইলেই এখানে মেহমানের মর্যাদা পাইত। এখনো পায়। দেখতেই তো পাইতেছেন। কিন্তু আগের দিন হইলে আপনের সাথে এই রকম কথাবার্ত বলতে হতো না আমাকে। বাংলাদেশী তালেবানরা আর বাংলাভাইরা মাথাচাড়া দেওয়ার পর থাইকা আমাদেরও একটু সতর্ক থাকা লাগে। কে যে কোন নিয়তে আসে!
তাছাড়া ধরেন অনেক মানুষই গা-ঢাকা দেওনের জন্যে এইখানে থাকে। মার্ডার কেসের আসামিও এইখানে থাকে। জানে যে এখান থেকে পুলিশ তাকে রেইড দিয়ে তুলে নিয়ে যেতে পারবে না। এমনও হইছে যে এক সময়ের সর্বহারা, মানে গলাকাটা নেতা এইখানে আইসা মুরিদ সাইজ্যা কাটাইয়া গেছে মাসের পর মাস। পরে অবশ্যি সে আর আগের জীবনে ফির্যা যায় নাই। মানে আমি কইতেছি যে নানা কিসিমের মানুষ আসে এই দরবারে।
আশ্বাসের ভঙ্গিতে হাসে সে। বলে- আমি সেরকম কেউ না।
মেনে নেয় বাবুল। বলে- মানুষ এই জাগাত আসে দুই উদ্দেশ্যে। এক দুনিয়াবি চাওয়া নিয়া, আরেকটা হইল আধ্যাত্মিক সাধনার জন্যে। আপনের মধ্যে কোনোটাই নাই। আপনে এখানে ক্যান আইছেন?
এবার আর নিজের উদাস হয়ে ওঠা লুকাতে পারে না সে। ভারিকণ্ঠে বলে- আমি সংসারের বোঝা বইতে বইতে ক্লান্ত। কিন্তু কেউ সেকথা ভাবে না। সবার ভার বইতে হয়। কিন্তু সবাই অভিযোগ করে যে আমি তাদের কাউকে ঠিকমতো ভালো রাখতে পারছি না। বউ অপমান করে। ছেলেকেও শিখিয়েছে আমাকে অবজ্ঞা করতে। আর মা-বাবা, ভাই-বোন ভাবে যে আমি সব বউ-ছেলের পেছনে ঢালি। তাই তাদের চাওয়া সব পূরণ করতে পারি না। বিশ বৎসর হতে চলল, আমি একাই উপার্জন করি। আর বাকি সবাই বসে খায়। আর সারাদিন আমাকে গালমন্দ করে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। হাল বইতে বইতে যে বলদের কাঁধের মাংসে থলথলে চড়া পড়ে যায়, মালিক তাকে দিয়েও হাল বওয়ায়। তবে মাঝে মাঝে সেই কাঁধে আদরের হাতও বুলায়। কিন্তু আমার পিঠে একবারও ¯েœহের বা সহানুভূতির হাত রাখেনি কেউ।
এত স্থূলভাবে একজন অচেনা লোকের কাছে এসব বলতে পেরে সে নিজেই অবাক হয়ে যায়। কথাগুলো একেবারে নাটকীয়ও বটে। কিন্তু তার কণ্ঠে এতটাই হাহাকার বেজে ওঠে যে বাবুল পর্যন্ত কিছুক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারে না। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। তারপর হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করে তার হাত। নরম কণ্ঠে বলে- খাজা বাবা আপনেরে দয়া করুক! আপনের বুকে অনেক জখম ভাইজান।
০৩.
এখানকার রাতগুলি সত্যিকারের রাত। রাত মানে নিরবচ্ছিন্ন নৈঃশব্দ কিংবা নির্জনতা নয়। রাতের নিজস্ব কিছু শব্দ আছে। সেই মন্দ্র মগ্ন শব্দগুলি মানুষের গভীরতাকেই কেবল স্পর্শ করে, স্পর্শকাতরতাকে জাগিয়ে তোলে, আর জাগিয়ে তোলে কষ্টগুলিকে। তাই যেই দুচোখের পাতা এক হয়ে আসে অমনি মনে হয় পুত্র তাকে খুজছে। স্ত্রী তাকে খুঁজছে। বাবা-মা তার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো তারা কাঁদছে ছেলেটার ওপর এত অত্যাচার করা ঠিক হয়নি ভেবে অনুশোচনায়। সবাই নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারছে যে তাকে কেবলমাত্র টাকা উপার্জনের মেশিন ভাবাটা ঠিক হয়নি তাদের।
মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু গভীর রাতে অন করে রোজই। খোঁজে, কেউ তাকে এসএমএস পাঠিয়েছে কি না। সুগন্ধা, ছোট বোনটা, ভাইটা।
কিন্তু না।
কুড়ি-পঁচিশ দিন কেটে যাওয়ার পরেও কারো কোনো ক্ষুদে বার্তা আসে না তার মোবাইলে।
সত্যটা আবিষ্কার করতে পারে সে হঠাৎ-ই। সে নিজেই যে ফিরে যাবে অন্তরের আর্তির কারণে, এতগুলো মানুষকে পথে বসানো তার দ্বারা সম্ভব নয়, মৃত্যুর আগে সে নিজের দায়িত্ব থেকে সরে যেতে পারবে না, একথা তাদের পরিবারের সবাই বোঝে। তাই তারা কেউ তার হঠাৎ নিরুদ্দেশে উদ্বিগ্ন নয় মোটেই।
আরো আজব ব্যাপার হচ্ছে এই আবিষ্কারটি তাকে খুবই আনন্দিত করে তোলে।
ফোঁওশ করে বড় একটা নিশ্বাস ছাড়ে সে।
কাল সকালে বাড়ি ফেরার বাস ধরতে হবে।