হারানো জীবন কুড়ানো
আমি রাস্তায় একটি নীল প্রজাপতি ধরতে ধাওয়া করছিলাম। এরমধ্যেই একটি গাড়ি এসে আমাকে বাড়ি দেয়, অল্পের জন্য গুরুতর কিছু হয়নি। কিন্তু আমার প্রচণ্ড মেজাজ খিচিয়ে ওঠে, ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ খারাপ করে চিৎকার করে উঠি। কিন্তু গাড়িওয়ালা একটানে দাবড়ে চলে যায়- আমার দিকে একবার ফিরেও তাকায়নি। আমি আবার প্রজাপতি খুঁজতে শুরু করি। প্রজাপতির হদিস নাই। কিন্তু পাড়ায় এমন কিছু মেয়ে থাকে না- যাদের দেখলেই মনে হয়, আল্লাহ আজ কার মুখ দেখে ঘুম ভাঙছিল, সেরকম মহাবিরক্তিকর একটি মেয়ে তার খেলনা কুকুর নিয়ে রাস্তায় নামে। আমি তাকেও জিজ্ঞেস করি, এদিকে একটি নীল প্রজাপতি দেখেছো? ও বললো, ওই যে আমার দাদুবাড়ির লাগোয়া যে বার্চ গাছটি আছে, প্রজাপতিটিকে ওখানে উড়তে দেখেছি। আমি একপলকে বলি, অনেক ধন্যবাদ তোমায়। বলেই প্রায় দৌড়ে বার্চ গাছের দিকে যাই। দেখি, সেই প্রজাপতি এক ফুল থেকে আরেক ফুলে রঙ্গ ভরে লীলা করে- কেবল ওড়াউড়ি নয় যেন, বুঝি শিল্পীর তুলিতে আবীর ছড়িয়ে দেয়। আমি নিজেরে হারিয়ে খুঁজি, বেমালুম ভুলে যাই এ-কে আমার ধরবার কথা ছিল; কোন গহন মন থেকে মনে হতে থাকে- আমি বুঝি এ-কে অন্য এক জনমে চিনতাম; এমনও হতে পারে- এ কেবল স্বপ্নের ভিতরে আমার লগ্নে এসেছিল- যেভাবেই আসুক, একান্তে বলতে চাই- এই প্রজাপতি আমার ইন্দ্রিয়ের অধিকে এসেছিল। আমি আর জনমে কর্ডোবা নগরীর পথে পথে এক অন্ধ ভিখারি ছিলাম- আমার আঁধির ভিতরে ওকে দেখে থাকবো বুঝি- কেমন করে আবার তুমি এই বাগানে আসো!
Source poem : The search for lost lives.
রাত্রি অঙ্কনকারী
একজন রিপোর্টে জানালো, এক লোক নিঝুম রাত্তিরে পুকুর পাড়ে রাত্রি আঁকছে। একটি পুলিশের গাড়ি সরেজমিনে তদন্ত করতে সেদিকে ছোটে। দু’জন অফিসার বিশাল ফ্ল্যাশলাইট মেরে তল্লাশি করে, কিন্তু তেমন কিছুই আমলে আসে না। দুই অফিসারের মধ্যে ছোট জনার নাম হেচার। হেচার জনসনকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, তোমার কী ধারণা- অন্ধকারে সে কী আঁকছিল! কিছুটা অসহিষ্ণুভাবে জনসন বলে, এই ধরো ব্যাঙ, আঁধারে বিছানো শাপলার পাতা, কালচে রাত; দিনে যেমন তারা দিব্যি আছে, রাতেও তাই, তফাৎ কেবল নীরবতায়, অমায়- এই আর কী! এবার জনসন শ্বাস নেয়, ভিতরে ভিতরে রাগে পটপট করে। বেচারা হেচার এই বলে নিজেকে একটু জুড়ে দেয়, যদি একটু দেখতে পারতাম, চাই কী- একটা কিছু কিনেও ফেলতাম! মন বলছে- যা বলছো, যতোটুকু ধারণা করা যাচ্ছে- হয়তো বা তার থেকে বেশি কিছু রয়েছে ওখানে, এমন গিজগিজে অন্ধকারে আরো কিছু লুকিয়ে আছে, আমরা ঠিক দেখতে পাচ্ছি না।
Source poem : The painter of the night.
যথা আজ্ঞা
আমি একটি ফোন প্রাপ্ত হই, এই কল হোয়াইট হাউস থেকে আসে। প্রেসিডেন্ট নিজে আমাকে ফোন করেন, তিনি আমার কাছ থেকে সামান্য আনুকূল্য চান। রাজ্যের রাষ্ট্রপতি বলে কথা- আমি তাঁকে সম্ভ্রম করি। বলি, আলবৎ, আলাম্পান প্রেসিডেন্ট, আপনি বলেই দেখুন, আমি অবশ্যই আপনার কথা রাখবো। তিনি বলেন, তুমি কেবল স্বাভাবিক আচরণ করবে, আর কিচ্ছু নয়, তুমি কোনকিছুতেই গা করবে না। ভাববে, কোথাও কিছু হয়নি, সব স্বাভাবিকতার একশেষ, পারবে না লিয়ন? কী বলেন, ব্যাপার না। আমি স্বাভাবিক থাকবো, একদম স্বাভাবিক। যতো বেকায়দায়ই থাকি না কেন, কেউ আমার নির্বিঘ্নতায় একটা আঁচড়ও কাটতে পারবে না। তিনি বড়ই খোশমেজাজে ফোন রাখেন। এই ঘটনা কাউকে না কাউকে বলার জন্য ভিতরে ভিতরে আমি একদম মরিয়া হয়ে উঠি, কাউকে বলার জন্য কথাটা পেটের মধ্যে বারবার ঘোরপাক খেতে থাকে। যে-কোন অবস্থায় স্বাভাবিক থাকার ব্যাপারটা আমাকে তলেতলে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। কে শোনে কার কথা- নানাকিছু বিরামহীন ঘটে যাচ্ছিল, কিন্তু আমি ধরে নিচ্ছিলাম- কিছু হচ্ছে না, সব যথা বিহিত স্বাভাবিক। গতকাল রাষ্ট্রপতিকে টেলিভিশনে দেখি- তিনি এক লবেজান চাষার সঙ্গে করমর্দন করছিলেন। কী হবে- লোকটা যদি সত্যিকার চাষীই না হয়ে থাকে? আমার দুধ কেনা দরকার ছিল, কিন্তু বাইরে যাবো ভাবতেই অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। বোঝার চেষ্টা করি- আদতে আমাকে কেমন দেখা যাচ্ছে? আমার নিজের মনে হচ্ছে- ঠিকই তো আছি, আবার আরেক মন বলছে- আসলে হয়তো স্বাভাবিক নই, কেবল স্বাভাবিক দেখানোর কসরত করে যাচ্ছি। তাই যদি হয়, তাহলে তো ধরা খাবো। যাই হোক, দরজা খুলি, চারদিক হেব্জ করে নিই। আমার গাড়ির সামনে একটা গাড়ি পার্ক করা- আগে কোনদিন এমন তো দেখিনি, গাড়িটা এমন ভঙ্গিমায় রাখা যে মনে হতে পারে- এটা কোন ব্যাপারই না- এক্কেবারে স্বাভাবিক; কিন্তু আমাকে আহাম্মক বানানো কী এতো সোজা! ধরো, তোমার দোকান থেকে এক গ্যালন দুধ কেনা দরকার- মুলামুলি না করে দুধ কিনে নিয়ে আসো, ব্যস লেটা চুকে গেল। তা না করলেই মনে হবে কোথাও ঘাপলা আছে! আমি আমার গাড়িতে উঠি, একটানে নেমে আসি রাস্তায়। হঠাৎ স্পিডের জন্য ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে কেমন পটপট আওয়াজ ওঠে, এটা আসলে স্বাভাবিক, আমাকে আটকাবার জন্য কেউ ওঁৎ পেতে নেই। গাড়ি থেকে নেমেই একটা দোকানে ক্রিস্টিনের কাছে যাই, ক্রিস্টিন আমাকে জিজ্ঞেস করে, কী লিয়ন, কেমন চলছে সব? ওর হাসিটা কী সুন্দর মাইরি! ওর কাছে মিথ্যা বলার কথা ভাবতেই পারি না- সবই তথৈবচ, বিড়ালের জন্য দুধ কিনতে এলাম। তোমার যে বিড়াল আছে জানতাম না তো! কী কাণ্ড, তুমিই ঠিক, আমার বিড়াল নেই, বলতে চেয়েছিলাম- কফি’র জন্য এসেছি এখানে। মাঝেমধ্যে খেলাচ্ছলে আমি কফি বোঝাতে বিড়াল বলি। ধরতে পারো- এ আমার একধরনের নিজের সঙ্গে নিজের খামখেয়ালি খেলা। সব ঠিক আছে লিয়ন? ষোল আনা পাক্কা ক্রিস্টিন, সব ঠিকঠাক- মাথার দিব্যি, সব সামাল। আমাগো প্রেসিডেন্ট এক কৃষকের সঙ্গে করমর্দন করেছে- বিরাট ব্যাপার তাই না? ক্রিস্টিন বলে, আমিও দেখেছি, তবে তোমায় বলি- ওই লোক আলবৎ কোন কৃষক নয়। ক্রিস্টিনের কথার পিঠে বলে উঠি- আমি জানি- বলতে পারা মাত্রই কেমন ভালো লাগতে থাকে আমার!
Source Poem : Bounden duty.
আকাশ খরগোশ বুঝি লাফিয়ে পড়ছে
ওলিভার চেয়ারে বসেছিল- বোতলের ভিতর যেমন দুধ স্থির। না, ঠিক বলা হলো না। ওলিভার চেয়ারে বসেছিল- একটি লাঠি যেভাবে কাদায় লেপ্টে থাকে। না, ঠিক তা-ও নয়। ওলিভার চেয়ারে বসে থাকে মুখের ভিতর যেমন বাতাস আটকে রয়। ধুর, তা হয় না-কী! ওলিভার কেদারায় বসেছিল লগ্ন- স্যান্ডুইচ বলা মাত্রই যেভাবে ধরে নিই এর ভিতর বিষ আছে। ধুত্তুরি, তা-ও না, ওলিভার চেয়ারে সেঁটেছিল যেভাবে সহিস ঘোড়ার উপর দাবড়ে বসে থাকে। এখনও পুরোপুরি মিল খায়নি। বরং এভাবে বলি- ওলিভার চেয়ারে বসেছিল- একটা কাদার গর্তে আটকে ছিল। ওলিভার বসেছিল- গোলাপের কোমল মুখে একটি কাঁটাওয়ালা ফড়িং। আমার মনে হয়, এতোক্ষণে ঠিকভাবে বলা হলো। সে বসে থেকেই নিচের দিকে মাথা ঝোঁকায়, মাটি থেকে একটি পেন্সিল তোলে। পেন্সিলে আঁকতে শুরু করে।প্রথমে পুরো পাতা জুড়ে একটি বৃত্ত আঁকে। তারপর বৃত্ত ছোট করতে থাকে, একের পর এক ছোট থেকে ছোট, আরো ছোট বৃত্ত বানাতে থাকে, এক নিশানায় আঁকতে আঁকতে শেষপর্যন্ত থামে যেই না বৃত্ত একটি অতিক্ষুদ্র বিন্দুতে এসে ঠেকে। এবার এই এত্তোটুকু ফোঁটার দিকে ওলিভার নিষ্পলক চোখ বসিয়ে রাখে, পাতা পড়ে না- একদিশায় অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। চেয়ে থাকতে থাকতে মাথা ঝিমঝিম করে, চেয়ার থেকে পড়ে যাবার দশা হয়। তার হুঁশ ফেরে। কাগজটি নিমেষে দলামোচা করে ময়লার ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলে, কিন্তু তা ছিটকে ঝুড়ির বাইরে গিয়ে পড়ে। সে অবশ্য কখনোই বাস্কেটবল খেলায় ভালো ছিল না; উচ্চ মাধ্যমিক ইস্কুলে বাস্কেটবল টিমে জায়গা করে নিতে পারেনি। সে ঘরের বাইরে তাকায়। বরফ পড়ছিল। কয়েক ঘন্টা ধরেই তুমুল তুষারপাত। কেউ বরফ পরিস্কার করেনি। রাস্তার উপর, তার বাড়ির গাড়ি পথে একফুট উঁচু বরফ জমে। ওলিভারের মনে হয়, তার জড়বস্তুতে রূপান্তর ঘটেছে- সে নড়াচড়া করতে পারছে না। তার মাথার উপর একটি খরগোশ লাফিয়ে পড়েছে। এমন সময় বেথ আসে। তুমি কী করছো? এই তো বসে আছি। এ-দিয়ে কী বোঝাতে চাচ্ছো- এই তো বসে আছি? আরে কী মুশকিল বাবা, বসে আছি মানে বসে আছি! এমন কথা আমার বাপের জন্মেও কেউ শোনেনি- একজন কেবল বসে আছে। বুঝলাম বসে আছো; তারমধ্যেই তুমি হয়তো দেখছো- আকাশ থেকে একটা তারা খসে পড়ছে, অথবা ময়লা তুলে নেবার ট্রাক আসছে রাস্তায়, কী একটা বিষধর সাপ কাউকে কামড়ে দেবার জন্য ফুঁসে উঠছে। আমি বলতে চাইছি- তুমি বেহুদা বসে আছো, তোমার মনের ভিতর কিছুই খেলে যাচ্ছে না? না, আসলেই তেমন কিছু হচ্ছে না। তাহলে তুমি মারা গ্যাছো। তুমি কী কখনো ভেবেছো- বস্তুত এমনও হতে পারে? আমার মনে হয় না এমন কিছু ঘটেছে। তাহলে একটু বাজিয়ে দেখি- তুমি কী ইচ্ছা করলেই চেয়ার থেকে উঠতে পারো? জানি না। অনুভব করছি, এভাবে থাকতে আমার ভালো লাগছে। তোমাকে দেখে কিন্তু এমন মনে হচ্ছে না। তোমার অবস্থা সঙ্গীন। আমি কেবল বোঝার চেষ্টা করছি- খরগোশ কীভাবে ঘরে ঢুকলো। কী আবোলতাবোল বকছো- এখানে খরগোশ কোথায় পেলে- তার কোন চিহ্নও নেই! মাত্র মিনিট কয়েক আগে একটি খরগোশ আমার মাথায় লাফিয়ে পড়েছে। আমি তোমার কথা মোটেও বিশ্বাস করি না- তোমার মধ্যে গোলমাল হচ্ছে। বিশ্বাস করো, আমি কিছুই বানিয়ে বলছি না, যা বলছি- ষোলআনা সত্যি কথা। একজায়গায় ঠাঁই বসে থাকার ফলে তোমার চোখেমুখে ধান্ধা লাগছে। আমাকে আমলে না নিলে যাও, ঘরে খরগোশকে জিজ্ঞেস করে এসো, যাও।শোন, ওখানে কোন খরগোশ নেই। তা হতে পারে। এখানে যেমন বেথ বা ওলিভার বলে কেউ নেই। তুমি পুরা আউলাইয়া গ্যাচো, দুনিয়া ছাড়া কথা বলছো। হ, আমি উল্টাপাল্টা কিছু করতে চাই, কিছু করতে চাই লাইনঘাটের বাইরে। আমি এতোটাই ক্লান্ত। গা ঝাড়া দিয়ে ওঠো, দেখো- আকাশ কেমন ভেঙে পড়ছে! এ-টি আকাশ না, একটি খরগোশ লাফিয়ে নামছে, আমি বুঝেই বলছি- এটি খরগোশ।
Source poem : The sky is falling like bunnies.
এলভিস বাড়ি নেই
একটা বুনো রেকুনকে আমার ছাদে দেখতে পাই, ওখানেই আছে, নামছে না। আমি ওটাকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ি। সে বাউলি কেটে দিব্যি নাচতে থাকে। এবার বন্দুক নিয়ে আসি। দেয়ালে মই লাগিয়ে রেকুনের কাছাকাছি উঠে যাই, ওটার দিকে নিশানা ঠিক করে গুলি করে দিই। ভয়ের লেশমাত্র নেই, ও বরং আমার দিকে মাতঙ্গ নাচ নাচে, স্বাভাবিকভাবেই আমি গুলি লাগাতে পারি না- গুলি লাগে ছাদে, একটি ছিদ্র হয়ে যায়। এরমধ্যে পাশের বাড়ির ডেনি বেজান দৌড়ে আমার দিকে আসতে থাকে, চিৎকার করে- না, এ-কে গুলি করো না, এ-টি আমার পালা রেকুন। আমি ওর দিকে ফিরে তাকাই, ভাবি- মশকরা করে। ঠিকাছে, রেকুন তোমার হলে নিয়ে যাও। ডেনি মইয়ের গোড়া থেকে তুকতাক করে ডাকে- আয়, নিচে নেমে আয়। আমি পুরো বেকুব বনে যাই। রেকুন তৎক্ষনাৎ নিচে নামে, ডেনির হাতের বেড়ের ভিতরে আসে, দু’জন ডেনির বাড়ির দিকে হেঁটে যায়। আমি অতঃপর মই সরিয়ে নিই, বন্দুক নিয়ে ঘরে চলে আসি। একটু বাদে পড়ার ঘরে যাই, কাজে মন বসাই। তিনঘন্টা খাটাখাটনি করে অফিসের একটা দরকারি রিপোর্ট তৈরি করি। ক্লান্ত বোধ করছিলাম। মনে হলো, একটু ঘুমিয়ে নিই। ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় গা এলিয়ে দিই। ধারণা করি, আমি ঘন্টাখানেক ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমার কোলে রেকুন। চোখ খুলেই ঢাউশ চিৎকার করে উঠবো বলে, আবার কী মনে করে মুখের হা বুজিয়ে ফেলি, চিৎকার করার বদলে রেকুনের মাথায় আলতো হাত বুলাতে থাকি; আমি জানতাম সে তা পছন্দ করবে। আমরা প্রায় একঘন্টা এভাবেই শুয়ে থাকি, এর মধ্যে শুনি কেউ দরজায় টোকা দিচ্ছে। আমি রেকুন কোলে করেই দরজা অবধি যাই। দরজা খুলে দেখি- পড়শী ডেনি; বলে- আমি কী আমার রেকুন ফেরত পেতে পারি? আমার কোন ধারণা নেই- কীভাবে সে এখানে এলো; তিনসত্যি, একদমই জানি না। নিশ্চয়ই, এই ধরো তোমার রেকুন। আচ্ছা, এর নাম কী? এলভিস- বলেই ডেনি তার রেকুন একলহমায় তার কাছে নিয়ে নেয়। কয়েকদিন পর আমি বাড়ির পিছনের চত্ত্বরে সারাদিন ধরে কাজ করছিলাম। ক্লান্তিতে একদম চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। সেদিন তাই ঘরে এসে সকাল সকাল শুয়ে পড়ি। হাড্ডিভাঙা ঘুমের পর জেগেই দেখি এলভিস আমার হাতের উপর মুড়িয়ে বসা। এলভিসকে পুরোদস্তুর আশ্বস্ত আর স্বাভাবিক লাগছিল। আমি ওকে চুমু খাই, বিছানা ছেড়ে ওর জন্য নাস্তা বানাই- দুধ সিরিয়াল। সে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খায়। তারপর সারাদিন কাজকামের পিছনে লেগে থাকি, এলভিস সাথেসাথেই ছিল। রাতেও আমার সঙ্গেই থাকে, পরের দিনও। ওর ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছিল- আমার এখানে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। আমরা আস্তে আস্তে একটা রুটিনের ভিতর নিজেদের গুছিয়ে আনতে থাকি, খাবারের ফর্দও ঠিক করে ফেলি। একদিন শীতকালে আমার বাড়ির পিছনে পাতা কুড়াচ্ছিলাম- হঠাৎ পাশের বাড়ির বব আর সুজেন-কে দেখতে পাই। ওরা ডেনিসের বাবা-মা। কুশলাদি জিজ্ঞেস করেই আমি ডেনিসের কথা পাড়ি। ডেনিসের বাবা বব বলে- আমি ভেবেছিলাম, আপনি জানেন, ডেনি গেল সামারে মারা গ্যাছে- ওর পোলিও হয়েছিল। আহা, আমি খুবই দুঃখিত। আমরা বহুদিন ডেনি-কে মনে তুলে রাখবো। এবার পাতা কুড়ানি বাদ দিয়ে ঘরে চলে আসি। কিছু নথিপত্র গোছগাছ করি, একফাঁকে একটু ঘুমিয়ে নিই, আমাদের দুজনের খাবার তৈরি করি। কিন্তু বারবার মনে গাওয়া দিতে থাকে- কী যেন ঠিক নেই। আমি এলভিসকে খুঁজি, কিন্তু নেই, কোথাও এলভিস নেই।
Source Poem : Elvis has left the house.
জেমস টেইট।।
জেমস টেইট-এর কবিতা মাইক্রো বিন্যাস, বৃত্তের মাঝখানের দূরবর্তী তীব্রতায় স্থির বিন্দু; মনে হবে স্বাভাবিক, আটপৌরে- কিন্তু ভিতরে অন্য মোচড়, ভিন্ন তাকদ। হাসি, ঠাট্টায়, দিনরাত্রির গার্হস্থ বয়ানে টেইট তাঁর কবিতা একটি মেলার আয়োজনে বিন্যস্ত করে তোলেন। তাঁর কবিতা জীবনের সহযাত্রায় স্বাভাবিক, আর অনিবার্য অনল। সাধারণত জেমস টেইট কবিতা শুরু করেন ঠাট্টার আহবানে,আর শেষ করেন আঘাত ও ক্ষরণের মোড়কে।
আসলে আঘাত আর নিঃসঙ্গতা-ই টেইটের কবিতার কেন্দ্রীয় প্রবণতা। তাঁর কবিতা পাঠকের বোধে এক ধন্দ তৈরি করে- হয়তো বা এই দোলাচল তাঁর জীবনেরই এক অমোঘ অংশ। জেমস টেইটের বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন, তিনি ছিলেন যুদ্ধবিমানের পাইলট। ফলে তিনি জনমভর হয়ে থাকলেন স্নেহের কাঙাল। যুদ্ধের কাছে, মুনাফার দাপটে আমাদের যে বিকার ও অসহায়তা- টেইটের কবিতা কখনো তা হাসি, পরিহাস, বা ক্ষণিক অধিবাস্তবতা, অশ্রুপাত ও আশা-নিরাশা এবং নিরর্থকতার বান্ডিলে উপস্থিত করে। চার্লস সিমিক আর ডোনাল্ড জাস্টিস-এর কবিতায় এমন হাসি ঠাট্টা বেদনার দেখা মেলে। জেমস টেইট ১৯৪৩ সনের ৮ই ডিসেম্বর মিজৌরি অঙ্গরাজ্যের ক্যানজাস সিটিতে জন্মগ্রহণ করেন, সাকল্যে তাঁর ২০টির মতো বই আছে।
বদরুজ্জামান আলমগীর: কবি, নাট্যকার, অনুবাদক।