You are currently viewing কোথায় যে পাই || বিচিত্রা সেন

কোথায় যে পাই || বিচিত্রা সেন

কোথায় যে পাই
বিচিত্রা সেন

মহা ধুমধাম করে দুর্গাপূজা শেষ হয়ে গেলো। গতকাল ছিল বিজয়া দশমী। এবারও বাবা এলো না। অনির মনটা আজ খুব খারাপ। কতবার করে বন্ধুদেরকে সে বলে রেখেছিল,এবার তার বাবা আসবেই। অথচ এবারও বাবা এলো না। গত পাঁচটি বছর ধরে সে অপেক্ষা করছে তার বাবার জন্য। এর আগে অপেক্ষা করেছিল কিনা তার মনে নেই। তবে যখন সে স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলো,তখন থেকেই প্রতিপূজায় সে বাবার জন্য অপেক্ষা করে। আসলে স্কুলে যাবার আগে বাবার কথা তার তেমন করে কখনো মনেও পড়েনি। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে সে দেখছে,সবার বাবারা কোনো না কোনো কাজে স্কুলে আসেন। বিশেষ করে যখন বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়,তখন তো সব বাবারা মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে হৈ হুল্লোড় করে নিজেদের বাচ্চাদের জিতিয়ে দিতে চান। তখনই ওর বাবার কথা খুব মনে পড়ে। ওর মা তো অফিসে থাকেন,তাই কখনো স্কুলে আসেন না। অবশ্য অন্য বান্ধবীদের মায়েরাও কখনো স্কুলে আসেন না। কিন্তু বাবারা তো আসেন। বাবারা আসলে একবার এসে ওদের ক্লাসে উঁকি মারেন। সাথে সাথে ওর বান্ধবীরা এক ছুটে বাবাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। ওর মনের ভেতর তখন কেমন যেন লাগে। খুব ইচ্ছে করে ওর বাবাও একদিন আসুক। সেও ছুটে গিয়ে বাবাকে এভাবে জড়িয়ে ধরবে। বান্ধবীরা দেখবে ওরও বাবা আছে।

অনি পড়ে আগ্রাবাদের গোসাইলডাঙ্গা এলাকায় সারদেশ্বরী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্কুলের শিক্ষকরা তাকে খুব ভালোবাসেন, এটা সে বেশ বুঝতে পারে। তার বান্ধবীরাও তাকে খুব ভালোবাসে। মা তো তাকে কখনো একটুও বকা দেন না। সবাই তাকে এত এত ভালোবাসে, তবুও যে তার মনে অনেক দুঃখ। তার শুধু বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করে। এখনো পর্যন্ত সে তার বাবাকে দেখেনি, কখনো বাবা বলে ডাকতেও পারেনি। বান্ধবীরা যখন বাবা বাবা বলে ডাকে,তখন তারও ইচ্ছে করে চিৎকার করে বাবা বলে ডাকতে। ইদানিং সে মাকে খুব বিরক্ত করছে। আজকেও অফিস থেকে ফিরলে মাকে গিয়ে সে জড়িয়ে ধরলো।বললো,
-মা,এবারও তো পূজায় বাবা এলো না। পাঁচবছর ধরে তুমি বলে যাচ্ছো, পূজায় আমার বাবা আমার জন্য লাল জামা আর বড় একটা পুতুল নিয়ে আসবে। আমি সবাইকে বলে রাখি,অথচ বাবা আসে না। আমার বাবা কোথায় থাকে মা? একবারও আমাদের কাছে আসে না কেন বাবা?

মা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
-তোমার বাবা অনেক দূরের একটা দেশে থাকে। সেখান থেকে তোমাকে ঠিকই দেখতে পায়। তুমি লেখাপড়া করলে,ভালোমতো চললে একদিন ঠিকই চলে আসবে।
অনি পাল্টা প্রশ্ন করলো,
-তাহলে যে তুমি এতদিন বলেছো পূজায় আসবে।
মা বললেন,
-আমি ভেবেছিলাম পূজায় আসবে। এখন তো দেখছি এলো না। যাও,তুমি মাঠে গিয়ে বন্ধুদের সাথে খেলা করো।
অনি কী বুঝলো কে জানে,তবে আর কথা না বাড়িয়ে এক ছুটে মাঠে চলে গেলো।

মেয়ে চলে গেলে অনির মা মালতী দেবী খাটে শরীরটা এলিয়ে দিলেন। অফিস থেকে আসার পর তাঁর শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগে। এসময় তিনি চুপচাপ শুয়ে থাকেন। তাঁর শাশুড়িই রান্নাঘরটা সামলান। রান্নাঘরে যেতে তাঁর এখন আর ইচ্ছে করে না। খাওয়াদাওয়া ভালো লাগে না। তবু বাঁচার জন্য খেতে হয়। তাঁকে তো বেঁচে থাকতে হবে। নাহলে পাঁচজনের এই সংসারটা চলবে কী করে? অনি ছাড়াও তাঁর আরও দু সন্তান রয়েছে। ছেলেটা কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। বড় মেয়েটা ক্লাস টেনে। ওরা অনেককিছুই বোঝে। বিশেষ করে বাবা ছাড়া সংসারে কীভাবে সব চাওয়াপাওয়া মুখে প্রকাশ না করে চুপিসারে গিলে ফেলতে হয়,তা ইতোমধ্যেই তারা শিখে গেছে। কিন্তু অনিটা এখনো একদম অবুঝ। ক্লাস ফাইভে পড়ে ঠিকই,কিন্তু এখনো অনেককিছু বুঝতে পারে না। তাই তো এখনো সে বাবার জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে। বাবা বাবা বলে মাকে অস্থির করে তোলে। মায়ের পরনের কালো পাড় সাদা শাড়ি এবং সিঁদুরবিহীন সিঁথি তাকে বোঝাতে পারে না তার বাবা বেঁচে নেই। অনিকে এ নির্মম সত্যটা তিনিও জানাতে পারেন না। ভয় হয়,যদি মেয়ে এ আঘাতটা নিতে না পারে। তাই তিনি দিনের পর দিন মেয়েকে একটা মিথ্যা আশ্বাস দিয়েই যাচ্ছেন। অনিও সেটা বিশ্বাস করে বছরের পর বছর কাটায়।

বড় মেয়ে মণি এসে মালতী দেবীর মাথার পাশে দাঁড়ায়। বলে,
-মা,ঠাকুরমা তোমাকে চা খেতে ডাকছে। চলো।
মালতী দেবী উঠে বসেন। তারপর মণির দিকে তাকিয়ে সস্নেহে বলেন,
-মণি,তুই এত চুপচাপ থাকিস কেন? কোনো কারণে মন খারাপ?
মণি দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,
-না মা।
তারপর একটু চুপ থেকে বলল,
-মা একটা কথা বলবো?
মালতী দেবী প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। মণি মাথা নিচু করেই বলল,
-আমার মনে হয়,এবার অনিকে সত্য কথাটা বলে দেওয়া ভালো। একটা মিথ্যা আশায় থেকে থেকে সে বড় হয়ে অনেক কষ্ট পাবে মা।

মালতী দেবীরও কয়দিন ধরে এ কথাটা মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল,এবার সব মিথ্যার অবসান হওয়া উচিত। তিনি রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,
-হুম,আমিও সেটা ভাবছিলাম।
তাঁরা রান্নাঘরে গিয়ে খাবার টেবিলে বসলেন। ডাইনিং টেবিল বলতে যা বোঝায়,এই টেবিলটা ঠিক সেরকম নয়। এটা এমনি একটা টেবিল। তখনকার দিনে প্রায় সব ঘরেই এরকম কিছু চেয়ার টেবিল থাকতো। সেখানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা হতো। এই টেবিলটাও অনিদের ঘরে অনেক আগে থেকেই ছিল। এখন তিনপাশে চারটা চেয়ার দিয়ে এটাকে ডাইনিং টেবিল বানানো হয়েছে। অনির ঠাকুরমা গরম রুটি আর নিরামিষ সবজি বৌমার সামনে সাজিয়ে দিলেন। তাঁর ছেলে মারা যাবার পর থেকে বৌমাই চাকরি করে সংসারটাকে টেনে নিচ্ছে। নাহয় সংসারটা কোথায় ভেসে যেতো। তাই বৌমার প্রতি তাঁর অনেক কৃতজ্ঞতা। রান্নাঘরের দায়িত্বটা তাই তিনি নিজেই সামলান। বৌমাকে কোনো কাজ করতে দেন না। এ নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। সেসব কথা তিনি কানে তোলেন না। সব আত্মীয়স্বজনকে তাঁর চেনা হয়ে গেছে। যুদ্ধের পর একটা বছর তিনি হাড়ে হাড়ে চিনেছেন কে কেমন। এক নিমিষে যখন তাঁর সোনার সংসারটা পুড়ে ছাই হয়ে গেলো,তখন কেউ এগিয়ে আসেনি তাঁদের পাশে। যখন তিনটা সন্তানকে ঘরে রেখে তাঁর বউমা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেলো,তখন কেউ কেউ ধুয়া তুলেছিল,মেয়েমানুষ চাকরি করলে চরিত্র ঠিক থাকে না। তিনি রুখে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন,”সেটা নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। আমি চরিত্রহীন বৌমাকে নিয়েই থাকবো। তোমরা কেউ আমাদের সাথে সম্পর্ক রেখো না।” সম্পর্ক সবাই ঠিকই রেখেছে। কারণ বৌমা যে নিজের যোগ্যতায় সরকারি চাকরি পেয়েছে। আজ আট বছর এই বৌমাই একলা সংসারটাকে টেনে নিচ্ছে। তাই তিনি সবসময় খেয়াল রাখেন বৌমার একটু বাড়তি যত্ন নিতে। কিন্তু টানাটানির সংসারে সেটা আর পারেন কই! তিনি আরেকটা রুটি বৌমার পাতে দিতেই হঠাৎ হাঁউ মাঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢোকে অনি।

এসেই সে মাকে জড়িয়ে ধরে,তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-মা,মা,তপু কী মিথ্যা কথা বলছে দেখো না। ও সবার সামনে বলছে,আমার নাকি বাবা নেই। আমার বাবা নাকি মরে গেছে। আমার বাবা নাকি আর কখনো আসবে না।
অনির মা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাকান মণির দিকে। সে দৃষ্টিতে যেন প্রশ্ন,তিনি এখন কী করবেন। মণির দৃষ্টি কিন্তু মায়ের দিকে নয়, সে ফ্যাকাসে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বোনের দিকে। আর অনির ঠাকুরমা রুটির প্লেটটা শক্ত হাতে ধরে বাজ পড়া ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন বৌমার দিকে। বৌমা তখন অনির মুখটা নিজের পেটের সাথে চেপে ধরে কান্না সামলানোর চেষ্টা করছেন। অনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো,
– মা,তুমি চলো মাঠে। তপুকে সবার সামনে বকবে। ও কেন মিথ্যে বলবে? এই দিদি,তুমিও চলো মাঠে। তপুকে খুব করে বকবে।
মণি ঠোঁটটা কামড়ে ধরে একবার মায়ের দিকে তাকালো। তারপর চোখ দিয়ে মাকে আশ্বস্ত করে আস্তে আস্তে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-বোকা মেয়ে এমন করে কাঁদছিস কেন তুই? বাবা মরে গেছে বললে এমন করে কাঁদতে হয়? সবার বাবা কি সারাজীবন বেঁচে থাকে? আমাদের বাবা বেঁচে নেই ঠিকই,তবে আমাদের বাবা অমর। তিনি কখনো মরবেন না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তিনি এ দেশের জন্য শহিদ হয়েছেন। বইয়ে পড়িসনি? শহিদেরা অমর।
মণির কথা বলায় কী এমন ছিল,অনি কান্না থামিয়ে দিদির দিকে তাকালো। মা অনির মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বললেন,
-শুনলে তো দিদি কী বললো? তুমি বাবা নেই বলে মন খারাপ করবে না। বরং বাবাকে নিয়ে গর্ব করবে। কারণ তোমার বাবা এ দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছিলেন বলে তোমার বাবাকে এ দেশের কিছু রাজাকার পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। সেই বাবার রক্ত তোমার শরীরে। তোমাকেও বড় হয়ে দেশের কাজ করতে হবে। তাতে তোমার বাবা খুব খুশি হবেন।
অনি চোখ মুছে বলল,
-বাবা কীভাবে খুশি হবেন? বাবা তো মরে গেছেন। ওখান থেকে কি বাবা আমাকে দেখতে পান?
মা মাথা নেড়ে বললেন,
-হ্যাঁ,আকাশ থেকে বাবা সারাক্ষণ তোমার দিকে নজর রাখেন। তুমি লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হলে বাবা খুব খুশি হবেন।
অনি জানালা দিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকালো। তারপর বললো,
-তাহলে এতদিন তোমরা আমাকে মিথ্যা কথা বলেছো কেন?
মণি একটু হেসে অনির গালটা চেপে বললো,
-এতদিন তো তুই ছোট ছিলি। এখন তো ক্লাস ফাইভে পড়িস। আর দুমাস পর হাইস্কুলে যাবি। এখন তো তুই সত্যটা বুঝতে পারবি। বল,বাবার জন্য আর কখনো কাঁদবি না। বরং শহিদের কন্যা হিসেবে বাবাকে নিয়ে গর্ব করবি। মনে থাকবে?
অনি মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-মা,তুমি কিন্তু আমাকে ফেলে কোথাও যাবে না। তারপর জানালার কাছে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
-বাবা,তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছো? আমি কেন তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না?
অনির ঠাকুরমা এতক্ষণ ধরে অনবরত চোখ মুছছিলেন। এবার অনির মাথায় হাত রেখে বললেন,
-তোর চারপাশে যেদিকে তাকাবি,সেদিকেই তোর বাবাকে পাবি। কারণ এ দেশটা যে তোর বাবার রক্তের বিনিময়ে পাওয়া। একদিন যখন তুই অনেক বড় হবি,সেদিন বুঝবি এটা কত বড় গৌরবের।
অনি ঠাকুরমার কথাগুলো শোনে। কঠিন কঠিন কথাগুলোর অর্থ সে কিছুটা বুঝতে পারে। সবার কথা শুনে তার বাবাকে নিয়ে একটু একটু গর্ব হচ্ছে। কিন্তু তারপরও বুকের ভেতর এত হু হু করছে কেন? এতদিন তো তবু একটা আশা ছিল,একদিন বাবা আসবে,সে বাবা বলে ডাকবে। আজ থেকে তো সে জেনে গেলো তার বাবা আর কোনোদিনও ফিরবে না। ‘বাবা’ শব্দটি সে আর কোনোদিনও উচ্চারণ করতে পারবে না। গভীর শূন্যতা নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে।

******************************