You are currently viewing স্বাধীনোত্তর বিপর্যয় ব্যবস্থাপন ও আত্মকথন || হিমাদ্রি মৈত্র

স্বাধীনোত্তর বিপর্যয় ব্যবস্থাপন ও আত্মকথন || হিমাদ্রি মৈত্র

স্বাধীনোত্তর কালে বিপর্যয় ব্যবস্থাপন 

হিমাদ্রি মৈত্র

বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য ব্যবস্থা নিতে হয় অনেক আগে থেকে, কিন্তু সেই ধারণাটা আমাদের ধাতে নেই, এবং বাংলা মিডিয়াও বিপর্যয় ব্যাবস্থাপনার সাথে এর পার্থক্য না বুঝে ‘মোকাবিলা’র প্রচার করে যাচ্ছে। মোকাবিলা করতে যে ব্যপক প্রস্তুতি দরকার, সেটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। স্বাভাবিক ভাবেই বিপর্যয় ব্যবস্থাপনায় জগৎজুড়ে যে অগ্ৰগতি, আমরা তাকে ত্রাণের পরিমন্ডলেই সীমিত করে রেখেছি। পুরো ব্যবস্থাটার স্বাধীনতা পরবর্তী বিবর্তণটাকে একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টায় এই প্রবন্ধের প্রস্তাবনা। 

প্রাক- ব্রিটিশ ত্রাণ ব্যবস্থা 

ভারতীয় উপমহাদেশে দুর্ভিক্ষ একটি নিয়মিত বৈশিষ্ট্য।  ভারতের কৃষি উপযুক্ত জলবায়ুর উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।  মরশুমী বর্ষা ফসলের সেচের জন্য অপরিহার্য।  বৃষ্টিপাতের অভাব এবং খরার কারণে একাদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে ভারতে বেশ কয়েকটি দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল।  খরায় জলের চরম অভাব সৃষ্টি হয় এবং ফলস্বরূপ ফসল নষ্ট হয়।  অন্যদিকে, বন্যা ও ভূমিকম্প ফসল বা খাদ্য সঞ্চয়ের স্থানগুলো নষ্ট করতে পারে। উপকূল এলাকায় সমুদ্রের উচ্ছ্বাসেও (storm surge) এটা হতে পারে। এসবের ফলে খাদ্যের অভাব দেখা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। 

ঐতিহাসিকভাবে, এদেশের শাসকরা দুর্ভিক্ষ-ত্রাণের বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন।  এর মধ্যে কিছু ছিল সরাসরি, যেমন বিনামূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণ শুরু করা, মানুষের কাছে শস্যের দোকান খুলে দেওয়া এবং রান্নাঘর খুলে দেওয়া।  অন্যান্য ব্যবস্থার মধ্যে ছিল আর্থিক নীতি যেমন রাজস্ব মওকুফ, কর মওকুফ, সৈন্যদের বেতন বৃদ্ধি এবং অগ্রিম ঋণ প্রদান।  তাছাড়াও অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে পূর্তদপ্তর (public works department) নির্মাণ, খাল এবং বাঁধ ও কুঁয়ো নির্মাণ।  

প্রাক-ব্রিটিশ যুগে কোনো অখন্ড ভারতীয় রাজ্য বা সাম্রাজ্য (Nation-state) ছিল না। ফলতঃ কোনো অখন্ড ভারতীয় প্রশাসন ছিল না, রাজা বা সম্রাটরা তাদের নিজ নিজ চৌহদ্দিতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা বলবৎ করতেন আবার রাজত্ব পাল্টালে সেটাও পাল্টে যেত। যাই হোক, অনেক রাজাই নিজের প্রজাদের জন্য পুকুর খনন, ইত্যাদি করতেন বা নদীতে/ বড় দিঘীতে বাঁধের ব্যবস্থা করতেন, কর ছাড়ের ব্যবস্থাও ছিল। আকালের সময় কিছু লোকের মজুরি বা খাদ্যের বদলে কাজও জুটত।

ব্রিটিশ যুগের ব্যবস্থা

ব্রিটিশ রাজের সময় ভারতীয় উপমহাদেশের বহুবর্ষকালীন বৈশিষ্ট্য ছিল দুর্ভিক্ষ।  ব্রিটিশদের থেকে উদ্ভূত কৃষি ব্যবস্থায় কৃষিকে ধ্বংসের একটি অন্তর্নির্মিত (in built) ব্যবস্থা ছিল।  বর্ষার অপ্রাচুর্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির মতো দুর্ভিক্ষের ঐতিহ্যগত কারণগুলি ছাড়াও ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক নীতি এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছিল যাতে ভারতে খাদ্যের সঙ্কট এবং বারবার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।  অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতকের সময়, এদেশের জনগণ একের পর এক প্রলয়ঙ্করী দুর্ভিক্ষের দ্বারা বিপর্যস্ত হয়েছিল, যা কিনা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কম এবং ঔপনিবেশিক নীতির দ্বারা বেশী, যেমন চাপিয়ে দেওয়া লীজ-ভাড়া (rack-rent), বৈধ এবং অবৈধ উভয়ই, কৃষিকে অবহেলা, “মুক্ত-বাণিজ্য” নীতি এবং যুদ্ধের জন্য অতিরিক্ত শুল্ক আদায়। প্রাথমিকভাবে, ঔপনিবেশিক সরকারের এই জরুরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য কোন সমন্বিত নীতি ছিল না, শুধু মজুতদারি এবং অপরাধ প্রতিরোধ করা ছাড়া; আর কিছু বিচ্ছিন্ন লপসি রান্নার ঘর (gruel kitchen), দরিদ্রদের থাকার ঘর(shelter) এবং পূর্তব্যবস্থার মতো কিছু অ্যাডহক ত্রাণ ব্যবস্থা। বারবার দুর্ভিক্ষ এবং ক্ষুধার কারণে বিপুল প্রাণহানির জন্য ব্রিটিশ সরকার ইংল্যান্ডে চাপের মুখে পড়ে।  ১৮৭৬-৭৮ সালের দুর্ভিক্ষের বিধ্বংসী প্রভাবের কারণে ভারতে দুর্ভিক্ষের পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে উল্লেখযোগ্য কিছু করতে বাধ্য করেছিল।  তাই দুর্ভিক্ষের কারণগুলি মূল্যায়নের জন্য তারা তিনটি কমিশন গঠন করে। এই কমিশন গুলোল সুপারিশ ছিল যে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার সরকারী ব্যবস্থাকে অবশ্যই সারা বছর কাজ করতে হবে যাতে সময়মতো খাদ্যশস্যের ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

এই কমিশন নির্ধারিত কোডগুলো ঔপনিবেশিক প্রশাসকদের ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক নির্দেশিকা প্রদান করেছে।  এর মধ্যে রয়েছে দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস দেওয়ার নির্দেশাবলী, এবং জীবন বাঁচানোর জন্য, কিন্তু স্পষ্টভাবে কোষাগারের সর্বনিম্ন সম্ভাব্য খরচে জীবিকা নির্বাহের মজুরিতে কর্মসংস্থান প্রদানের মাধ্যমে। উল্লেখ্য, সমস্ত famine code-এর, ঔপনিবেশিক এবং সমসাময়িক উভয়ই, আইনি কোনো প্রয়োগ করা যায় না।  ব্রিটিশ কোডগুলোয় সরকারী কর্মকর্তাদের ন্যূনতম ব্যয় করার জন্য মাত্র একটি খরচের ক্ষেত্রেই সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল, তা হল কেবল প্রাণহানি রোধ করার জন্য, এবং এর বাইরে কিছুই ছিল না।  উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪১ সালের বেঙ্গল famine code এটি স্পষ্টভাবে বলে যে, “সরকার জীবন রক্ষার জন্য যা একেবারে প্রয়োজনীয় তার সহায়তা সীমিত রাখতে বাধ্য।  যখন জীবন সুরক্ষিত হয়, তখন ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি দায়বদ্ধতা বন্ধ হয়ে যায় এবং কর প্রদানকারী জনসাধারণের প্রতি দায়বদ্ধতা শুরু হয়।”

ত্রাণকে এই ন্যূনতম করার কাজটা কঠোর “Test Relief” (TR) নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে আংশিকভাবে সম্পন্ন করা হয়েছিল সকলকে নিরুৎসাহিত করার জন্য, শুধু সেই সমস্ত হতভাগ্য ব্যক্তিদের ছাড়া, যাদের এরকম কাজে যোগ দেওয়া ছাড়া জীবিকানির্বাহের আর কোনো উপায় ছিল না।  এর জন্য, এদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে নিরানন্দ পরিবেশে কঠোর একঘেয়ে কাজ করতে রাজি হতে হয়েছিল।  অর্থাৎ যদি প্রকৃতই খাদ্যাভাব থাকে, তবে রাজি হও, নয়তো‌ মর (এটাই Test)। প্রমাণ করা যায় যে ভারতীয় দুর্ভিক্ষ-ত্রাণের এই অনুশীলনগুলো পরবর্তীতে হলোকাস্টের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ব্যবহৃত মডেল ছিল।

অতীতের দুর্ভিক্ষ কোডগুলোয় হস্তশিল্পী, কারিগর এবং তাঁতিদের মতো অ-কৃষিকাজে যুক্ত গ্রামীণ দরিদ্র ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সংস্থান ছিল না। তারা দুর্ভিক্ষে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কিন্তু তাদের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে তারা খুব কম কায়িক পরিশ্রম দিতে পারত, তারা এই ধরনের কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য শারীরিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও অভ্যস্থ  ছিল না। ফলে তারা ‘Test Relief’ এর মত কঠিন কাজে অনুপযুক্ত থাকায় তাদের ন্যূনতম ত্রাণটুকুও জুটত না। এছাড়া দ্রুত ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, ক্রমবর্ধমান পারিবারিক ঋণ, বিকাশহীন কৃষি উৎপাদনশীলতা, সামাজিক স্তরবিন্যাস বৃদ্ধি এবং কৃষক শ্রেণীর তাদের জমিজমা থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে অবস্থার অবনতি ঘটে। 

যদিও, তিনটি দুর্ভিক্ষ কমিশন গঠন করা হয়েছিল, কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের জনসাধারণের জন্য কল্যাণমূলক পরিকল্পনাগুলোর সার্থক প্রয়োগে কখনও গুরুত্ব ছিল না।  দুর্ভিক্ষ ঘটতেই থাকে এবং বাংলার দুর্ভিক্ষ (১৯৪৩) ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ।  এটি ছিল ভারতকে ব্রিটিশ শাসনের সবচেয়ে খারাপ উপহারগুলোর একটি।

ব্রিটিশ রাজত্বে ভারতে অসংখ্য দুর্ভিক্ষ হয়েছিল।  তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলা।  এর মধ্যে প্রথমটি ১৭৭০ সালে, তারপরে ১৭৮৩, ১৮৬৬, ১৮৭৩, ১৮৯৩, ১৮৯৭ এবং সর্বশেষে ১৯৪৪-৪৪ সালেরটা ছিল ভয়ঙ্কর। ব্রিটিশ শাসনের আবির্ভাবের পরে, বেশিরভাগ দুর্ভিক্ষ ছিল বর্ষা বিলম্বের ফল এবং ব্রিটিশরা তাদের নিজস্ব আর্থিক লাভের জন্য দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণের ফল।  তবুও তারা এই কর্মকাণ্ডের বিপর্যয় স্বীকার করতে সামান্য কিছুই করেনি।

অনেক বিস্তারিত দুর্ভিক্ষ-মোকাবিলা প্রকল্পের বিকাশ সত্ত্বেও, দুর্ভিক্ষ অব্যাহত রয়েছ।  এর একটি কারণ হল যে ১৯৮০’র দশক পর্যন্ত বেশিরভাগ দুর্ভিক্ষের অন্তর্নিহিত কারণগুলি ঠিকভাবে বোঝা যায় নি।  যুগে যুগে এর মোকাবিলার জন্য কিছু সচেতনতা থাকা সত্ত্বেও, দুর্ভিক্ষ প্রাথমিকভাবে খাদ্য উৎপাদন হ্রাসের কারণে ঘটে বলে মনে করার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে।  ফল হল যে দুর্ভিক্ষগুলো যে এই ধরনের খাদ্যাভাবের ফলে নয়, এবং সাধারণত তা দুর্ভিক্ষ হিসাবে আগে থেকে বলা হয় না যতক্ষণ না তা ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ, দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করতে এবং এর ফলে দুর্ভিক্ষ কোডে নির্ধারিত সরকারী প্রতিক্রিয়াগুলোকে সময়মতো কাজে লাগাতে সরকারের ব্যর্থতার কারণে ব্যাপকভাবে আরো খারাপ পরিস্থিতি হয়েছে।

ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের কাজ দুর্ভিক্ষের অধ্যয়নের(study) ক্ষেত্রে একটি পরিবর্তিত ধারণার দিকে নিয়ে যায়।  দারিদ্র্য এবং দুর্ভিক্ষ(১৯৮১)’র মতো কাজগুলোতে, তিনি প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। এই ধারণা হল মোট খাদ্য-প্রাপ্যতা হ্রাস (Food Availability Decline) হল সমস্ত দুর্ভিক্ষের কেন্দ্রীয় কারণ। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে আরও আনুমানিক কারণ হল তথাকথিত “entitlement failure”, যা সামগ্রিক খাদ্য উৎপাদনে কোনো ঘাটতি না থাকলেও ঘটতে পারে। অর্থাৎ খাদ্যাভাব নয়, খাবার জোগাড় করার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে অনাহার থাকার পরিস্থিতি।

একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিপর্যয়কে সামলানোর সামর্থ্য নির্ভর করে তার ‘resource & assets’ এর উপর অর্থাৎ তার ‘entitlement’এর উপর। একজন ব্যক্তির এনটাইটেলমেন্ট বিভিন্ন কারণে পরিবর্তিত হতে পারে – উদাহরণস্বরূপ, পণ্য ও পরিষেবার দামের তারতম্য, নতুন রেশনিং নিয়মের প্রয়োগ, কীটপতঙ্গ দ্বারা কৃষকের ফসলের আক্রমণ বা যুদ্ধের মাধ্যমে খাদ্য-বন্টন চ্যানেলের ব্যাঘাত।  এই উদাহরণগুলি দেখায় যে কীভাবে জনসংখ্যার কিছু অংশ খাদ্য উৎপাদনে সামগ্রিক ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও food security বিনষ্ট হতে পারে।  

খাদ্য উৎপাদনে সামঞ্জস্যপূর্ণ ঘাটতি ছাড়াই এনটাইটেলমেন্ট-ভিত্তিক দুর্ভিক্ষের একটি ভাল উদাহরণ হল ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ, যা সবচেয়ে নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করা দুর্ভিক্ষগুলির মধ্যে একটা।  যা ‘৪৩ সালকে আলাদা করেছিল তা হল মুদ্রাস্ফীতি, যা যুদ্ধের একটি সাধারণ পরিণতি! পণ্যের দাম বৃদ্ধি সত্ত্বেও, কৃষি শ্রমিকদের মজুরি স্থবির হয়ে পড়ে।  ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে, খাদ্যশস্যের দাম ৩০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে, যা মুদ্রাস্ফীতির হারকে সামান্য ছাড়িয়ে গেছে, সেখানে কৃষি শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ।  কৃষি শ্রমিকরা, একটি শ্রেণী হিসাবে, খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যার ফলে অনেকের মৃত্যু হয়েছিল।  তবুও, গ্রামীণ বাংলা যখন দুর্ভিক্ষের দ্বারা বিধ্বস্ত হচ্ছিল, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী শহর কলকাতা খুব কমই প্রভাবিত হয়েছিল।  গবেষণায় দেখা গেছে যে কলকাতায় দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যুগুলি মূলত অভিবাসীদের মধ্যে ঘটেছে যারা গ্রাম থেকে খাদ্য ও ভিক্ষার সন্ধানে এসেছিল।

ত্রাণ ও বিপর্যয় ব্যবস্থাপন

স্বাভাবিকভাবেই এই আলোচনা করতে হবে স্বাধীনোত্তর ধারনার প্রেক্ষাপটে, কারণ তার পরিপ্রেক্ষিতে ত্রাণ ব্যবস্থাপনার ভূমিকার একটা মূল্যায়ন করা যেতে পারে। 

ত্রাণের কাজ, একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রে, চরিত্রে নেতিবাচক হওয়া উচিত নয়, শুধুমাত্র দুর্দশার লক্ষণগুলি বাস্তব বা প্রতারণামূলক কিনা তা খুঁজে বের করার জন্য, যেরকম ব্রিটিশরা ভেবেছিল। হস্তশিল্পী, তাঁতীরা যে কায়িক শ্রমের মাধ্যমে নিজের খাদ্য উৎপাদনে দক্ষ নয়, তাদের সংস্থানের কথাও ভাবতে  হবে। প্রকৃতপক্ষে এধরনের কল্যাণমূলক কাজ দিয়েই শাসকের চরিত্র বোঝা যায়। সস্তায় শ্রমিক (এবং সৈন্যশ্রমিক) পেতে গেলে খাদ্য এবং জীবিকার সঙ্কট তৈরী করাটা শাসকের পক্ষে সহজ, সনাতনী উপায়।

অনেক প্রগতিশীল ভাবনা থাকলেও তা আমাদের কাজের পরিবেশ বা জনগণের কল্যাণে খুব একটা কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারেনি। এরপর আসে সামাজিক উন্নয়নের সাথে বিপর্যয়ের যোগের ধারণাটা। আমাদের কৃষিপ্রধান দেশ। যেকোনো দুর্যোগ জনিত ক্ষতির হিসাব করতে প্রথমেই খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্নটা এসে যায়। যে কোনো দুর্যোগ সামাল দিতে ভাবা হত খাদ্য সঙ্কট যেন না হয়। পূর্ববর্তী দুশো বছরের দুর্ভিক্ষের ব্যপকতা প্রশাসনিক মনস্তত্ত্বে এমন দাগ কেটে দিয়েছিল যে এই ভাবনা থেকে বের হবার রাস্তা ছিল না। ফলে ঐ শুধু খাদ্য সঙ্কটের কথা মাথায় রেখে কৃষির ক্ষতি সামলানো ও খাদ্য সঙ্কট মেটানোর দিকেই বেশী নজর দেওয়া হয়েছে। 

গত শতকের শেষভাগে সামাজিক উন্নয়নে বিনিয়োগের ‘return’ আশানুরূপ না হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল বিপর্যয়ের ক্ষতি উন্নয়নের ফসলে ভাগ বসাচ্ছে। ১৯৯৪ সালে ইয়াকোহামায় আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনে আলোচনা সাপেক্ষে এটা ধারণা করা হল, পরিকাঠামো ভিত্তিক পুনর্গঠনের দ্বারা ক্ষতি মিটানো‌ যাবে না। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির দরকার ক্ষতির জড়ে পৌঁছাতে। তার জন্য যারা এবং যা যা সরাসরি ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তাদের বিপন্নতার কারণ বিশ্লেষণ করে তবেই ক্ষতির সম্ভাবনা(ঝুঁকি) কমানো যাবে। এই ধারণাকে ছড়িয়ে দেবার জন্য বিভিন্ন সভা-সমাবেশ হতে থাকে। কিন্তু বিপর্যয়ের ক্ষতি কমানোর রাস্তাটা যে সুস্থায়ী উন্নয়ন, সেটা ‘ত্রাণ কার্যের দৃশ্যমানতায় এবং চালু ‘populism’ এর জন্য বারে বারে আড়াল পরে যায়।‌ প্রান্তিক জনগণকে সুস্থায়ী উন্নয়নের বদলে ত্রাণ, দান, খয়রাতিতেই তুষ্ট থাকতে হয়। এ বিশ্বে দেশগুলো উন্নয়নের নিরিখে দুরকম: উন্নত আর অনুন্নত। অনুন্নত দেশগুলো উন্নত হতে গেলে যে কাঠখড় পোড়াতে হয়, সেটাকে ঢাকার জন্য ‘উন্নয়নশীল’ নাম দিয়ে চোখে ঠুলি পড়ানো হয়। কারণ বৃদ্ধির রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়া মানুষ ও তার দেশ পিছিয়েই থাকে, সুস্থায়ী উন্নয়নের ফাঁকা বুলির ঢাকঢোল পিটানোর মাঝখানে অর্থনীতির প্রান্তিক মানুষ অনুন্নতই থেকে যায়।

==================