খোলা কবিতার কবি মোহাম্মদ রফিক কবিতা বন্ধ করলেন
খোলা কবিতার কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত মোহাম্মদ রফিক কবিতা বন্ধ করলেন তাঁর খোলা কবিতার পাতা। গত ৬ আগস্ট ঢাকা ফেরার পথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বরিশালের স্থানীয় একটি হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎস তাকে মৃত ঘোষণা করেন (২৪ অক্টোবর ১৯৪৩ – ০৬ আগস্ট ২০২৩)। বাংলাদেশের একজন কবি, লেখক ও শিক্ষক। তিনি একজন মননশীল আধুনিক কবি হিসাবে পরিগণিত যার আত্মপ্রকাশ ১৯৬০-এর দশকে। পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলন ও কবিতায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কাব্যিক রসদ যুগিয়ে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-এর ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে ২০০৯-এ অবসর নিয়েছেন। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০২০ সালে তিনি ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।
তার জন্ম ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ২৩ অক্টোবর বাগেরহাট জেলার বৈটপুরে। পিতার নাম সামছুদ্দীন আহমদ এবং মাতার নাম রেশাতুন নাহার। আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ। মোহাম্মদ রফিক বাগেরহাটে শৈশব কাটান। মেট্রিক পাশ করে ঢাকার নটরডেম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন, কিন্তু পরে ঢাকা কলেজে মানবিক বিভাগে চলে যান। এ সময় কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাথে তার বন্ধুত্ব হয় যা তার সাহিত্যিক চেতনায় প্রগাঢ় ছাপ ফেলে। বি.এ. পাশ করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে এম এ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তার কবিতা সমকাল সহ বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। এ সময় তিনি পাকিস্তানের সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হন। পাকিস্তানের সামরিক আদালত তাকে দশ বছরের কারাদণ্ড দেয়, কিন্তু এম. এ. পরীক্ষার জন্য তিনি ছাড়া পান। ১৯৭১ সালে তিনি প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের ১ নং সেক্টরের কর্মকর্তা হিসেবে এবং পরে স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করার পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে যোগ দেন। তিনি ২৯ জুন ২০০৯ পর্যন্ত দীর্ঘকাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।
কবি মোহাম্মদ রফিক ১৯৬০-এর দশকের প্রারম্ভে সমকাল, কণ্ঠস্বর, স্বাক্ষর, অচিরা ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বৈশাখী পূর্ণিমা প্রকাশিত হয়। তার কবিতায় নৈসর্গিক আবহে লালিত আধুনিক মানস-চেতনার প্রচ্ছাপ লক্ষ্য করা যায়। কবিতায়, জ্ঞাতে হোক আর অজ্ঞাতে হোক, রয়েছে দৃষ্টান্তবাদী মনীষা। যেন শহরে নয়, গাঁয়ে থেকে গাঁয়ের কাব্যবয়ান করেছেন, নদীর পাশে বসে লিখেছেন নৌকোর দৌড়াদৌড়ি, নদীনির্ভর জীবনের ব্যস্ততা। গাওদিয়া তার একটি বহুলপঠিত কাব্যগ্রন্থ। তিনি প্রধানত কবি হলেও কিছু গদ্যগ্রন্থ রচনা করেছেন।
কাব্যগ্রন্থঃ
- বৈশাখী পূর্ণিমা (১৯৭০)
- ধুলোর সংসারে এই মাটি (১৯৭৬)
- কীর্তিনাশা (১৯৭৯)
- খোলা কবিতা (১৯৮৩)
- কপিলা (১৯৮৩)
- গাওদিয়া (১৯৮৬)
- স্বদেশী নিশ্বাস তুমিময় (১৯৮৮)
- মেঘে ও কাদায় (১৯৯১)
- নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৩)
- রুপকথা কিংবদন্তি (১৯৯৮)
- মৎস্যগন্ধা (১৯৯৯)
- মাতিকিসকু (২০০০)
- বিষখালী সন্ধ্যা (২০০৩)
- নির্বাচিত কবিতা (২০০৩)
- কালাপানি (২০০৬)
- নির্বাচিত কবিতা (২০০৭)
- নোনাঝাউ (২০০৮)
- দোমাটির মুখ(২০০৯)
- ত্রয়ী (২০০৯, ঐতিহ্য)
- মোহাম্মদ রফিক রচনাবলী ১ (২০০৯, ঐতিহ্য)
- মোহাম্মদ রফিক রচনাবলী ২(২০১০, ঐতিহ্য)
- চিরহরিতের উপবাস (২০১৯) [২]
- গীত ক কুবির (২০২২) [৩]
গদ্যসাহিত্যঃ
- আত্মরক্ষার প্রতিবেদন (২০০১)
- স্মৃতি বিস্মৃতি অন্তরাল (২০০২)
- ভালবাসার জীবনানন্দ (২০০৩)
- দূরের দেশ নয় আয়ওয়া (২০০৩)
- খুচরো গদ্য ছেঁড়া কথা (২০০৭)
- গল্প সংগ্রহ (২০১০
রচনাসমগ্রঃ
- মোহাম্মদ রফিকের রচনাবলী, ১ম খণ্ড (২০০৭)
- আমার জীবনানন্দ (২০২১)
আত্মজীবনীমুলক গদ্যঃ
- পথিক পরান ১ (২০২০), পথিক পরান ২ (২০২১) ও পথিক পরান ৩ (২০২২
পুরস্কারঃ
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার – ১৯৮৬
- একুশে পদক – ২০১০ (ভাষা ও সাহিত্য)
- মযহারুল ইসলাম কবিতা পুরস্কার ২০১৫
- প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪২০
- ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০২০
তাঁর প্রয়াণে আমরা অত্যন্ত শোকাহত। তাঁর খোলাকবিতা কালের প্রেক্ষাপটে খোলা থাকুক, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
*****************************************