রং খেলে স্মৃতির চক্রবালে
শাহাব আহমেদ
প্লেন উড়ছে। ডিসি যাচ্ছি। নীচে তুষার ঢাকা প্রান্তরের মত সাদা মেঘ, শেষহীন। তবে কোনো গাছপালা নেই, না-বার্চ, না-পাইন, না-মেপল। একটু আগে প্লেন মিস করার অবস্থা হয়েছিল। বহু আগেই গেইটে এসেছি, ২৩১ নম্বর গেইট থেকে প্লেন ছাড়বে কিন্তু সেখানে বসার জায়গা নেই। ২৩০ এর সামনে বসে আছি, বিশাল একটি সমস্যার চিন্তার গহ্বরে তন্ময়ে তথাগত। সিকিউরিটি পার হচ্ছিলাম যখন জীবনের কদর্য মর্মমূল থেকে অস্বস্থিকর ফোনটি এসেছিল। কখন ঘোষণা দিয়ে বোর্ডিং শুরু ও শেষ হয়েছে টের পাইনি। ওয়াশিংটন ডিসির ফ্লাইট, শেষ কল! দেখি ১২ মিনিট বাকি।
ছুটে আসি।
বোর্ডিং শুরু হয়েছে?
শেষ হয়ে গেছে। সবাই প্লেনে সিট নিয়ে বসেছে, তোমার নাম ধরে ডেকেছি, তুমি কোথায় ছিলে?
কোথায় ছিলাম, জটিল প্রশ্ন। ছিলাম মায়ের পেটে এটা নিশ্চিত, তার আগে কোথায় ছিলাম বা তার পরে কোথায় আছি, নিশ্চিত নই। এখন ডিসি যাবো, তারপরে কোথায় কে জানে?
মা ভালোবাসতো নিশ্চিত জানি, কারণ সে কোনোদিন বলেনি ভালোবাসে না।
মাথায় চুমু খেয়েছে, চুলে হাত বুলিয়ে দিয়েছে, নরম হাতকে কঠিন করে চেপে ধরে আমার আর্ত চিৎকার অতিক্রম করে খুঁজলির পূ্ঁজ বের করে এন্টিসেপটিক সাবান দিয়ে ধুয়ে দিয়েছে। তখন অভিমান করে বলেছি, তুমি আমার মা না।
মা হেসে বলেছে, তবে কে?
বহু চিন্তা করেও খুঁজে পাইনি, মা না হলে সে কে? ফুপু, খালা, চাচি? কিন্তু তারা সবাই ভালো। তবে এত খারাপ আর কে হতে পারে? ডাইনি কী, তখনও জানি না, জানলেও মাকে অত খারাপ মনে হয়নি।
তবে সে কে?
মা, অবশ্যই মা। একশো হাজার বার, আমার মা। ছোট ছোট সন্তানেরা অভিমান করে কত কিছু বলে, কিন্তু তা কি মনের কথা?
সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করার সময় আর নেই।
সত্য কী?
মিথ্যুকের মুখের ভাষা।
দেশ ছেড়ে চলে গেছি এবং ৫ বছর পার হয়ে গেছে। কী দীর্ঘ সময়! সময়ের কখনই এত দীর্ঘ হতে নেই। এবং দূরত্বেরও হতে হয় না এত দূর, ফোন নেই, নেট নেই, কম্পিউটার কী তাও কেউ জানে না, মায়ের সাথে মানুষ কথা বলে কী করে?
বলে না।
চাইলেও বলা যায় না।
গাছের এমেরাল্ড সবুজ পাতা, আস্তে আস্তে রং বদলায়, একসময় উজ্জ্বল হলুদ বা লাল হয়, তারপরে ঝরে যায়। অনম্বর গাছগুলো দাঁড়িয়ে থেকে শীতে কাঁপে, তাদের ছোট ডালায়, বড় শাখায় তুষার জমে থাকে, পা জড়িয়ে থাকে শাদা শীতল কম্বলে।
সেই শীতও অতিক্রম হয়ে গেছে, শালিকের কণ্ঠের কোলাহল শুনে শুনে বসন্ত এসেছে কৌতুহলী। এবং জাজিমের নিচে কাঠ দিয়ে অবতল থেকে সমতল করা স্প্রিংয়ের বিছানায় খেলা করছে একটুকরো রোদ, আর সেই রোদে শুয়ে আছে টাইশিয়ানের ভেনাস, শীতের বৃক্ষের মত পত্র পল্লবহীন। মর্মরের মত মসৃন ত্বক, ফিরোজা আসমান চোখ, বাদামি কাশফুল চুল। আর কেউ নেই, কোথাও কেউ নেই, শুন্য, শুন্য, শুন্য, সুন্দর!
বুড়ো পৃথিবীটা মরে গেছে সেই কবে, যেখানে মা মা-ই, বাবা বাবা। দাদা দাদী কাকা, খালা, ফুপু, চাচী প্রত্যেকেরই নিজস্ব আপন মুখ।
মুখগুলো মুছে গেছে।
এখন রৌদ্রের নীচে অন্ধকার, দুঃখকে কন্যা বলে ডাকি, বন্ধুকে পরিচিত মনে হয়, অপরিচিতকে অচেনা বৃক্ষ।
এবং শূন্য চারিদিকে।
শৈশবে যে আকাশটাকে উপুড় করা নিটুট দস্তার ঢাকনা মনে হতো, এখন তা শূন্য ছাড়া আর কিছু নয়।
আমি শূন্যে দ্রবীভূত তুঁত-খণ্ড।
“কী দিই তোমাকে?”
“আমার কি অভাব আছে কোনো?”
“তোমার সাথে জীবনটা ভালোই কাটালাম।”
“শেষের ঘণ্টাধ্বনি? কখনই অমন করে বলতে নেই, মানুষ অতীতে বাঁচে না, বাঁচে বর্তমানে। বলবে তোমার সাথে জীবনটা তো ভালোই কাটছে।”
“ভালোর বড় ফ্যাঁকাসে মুখ, জীবনের জ্যোতি নিভে গেছে!”
“স্বর্ণকান্তি ওই মেপলের পাতাগুলো দেখো, ঝরে যাবে কিন্তু ওদের মুখে কোনো বিষণ্ণতা নেই।
তুমি কেন বিষণ্ণ হও?”
কোমল পায়ে হাঁটা দেবদারু বৃক্ষ তুমি, আদি ও অনাদির অকৃত্রিম দুহিতা, অনীত চরাচরে তুমি আমার শূন্যতাকে ভরাট করে আছো।
অক্টোবর ২৮, ২০২২
=====================