একগুচ্ছ কবিতা || রশীদ হারুণ
দীর্ঘশ্বাসগুলো
ওপারে রূপসা, থাকো, বিরক্তহীন মাঠের মাঝখানে।
রাস্তা এক দীর্ঘশ্বাস— পা ফেলছি আততায়ীর ছুরির ফলায়।
সৌরগাছের তলায়, মানুষ, রেললাইন রুয়ে যাচ্ছে।
ঘাম ঝরছে— বিশ্রীরকম একটা জংশন উড়ে এলো,
গ্যাস আর সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, পাশে, ম্রিয়মান গাছ ও স্তব্ধতা।
গরীব কবিতাগুলো আশ্চর্য কাঠবিড়ালি?
জানলা খুলতে-খুলতে পার হয় মেয়েগাছের বাগান।
ঝুঁকে পড়ে আমি দেখছি পাতাদের সর্দিজ্বর,
ধুলোর বড়শি খেয়ে নাজুক শ্লেষ্মার ল্যাম্প ঝুলে আছে বিষন্ন হাওয়ায়।
…তার নীচে, কয়েকটি ক্লান্ত বেলচা, মাটিমাখা, ঘুমিয়ে রয়েছে।
সমুদ্র এখন জলখই ভাজছে আর দুপুরের নির্দয়তা
পরামর্শ দিচ্ছে, বসো, গাছের বাহুর নীচে—
বসলেই ছোট হয়ে যাবে, অনুভব হবে— ছদ্মবেশ,
পাতাঝরা, নগ্নতা ও আত্মবিলাপের আর্শিধ্বনি।
বাদাম বাগান থেকে, কাঠবিড়ালি, তুমি কি দেখেছো আমায়?
হৃদয়
কখনও কখনও পর্দা সরিয়ে ওপাশে যেতে হয়।
যেতে হয় দূরজলে, দিগন্ত দুয়ার খুলে।
দৃশ্যহীন সাঁকো দৃষ্টি উজিয়ে তোমাকে দেখছে—
রাখো প্রতিবিম্বের পা, নিঃস্বতা ও ধূসর গোড়ালি।
অবচেতন, মূলতঃ বিস্ফোরণের বিষাদ;
যেন ঠাণ্ডারাত যাচ্ছে শিরার সড়ক ধরে,
নাই-আলোর ভেতর তুমি যেন একটি নাই-মানুষ।
হাওয়ারা সনেট লেখে তোমার ভেতর। আর,
নিস্তব্ধতারা ফিসফিস করছে। দ্যাখো,
অনুচ্চারিত গানের মতো ফুল ঝরছে গহীনে-গহীনে।
ধানকন্যা
বাড়িমুখো সরুপথ, নিথর সুন্দর, এ-রকম ভাবি।
স্বপ্ন হয়; রোদ চেটে যাচ্ছে নুয়ে পড়া কুমড়োর ডগা,
গাভিটির ভোঁতা শিঙ, কাকের শব্দাস্ত্র, ঘামনুন, ঘাস,
তোমার তামাটে দৃষ্টি। চুলের জমিনে আঙুল ঢুকিয়ে
ফড়িঙ বানাই। ভাবি, চোখের অসুখ গড়ালে এখানে
বেড়ে যাবে জ্বর আরও? ভাষাহীনতার নীল শার্সি খোলা—
প্রতিটি ঋতুতে শীত ও শরৎ, বিস্কুট বিকেল থাকে।
প্রতিটি সবুজ আলাদা আলাদা পাতার সবুজ— গান,
আন্তঃগান, দৃষ্টিঘুঘু— হৃদকম্পনের বিভাজিত ব্যথা!
একা এক সঙ্গহীন শূন্য; বসে আছে সংখ্যার আশায়!
অনেক আলাপ জমে আছে নিঃশব্দের আঙুলে আঙুলে।
পাতানৌকোর পিঁপড়ে আমি, যাই, স্রােতে, ওপারে, বিকেলে,
হিজলের নীচে অন্ধকার কেঁপে উঠছে জলে।ধানকন্যা,
তোমার শরীরে গরীব আঙুল ছোট-ছোট গল্প লিখছে।
লবণ
পানি বাড়ছে। সমুদ্রের ঘড়িটিকে আমি তুলে রাখছি তোমার উঠোনে। নোনাজল। নীলচাবির পুতুল পড়ে আছে গলাঅব্দি। জল আর রোদের দৌড়ের বৃত্তে আমি ঘুরি— তীব্র সাইরেন— ধূমুল খেয়ার মদ। বোতল উল্টিয়ে ঢেলে দাও আমার হৃদয়— শ্যাওলার ছোট্ট শুকনো মোচার বাগান গলে যাক নির্জনে-নির্জনে। নোনা পালকের গন্ধ, গোধূলির ঘাম আর বজ্রমোরগের কেশর বুনতে-বুনতে চলে যাচ্ছি আতশি কাঁচের মর্মে। সখা, তুমি শুধু নিঃশব্দ রচনা করো— শীতল, গুমোট! গরাদখানাই আমার অস্তিত্ব— দূরে, প্ররোচিত-পথ চোখের বগলে রেখে ঘুমিয়েছি; কখন কবিতা আসে? কখন, বৃষ্টির রুপালি আঙুল ধরে চলে যাবো নমিত উপত্যকায়— শ্বাস আর শালগমে। রঙ পাল্টে-পাল্টে পার হচ্ছি জলের স্টেশন। ছোট্ট লঞ্চ, নীলকাঞ্চনের ঘাটে রেখে যাও দু’খান পা। রক্তজলে মিশে আছে আলোচালের জাউ— তোমার গ্রাসময় লাবণ্য।
হে লবণ, আমার ভেতর কেনো ডিঙিনৌকোর নিঃশ্বাস ভাসে!
নীল জামরুলবাক্য
আমার ফাঁকফোকরে কেউ হয়ত ঢুকছে, আমিও কোথাও ঢুকে যাচ্ছি— মেঘেদের এই পিটবুল-সারমেয় তাড়াচ্ছে আমার চোখ; …পলায়নরত সেতুগীত যখন নির্ভার, সাদা-ধ্বনি ভেসে আসছে— গাইছে অনর্জনের মর্শিয়া— স্বগতোক্তি। শীতপোড়া রাত্রে, কোথাও দূরের বাদাড়ে হাঁসের মাংস রান্না হচ্ছে। হাঁস-চোর-বন্ধু-সব পশম লুকাতে-লুকাতে হাসছে। দেখছে পাড়ার মেয়েদের নিম-আলো-ঘর। আমি রাত্রিডানা নিয়ে উড়ে যাবো মৌনতা দর্শনে। প্রতিটি চাঁদভাষা এক-একটি জ্যোতিষ বাহিনী। ফালি-ফালি আলোখণ্ডে দুঃখে, ঢুকে যাবো নিস্তব্ধ মর্মরে— ‘হাঁসের মাংসের মতো’।
জানালা একটি কবিতা অথবা ঠিক উল্টো— কবিতাই জানালা। একটুকরো উঠোন অথবা জোৎস্নাপ্রবাহ বারান্দা হলে ভালো হতো। হাঁসচাঁদ কেটে-কেটে কবিতার চুলোয় ঢুকিয়ে দেয়া যেতো। এখানে দেখছি পাতার চিরল তাওয়ায় চাঁদের কুসুম ছিটকে পড়ছে। আমার তাওয়া-চোখে রান্না হচ্ছে কাহার কুসুম! খোঁজবিবাদের কবিতার নোটখাতা খুলে যাচ্ছে আর ছুঁড়ে দিচ্ছি নীল জামরুলবাক্য… কোথায়! জানি না
**************************