You are currently viewing মিউজিক এন্ড মিউজিশিয়ানঃ আশিকউজ্জামান টুলু || আশরাফুল কবীর

মিউজিক এন্ড মিউজিশিয়ানঃ আশিকউজ্জামান টুলু || আশরাফুল কবীর

 মিউজিক এন্ড মিউজিশিয়ানঃ আশিকউজ্জামান টুলু

পাঠপর্যালোচনাঃ আশরাফুল কবীর

 

“Music is the language of the spirit. It opens the secret of life bringing peace, abolishing strife.” Kahlil Gibran

লেবানিজ-আমেরিকান কবি ও দার্শনিক কহলিল জিবরান এর মতে — সঙ্গীত হচ্ছে অন্তরাত্মার ভাষা। শান্তিকে আনয়ন করে ও বিবাদ দূর করে সঙ্গীত মূলত জীবনের রহস্য উন্মোচন করে।

সঙ্গীত কি করতে পারে আর কি করতে পারে না সেদিকে না গিয়ে আপাতত বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীত সম্পর্কিত একটি চমৎকার বই “Music & Musician” এর উপর নজর দেই। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের উত্থানের একদম শুরুর দিনগুলো থেকে বর্তমান সময়ের মিউজিশিয়ান পর্যন্ত পুরো সময়কে আবদ্ধ করে চমৎকার এ-বইটি লিখেছেন, বাংলাদেশের দুটি প্রখ্যাত ব্যান্ড “আর্ক” ও “চাইম” এর প্রতিষ্ঠাতা, অন্যতম মিউজিক কম্পোজার, কিবোর্ডিস্ট ও কণ্ঠশিল্পী “আশিকউজ্জামান টুলু”।

বাংলাদেশের ব্যান্ডসঙ্গীত নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও ভাবালুতা বর্ণনা করার পাশাপাশি লেখক এ বইয়ে শিল্পীদের জীবনের নানান বাঁক, মায়াপ্রপঞ্চ ও প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরেছেন। মোট পাঁচটি বিভাগ রয়েছে বইটিতেঃ শিল্পী ও শিল্প, ব্যান্ড, গান, মিউজিক ও কম্পোজিশন এবং গল্পগুচ্ছ।

সঙ্গীত সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় যেমনঃ গানের প্রোডাকশন ও ক্রিয়েশন, গানের স্ট্রাকচার, গায়ক গায়িকার শ্রেণিবিভাগ, মিউজিক এন্ড টেকনোলজি, মিউজিশিয়ানদের প্রোগ্রাম বিষয়ক কোড, কর্ড প্রগ্রেশন, ফিউশন, স্টেজ পারফরম্যান্স তুলে ধরেছেন বইটিতে, করেছেন বিশেষভাবে শিল্প ও শিল্পীর জীবনের উপর প্রখর আলোকপাত, দিয়েছেন নতুনদের জন্য চমৎকার কিছু দিকনির্দেশনাও। বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের ধাঁচ বর্ণনা যেমনি করেছেন ঠিক তেমনিভাবে স্মৃতিতে ভর করে পাঠকদের উপহার দিয়েছেন কিছু রসাত্মক গল্পগুচ্ছও।

সঙ্গীতের কিছু খুটিনাটি বিষয়কে তুলনামূলক ও সহজভাবে তুলে ধরেছেন তিনি এ-বইয়ে। একটু বইয়ের শুরুর দিকে চোখ ফেরানো যাক —

“নদীর যখন ভাঙ্গন শুরু হয় তখন সে সবকিছু পানিতে টেনে নেয়, দেখে না কার ঘর ভাঙলো আর কার ভাঙলো কপাল। শিল্পীদের সাঁঝবেলাটা ঠিক তেমন। প্রকৃতপক্ষে শিল্পী ভীষণ একা, সারাজীবন একান্ত নিজের একটা জগতে বসবাস করে বলে কারো ভীষণ কাছে কোনোদিনও যাওয়া হয় না। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে থেকেও ভীষণ একা একটা জীবন পার করে। ঠিক সত্যজিত রায়ের নায়ক সিনেমার মতো।” (পৃষ্ঠা ১০)

একজন গড়পড়তা সাধারণ মানুষ ও একজন শিল্প-সাহিত্য সংশ্লিষ্ট মানুষের মধ্যে, বিশেষভাবে বলতে গেলে একজন সঙ্গীতজ্ঞের সাথে শেষপর্যন্ত পার্থক্য সূচিত হয় অন্তর্নিহিত একাকীত্ব দ্বারা। সবসময় সবার সম্মুখে থাকা সত্বেও অন্তর্নিহিত ও নিমজ্জমান তীব্র একাকীত্ব একজন শিল্পীকে জোরপূর্বক জনশূন্য একটি দ্বীপের একলা নাবিক বানিয়ে দেয়, যার স্বরূপ বুঝতে যাওয়া নিতান্তই দুষ্করঃ

“অতি সন্তর্পণে সাঁঝ পেরিয়ে রাত নেমে আসে শিল্পীর জীবনে। চারিদিকে ঘুটঘুটে কালো কালি দিয়ে লেপে দেয়া অন্ধকার। একধরনের অভূতপূর্ব একাকীত্ব এদেরকে গ্রাস করে। একা একা ক্ষয় হতে থাকে সবার চোখের অলক্ষে, কাউকে শেয়ার করে না মনের ভিতর জমে থাকা ব্যাথার কাব্যগীতি। সারাটা জীবন অন্যকে আনন্দ দেয়া মানুষটা নিজেই আনন্দের আকালের সন্ধানে দিনাতিপাত করতে থাকে। বয়সের ভারে ইতোমধ্যে দুরারোগ্য ব্যাধি এসে বাসা বাঁধে শরীরে। আয় রোজগার অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু বন্ধ হয় না প্রাত্যহিক সাংসারিক চাহিদা। এমন একটা অবস্থার মধ্যে এসে দাঁড়ায় জীবনটা যে তা আর কারো সাথে

শেয়ার করা যায় না। একসময়ের ধোপদুরস্ত একনামে চেনা শিল্পী, ঝড়ের রাতে বিশাল সমুদ্রে ভেসে থাকা জীবন নায়ের একলা নাবিক হয়ে যায়, যার চোখের সামনে শুধু অগণিত ঢেউ আর বুকফাটা সমুদ্রের গর্জন।” (পৃষ্ঠা ১০ ও ১১)

নিজের প্রতিষ্ঠিত দু’টো ব্যান্ড “চাইম” ও “আর্ক” এর শুরুর সময়ের ইতিহাস জানানোর পাশাপাশি লেখক খুব চমৎকার ও বিশদভাবে ব্যান্ডের বিভিন্ন কাল (শিশুকাল, কৈশোরকাল, যৌবনকাল, পুর্ণাঙ্গকাল, বৃদ্ধকাল) বর্ণনা করেছেন, পাশাপাশি ব্যান্ডে বাজানোর প্রস্তুতি কেমন হতে পারে, ব্যান্ড গঠন করার প্রক্রিয়া, সোলো ও ব্যান্ডে বাজানোর মধ্যকার পার্থক্য, গানের গঠন দারুণভাবে বর্ণনা করেছেন। যে সকল শিল্পী নতুনভাবে ব্যান্ড শুরু করেছেন কিংবা পরিকল্পনা করছেন ব্যান্ডদল গঠনের, তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য হতে পারে বইয়ের এ অংশটুকু (পৃষ্ঠা ১৫ – ৪২)।

“আমাদের জীবনে সময় খুব কম, এই কম সময়ে যতদূর সম্ভব এবং যতগুলি সম্ভব সৃষ্টি করে যেতে হবে, থেমে গেলে চলবে না, মন খারাপ করলে চলবে না, অন্যের ওপর রাগ করে নিজের সৃষ্টি বন্ধ করলে চলবে না। মানুষের সৃষ্টির মাধ্যমেই তাকে অন্যরা চেনে তাই মন যদি সৃষ্টিশীল হয়, ইচ্ছামত সৃষ্টি করে যাওয়া উচিত যখন যেটা মন চায়। কারণ সৃষ্টির সময়ে বোঝা যায় না কি সৃষ্টি হচ্ছে, বোঝা যায় ১০ কিংবা ২০ বছর পর। তাই মন যত চায়, তত হোক নতুনের আগমন, ক্ষতি নেই তাতে যদি একটা ভালো আর দশটা খারাপ হয়। কারণ ঝুড়ির মধ্যে থেকে একটা ভালো আমের জন্য অনেক সময় দশটা আম বাছতে হয়।” (পৃষ্ঠা ২৫)

ব্যান্ড সঙ্গীতের প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বর্ণনা করার পাশাপাশি অবধারিতভাবে গল্পগুচ্ছে এসেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে লেখকের মিথস্ক্রিয়া, আন্তরিকতা, হৃদ্যতা, সখ্যতা ও সরল আড্ডার কথা। সঙ্গীত শিল্পী ফিরোজ সাঁই, লাকি আখন্দ, গুরু আজম খান, পিলু মমতাজ ও হ্যাপি আখন্দকে নিয়ে আলাদাভাবে স্মৃতিচারণা সঙ্গীতবোদ্ধাসহ সাধারন পাঠককে শুধুমাত্র স্মৃতিকাতরতায় আক্রান্ত করবে না, বরঞ্চ সকলকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আশি ও নব্বই দশকের বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের উত্তাল দিনগুলোতে।

শেষ করছি বই থেকে সাউন্ড সম্পর্কিত চমৎকার একটি উদ্ধৃতি দিয়ে –

“সেই সাউন্ডের কমপ্লেক্সটা আজ অবধি মন থেকে যায় নাই, আমি জানি আমার জীবন চলে যাবে তবুও আমি একদিনের জন্যেও শান্তি পাবো না এই সাউন্ড নিয়ে। শুধু আমার না, সব মিউজিশিয়ানদের মনের একটা বিরাট অংশ জুড়ে সাউন্ডের ঝড় সারা জীবন বইতে থাকে, এরা এই ঝড়ের মধ্যেই দিনাতিপাত করতে থাকে, সম্পূর্ণ শান্তি পায় না। আমার ভাষায় – একজন পূর্ণাঙ্গ মিউজিশিয়ানের বিয়ে হয় সাউন্ডের সাথে এবং এই বিয়েতে ঐ মিউজিশিয়ানটা জীবনেও সুখী হয় না, হয় ওকে সাউন্ড সুখী করতে পারে না অথবা ও সাউন্ডকে সুখী করতে পারে না, যুদ্ধ লেগে থাকে সারাজীবন”। (পৃষ্ঠা ৯৮)

পুরো বইটি পাঠ করার পর এক ধরনের ভাবালুতায় মন আচ্ছাদিত হয়ে যায়। শিল্প ও শিল্পীর সাথে আরও বেশি করে সম্পর্ক স্থাপনে মন ধেয়ে যায়।

“মিউজিক এন্ড মিউজিশিয়ান” প্রকাশিত হয়েছে অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ এ। বইটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ রাইটার্স গিল্ড, প্রচ্ছদ করেছেন মুস্তাফিজুর রহমান রুপম ও বইটির মূল্য ৪০০ টাকা।

***************************

      আশরাফুল কবীর
কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক

*************************