আমি, একটি ব্যাঙ ও চড়ুই পাখি || বিশ্বনাথ চৌধুরী বিশু
রাতের বেলা খেতে বসে মা হঠাৎ করে বললেন
–আমরা সবাই কাল বিকেল বেলা তোদের মামার বাড়িতে বেড়াতে যাবো। মামা নতুন বাড়ি করেছেন। বাড়িতে উঠার দিন মেজবান দিয়েছিলেন। পরীক্ষা ছিলো বলে যেতে পারিনি আমরা। শীতের দিন, আমি নতুন চালের কিছু পিঠা বানিয়ে রাখবো। একটা টেক্সী বলে রাখিও।
আমাদের বাবা গ্রামের, সরদা সুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। একজন নীতি-নিষ্ঠাবান, অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে আমাদের গ্রামে বাবার বেশ নাম ডাক। বাবা বললেন,
– -আমিতো এখন যেতে পারবো না অনু। তোমরাই যাও। পরীক্ষা শেষ, রেজাল্ট তৈরির কাজ চলছে। স্কুল বিল্ডিং ডেভেলাপমেন্টের কাজ চলছে। আমি পরে যাবো। তুমি নাসিমা আর বিনয়কে নিয়ে ঘুরে আসো। ভালোই হবে।
–তুমিতো কখনো যেতে পারবে না! তোমার ব্যস্ততা কোন দিন শেষ হবে না। শুধু স্কুল আর স্কুল। সংসারের কোনদিকে নজর আছে বলতে পার তুমি?
–রাগ করছো কেন তুমি! আমাদের ছোট্ট সংসারের ভার তো তোমার হাতে দিয়ে রেখেছি আমি। আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় ষোল-সতর বছর। একদিনের জন্যেও আমাদের কোন অসুবিধা হয়নি। বেশ ভলোইতো চালিয়ে যাচ্ছ তুমি। আমাকে স্কুলের বড় সংসারটা চালাতে একটু সহযোগিতা করো।
–মেজবানের দিন যেতে পারিনি বলে ভাইয়া বার,বার বলেছে বার্ষিক পরীক্ষার পর সবাই যেন একসাথে যাই। তুমি না গেলে, ভাইয়া কি মনে করবেন বলতো?
–তুমি একটু বুঝিয়ে বলো ভাইয়াকে, স্কুলের রেজাল্ট আর বিল্ডিংয়ের ছাদ ঢালাইয়ের কাজটা শেষ হলে আমি বেড়িয়ে আসবো।
আপু বললো,– আমিতো কিছুতে যেতে পারবো না। সোমবার থেকে আমার কোচিং ক্লাস শুরু হচ্ছে, ক্লাসতো মিস্ করা যাবে না। আমি বাবার সাথে পরে যাব।
মা অনেকটা অভিমানের সুরেই বললেন –আমি বিনয়কে নিয়ে কাল বিকালেই যাবো।
সত্যি আমাদের সংসারটা ছোট। আমি বিনয় রহমান, ক্লাস এইট থেকে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছি। আমার আপু নাসিমা রহমান আগামীবার এস,এস,পরীক্ষা দেবে। আমি আপুর চেয়ে দুই বছরের ছোট। মা আনোয়ারা বেগম একজন গৃহিনী। বাবা মাকে অনু বলেই ডাকে।
আমার মামার বাড়ি চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ নালাপাড়ায়। নানা ছিলেন চট্টগ্রামের নামকরা উকিল। আমার মা আর মামাকে নিয়েই ছিলো তাঁদের সুন্দর ছোট্ট সংসার। আমার জন্মের একবছর আগে নানা মারা যান। আমি তাঁকে দেখিনি। আমার বয়স যখন চার বছর, তখন নানী মারা যান। নানীর কথা আমার মনে নেই। মামীমা সিটি কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। খুব শান্ত, ধীর-স্থির স্বভাব তাঁর। অনেকটা আমার মায়ের মতো। মামা তাঁর বাবার পেশাকেই আঁকড়ে ধরেছেন। তিনিও চট্টগ্রাম কোর্টের একজন খ্যাতিমান আইনজীবী। একটু রাসভারী স্বভাব তাঁর। তবে আমাদের প্রতি তাঁর স্নেহ-ভালোবাসার কার্পণ্য নেই। আমার মায়ের প্রতি অত্যধিক স্নেহ পরায়ণ সবসময়। তাঁদের পরিবারেও দুই সন্তান। মেয়ে রুহিদা,রুহিদা আপা,ইংরেজি,অনার্স ফাইনাল দিলেন এবার। ঠিক মামার মতো, কথা বলেন কম, গম্ভীর প্রকৃতি তাঁর। মামার ছেলে আবিদ, আমাদের আবিদ ভাই এইচ,এস,সি ফাইনাল দেবেন এবার। ডাক্তারী পড়ার ইচ্ছে আছে, খুবই শান্ত, হাসি-খুশি এবং সরল।আমাদের গ্রামে বেড়াতে এলে,আবিদ ভাইকে নিয়ে সারা গ্রাম আমি ঘুরে বেড়াতাম।
মা আর আমি সন্ধ্যার একটু আগেই মামার বাড়িতে এসে পৌঁছালাম টেক্সীতে।একসময় কর্ণফুলি নদী পারি দিয়ে নৌকায় আমরা মামার বাড়িতে আসতাম। নৌকায় বেড়াতে যাওয়া, অন্যরকম এক আনন্দের অভিজ্ঞতা । ছোট ছিলাম কিছুটা ভয়,ভয় লাগতো। নদীর পানি খুব শান্ত থাকে শীতের সময়। অনেক গুলো সাদা পাল তোলা নৌকা নদীর বুকে ভাসতে,ভাসতে এদিক-ওদিক যাওয়া আসা করতো। কোন কোন মাঝি গলা খুলে গান গাইতো। বড় নৌকার সাথে সাম্পানগুলো মালামাল আনা-নেয়া করতো বেশি, যাত্রীও থাকতো তাতে। যাত্রীবাহী নৌকা একটু ছোট হতো। নদীতে কালো রঙের ডলফিন মনের আনন্দে লাফ দিয়ে উঠতো মাঝে,মাঝে। ভয়ে পেয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতাম,
–ওগুলো কি লাফাচ্ছে মা?
মা বলতো,–ভয় নেই, ওগুলো শুষুক মাছ।
এখন বুঝতে পারি ওগুলো ডলফিন। এখন আমাদের গ্রামের মাঝ দিয়ে চমৎকার এক রাস্তা হয়েছে, যা’ চট্টগ্রাম কক্সবাজার সড়কের সাথে যুক্ত হয়েছে।
নালাপাড়ায় মামার বাড়ির নাম ‘আইন ভিলা’। এটা নানার দেয়া নাম। দোতলা সুন্দর বাড়ি করেছেন মামা। ঘরের সামনে ফুলের বাগান। নানা রঙের, নানা গন্ধের ফুল বাগানে। নানা রঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়ায় সে বাগানে।
টেক্সী বিদায় করে আমরা ব্যাগপত্র নিয়ে গেইটের ভিতর ঢুকলাম। কলিং বেল টিপ দিতেই আবিদ ভাই এসে দরজা খুলে দিলেন। চিৎকার করে মামীকে ডেকে বললেন,
–মা,মা দেখো, কারা এসেছে,বিনয় আর ফুপি।মামী হাতের কাজ ফেলে দৌঁড়ে ড্রইং রুমে আসলেন। মাকে জড়িয়ে ধরে চেয়ারে বসালেন।কুশল বিনিময়ের পর, মা জিজ্ঞেস করলেন,
—ভাইয়া কোর্ট থেকে ফিরেনি এখনো ?
মামী বললেন, –একটু পরেই ফিরবে।
মা জিজ্ঞেস করলেন,- -রুহিদা কোথায়,ভার্সিটি থেকে ফিরেনি এখনো?
মামী বললেন, –ফিরেছে,উপরে তার ঘরে আছে। রুহি, রুহি করে ডাকলেন মামী দু’বার। বললেন, –কে এসেছ দেখ্, তোর ফুপি আর বিনয়।
রুহিদা আপা খুবই সুন্দরী। একেবারে যেন রাজকন্যা, চলনে-বলনে এবং অহংকারেও। লেখাপড়ায় বরাবরই ভালো। আবৃত্তি করতে পারেন চমৎকার। ভার্সিটিতে প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান তাঁর। দুই বছর আগে ঈদের ছুটিতে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন উনারা সবাই। পাঁচ দিন ছিলেন, আড্ডায় গল্পে,খানাপিনায় বাড়িতে যেন উৎসব,উৎসব পরিবেশ জমে উঠেছিলো। আমার বন্ধু সৌম্য, আবীর, শফিক আর আপুর বান্ধবী নন্দিতা, রাবু আপুরা আসতো আমাদের বাড়িতে। ক্যারাম,লুডু খেলা,গান, কবিতায় মিলে এ যন এক বিরাট আনন্দ যজ্ঞ! আবিদ ভাই তাঁর গিটার নিয়ে গিয়েছিলো সাথে। গিটার বাজিয়ে, কি সুন্দর গান তিনি শুনিয়েছেন। চমৎকার কন্ঠ তাঁর। রুহিদা আপার আবৃত্তি মোহিত করেছিলো সকলকে।
রুহিদা আপা নীচে নেমে এলেন। মাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
–মেজবানের দিন তোমরাতো কেউ এলে না?
-–নাসিমা আর বিনয়ের পরীক্ষা ছিলোনা ! বিনয়ের বার্ষিক পরীক্ষা,বৃত্তি পরীক্ষা আর নাসিমার টেস্ট পরীক্ষা । নাসিমা এস,এস,সি দেবে এবার।
-–নাসিমা,ফুপা ভালো আছেনতো ?
–নাসিমার কোচিং শুরু হচ্ছে আগামীকাল থেকে,আসতে পারেনি। তোর ফুপা তো স্কুল নিয়ে পড়ে আছে। ওরা ভালো আছে। তা’ তুই কেমন আছিস রুহিদা ?
–-ভালো আছি ফুপি। তা’ ভীষণ বিনয়ী বিনয়,কেমন আছিস ? আরে তুইতো বেশ বড় হয়ে গেছিস! একেবারে সুন্দর সাহেবী, সাহেবী ভাব এসেছে তোর চেহারার মধ্যে।
মামী বললেন,– বড় হবে না! সে যে এইট থেকে নাইনে উঠবে।
— পরীক্ষা কেমন হলো,বৃত্তি পাবিতো ?
-–ভালো হয়েছে পরীক্ষা, হয়তো পাবো । ভয়ে ভয়ে আমি বললাম।
–হ্যাঁরে, গত বর্ষায় একটা ব্যাঙ নাকি তোকে কামড়িয়ে ………..।
মা রুহিদা আপার কথা থামিয়ে দিয়ে বললেন,
— ও কিছু না,সব ঠিক হয়ে গেছে। মামী রুহিদা আপাকে ধমকের সুরে বললেন,
–এটা নিয়ে ওকে কিছু বলিস না রুহি। এমনিতেই বিনয় তোকে খুব ভয় পায়।
রুহিদা আপা এসে আমাকে চেয়ারের পেছনে দিক থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
–কেনরে,আমি কি বাঘিনী,অত ভয় পাস কেন!
আমি মনে মনে বললাম,–বাঘিনীর মতোইতো ছিলে,হঠাৎ কি হলো তোমার আজ! রুহিদা আপার শরীর থেকে অপূর্ব এক মিষ্টি গন্ধ আমার নাকে এসে লাগলো,আমি লজ্জায় আরো আড়ষ্ট হয়ে পড়লাম।
–বিনয়,তুইতো আমাকে সালাম দিসনি!
–-তুমিওতো মাকে সালাম দাওনি!
–উনিতো আমার ফুপি,আমার মায়ের মতো।
–তুমিওতো আমার আপু,আমার ……..।
মামী থামিয়ে দিয়ে বললেন,
–এবার থামতো। তোর ফুপি কত পিঠা এনেছে দেখ,খাবি চল।
–তোর মুখে বেশ বুলি ফুটেছেরে বিনয়, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,–কিছু মনে করিস না,তোর সাথে দুষ্টোমি করছিলাম। ফুপি কি পিঠা এনেছে,দাও।
আবিদ ভাইকে ডাকলেন মামী। নিজের ঘরে ছিলো , দৌঁড়ে এসে বললো,
–আমাকেও দাও,আমার ফুপি যা’ মজার পিঠা বানান না! পিঠা বানানোর দক্ষ এক কারিগর ফুপি!
সবাই একসাথে হেসে উঠলাম আমরা। এমন সময় মামা এসে ঘরে ঢুকলেন।
–কিরে, কেমন আছিস, কখন এলি তোরা, একটা খবরতো দিতে পারতিস।
–বাপের বাড়িতে আসবো,খবর দিতে হবে কেন?
– –তা’, যা’ বলেছিস,শোন এখন কি বাজারে যেতে হবে ?
–না, কাল সকালেও যেতে হবে না। কত শাক-সব্জি এনেছে দেখো, একেবারে তাজা। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি চা বানাচ্ছি।
সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে পিঠা আর চা খাচ্ছে। মামী নিজ হাতে পিঠা তুলে দিচ্ছেন সকলের প্লেটে। মামা বললেন,–হেড মাস্টার সাহেব, নাসিমা এরা কেমন আছে? এলো না কেন!
মা বললেন,–নাসিমার কোচিং শুরু হচ্ছে কাল থেকে। আর হেড মাস্টার সাহেবতো স্কুল নিয়ে ব্যস্ত।
চা খেতে খেতে আবিদ ভাই জিজ্ঞেস করলো, –আজকে কি রান্না হবে মা?
–-ভুনা খিচুরী,ইলিশ ভাজি,শুকনো করে ছাগলের মাংস,পিঁয়াজু আর বেগুনি। শীত পড়েছে,খেতে ভালো লাগবে সবার। আমাদের বিনয়ের নাকি খুব পছন্দ,তাই নারে বিনয়?
–-হ্যাঁ,একটু বৃষ্টি হলে বা ঠাণ্ডা একটু বেশি পড়লে,বিনয় আব্দার করে বসবে,মামীর মতো শুকনো করে খিচুরী রান্না করার।
–তোমার ভাইয়ার এক মক্কেল,চাঁদপুর থেকে দুটো ইলিশ এনেছিলো কাল। আজকে রান্না করব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম।
মামী নিজ হাতেই রান্না করা পছন্দ করেন। কাজের এক মহিলা আসে সকাল- বিকাল। বাসন মাজা,ঘর ঝাড়ু দেয়া,মোছা,কাপড় ধোয়া,কুটনো কাটা প্রায় সব কাজই করে দিয়ে যায়। অফিসের মতো সময় সূচি। সকাল সাতটা থেকে নয়টা,বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যে সাতটা।
রুহিদা আপা বললো,– আমাকে একটু চা দিও মা। দুধ রাতে খাবো। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,–কিরে তুই চা নাকি দুধ?
–আমি দুধ খাই না,চা খাবো।
–সে কিরে,দুধ,ডিম,কলা তিনটায় খেতে হবে। জানিস রাতে দুধ খেলে ঘুম ভালো হয়।
–আমার দুধ খেতে ভালো লাগেনা।
মা বললেন –কত করে বলি,কিছুতেই শুনবেনা।
–আমাকে দিও,পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে দেবো,তারপর খাবে। অনেকক্ষণ পর মামা বললেন,
–হয়েছে,তোর আর পিঠের ছাল তুলতে হবেনা। খেতে না চাইলে জোর করে লাভ নেই।
চায়ের পর্ব শেষ করে যে যার ঘরে চলে গেলেন সবাই। মামা বললেন,
–আমি বাহির থেকে একটু বেড়িয়ে আসি।
মা আর মামী রান্না শুরু করে দিয়েছেন। আমি ঘুরে ঘুরে নতুন বাড়ি দেখছি। সুন্দর বাড়ি করেছেন মামা। নীচে দু’টো বেডরুম, কিচেন,ডাইনিং ও ড্রইং রুম। উপরে তিনটা বেডরুম। মামা-মামীর পাশেই আবিদ ভাইয়ের রুম আর সবার শেষে রুহিদা আপার রুম। তিনটা রুমের সামনে রেলিং দেয়া সুন্দর বারান্দা। উপরের বারান্দা থেকে ড্রইং রুম দেখা যায়।
এবার এসে রুহিদা আপার একটা পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করেছি। আগের মেজাজী ভাবটা অনেকটা কমে গেছে। কথা-বার্তায়ও বেশ আন্তরিকতা এসেছে। অনার্স ফাইনেল শেষ হয়ে গেলো।অতীতের সব পরীক্ষার ফলাফল খুব ভালো। মাস্টার্সে ভালো রেজাল্ট করে ভার্সিটিতে জয়েন করার ইচ্ছা আছে তাঁর। মামা-মামীও তাই চান। রুহিদা আপার রুমের সামনে যেতেই আমার হাঁটার শব্দ পেয়ে, উনি আমাকে ডেকে বললেন,
–বিনয় ভেতরে আয়।
আমি ঘরে ঢুকে দেখি,হাল্কা লাইট জ্বালিয়ে রুহিদা আপা শুয়ে আছেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,–সন্ধ্যার সময় শুয়ে আছ কেন,অসুখ লাগছে?
–-মাথাটা ব্যথা করছে।
–ঔষধ খেয়ে নিলে পারতে।
–ঔষধ খেতে ইচ্ছে করেনারে আমার, এখানে বসে তুই আমার মাথাটা একটু টিপে দেতো।
আমি তাঁর কাছে যেয়ে বসে,আস্তে,আস্তে মাথা টিপে দিতে লাগলাম। বললাম –একটু টাইগার বাম লাগিয়ে দিলে ভালো হতো মনে হয়।
–লাগবে না,এমনিতে ভালো লাগছে।
–তোমার টেবিলের ইংরেজি বই গুলো দেখলে, আমারই মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়।পড়লে না জানি কি হয়!
–তাহলে বাপু তুই ওদিকে দেখিস নে। তোর মাথা ব্যথা শুরু হলে,আবার আমাকেই তোর মাথা টিপে দিতে হবে। রুহিদার আপার কথায় হাসলাম দুজনেই। কিছুক্ষণ পরে রুহিদা উঠে হাল্কা করে, আমার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বললেন –-থ্যাঙ্ক ইউ। কেউ থ্যাঙ্ক ইউ বললে, বলতে হয়, ইউ ওয়েলকাম।
আমি বললাম –-ওমা তাই! ইউ ওয়েলকাম।
–যা’ তুই এখন নীচে যা’,ঘন্টা খানেক পরে আসিস, আমাকে কিছুক্ষণ পড়তে হবে।
–ঠিক আছে,বলে নীচে নেমে গেলাম আমি।
ড্রইং রুমে বসে,পত্রিকা নিয়ে পড়তে লাগলাম। মামী বললেন,–বিনয়,ক্ষিধে পেয়েছে,কিছু খাবি?
–না মামী,কিছু খাবো না। কথা না শুনে,মামী একটা বাটিতে,কিছু ছনাচুর,কাঁচা মরিচ আর পিঁয়াজ কুচি দিয়ে বললেন,–এ গুলো খেয়ে নে,দশটায় আমরা ভাত খেয়ে ফেলতে পারবো।
–আমার অসুবিধা হচ্ছে না মামী।
–তবু ,খেয়ে নে।
মা রান্না ঘর থেকে বললেন,–মামী আদর করে দিচ্ছেন,খেয়ে নে।
— মামী, এ চনাচুড়টা বেশ স্বাদতো! মিষ্টি,মিষ্টি,তার সাথে কাঁচা মরিচ,পিঁয়াজ কুচি!
— এখানে পাথরঘাটা একটা দোকানে বানায়।
মনে মনে বললাম,এই না হলে মামার বাড়ি!
এক ঘন্টা সময়েরও কিছু পরে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রুহিদা আমায় ডাকলেন উপরে। আমি উপরে উঠে তাঁর রুমে ঢুকলাম। কি সুন্দর করে সাজানো রুম। একদিকে পড়ার টেবিল,তার উপর সাজানো বই,পাশে সিঙ্গেল সোফা। অন্যদিকে বইয়ের আলমারী,বইয়ের সেলফ,একটা ছোট্ট সো-কেইজ। সবশেষে মাঝারী সাইজের খাট,দেয়ালে সাঁটানো রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের দু’টো ছবি।
–-ওটা কার রুম রুহিদা আপা?
—ওটা আমার ড্রেসিং রুম। যা’ দেখে আয়।
আমি দরজা খুলে ড্রেসিং রুমে গেলাম।একটা ওয়ারড্রপ,ড্রেসিং টেবিল বসনো হয়েছে রুমের ভেতর। একটা কাঠের পোষাক ষ্ট্যান্ডে,ছোট বড় নানা ধরণের পোষাক ঝোলানো। শেষের দিকে বার্থরুম। বেরিয়ে আসার পর রুহিদা আপা জিজ্ঞেস করলেন,–কেমন লাগলোরে তোর ?
–বেশ ভালো। শুধু কি তোমার জন্যে এ ব্যবস্থা?
–না,সবগুলো বেডরুম একই রকম,একই ব্যবস্থা।
–তুই চেয়ারে বসে এই বইটা পড়,আমি একটু পরে তোর সাথে কথা বলছি। একটা বই উনি আমার হাতে দিলেন। বইট হাতে নিয়ে আমি বললাম,
–এই বই আমি পড়তে পারবো!
–-কেন পারবি না! পড়ে দেখ, একেবারে সহজ ইংরেজি।
এর আগে মামার বাড়িতে আসলে,রুহিদা আপার ইংরেজি বইগুলো দেখলে আমার মাথা ঘুরে যেতো। কি কঠিন,কঠিন সব বই! ভাবতাম এগুলো পড়েন কিভাবে! আমি বইটা পড়ার চেষ্টা করছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর রুহিদা আপা তাঁর পড়া শেষ করে বললেন,
— খেলবি আমার সাথে?
আমি বললাম –-কি!
–সাপ লুডু? আমি মাঝে-মধ্যে একা একা খেলি।
লুডু নিয়ে আমার পাশে এসে বসলেন তিনি। –জানিসতো খেলতে?
–হ্যাঁ জানি।
–এই, তোর মুখ থেকে পিঁয়াজের গন্ধ করছে কেন?
–-মামীমা চনাচুর, পিঁয়াজ খেতে দিয়েছিলেন।
–ঘুমোতে যাওয়ার আগে ব্রাশ করে ফেলিস।
–প্রতি রাতেই আমি ব্রাশ করি।
–গুড বয়। খেলাটা কি চমৎকার,নারে। মই বেয়ে উপরে উঠা,সাপের মাথায় পড়লে,সাপের লেজে চলে আসা। এইভাবে উঠা আর নামাতে চলছে মানুষের জীবন।
এরই মধ্যে একটা গেম শেষ হয়ে গেলো। রুহিদা আপা বললেন,–আর নয়। এক্ষুনি মা খেতে ডাকবে। বইটা পড়ার চেষ্টা করেছিস?
— হ্যাঁ,ইডিপাস,বেশ কঠিন! আমি আগে বাংলা অনুবাদটা পড়েছি,বাবা কিনে দিয়েছিলেন ।ওটা পড়া থাকাতে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিলো না।
মামী ডাকলেন –-তোরা সবাই খেতে আয়। খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
–দেখেছিস,সব কিছু সময় মতো।রাত সাড়ে নয়টা থেকে দশটার মধ্যে খেতে বসে যাবো। চল্ উঠি। রুহিদা আপা দাঁড়িয়ে,তাঁর শো কেইজ দেখিয়ে বললেন—ওটা কি দেখেছিস?
আমি বললাম—ব্যাঙ, ওটা কেন রেখেছো?
–-খুব সুন্দর না! শান্ত হয়ে বসে আছে। ভয় নেই কামড়াবে না তোকে।
আমি বললাম,–যা’ পাপেট তো কামড়াতে পারেনা।
শীতের রাত, ঠাণ্ডাও বেশ। তবে গ্রামের চেয়ে অনেক কম। সবাই একসাথে খেতে বসলাম। নিজের হাতে,যার যতটুকু লাগে নিয়ে খাওয়া। মামীমার রান্নাও হয়ছে চমৎকার। শসা,পিঁয়াজ,গাজর,দৈই,সরিষা বাঁটা দিয়ে এক সালাদ করেছেন মামী। এর আগে এরকম আমি কখনো খাইনি। ভুনা খিচুরী, ছাগলের মাংস, পিঁয়াজু, বেগুনি সাথে ইলিশ ভাজি।এক মজার খাবার।
মামীমা বললেন,–লজ্জা করিস না বিনয়। যা’ ভালো লাগে নিয়ে খাবি,আমি তুলে দিচ্ছিনা কিন্তু।
–না,মামী খাবো, সালাদ টা খুব ভালো লাগছে।
মামা বললেন—মামার বাড়িতে লজ্জা কিসের, নিজের বাড়ির মতোই খাবি। লজ্জা করবি শ্বশুর বাড়িতে। শ্বশুর বাড়িতে যত বেশি লজ্জা পাবি, তত বেশি খেতে পাবি।
রুহিদা আপা বললেন –-তুমিও কি তাই পেতে বাবা?
–হ্যাঁরে, প্রথম প্রথম তাই পেয়েছি, এতে সমাদরও বেড়ে গেছে, লাভও বেশি হয়েছে।
মামীমা বললেন—উকিলের যত বুদ্ধি!
–-একবার হয়েছে কি জানিস,গেছি তোর মাকে নিয়ে তোদের মামার বাড়িতে। তোদের নানীরও রান্নার হাত ছিলো চমৎকার। টেবিলে সব লোভনীয় খাবার। আমি বললাম,– অত খাবার খাবো নাকি! আমি একটু, একটু করে খাবো কিন্তু। তোর মা বললো,–সব খাবার তোমার নাকি! তাতেই হয়েছে,তোদের নানী তোর মাকে বকুনি দিয়ে, নিজ হাতে ডাবল,ডাবল খাবার তুলে দিলেন। বললেন — জামাইয়ের জন্যেই করেছি, একটুও ফেলে রাখতে পারবেনা। তুই চুপ থাক্ ।
আবিদ ভাই বললেন — কথাটা আমাদের মনে রাখতে হবে বিনয়।
খেতে বসে সুদীর্ঘ আড্ডা ডাইনিং টেবিলে। খাওয়া শেষ হওয়ার পর মামী, বাটিতে মিস্টি তুলে সবার হাতে দিতে দিতে বললেন,–তোর মামা এনেছে,বরিশালের গৌরনদীর দই।
মা বললেন, –এখানে পাওয়া যায়?
মামা বললেন,– হ্যাঁ,স্টীমারে আসে।
মামী বললেন—রুহি,বাবার বিছানাটা একটু গুছিয়ে দিস্। আমি আর তোর ফুপি গেস্ট রুমে থাকবো,তার পাশের রুমে বিনয় থাকবে।
মা বললেন—বিনয় একা, একা ঘুমোতে চায়না, সে বাড়ীতে নাসিমার ঘরে ঘুমোয়।
রুহিদা আপা বললেন,–ওমা, কি বলো! কচি খোকা নাকি বিনয়, ভয় পাস? ঠিক আছে,ভয় নেই তুই আমার সাথে ঘুমোস।
সেই ভাবে ব্যবস্থা হলো। সবার বিছানা গুছিয়ে রহিদা আপা চলে গেলেন উনার রুমে।আমিও সাথে গেলাম। –তোকে কবিতা শুনাবো বলেছিলাম, শুনবি?
–হ্যাঁ, শুনবো। রুহিদা আপা শুরু করলেন,’কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও……………।‘–-বাহ্, অপূর্ব রুহিদা আপা,তোমার তুলনা নেই।
–দেখি তুই,কর একটা।
–আমিতো পারিনা।
–যা’ পারিস কর। আমি পড়লাম— ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর’।
–ভালো করেছিসতো তুই,তোর উচ্চারণে কিছু সমস্যা আছে। ঠিক হয়ে যাবে।–-একটু করে দুধ খা’।
উনি গ্লাসটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, –মধু দিয়ে এনেছি,ভালো লাগবে।
-–না, রুহিদা আপু, আমি খাবো না।আমার ভালো লাগেনা।
–দই খেয়েছিস, কি ভাবে?
–-দুধতো খাইনি।
–কচি খোকা, একা থাকতে ভয় পাস আবার দুধ খাসনা। যা’ দাঁত ব্রাশ করে আয়।
আমি দাঁত ব্রাশ করে ফিরলাম।
–বোস তুই,আমি আসি, বলে রুহিদা আপা তাঁর ড্রেসিং রুমে চলে গেলেন। দাঁত ব্রাশ করে, স্লিপিং গাউন পড়ে বের হলেন রুম থেকে। হাল্কা বেগুনি রঙের স্লিপিং গাউনে অপূর্ব লাগছে তাঁকে।
জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন রুহিদা আপা।
–এ দিকে আয় বিনয়, দেখ কি সুন্দর চাঁদ!
–এতো কুয়াশায় ঢেকে গেছে রুহিদা আপা।
–নারে, এ হলো মাঘী পূণিমার চাঁদ। কুয়াশার আচ্ছনতায়, চাঁদের আলোটা যেন আরো স্নিগ্ধতা পেয়েছে। কুয়াশা কেটে গেলে, চাঁদের আলোটা আমার উপর এসে পড়বে আর আমি তার আলোতে স্নাত হবো। এ এক অপূর্ব অনুভব বিনয়। কিছু বুঝতে পারছিস? আমার সর্বাঙ্গে এই আলোর প্লাবন বইছেরে বিনয়। চল শুয়ে পড়বো।
–এবার ব্যাঙের কাহিনীটা বলতো বিনয়। ব্যাঙ তোকে কিভাবে আক্রমণ করছিলো,খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। আমি মাথা নীচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
–কিরে, কথা তোর কানে যাচ্ছে না? আমি কাউকে বলবোনা।
–আমার লজ্জা করছে।
–আহারে লজ্জা,ভাজা মাছটা উল্টিয়ে খেতে জানেনা!
–ঠিক আছে,শুয়ে শুয়ে বলবো।
–একটা কম্বলে ঘুমাবো আমরা,কম্বলটা ডাবল,অসুবিধা হবেনা।
–তার আগে একটা কথা বলি,তোমাকে বেশ সুন্দর লাগছে রুহিদা আপা। যেন বেগুনি রঙের ফাঁকে এক রক্তজবা উঁকি দিচ্ছে । একেবারে পরী মতো! রুহিদা আপা আমার গাল টোকা দিয়ে বললেন,
–- চমৎকার বলেছিতো। থ্যাঙ্ক ইউ।
–ইউ ওয়েলকাম।
–চল্ শুতে চল্।কম্বল গায়ের উপর টেনে দিয়ে বললেন,– এবার বল্।
–তখন বর্ষা পুরোপুরি শুরু হয়নি। সন্ধ্যের একটু আগে। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। একটা ঝোঁপের উপর কতগুলো চড়ুই খেলছিলো।আমি ঝোঁপের আড়ালে প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে বসলাম।
–সেটা কি আবার !
–কিছুনা,যাও, বলবো না।
রুহিদা আপা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,–আচ্ছা,বল্ বল্।
–হঠাৎ চড়ুই পাখি গুলো উড়ে চলে গেলো।
–তারপর,তারপর…….।
–একটা বড় ব্যাঙ কোত্থেকে লাফ দিয়ে এসে,আমার ওটায় কামড়ে ধরলো। আমি চিৎকার করে হাত দিয়ে ব্যাঙটাকে ছুঁড়ে ফেললাম।
–তোর ওটাকে চড়ুই পাখি মনে করে,গিলে ফেলেছিলো,তাই না! ব্যাথা পেয়েছিলি খুব?
–-না, তেমন নয়, সামান্য।ঘরে এসে কাঁপতে কাঁপতে মাকে বললাম। মা,হাল্কা গরম পানি করে,ডেটল দিয়ে ধুয়ে দিলেন। কি একটা মলম লাগিয়ে দিলেন। বাবা, ভাত খাওয়ার পর দুটো টেবলেট খেতে দিলেন,আর তেমন ব্যাথা লাগেনি।
— এই ব্যাঙ,খুবই শান্ত, নিরীহ একটা প্রাণী। শিকার উড়ে যাওয়াতে ঐ ক্ষুধার্ত ব্যাঙের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো হয়তো।ফলে সে তোর নুনুটাকেই গিলতে চেয়েছিলো। হ্যাঁরে বিনয়,আমি একটু ধরে দেখি কোথায় কামড়িয়েছিলো ।
–আমার খুব ভয় করছে!
–- কচি খোকা, ভয় কিসের, আমি আছিনা ….আমারও একটা ব্যঙ আছে। ওটা কামড়িয়ে ধরলে যাথা লাগেনা.। ডিমলাইটটা অফ্ করে দিলেন রুহিদা আপা।
বেশ খানিকটা সময় পর আমি বললাম –-তুমি না খুব……
–দুষ্ট তাইনা! আমি নারে, দুষ্ট ঐ ব্যাঙটা।
…………………………………………..