রুটিন
মোহাম্মদ কাজী মামুন
প্রতি বছর রমজানের শুরুতে একটা যুগপৎ অনুভূতি হয় আমার। একদিকে রুটিন বদলে যাওয়ার টেনশান। অন্যদিকে, নতুন রুটিনের রোমাঞ্চ। প্রথম দিনটা তো খুব কষ্টেই কাটে, সেই সুবহে সাদিকের আগে ঘুম থেকে উঠে খেয়ে-দেয়ে তারপর সারাদিন আর এক ফোঁটা পানিও স্পর্শ না করা। এরই মধ্যে সকাল সকাল আবার অফিস ধরা, ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে কম্পিউটারে কাজ করা। ঘন ঘন প্রস্রাবে শরীর ক্রমেই শুকোতে থাকে, এক সময় হাঁটাচলার শক্তিটাও আর থাকে না; ওদিকে মগজটাও ফাঁকা হতে হতে এক পর্যায়ে টিনবাক্সের মত দুলতে থাকে। কিন্তু যতই এগিয়ে আসতে থাকে ইফতারের সময়টা, একটা অচেনা পুলক কাজ করতে থাকে সেই মগজেই। দুনিয়ার সব কিছুকে সুন্দর আর মধুর মনে হতে থাকে তখন।
এরকম একটা অনুভূতি থেকেই হয়ত সেদিন রাজ্যের সব সামগ্রী সদাই করে বাসায় ঢুকেছিলাম মৌসুমের প্রথম ইফতারটার জন্য। কিন্তু ডাইনিং রুম ও রান্নাঘরের সংযোগস্থলে যে এক চিলতে জায়গা আছে, সেখান থেকে একজন বৃদ্ধার মুখ ভেসে উঠতেই পিত্তি জ্বলে উঠল আমার! এমন নয় যে, ঐ বৃদ্ধার গায়ে ঘা-পাঁচড়া-পুঁজ লাগানো! বা, তার চেহারায় ভয়ঙ্কর কিছু বিদ্যমান! বা, তার সাথে আছে পূর্ব কোন অমধুর স্মৃতি! একান্তই নিরীহ গোছের একটি চেহারা, আর কাঁচুমাচু বসার ভঙ্গি!
বোকা বোকা চেহারার এই বৃদ্ধাকে কবে থেকে দেখছি, মনে করতে পারি না। তবে সে যেন আমার মা’র কাছে সেহরি, ইফতার, আর তারাবি নামাযের মতই রোযার মাসের একটা অত্যাবশকীয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে! ইফতারের সময়ই সে ঘরে প্রবেশ করবে, কিন্তু ইফতার সেরেই চলে যাবে না; অপেক্ষা করবে কোঁচড় ভর্তি করে এই রাত ও সেহরি রাতের খাবার নিয়ে যাওয়ার জন্য। তারপর রমজানের শেষদিকে বৃদ্ধার হাতে তুলে দিতে হবে একখানা কাপড়,আর সায়া-ব্লাউজ। সবশেষে, মা আমার কাছে ধন্না দিতে থাকবেন কিছু নগদ টাকার জন্য, যা বিদায়কালে বৃদ্ধার হাতে গুঁজে দেয়া হবে দোয়া করার আর্জি জানাতে জানাতে!
‘গুনাহ বাড়াইস না! ওর আপনার বলতে কেউ নেই দুনিয়াতে!’ মা বলে উঠেন।
‘হ, দুনিয়ায় অসহায় বলতে এই এক বুড়িই আছে!’ আমার রাগ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। বলতে কি, বুড়িকে আমার কখনোই মন থেকে বিশ্বাস হয়নি। নিশ্চিত সে আমাদের উদারতার পূর্ন সুযোগ নিয়ে ঠকিয়ে যাচ্ছে বছর বছর!
আমার মধ্যে সেদিন হঠাৎই প্রবল একটা জেদ চেপে বসে। নাহ! যে করেই হোক তাড়াতে হবে বুড়িটাকে, বন্ধ করতে হবে ওর বদমায়েসিটা!
সম্ভবত দুদিন পরেই হবে; মাগরেবের নামাযটা সেরে মসজিদ থেকে বেরিয়েছি, একটি আপাদমস্তক বোরখায় মোড়া নারীদেহ আমার সামনে চলে এল, আর তার কোচকানো হাতে কিছু পয়সা ঠেলে দিতে দিতে আমার মাথায় আইডিয়াটা ভর করল। মহিলাটিকে পিছন পিছন আসতে বলে আমি বাসার দিকে ফিরে চললাম।
বাসার দরজাটা আধভেজানো অবস্থায় ছিল। মহিলাটাকে দরজার বাইরেই দাঁড়াতে বলে আমি ভেতরে ঢুকলাম আর দেখতে পেলাম মা ডাইনিং টেবিলে বসে পান চিবুচ্ছেন, আর ঐ বুড়ি মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে তার দুঃখের কাহিনি বয়ান করে চলেছে – সেই কাহিনি যা আমারও মুখস্ত হয়ে গেছে! মা কিছুক্ষণ বাদে মিটসেফ থেকে একটা পলিথিনে মোড়া খাবারের পোটলা বুড়ির চোখের সামনে মেলে ধরতেই মাথা-হাত-পা সহ পুরো দেহটাই যথারীতি নত করে ফেলল সে। আর আমার মায়ের চোখে-মুখে খেলে যেতে লাগল একটা অদ্ভূত প্রশান্তি – একটা নিশ্চিত রুটিনে থাকলে যেমন হয়!
দৃশ্যটা কেমন আনমনা করে দিল আমায়! দান ও দয়ার এই সিজনে রুটিনটা ভাঙ্গতে ইচ্ছে করল না কেন জানি! আমি মানিব্যাগ থেকে আরো কিচু পয়সা বের করে দরজার বাইরের মহিলাটাকে বিদায় জানিয়ে ফের ঘরে ফিরে এলাম।
নাহ,, বেশী রূঢ় হয়ে গেছে আমার আচরন। মা’কে খুশী করার গরজ থেকেই কিনা, তাকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে বললাম, ‘বুড়িটাকে আমাদের সাথেই খেতে দিও আজ থেকে; নীচে বসলে কেমন খারাপ লাগে দেখতে!“
‘অত কিছু নিয়া তর মাথা ঘামাইতে হইব না! টেবিলে ভাত দেয়া আছে! ক্ষিদা লাগলে খাইয়া নিতে পারোস!’ বলেই মা আগুনে একটি দৃষ্টি হেনে রান্নাঘরের দিকে এগুতে থাকেন।
এদিকে আমার জিভে কামড় লেগে গেছে ততক্ষণে! রুটিন ঠিক রাখতে যেয়ে কখন যে বদলানোর প্রস্তাব করে ফেলেছি, একদমই খেয়াল ছিল না!
****************************