সুমন শামসুদ্দিন ||একগুচ্ছ কবিতা
পদ্মলোচনা
আঁধার থেকে স্নিগ্ধতা চিরে পেয়েছি তোমার মিহিঘ্রাণ,
অশ্বত্থ পাতার সরু সূচাগ্রে ভাসে শিশিরবিন্দু প্রাণ।
শিহরণ জাগে ভীরু বাসনায় হিমায়িত সুপ্ত মন,
পাখির নীড়ে খুঁজেছি অনুপম অনুরাগ অনুক্ষণ।
হৃদয়ের সীমানায়, অথচ অস্পৃশ্য স্মিতহাস্য আঁখি,
আয়তনয়না তুমি নিশীথিনী সুহাসিনী এক পাখি!
কুয়াশাপ্রাতে নৌকোতে তুমি, জল ছুঁয়ে যাও আলতা পায়ে,
জল-লহরী ভেসে চলে, চুপ করা ভোর হাসে স্বপ্ননায়ে।
একলহমার বৃষ্টি, সোঁদাগন্ধে ভীরুমন আত্মভোলা,
বেলোয়ারি ঝাড় বাজে রিনিঝিনি সুরে, দিয়ে যায় দোলা।
বিমূর্ত আমি তাকিয়ে থাকি শুধু, মুগ্ধ অপলকে একা,
তিমিরালোকে বিভোর হয়ে শুনি, প্রীতি-ময়ূরের কেকা!
নৃত্যরত মন, আজ উড়ে যায়, দূর-অচেনার বাঁকে,
জলদ্যুতিতে হেসে ওঠে নদী, সুরভিত প্রেমসিক্ত ডাকে!
আজ মেঘালয়ে, মেঘছায়া বাস, অঙ্গনা-ভূষণ শাড়ি,
আমার ধরণী তুমি, ধূসরাভনীল পদ্মলোচনা নারী!
ছন্দযুগল রথ
চোখধাঁধানো ঝলমলে রোদ আলোয় ভুবন ভরা,
বাতাসে আজ সুরের দোলা আনন্দিত ধরা;
ঊর্মি নাচে উতল জলে ঢেউয়ের পলে পলে,
জলজগাছ হেলেদুলে নাচছে জলের তলে।
বিজনবেলা তট একেলা গাঙচিলেদের সুরে,
বেলাভূমি রৌদ্রচুমি দৃষ্টি হারায় দূরে!
সুনীল জলের উদার বুকে বিশাল আকাশ ভাসে,
সেই আকাশের অসীম প্রান্তে মেঘরানি হাসে।
আজ সারাদিন কাব্যবিহীন ভাববো না আর কিছু,
অংশুমালীর দীপন ছোটে মনতটিনীর পিছু;
পাহাড়বুকে বেড়ে ওঠা লতাফুলের ঘ্রাণে,
পরিযায়ী পাখির সুরে মাতন লাগে প্রাণে।
পদ্মবিলে হংসমিথুন জলকেলিতে রত,
নদীর বুকে রুপালদ্যুতির চমক শতশত;
মহুয়াতে মৌয়ের ঘ্রাণে মধুলিহ গায়,
প্রজাপতির চঞ্চলতা ফুলেলবনে ধায়।
চিত্তহরিৎ মাতালবনে আলোছায়ার খেলা,
পাতার ফাঁকে রবির উঁকি চলে সারাবেলা;
মনমালঞ্চ উচ্ছ্বাসে আজ ব্যাকুলবনের পথে,
আকাশ-বাতাস, পাহাড়-নদী ছন্দযুগল রথে!
টেলিপ্যাথি
যখনই সময়ের হাত ধরে ব্যস্ততা হাঁটে;
তোমাকে ভীষণ মনে পড়ে!
চায়ের সাথে স্নায়ুর সম্পর্কটা একটু বাড়িয়ে দিই,
তখনই তুমি এসে দাঁড়াও-
ঠিক অন্তরদৃষ্টির অন্তরালে!
ব্যাপৃত বাতাসের পেছনে হেঁটে যাই,
ত্রস্ত-বীজন কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ে যায়;
আচ্ছাদিত করে রেখে যায় আমাকে-
ভীরু সম্মোহন আবর্তে।
আর তখনই তোমাকে মনে পড়ে যায়!
স্মৃতিছায়ার ওপর পিছু হাঁটি,
ক্রমাগত হোঁচট খেতে থাকি-
তোমার প্রতিচ্ছায়ার ওপর।
আর, কী আশ্চর্য!
ঠিক তখনই তুমি আমার
স্নায়ুতন্ত্রের পুরোটাই দখল করে ফেলো!
আসলে, তোমার টেলিপ্যাথির
কম্পাঙ্কের দূরত্বটা অত্যন্ত গভীর!
এড়িয়ে যাওয়া সত্যি অসাধ্য!
কবির দুঃখ
হৃদয়পুরে করুণ সুরে বেদনাফুল ফোটে,
মনের গহীন অন্তরীক্ষে ক্লান্ত শব্দ লোটে;
বৃক্ষ জানে পাতার মর্ম শুকনো যখন ডালে,
ঊর্মিভাঙা নৌকো ওড়ে ব্যর্থ-নদীর পালে।
অনুভূতির মৃত্যু দেখি গহীন হৃদয়-তলে,
মনের গতি থেমে যে যায় মৃতনদীর জলে।
মালয় সাগর ঘুরে এসে পাইনি তো তার দেখা!
বিম্বিসার ও অশোক রাজ্যে বেড়িয়েছি একা!
সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কই হাসেনি তো দুখু!
নীলবেদনায় কেটেছে তার আধেক জীবনটুকু!
সুনীল বাবুর পাহাড় কেনায় হলো জারি ডিক্রি,
ফেরীঅলার কষ্টগুলো আর হলো না বিক্রি!
কবির দুঃখ লোরকা যখন মৃত্যুকূপের বর,
দুখসাগরে আমি ভাসি ধরে কুটো-খড়।
অনাবিষ্ট লেকবিহার
বাতাসে নতুন শীতের গন্ধ,
খুবভোরে অনেকদিনের পর
স্নিগ্ধভোরে বইছে বাতাস মৃদুমন্দ;
আহা মনোরম ভোর! কি শুচিশুদ্ধ!
ফুসফুস যায় ভরে ক্ষালিত অম্লজানে
হেঁটে যাই একা, ভোর যে আমাকে টানে।।
ভোরের পাখি শিশ দিয়ে যায়
দিনশুরুতে সূর্য ওঠার গান
নির্মলা বাতাসে মন ভরে যায়।
বাসা থেকে দু’শ মিটার দূর
সেখান থেকে ডানদিকে নেই মোড়;
এই রাস্তাটি আরো নির্জন
একটা বাড়ির সামনে বিশাল লন
ফুল ফুটেছে হরেক রকম হলুদ গাঁদা
অন্যরকম দৃষ্টিকাড়া, চোখে লাগে ধাঁধাঁ!
গাঁদা আমার একটি প্রিয় ফুল!
সকালবেলা সূর্যমুখীর নাই যে কোনো তুল।
কিন্তু এখন সূর্যমুখী পেলাম না তো খুঁজে,
সকাল থেকে সন্ধ্যাজীবন বাঁধা ষড়ভুজে।
শহরতলীর পরে-
আরো একটু যাই, হাঁটছি বেভুল তালে,
পড়ছে এখন মনে-
যখন ছিলাম দুরন্তমন, সেই যে কিশোর কালে!
হঠাৎ শুনি-
একটি ঘুঘু ডাকছে কোথাও থেকে,
একটু এগোই-
হঠাৎ দেখি রোড গিয়েছে বেঁকে।
সামনে দেখি অজান-গাছের সারি,
দূরে কাছে বেশ মনোরম ভিন্ন আবাস-বাড়ি।
মন ছুটে যায় একটু পরেই নিকষিত লেকে,
লেকের ধারে ঘাসচাদরে ঝুলছে গাছের ডাল,
সবুজপটে মালার্ড জাতের একটি হাঁসের পাল,
মুক্তমনে হেলেদুলে চলছে ডেকে ডেকে।
কনক্রীটের এক বেঞ্চে গিয়ে বসি লেকের ধারে,
কাব্যনিধি মনে ভাবি অনাবিষ্ট লেকবিহারে।
************************************