You are currently viewing ওরা ফেরেনি কেউ – ৬ ||  বিচিত্রা সেন

ওরা ফেরেনি কেউ – ৬ || বিচিত্রা সেন

ওরা ফেরেনি কেউ 

বিচিত্রা সেন

কিস্তি-৬

১১.

শহরে এসে বাবার মতো আদিত্যও এসেছে সেই ঘোষবাড়িতে। এই ঠিকানা তাকে দিয়েছে তার মা। তার মা এই ঠিকানা পেয়েছিল তার বাবার কাছ থেকে। বাবার মুখে নাকি মা ঘোষবাড়ির অনেক গল্প শুনেছে। বাবাই নাকি কথা প্রসঙ্গে মাকে বলেছিল, আদিত্যকে ঘোষবাড়িতে রেখে চট্টগ্রাম কলেজে পড়াবে। সেই কথাটাই মা মনের মধ্যে গেঁথে রেখেছিল। তাই বাবা অকালে চলে গেলেও বাবার স্বপ্ন যাতে বিফল না হয় মা সে চেষ্টাই করেছে। মা তাকে শহরে পাঠিয়ে একটা ঠিকানা দিয়েছে। বাকিটুকু তাকেই করতে হবে।
এক অদ্ভুতবাড়ি এই ঘোষবাড়ি। গাদা গাদা মানুষ সারাবাড়িতে গিজগিজ করছে। বাড়ির একপাশে তারা অতিথিশালা করে রেখেছে। সেই অতিথিশালা একদিনের জন্যও খালি থাকে না। দূর দূরান্তের আত্মীয়রা শহরে কোনো কাজে আসলে এই অতিথি শালায় এসে ওঠে। এখানে সকালের নাস্তা, দুপুর এবং রাতের খাবার ফ্রি। ঘোষরা বড় ব্যবসায়ী চাক্তাইতে তাদের অনেকগুলো দোকান। যেমন তাদের বিত্ত, তেমন তাদের চিত্ত। আদিত্য প্রথমদিন এসে বাড়ির কর্তা এবং গিন্নীকে প্রণাম করে এসেছে। তারপর থেকে তাদের সাথে আর দেখা হয়নি। কিন্তু তাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না আদিত্যের। রান্নাঘরে গিয়ে প্রতি বেলায় বেলায় সে খেয়ে আসে।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম কলেজে গিয়ে সে অধ্যক্ষের সাথে দেখা করেছে। অধ্যক্ষ জীবনকৃষ্ণ রায় তার একটা পরীক্ষাও নিয়েছেন। তারপর আর বেশি কষ্ট করতে হয়নি আদিত্যকে। প্রথম বিভাগ দেখে তাকে সহজেই ভর্তি করানো হলো চট্টগ্রাম কলেজে।
আদিত্য ঘোষবাড়িতে থেকেই কলেজে যাওয়া শুরু করলো। সময়টা ১৯৪৫ সাল। শহরে আসার পর থেকে আদিত্য বুঝতে শুরু করেছে গ্রাম আর শহরের মধ্যে অনেক পার্থক্য। এখানে প্রতিদিন নানা ধরনের মানুষের সাথে দেখা হয়, পরিচয় হয়, কখনো কখনো ঘনিষ্ট আলাপও হয়। পরের দিন হয়তো তাদের অনেককে সে আবার খুঁজে পায় না। তাদের গ্রামে তো সব মানুষই ছিল তার পরিচিত। যখন যাকে দেখতে ইচ্ছে করতো, তখনই তার বাড়িতে চলে যাওয়া যেতো। এখানে তা সম্ভব নয়। এখানে এসে আরও একটা জিনিস তার চোখে পড়ছে, তা হলো দারিদ্র। গ্রামে তাদের প্রচুর ভূসম্পত্তি। অভাব কী জিনিস সে কখনো দেখেনি। বাড়ির আশে পাশে কিছু দরিদ্র পরিবার আছে বটে, তবে তারা স্বচ্ছল পরিবারগুলোতে কাজ করে নিজেদের আহার জোটাতে পারে। কিন্তু শহরে এসে কলেজের এমন কযেকজন বন্ধুকে দেখেছে যারা খুবই গরীব। এর মধ্যে নাকি চলকে বিশ্বযুদ্ধ, তাই বাজারে জিনিসপত্রের দাম খুব চড়া। ঘোষবাড়িতে থাকলে এসব অভাবের ছিটেফোটারও দেখা পাওয়া যায় না। কিন্তু রাস্তায় বের হলে ফুটপাতের অনেক হাড় জিড়জিড়ে মানুষের দেখা পাওয়া যায়, যারা হাত পেতে সাহায্য চায়। এসব দেখলে আদিত্যের খুব খারাপ লাগে। তার তো কোনো অভাব নেই। মাসে দুইবার বাড়ি গিয়ে সে টাকা-পয়সা নিয়ে আসে। ঘোষবাড়িতে সে থাকাখাওয়া বাবদ কিছু খরচ দিতে চেয়েছিল, কিন্তু কর্তা তা নেননি। উল্টো তাকে প্রচ- বকা খেতে হয়েছে। এরপর সে আর ও পথে যায়নি। তবে টাকা না দিযে খেতে তার খুব সংকোচ হয় বলে ইদানিং সে দুপুরবেলার খাওয়াটা কলেজের পাশের একটা হোটেলে খেয়ে আসে।
ইদানিং তার মনটা ভালো নেই। কলেজে গেলে গরম গরম খবর শুনতে হয়। দেশের পরিস্থিতি নাকি ভালো না। একে তো যুদ্ধ চলছে বিশ্বে, তার মধ্যে নাকি বার্মা থেকে চাল আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। টাকা দিলেও বাজারে চাল পাওয়া যাচ্ছে না। ঘরে ঘরে দুর্ভিক্ষ বলতে গেলে শুরুই হয়ে গেছে। এদিকে আরেকটা বিষয় আরও আতংজনক তা হলো হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায় এতকাল পাশাপাশি বাস করে আসলেও ইদানিং দু-সম্প্রদায় পরস্পরকে বিষনজরে দেখছে। কলেজের মুসলিম বন্ধুরাও কেমন যেন দূরে সরে যাচ্ছে। এসব দেখে আদিত্যের ইচ্ছে করে সবকিছু ফেলে তার মা-ঠাকুরমার কাছে চলে যেতে। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পাশ না করে বাড়ি গেলে তার মা খুব কষ্ট পাবে। এই ভেবে সে নিজেকে মানিয়ে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। সময় গড়িয়ে যায়।
কলেজে এরই মধ্যে তার ছয়সাত জন বন্ধু জুটেছে। ওদের সাথে সে মাঝে মাঝে শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ায়। এভাবে সে চিনে নিতে চায় শহরটাকে। মাঝে মাঝে ওরাও আসে ঘোষবাড়ির অতিথিশালায়, কখনো কখনো গানের আসরও বসে। অতিথিশালায় একটি হারমোনিয়াম আছে। যেসব অতিথি গান পারে, তারা নিঃসংকোচে হারমোনিয়ামটা টেনে গান গায়। আদিত্য ছোটবেলা থেকে গান শেখেনি, তবে মায়ের সাথে আসলে বসে উপাসনা সঙ্গীত গাইতো। সেই সুবাদেই হয়তো সেও গায়ক সেজে যায়। তাদের এই বন্ধুদের দলে দুজন মুসলিম বন্ধুও আছে। একজনের নাম ইউসুফ, আরেক জনের নাম কামাল। মজার ব্যাপার ইউসুফ তাদের পাশের গ্রামেরই ছেলে, কিন্তু কেউ কাউকে চিনতো না। কামালদের বাড়ি বাংলাবাজার এলাকাতেই। তবে ঘোষবাড়ি থেকে কিছুটা দূরে।
সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি কিছুটা ঘোলাটে হলেও ইউসুফ ও কামালের মধ্যে তার কোনো প্রভাব দেখা যায় না।
দেশে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। অভাবী মানুষরা শহরে ছুটে আসছে। গ্রামে কাজ নেই, খাদ্য নেই। যে ঘোষবাড়িতে অঢেল খাওয়া দাওয়া ছিল তাদেরও এখন কিছুটা টান পড়েছে। বাড়িতে আদিত্যদের প্রচুর জমি থাকলেও ফসল না হওয়ায় তারাও কিছুটা চাপের মধ্যে পড়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলাটে হয়ে উঠছে। কলকাতার দাঙ্গার ঢেউ নোয়াখালীতে এসে লেগেচে। ধর্মের নামে মানুষ কেমন যেন উন্মত্ত হয়ে উঠে। মুসলিম লীগ এক দফায় তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছে। তারা মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র চায়। যার নাম হবে পাকিস্তান। এর মধ্যে কলেজ বন্ধ হয়ে গেলো। আদিত্য যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।

১২.

বাড়িতে আসার পর থেকে আদিত্য কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে। শহরে যখন থাকতো তখন তার মনে হতো গ্রামেই বুঝি যত শান্তি। কিন্তু গ্রামে আসার পর থেকে শহুরে জীবন তাকে টানছে। বন্ধুরা মিলে তারা যে শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াতো সেসব স্মৃতি মনে পড়লে তার মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। মনিবালার চোখে ছেলের পরিবর্তন চোখে পড়ে। কিন্তু কিছু বলে না। এই বয়সের ছেলে! চ লতা তো একটু থাকবেই। এই ভেবে মনকে সে সান্ত¦না দেয়। এদিকে রাজনৈতিক উত্তাপ গ্রামেও এসে ঠেকেছে। শোনা যাচ্ছে দেশ নাকি ভাগ হযে যাবে। প্রথমে শোনা গিয়েছিল দেশ নাকি তিন ভাগ হবে। ভারত, পাকিস্তান এবং অখ- বাংলা। তবে দিন যতই যাচ্ছে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। দেশ নাকি আসলে দুভাগ হবে। ভারত আর পাকিস্তান। এ গ্রাম হিন্দু অধ্যুষিত। সবাই বলছে পাকিস্তানে নাকি হিন্দুরা থাকতে পারবে না।
মনিবালা এসব কথা শোনে আর ভাবে। এত সম্পত্তি এত প্রতাপ, এত মায়া ছেড়ে তারা কি ভারত যেতে পারবে? না, অন্যরা পারলে পারুক গিয়ে, সে পারবে না। সে এদেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে। কিন্তু আদিত্য! আদিত্যের যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায় এ দেশে! আদিত্য তো এখন বড় হয়েছে। কলেজে পড়ে। ওর সাথেই বরং আলাপ করা ভালো হবে। এক সন্ধ্যায় মনিবালা আদিত্যকে বলে,
-আইচ্ছা, বেগ্গুনে হর এর দেশত বলে হিন্দু অল আর থাইত্ ফাইরত ন, তুই কী কস? আদিত্য দৃঢ়তার সাথে বলে,
-দুরো, হিয়িন ফালতু হতা। আঁরা আঁরার দেশ ছাড়ি হডে যাইয়ুম? এডের এত সম্পত্তি ফেলাই ইন্ডিয়া যাইয়ারে আঁরা কীরগুম্? মনিবালা মনে যেন একটা জোর পায়। সে যা ভাবছিলো ছেলেও একই কথা ভাবছে। তার শাশুড়ি ইদানিং প্রায়ই অসুস্থ থাকে। এই অসুস্থ মানুষটাকে নিয়ে সে টানাহ্যাঁচড়া করতে পারবে না। তাছাড়া এত বড় সাজানো সংসার ফেলে নতুন করে ইন্ডিয়াতে গিয়ে সে কী বা করতে পারবে? নন্দলাল থাকলে না হয় কিছু একটা ভাবা যেতো। চারপাশের হিন্দুদের মধ্যে কেমন একটা চাপা আতংক মনিবালা লক্ষ্য করে। তাপরও সে নিজের দেশে থেকে যাবে বলেই মন:স্থির করে।
তাদের গ্রামটা যেমন হিন্দু অধ্যুষিত, তেমনি তাদের পাশের গ্রামটা মুসলিম অধ্যুষিত। কিন্তু এমন একটা গোলমেলে সময়ে তারা কোনোরূপ বিরূপ আচরণ করে না। বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে এমন খবর মনিবালারাও পাচ্ছে। কিন্তু তাদের গ্রাম এদিক থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ। বরং পাশের গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ মুসলিমরা এসে বলে গেছে তারা যেন বিন্দুমাত্র ভয় না পায়। তারা আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনভাবে মিলে মিশে থাকবে। তাদের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে মনিবালার সাহস যেন আরও বেড়ে যায়।
এবার গ্রামে আসার পর আদিত্য তার বন্ধু ইউসুফের সাথে যোগাযোগ রাখা শুরু করেছে। ইউসুফদের বাড়ি তাদের পাশের গ্রামে। ইউসুফের সাথে কথা বললে আদিত্য মনে একটা জোর পায়। ভাবে, এমন বন্ধু থাকলে তাদের কোনো বিপদ হতে পারবে না। ইউসুফকে সে মাঝে মাঝে বাড়িতেও নিয়ে আসে। সে নিজেও ইউসুফের বাড়িতে যায়। সময় গড়িয়ে যায়। আদিত্যদের কলেজ খোলে। যথাসময়ে পরীক্ষাও হয়ে যায়। তারপর অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট মধ্যরাতে দেশভাগও হয়ে যায়।
তবে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের প্রত্যাশানুযায়ী পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও মনিবালাদের পাশের গ্রামে তেমন কোনো উল্লাস চোখে পড়ে না। মনিবালাদের গ্রামেও দেশভাগের তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না। সব আগের নিয়মেই চলতে থাকে। মনিবালাদের জমি-জিরাত আগের মতই মনিবালা দেখাশোনা করতে থাকে। আদিত্য বি.এ. পড়ার জন্য শহরেই রয়ে যায়।
ঘোষবাড়িতে থেকেই আদিত্য তার ডিগ্রীজীবন শুরু করে। এখন আদিত্য শহরের পথঘাট ভালোই চিনে গেছে। শহরের নিয়ম-রীতিও অনেকটা রপ্ত করে ফেলেছে। নতুন করে বন্ধুও জুটেছে তার। বন্ধুদের নিয়ে একেক বন্ধুর বাড়িতে মাঝে মাঝে গানের আসর বসে। সেই আসরের নিয়মিত শিল্পী আদিত্য। ছোটবেলা থেকে গান না শিখলেও তার গানের গলাটা চমৎকার। বন্ধুমহলে তাই তার অনেক কদর।
এমনি একদিন ঘোষবাড়ির অতিথিশালায় সে শ্যামাসঙ্গীত গাইছিল, ঠিক তখনই বাড়ির অন্দর মহলের এক কাজের লোক এসে উপস্থিত। এসেই সে আদিত্যের গান থামিয়ে দিয়ে বললো,
-অনরে বড়মা ডাকের। এহন যাইতো হইয়ে।
আদিত্যের বুকটা কেঁপে উঠলো। সে জানে এ বাড়ির রড়মা মানে কর্তা ঘোষবাবুর মা। এ বাড়ির আসল কর্ত্রী উনি। তিনি ডাকা মানেই নিশ্চয় আদিত্য কোনো ভুল করেছে। নাহলে এত বছরে তো কখনো তিনি তাকে ডাকেননি। আজ হঠাৎ কেন তার ডাক পড়লো? গান বন্ধ করে সে ধীরে ধীরে উঠলো। তারপর চাকরটার পিছু পিছু ঘোষবাড়ির অন্দর মহলের দিকে রওয়ানা হলো। ঘোষবাড়ি হিন্দুবাড়ি হলে কী হবে? ওরা খুব রক্ষণশীল। বাড়িটা সম্পূর্ণ দুভাগে বিভক্ত। বাহিরবাড়িতে বাড়ির পুরুষদেরকে হরহামেশা দেখা গেলেও বাড়ির মহিলারা কখনো এদিকে আসে না। তারা অন্দরমহল বা ভেতরবাড়ীতেই থাকে। তাই ভেতরবাড়ির দিকে যেতে আদিত্যের বুকটা সত্যিকারভাবেই কাঁপছিলো।
চাকরটার পিছু পিছু গিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা কক্ষে ঢুকলো আদিত্য। একজন সাদা থান পরা বৃদ্ধা খাটের ওপর বসে আছেন। কক্ষে আর একজন কিশোরী ছিল, সম্ভবত কাজের মেয়ে। আদিত্যকে ঢুকতে দেখে সে বেরিয়ে গেলো। আদিত্য ঢুকেই বৃদ্ধাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো। বৃদ্ধা আদিত্যের মাথায় হাত রেখে বললো,
-আইয়ু বাবা, আইয়ু। আঁর পাশে বোইয়ু।
বৃদ্ধার কন্ঠে এমন এক আন্তরিকতা ছিল, আদিত্য তাঁর কথাকে অগ্রাহ্য করতে পারলো না। সে খুব সংকোচের সাথে বৃদ্ধার পালংকের এক কোণে বসলো। বৃদ্ধা স¯েœহে বললেন,
-তুঁই শ্যামাসঙ্গীত গ যে আঁই প্রত্যেকদিন হুনি। বড়্ ভালা লাগে। কিন্তু দুরত্তুন ভালা হরি না হুনি। তুঁই প্রত্যেকদিন সন্ধ্যার সময আঁর ঘরত আইয়ারে আঁরে শ্যামাসঙ্গীত হুনাইত্ ফারিবা না?
আদিত্য অবাক হয়ে চেয়ে থাকে বৃদ্ধার দিকে। এ ঘরে ঢোকার আগে পর্যন্ত ওর বুকটা এমনভাবে কাঁপছিলো যেন সে বড় ধরনের কোনো অন্যায় করেছে। কিন্তু এখন বৃদ্ধার মুখে এ আবদার শুনে সে অভিভূত হয়ে গেলো। সে কখনো গান শেখেনি। মায়ের সাথে ছোটবেলা থেকে আসনঘরে বসে উপাসনাসঙ্গীত গেয়েছে। তবুও তার গান যে একজন বৃদ্ধাকে এভাবে স্পর্শ করেছে এটা ভেবেই তার খুব ভালো লাগছে। সে মাথা নেড়ে বললো,
-অবশ্যই ফাইরগুম্ বড়মা। আঁই প্রত্যেকদিন সন্ধ্যার সময় আইয়ারে অনরে শ্যামাসঙ্গীত হুনাই যাইয়ুম।
তার কথা শেষ হতেই সেই কিশোরী মেয়েটি এক গ্লাস জল ও প্লেটভর্তি পিঠা নিয়ে রুমে ঢুকলো। বৃদ্ধা হাসিমুখে আদিত্যের হাতে পিঠার প্লেটটা তুলে দিয়ে বললো,
-ধরো, ফিডা খ।
আদিত্য একটা পিঠা হাতে নিয়ে বললো,
-আইচ্ছা বড়মা, আঁই তোইলে এহন যাই।
বৃদ্ধা মাথা নেড়ে, বললেন,
-ঠিক আছে বাজি। কালুবাত্তুন চলি আইশ্শু।
আদিত্য মাতা নেড়ে সায় দিয়ে অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে আসে। এ মুহূর্তে তার মনটা যেন হাওয়ায় উড়ছে। খুব ইচ্ছে করছে মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে এ খবরটা জানাতে। মা শুনলে খুব খুশি হবেন। মায়ের কাছে এক স্বপ্নের বাড়ি এই ঘোষবাড়ি। বাবাই তাঁকে সে ধারণা দিয়েছিলেন। এখনো সে বাড়ি গেলে মা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চান ঘোষবাড়ি সম্বন্ধে। আজ যদি মা জানেন ঘোষবাড়ির সবচেয়ে বড় কর্ত্রী তাঁকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় শ্যামাসঙ্গীত শুনিয়ে যেতে আবদার করেছেন আদিত্যের কাছে তাহলে মায়ের খুশির সীমা থাকবে না। তাঁর স্বামী কখনো ঘোষবাড়ির অন্দরমহলে ঢুকতে পারেনি, কিন্তু তাঁর ছেলে এ সুযোগটা পেয়েছে। এ সময় হঠাৎ আদিত্যের মনে এক নতুন চিন্তা আসে। সে তো খুব ভালো আঁকতে পারতো। শহরে চলে আসার পর থেকে তার এ চর্চাটা থেমে গেছে। আবার তাকে আঁকাটা শুরু করতে হবে। প্রথম চর্চাটা শুরু হবে বড়মার পোট্টেট এঁকে। অতিথিশালায় নিজের রুমে এসে সে কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে বসে।

*************************