You are currently viewing গোলাম শফিক || জলকাদা ভালোবেসে…

গোলাম শফিক || জলকাদা ভালোবেসে…

গোলাম শফিক || জলকাদা ভালোবেসে...

 

মেঘরাশির জাতক আমরা
মেঘের কোলে থাকি
বায়ু-তাপ সঙ্গী করে
মেঘেই মাথা রাখি।

সেই মেঘের দেশে আবার এলাম জাতীয় শোকদিবসের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে। শোকের মিছিলে সেই কী উষ্ণতা ছিল! ঠেলঠেলিতে হাতঘড়ির তলা খসে পড়ে নিখোঁজ হয়, চশমার এক দিক বেঁকে যায় অদ্ভুতভাবে। অতঃপর আসতে সক্ষম হলাম জন্মগ্রাম সরিষাপুর। সূচনায় বৃষ্টির কোনো আলামত ছিল না। কিন্তু সন্ধ্যায় গুমরোমুখো প্রকৃতি তাণ্ডবনৃত্য শুরু করে দেয়। শয্যা গ্রহণ করে আকাশ থেকে বৃষ্টির পতন দেখছি। চোখের সামনে নারকেল বৃক্ষের পাতাগুলো কাঁপছে তিরতির। সমগ্র আকাশ জলপ্রসবিনী, কিংবা মাতৃরূপী স্তনবৃন্ত থেকে ঝরছে জলের অমীয় ধারা, দুগ্ধ স্রোতস্বিনী…। আমার গায়ে জলের ফোঁটা পড়লেও জানালাটা ভেজাই না। বৃষ্টির ছাঁটই এক স্বর্গীয় কোমলতা এনে দেয় চোখের পাতায়। অতঃপর ঘুমের অলীকরাজ্যে আরোহণ। কতোক্ষণ নিদ্রায় ছিলাম বুঝতে না পারলেও ঠাণ্ডায় যে কাঁপছি সেটা বোঝা গেল। তা’হলে কি জ্বর আসবে, এডিস কি এরই মধ্যে হুল ফুটিয়েছে? অবশেষে কোনো অমঙ্গল হলো না। ঐদিকে ভ্রাতুষ্পুত্র রাকিবের বিয়েটাও সম্পন্ন হল রাতেই।
তবে বিবাহ পুরাণের উল্টোরথে যাত্রা আমাদের। বিয়ের পর বসেছি গায়েহলুদ দিতে, মধ্যযামে। কনের পিতার অনুরোধে রাতেই একদল জোয়ানকে পাঠাই শাদির কাজ সম্পন্ন করতে। কিন্তু কাদার আস্তরণ অতিক্রম করে কীভাবে যে ওরা পৌঁছালো বাজিতপুর সেটাই ভাবছি। আমাদের গ্রামে বৃষ্টি হলেই কাদার পাহাড় জমে। তাই সরিষাপুরের নামটি কুয়ালালামপুরের আদলে হওয়া উচিত ছিল। কুয়ালালামপুর অর্থ ‘কাদা-নদী ও বন্দর-নদীর সংযোগস্থল’। সে কারণে আমাদের গ্রামের নামও হওয়া উচিত ছিল কাদারপুর, প্যাকের নগর অথবা কর্দমশাহী কিংবা লুদ পরগণা।
আসলে বলার আছে অনেক কিছুই, এ গ্রাম আর আগস্ট মাস নিয়ে। নিজের বিয়েটা হয়েছিল ০৫ আগস্ট, তখনও বৃষ্টির ঘনঘটা। বৃষ্টি আর জলবৃদ্ধির পথ ধরে অবশেষে ’৮৮র বন্যাটাই হয়ে গেল। বিয়ের পরপরই তাই নবপরিণীতার সাথে সাময়িক দূরত্ব তৈরি হয়। একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙায় কষ্ট করে চলে যাই কিশোরগঞ্জ, তবে ভৈরববাজার দিয়ে নয়, ময়মনসিংহ হয়ে। কারণ ভৈরব হরষে জলের ধাক্কা পুরো ভৈরবকেই তখন গ্রাস করেছিল। সমস্ত রাস্তা-ঘাট বন্ধ। মনে আছে ময়মনসিংহ হয়ে বধূর কাছে যেতে মোট ১৪বার যান বদল করতে হয়েছিল। ট্রেন, বাস, রিক্সা, টেম্পো, নৌকা, ভটভটি সবই ব্যবহৃত হয় সে যাত্রায়। আর শম্ভুগঞ্জে এক খেয়া নৌকায় বসে নিচে তাকিয়ে দেখতে পাই মানুষের ডুবে যাওয়া ঘরবাড়ি, ঘরের চালের অন্তত পাঁচ হাত উপর দিয়ে ডিঙ্গিটা ছলাৎ ছলাৎ চলে যাচ্ছে। এ দৃশ্য এখনও চোখ থেকে অন্তর্হিত হয়নি।
অতঃপর দশ বছরের মাথায় ভাইঝি ঝুমুরের বিয়ে, এক বছর আগেই মননটা দুনিয়ায় এলো, ১৫ আগস্ট। তবে ভাইঝির বিয়েতে ১০ আগস্ট কাদা ছাড়িয়ে তৈরি হল ‘লুদ’। আমাদের স্থানীয় ভাষায় লুদ মানে গভীর কাদা। জুতা পায়ে দেয়া সম্ভব নয় বলে খালিপায়ে হাঁটতে হয়েছিল, কখনো নাগরা চাপিয়ে। গামবুট জোগার করা সম্ভব হয়নি। আর সেই কী বৃষ্টি! প্রকৃতি যেন ঘাড় ধরে দেখাচ্ছে, বাপের জনমে বৃষ্টি দেখিসনি, এবার দ্যাখ। আবার বন্যার ঘনঘটা, ‘৯৮এর বন্যায় ফের নৌকা ভাসাই মাঝ দরিয়ায় …।
গায়েহলুদের আসরে প্রত্যেকেই রাকিবের কপালে হলুদ দিয়ে কিছু না কিছু খাওয়ায়। বললাম, এতো খেলে পেট ভরে উপচে পড়বে, কেবল খাওয়ার অভিনয়টা করে যা বাপ। ‘অভিনয়’ শব্দটা ওর কানে ঢুকিয়ে দিলাম, কারণ বিবাহিত জীবনে কতো যে অভিনয় করতে হয়। তবে খাওয়ার অভিনয় করাও অনেক বিব্রতকর। বারবার মুখ বাঁকাতে হয়, কুঁচকাতে হয়। তাতে মুখের ব্যায়াম হলেও একপ্রকার ব্যথা হয়ে যায়। তবে আমাদের চার ভায়ের তিন ভাইই অভিনেতা ছিলাম, জ্যেষ্ঠভ্রাতা মহিউদ্দিন ছিলেন না, যিনি এখন কবরে শুয়ে আছেন। তাঁর ছোটজন নূরুদ্দিন মন্টুর অভিনয় দেখে নবাব সিরাজুদ্দৌলা খ্যাত আনোয়ার হোসেনও বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। অদ্যকার বরের পিতা মঈনুদ্দিনও ভালো অভিনেতা ছিল। নিজে মোটামুটি রপ্ত করতে পেরেছিলাম, তবে বাস্তবজীবনে সেটা গড়পরতায় কাজে লাগাতে পেরেছি, তাই দাম্পত্যজীবনও মধুর।
আসলে প্রকৃতির বন্দনা গাইবার জন্যই আজ কলম ধরেছি। কাদা তো প্রকৃতিরই অংশ। কাদা দেখে কাঁদবার কিছু নেই, কাদাকে ভলোবাসতে হয়। আমাদের বাড়ির এক ঘর থেকে আর এক ঘরে যেতে প্রায়ই স্যান্ডেল-চটি হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, কে কারটা নিয়ে যায় ঠিক নেই। একবার রাকিবদের ঘরের বারান্দার নিচে কোনো খড়ম-চটিই আর পেলাম না। তাই ভাইঝি অনামিকাকে জুতা পারাপারের জন্য অনুরোধ করা হল, সে কয়েকবার এঘর থেকে ওঘরে আমাকে জুতা এনে দিয়েছে। আর মৃত্তিকা, নিজের মেয়েটা তখনও অঘোরে ঘুমাচ্ছে। জুতা পারাপারে কখনো এসে যায় নারী-পাদুকা। তাই মাপে ছোট বলে পা পিছলানোর সম্ভাবনা থাকে না।
এই মুহূর্তে কাদা নিয়ে শিবনাথ স্কুলের এক স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। বিদ্যালয় কর্মচারী সুভাষ দা দু’একবার আমাদের ক্লাস নেন। প্রথমদিন এসেই প্রশ্ন করেনÑ বলো তো ‘ইহা কাদার জন্য ভাল’ ইংরেজি কী? বললাম It is good for crying আরে বোকা ‘কাঁদা’ নয়, ‘কাদা’। তখন তো আর উত্তর দিতে পারি না, কারণ ‘কর্দম’-এর ইংরেজি আমাদের কারোরই জানা নেই। তাই তিনি বলে দিয়েছিলেন, তবে কাদার ইংরেজি ‘mud’ বলেছিলেন কিনা মনে নেই। পরে মনুর কাছে শুনলাম তিনি নিচের ক্লাসেও একই প্রশ্ন করেছিলেন, হয়তো ছাত্রদের জিজ্ঞেস করার মতো একটা প্রশ্নই ভাল ভাবে রপ্ত করতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু ‘ইহা’ বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছিলেন সেটা জানতে পারিনি, হয়তো জুতা বা বুটই হবে। তবে ইংরেজিটা যদি ‘কাঁদার জন্য ভাল’ বলতে ইঙ্গিত করা হতো, তাহলে উত্তরে এক নম্বরে বলতে হতো ‘বিয়ে’, দুই নম্বরে ‘মাইর’, তিন নম্বরে ‘মনের কষ্ট’ ইত্যাদি।
আমি আবার প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। সকালে রোদের হাসি নিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। কিন্তু হায় প্রকৃতিও অভিনয় শুরু করে দিল। এক পশলা ঝরিয়ে দিয়ে উঠোনের ভিজে শ্যাওলায় দেয়া হল শান। এখনও স্লিপ কাটিনি, তবে ভবিষ্যৎ নির্ণয় ন জানি। অনেক সময় মনের ইচ্ছেটা অবলীলায় আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। একবার আছার খেলে শরীরে যে ঝাঁকুনি লাগে তাতে সারাদিনের ব্যায়াম হয়ে যায়।
স্বভাব ও অভ্যাসবশত আমি বাড়ির পেছনে বর্ষার পানি দেখবার জন্য গিয়ে দাঁড়াই। প্রকৃতি আবারও নিজকে নতুন ভাবে মেলে ধরেছে। দেখলাম বন্যার জলে টান পড়েছে। ধইঞ্চা গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ। এখনও বাতাস শুরু হয়নি, হলে পরে দেখতে পাবো এদের আচানক নৃত্য। দেখলাম একটা কলার কাঁদা (কান্দা) নিচে ঝুলে আছে, গোড়ার দিকে ছাড়া মাঝখানে কোনো কলা নেই, অনেক নিচে থোরটি নিম্নমুখী হয়ে আছে অদ্ভুতভাবে। এই রকম অনেক দৃশ্যকল্প তৈরি করা আছে প্রকৃতির পটভূমিতে। দূরের দুই ধইঞ্চাপূর্ণ জমির ফাঁক গলিয়ে একটি ধর্মজাল শূন্যতার প্রতীক হয়ে ঝুলে আছে। আবার আমার পাগল হওয়ার পালা। দেখতে পেলাম একটা লালচোখা আয়রাপক্ষি, কাছে যেতেই উড়াল দিল। ফিরবার পথে শুনতে পাই ‘হুদহুদ’ ডাক, হয়তো এটিই আমাদের হুদহুদ পাখি, যা ছিল রানি বিলকিস অভিমুখে সোলেমান পয়গম্বরের বার্তবাহক। তাই আজ সবকিছুই অর্থপূর্ণ মনে হচ্ছে।
এতো অল্প সময়ের জন্য এসেছি যে, কিছু লিখবো আদৌ ভাবিনি। তাই কাগজও আনা হয়নি, অবশেষে ভ্রাতুষ্পুত্রী অনামিকাই জোগার করে দিল একটা, সে-ই আমার ঠাকুরবাড়ির ইন্দিরা…। অনুজের সদ্যনির্মিত প্রাসাদোপম ঘরে বসে কখনো হাঁটুর উপর রেখে, কখনো বা খাটের উপর স্লিপপ্যাডটা স্থাপন করে লিখে চলেছি, কষ্ট স্বীকার করে করে। বিয়ের আয়োজনে এ ঘর থেকে চেয়ার-টেবিল অন্তর্হিত হয়েছে। আবার মেঘের বিকট শব্দ শুনতে পাই, গুরুম গুরুম…। মনে পড়ছে কবরে শায়িত অগ্রজকে যিনি অসময়ের বৃষ্টিকে ‘… বাচ্চা’ বলে গাল দিতেন। তাঁর পুত্র শরফুদ্দিন মিঠুর বিয়ে আগস্ট-শ্রাবণে না হলেও যে বর্ষণ হয়েছিল তাতে অনেকেই বিবাহ অনুষ্ঠানে আসতে সক্ষম হয়নি, যারা এসেছিল প্রায় সবাই ১০০% ভাগ ভিজাবস্ত্রে, যাদের কেউ কেউ এদিন ফেরৎ যেতে পারেনি। যাবে কী করে, উঠানেই তো হাঁটু পানি। আর হ্যাঁ, আর এক ভাইপো আশরাফউদ্দিন সাথীর বিয়েটা সেপ্টেম্বরে হয়েছিল নির্ধারিত তারিখেই, কিন্তু বৌভাত আর আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছিল না। প্রবল বর্ষণের জন্য ১ সপ্তাহ পিছাতে হয়েছিল। তবে সে বছরও (২০১০) স্থানীয় বন্যার কারণে নৌকায় ওর শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়েছিল। সেই মায়াবী নৌবিহারের কথা এখনও ভুলতে পারি না। অকাল বর্ষণ, বন্যা, নৌকা, ডলক আমাদের চিরসঙ্গী। এমনই মেঘরাশির জাতক আমরা।
এ কষ্টার্জিত লেখ্য-সম্পদ অর্জনের ফাঁকে চোখ গেল মাওলানা আবুল কালাম আজাদের India Wins Freedom (সুভাষ মুখোপাধ্যায় অনূদিত ‘ভারত স্বাধীন হল’) বইয়ের মলাটের উপর যেটি গতরাত দুটো পর্যন্ত পাঠ করেছি। ভাবছি জেলখানায়ও নিশ্চয় আজাদ-গান্ধী-নেহরু-জিন্নাহ একই কায়দায় লিখতেন। আসলে আবহাওয়ার কারণে মনটাই ত্যক্ত-বিরক্ত হওয়ায় আর বেশিক্ষণ চালাতে পারবো না ।
সকালে দীর্ঘক্ষণ রাকিবকে নিরবে ঘুমাতে দেখলাম। হয়তো ক্লান্ত। ৪দিন আগে উদযাপিত ঈদ-উল-আজহার পূর্বেও প্রাণীগুলোকে এ রকমই দেখেছিলাম। সমাজ-সংসার-রেওয়াজ-বংশক্রম ধারা রক্ষার নামে এভাবেই রাকিবকেও কোরবানী দেয়া হচ্ছে। এ কোরবানী প্রতীকি। তবে বিবাহ যে এক ধরনের কোরবানী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিবাহ যদি কখনো ওর মনোকষ্টের কারণ হয়, তবে অন্য দিক দিয়ে সে লাভবানই হবে। তার কবিসত্তার আরো স্ফুরণ ঘটবে। ফেসবুক কবি থেকে সে প্রকৃত কবির তালিকায় নাম লেখাতে সক্ষম হবে। মিঠামইনের প্যাক-কাদা আর বিশাল জলরাশি এ প্রক্রিয়াকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।

===================