You are currently viewing ঈশ্বরের রায় || কাজী লাবণ্য

ঈশ্বরের রায় || কাজী লাবণ্য

ঈশ্বরের রায়

কাজী লাবণ্য

(১)

সময়ে নারী ভয়াল বিস্ফোরক, সময়ে নিশ্চল পাথর। এমন বিপদ বলে নয়, বিপদহীন সময়েও নারীর জীবনকে যদি চলমান যান ভাবা হয় নিয়মের রেললাইন থেকে একচুল সরে গেলে আস্ত যানটিই অতল গহ্বরে, আবর্জনায় মুখ থুবড়ে পড়ে। নারী হয়ে যায় পতিত। সাপ খোলস ছেড়ে আর পিছন ফিরে তাকায় না। নতুন শরীরে নতুন করে বেঁচে থাকে। কিন্তু মানুষ কী পারে আত্মাহীন হয়ে বেঁচে থাকতে! পারে। পারতে হয়। চাইলেও শরীর থেকে আত্মা উড়ে যায় না।

মেয়েটা আত্মাহীন হয়েই বেঁচে আছে। ঈশ্বরের হুকুম ছাড়া বৃক্ষের পাতা নড়ে না, সেই ঈশ্বরের হুকুমেই মেয়েটির চোখে অসময়ে ঘুম নেমে এসেছিল, কালঘুম। আর এই ঘুমের ফুরসতে ঈশ্বর একটা রায় দিয়ে দেন। সে মায়ের পাশ থেকে উঠে চকচকে আয়না দেখতে চলে যায়। যাদুর আয়না ডাক দেয় নিশি পাওয়া মানুষের মত। সেই চুম্বক আকর্ষনে আয়নায় সে নিজের ছবি দেখে খলবল করে আয়নার বুকে সেঁধিয়ে যায়।
সেও আজ তিনদিন হয়ে গেল। তিন তিনটে দিন! তিনবার সূর্য উঠেছে, তিনবার অস্ত গিয়েছে। সকল কাজ সমাধা হয়ে গিয়েছে। আপাতত হয়তোবা,  প্রথম ঈশ্বরের কাজও সমাধা হয়ে গিয়েছে।

ইত্যবসরে ২য় ঈশ্বরের আগমন ঘটেছে, এসে ওকে সাপ মারার মত মেরে পুরো শরীর থেতলে দিয়েছে। জায়গায় জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধেছে, জায়গায় জায়গায় ধারা নেমেছে। সে উঠতে পারে না, খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না। তাছাড়া এসবের আর কোন চাহিদা বা দরকার আছে বলে সে মনেও করে না। কিন্তু ওর মা তবু নিরাময়ের দুধ, তেলের বাটি নিয়ে ওর পাশে বসে থাকে। সারা শরীরে প্রলেপ লাগায়। লাগাতে লাগাতে করুণ সুরে বিলাপ করে।

কেউ কি কখনও গ্রামের কোন দুঃখী নারীর হৃদয়বিদারক করুণ আর্তনাদ শুনেছে? সে যে কী এক সুর! কী এক কলজে ছেঁড়া গীতিকা! কান্নার মধ্যেই পুরো ঘটনার বিবরণ তারা উপস্থিত সময়েই বর্ণনা করে। কি ঘটনা, কি বিত্তান্ত, সবই নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলে। মা-ই কেবল কাঁদে, কেঁদে কেঁদে অশ্রু দিয়ে বন্যার জল আরো বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু মেয়ে! নদীর মত সদা বেগবান, অচঞ্চল মেয়েটির মুখে একটি শব্দও নেই, চোখে একফোঁটা জল নেই। কোনো অভিব্যক্তি নেই। তবে অভিব্যক্তিহীন মেয়েটির একটি নাম আছে বৈকি। বাবা আদর করে একটি সুন্দর নাম রাখলেও ওকে সবাই বুড়ি বলে ডাকে।

(২)
বুড়ি ওর বাবামায়ের একমাত্র মেয়ে, সাত ভাইয়ের একমাত্র বোন। ছোটবেলা থেকে মায়ের সাথে ঘুরঘুর করত পাড়ার বড়বাড়িতে, মা সে বাড়িতে কাজ করত। খুব কাছেই বড়বাড়ি। ওরা বংশ পরম্পরায় ওই বাড়িতে কাজ করে আসছে। একটু বড় হওয়ার পর থেকে বুড়িও সে বাড়িতে ওদের ফুট ফরমায়েশ খাটত। তবে দশটা বাজলেই স্কুলে চলে যেত। বড় আম্মা বলেছিলেন-

-বুড়ি স্কুলে যাবে, লেখাপড়া শিখবে। ও তো সাতভাই চম্পার চম্পাবুড়ি। সে মতই বুড়ির স্কুলে যাতায়াত, পড়াশোনা, সাথে বাড়ীর টুকটাক কাজ চলতে থাকে। বাড়িতে বড়ভাইয়া, বড়আপা, মেজআপা, ছোটআপারা ছিল। তারা সবাই বিশেষত আপারা বুড়িকে খুব আদর স্নেহ করত। বুড়ি ছাড়া তাদের চলতই না। সবাই ডাকত চম্পাবুড়ি। কাজেই বুড়ির শৈশব, কৈশোর যতটা খারাপ কাটার কথা তার চেয়ে ঢের বেশি আনন্দ খুশিতে তরতর করে কেটে যায়।

বুড়ি প্রাইমারী স্কুল পাশ করে হাইস্কুলে ওঠে। তাইবলে স্কুলের দিনগুলি খুব যে সাবলীল কাটে তা নয়। শিক্ষকগণ সদাচারন করলেও সহপাঠীরা খুব একটা ওকে পাত্তা দিত না। সে অন্যের বাড়ীর ‘কামকরানী’ একথা বলতে তারা দ্বিধা করত না। কিন্তু চম্পাবুড়ি মুখবুজে সেসব সয়ে যেত। তবে ওর আনন্দের কমতি ছিল না। আপাদের বড় ফুলের বাগানে সে বিকেলে কাজ করত, আপাদের সাথে এক্কাদোক্কা, লুডু, ক্যারম খেলত। বাড়ির পেছনের কাঁঠালগাছের বাকল তুলে কমলা রঙয়ের এক ধরনের গুঁড়ো দিয়ে সে হাত রাঙাত। এসবই ছিল বালিকার বিনোদন। 

ধীরে ধীরে হাইস্কুলের একটা দুটা ক্লাস পড়ার পর থেকেই ওর বাবা মা ওর বিয়ের কথা বলাবলি করতে থাকে। কিন্তু আম্মার ভয়ে কেউ সাহস পায় না কথাটাকে জোরালো করার। এমনি করে একদিন বুড়ি নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে উত্তির্ণ হয়। বাড়ির বড়া’পা তখন দূর শহরের হলে থাকে। সেখান থেকে বুড়ির জন্য কত কী উপহার চলে আসে। বুড়ি, বুড়ির বাবামা বড় আম্মা সবাই খুশি হয়। বড় আম্মা বলেন-
-বুড়িও একদিন হলে যাবে, ওর বড়া’পার মত এমএ পড়বে। এই সুযোগে বুড়ির বাবা আম্মাকে জানায় বুড়ির বয়স হয়ে যাচ্ছে পরে আর ছেলে পাওয়া ভাবে না। কাজেই এখনই বুড়ির বিয়ে দেওয়া দরকার। আম্মা ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, ধমক দিয়ে নিজ নিজ কাজে পাঠিয়ে দেন। সেসময়ের জন্য চাপা পড়লেও একথা আর চাপা থাকে না। অশিক্ষিত মানুষকে পৃথিবীর কারো সাধ্য নেই ভালো মন্দ বোঝানোর। বড়আম্মাও ব্যর্থ হন এবং বিরক্ত হন।
পরবর্তীতে আম্মাকে না জানিয়ে বুড়ির বাবা পাশের গ্রামের মোজাম্মেলের পুত্র হালিমের সাথে বুড়ির বিয়ে দেন। সে ধানচালের চাতালে হলারম্যানের কাজ করে। বুড়ি দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও হলারম্যান কিন্তু ক অক্ষর গোমাংস। সেসব কথা অবশ্য কেউ আমলে আনে না। বরং বুড়ির বাপ মা, চাচা চাচী, ভাইয়েরা সবাই খুব খুশি হয় এমন জামাই পেয়ে। আবার অনেকেই বলতে থাকে-

-বড় আম্মাকে না জানায়া কামটা করা উচিত হয় নাই। বড় আম্মা লেখাপড়া শিখায়া এ্যার চায়া ভালো পাত্রের সাতে বিয়া দেলে হয়। নিজের ভালো পাগলাও বোজে, শালার গরীব মানুষ বোজে না।

প্রথম দিকে শ্বশুর বাড়িতে বুড়ির দিন ভালই চলতে থাকে। কিন্তু কিছুদিন পরেই তাদের আসল রূপ বের হয়ে আসে। মোজাম্মেলের মনে বড় আশা ছিল বেয়াই মেয়ের জামাইকে একটা ধানভাঙ্গা মেশিন কিনে দেবে। আভাসে, ইঙ্গিতে সে নাকি এমন কথা বলেওছিল। কিন্তু বেয়াই তা বোঝেনি বা বুঝতে চায়নি। যাহোক এ নিয়ে চরম ভুল বুঝাবুঝি শুরু হয়। বুড়িকে উঠতে বসতে শুনতে হয়-

-পরের বাড়ির দাসী, বান্দি তোর বাপে কি দিছে? তোর বাপ একটা ঠগ, একটা মিছামুখা। এমতোন উপযুক্ত ব্যাটাক কত মানুষ লাখ লাখ টাকা দিবার চাইছিল, হালিমের বাপে যে কী দেকি এই দাসীক বাড়ির বউ করি আনিল তা আল্লাই জানে।

এসব ঝগড়া কাজিয়ার মধ্যেই দিন যায়, মাস যায়, বুড়ি গর্ভবতী হয়। তখন সবাই বাড়ির বৌয়ের প্রতি কিঞ্চিৎ দরদী হয়ে ওঠে। হালিমের মনও নরম হয়, বউয়ের প্রতি সদয় আচরণ করে। যথাসময়ে কোন ঝামেলা ছাড়াই বুড়ি সুস্থ একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলে বুড়ির কপাল ফিরে যায়। বাড়িতে সবার কাম্য ছিল- বেটা য্যান হয়। ভাগ্যগুণে বুড়ির বেটাই হয়। আরো একটা ব্যাপার ঘটে এদের লক্ষ্মীর চাকাও ঘুরতে থাকে। বুড়ির স্বামীর আয় দিনদিন বাড়ে। মিল থেকে কিভাবে যেন গোপনে চাল আনতে থাকে। আর সে চাল বাজারে বিক্রি করে বুড়ির শ্বশুর। বাড়িতে গরু কেনা হয়, কেনা হয় ছাগল। সেগুলির যত্নের পুরো ভার পরে বুড়ির উপর। অবশ্য বুড়ির দুরন্ত ছেলের দেখাশোনা, খাওয়ানো, নাওয়ানো সব করে ছেলের দাদী। বুড়ির স্বাস্থ্য অটুট, কম কথাবলা পরীশ্রমী মেয়ে। সে সারাদিন মুখবুজে কাজ করে যায়। পেছনের জায়গায় সে লাউ, শিম, শাক, কুমড়ার গাছ লাগায়। সেগুলির পরিচর্যা করে মন লাগিয়ে। তা বিনিময়ে ওরাও উপচে দেয় বুড়ির অঞ্জলি। 
পৃথিবীজুড়ে সোনাঝুড়ি আলোতে বুড়ির বেগুনের ফুল, শিমের ফুল, লাউয়ের লকলকে সবুজ ডগা সত্যিই দেখার মত। ওর শাশুড়িও মনে মনে খুশি হয়, ভাবে আসলে বউটা ফলবতী।   

ধীরে ধীরে সংসারের অশান্তি অনেকটা কমে আসে।

তাছাড়া বাড়ির সব মানুষ ব্যস্ত থাকায় পুরনো গালিগালাজ, খোঁটা দেওয়াও বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু যৌতুকের ব্যাপারটা ওর শ্বশুর ভোলে না। তার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ধানভাঙ্গা একটা মেশিন কিনে নিজের ঘরের বাইরে বসিয়ে মনে মনে, বস্তায় বস্তায় মানুষের ধান ভাঙবে, আর টাকা গুনবে।

দাদা, নাতীকে ঘাড়ে বসিয়ে চক্কর দিয়ে নিয়ে আসে নিত্যদিন সকাল সন্ধ্যা। নাতী দাদার খুব ন্যাওটা। দাদাও নাতী ছাড়া কিছু বোঝে না। এইভাবে বিয়ের তিন বছর চলে যায়, ছেলের বয়স দুই পেরিয়ে যায়। নতুন বউ থাকতেই সেই ঝগড়া বিবাদের সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে রায় ঘোষণা হয়েছিল বউ জীবনে কোনদিন বাপের বাড়ি যেতে পারবে না। তিন বছর হয়ে গেল বুড়ি বাপের বাড়ির রাস্তায় পা দেয়নি।

(৩)
ছেলের তিন পেরিয়ে চারে পা দিতে চলল। বুড়ি আবার গর্ভবতী, কিন্তু এখনো কেউ জানে না। বুড়ি ইচ্ছে করে জানায়নি।
এদিকে ধানভাঙ্গা মেশিন কেনা হয়েছে। দিনরাত মানুষ ধান ভাঙতে আসে। ডালিতে ধান আসে আবার ভ্যানে ভ্যানেও ধান আসে, সাথে পয়সাও আসে। আজকাল শ্বশুর মেম্বার সাহেবের ডানহাত হয়ে উঠেছে, রাজনীতিও নাকি বোঝে। বিভিন্ন জায়গায় ওঠাবসা করে গ্রামের ‘একজন’ হবার চেষ্টায় রত। সামনের ইলিকশনে সে মেম্বারি ভোটে দাঁড়াবে এমনটাও শোনা যায়। তা সে করতেও পারে। সারাদিন পান খায়, ধান ভাঙে আর বিভিন্ন মানুষের সাথে শলাপরামর্শ করে। আজকাল আবার দান ক্ষয়রাতের হাতও বেশ খুলেছে। বড় মানুষজনের সাথে মাখামাখি হওয়ায় তার মেজাজ শরীফ ফুরফুরা থাকে।

সপ্তাহে শনি, বুধ এই দুইদিন হাটবার। বাড়ির এমন ফুরফুরা মৌসুমে এক হাটবারে, মাঝরাতে স্বামী ফিরে এসে বাপের শিকার বালিহাঁসের মাংস দিয়ে খাওয়া দাওয়া সারার পরে, খোঁপার রূপোর কাঁটা খুলতে খুলতে বুড়ি আবদার করে একবার বাপের বাড়ি ঘুরে আসার জন্য। বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে ওর স্বামী বলে-
-তা আমি ফির কি কই, আব্বাক কও, কয়া যাও।

বুড়ির শ্বশুরও দয়া করে সম্মতি জানায়।

এদিকে হাসতে হাসতে স্ত্রীকে বলে-

-এই বাইষ্যা শ্যাষ হইলে নাতীর খৎনা দেমো বড় করি প্যান্ডেল সাজায়া। গরু জবাই হইবে। মাইক বাজবে, ডেকরেটর ডাকামো, বাবুর্চি পাকশাক কইরবে। মেম্বার সাব আসপে, আরো মাইন্যগইন্য মানুষরা আসপে। ওই হালিমের শ্বশুরবাড়ির সোব্বাকে দাওয়াত দেমো। আসুক শালারা দেকুক মোজাম্মেল মিয়ার কইলজা কয় হাত! চাউলের মেশিন দেকুক, প্যান্ডেল দেকুক, হামার নাতী দেকুক, শালারা মানুষ চেনে না, শালার বেটা শালারা এই মোয়াম্মেল মিয়াক চেনে না!

আজকাল মোজাম্মেল নামের শেষে মিয়া লাগিয়েছে।

বর্ষাঋতুর দু’মাস আষাঢ় শ্রাবণ। এবারে আষাঢ়ের শুরু থেকেই দেশে বর্ষার বিস্তার। শ্রাবণে তো কথাই নেই। শেষ শ্রাবণের কালো মেঘ আর তার গগনবিদারী চিৎকারই বলে দিচ্ছে-

“এই শ্রাবনের বুকের ভেতর আগুন আছে”। তা সত্যি সত্যি শ্রাবণ আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত নিয়েই হাজির হয়েছে।
মাঠ, ঘাট, রাস্তা, নালা, ডোবা সব জলমগ্ন। গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা মরা গাঙ্গ এখন একেবারে পূর্ণ যৌবন পেয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে মানুষের বাড়ীর আঙ্গিনা, খলান। সেখানে কোথাও হাঁটু জল, কোথাও কোমর জল।
যেদিকেই তাকানো যায়, উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে জলের আয়না চিকচিক করছে। তালপাতার বাতাসের মত হালকা বাতাস সেই আয়নার উপর খেলে বেড়াচ্ছে মৃদু ছলাত ছলাত উর্মিমালায়।
একথা সত্যি বড়রা বিপাকে পড়েছে। চলাচলে অসুবিধা, গাড়ি, সাইকেল, রিকশা, ভ্যান সবই অচল হয়ে বসে আছে। কিন্তু অনেকের মনেই আনন্দ। তারা হাত জাল, টানা জাল, ঝাঁকিজাল, বড়শি, ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে নেমে গেছে। মাছ পাওয়াও যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে। পুঁটি, টেংরা, টাকি, জোয়ারি, ভাঙনা, সরপুঁটি খুব সহজেই বঁড়শিতে ধরা পড়ছে। জালেও আসছে মলা, পুঁটি, গচি, বাইম, ডানকানা মাছের ঝাঁক। ওপাড়ার খোরসেদ সেদিন জাল ফেলে বিরাট এক বোয়াল ধরে ফেলেছে, তা নিয়ে সেকি হৈচৈ। মাছ ধরা নিয়ে পুরো এলাকায় একটা উৎসব উৎসব ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাচ্চাদের তো কথাই নাই। দিগম্বরের দল হাঁটু পানিতে সাঁতারের নামে ঝাঁপাঝাঁপি, দাপাদাপি করছে। তবে কিছুটা বড়র দল পুলের উপর থেকে, গাছের উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়ছে গাঙের গভীর জলে। তাদেরকে জল থেকে তোলাই মুশকিল। বড়দের ধমক বা লাঠির ভয় ছাড়া ওরা জলের তলেই জলকেলি করে। 

(৪)
চারবছর পরে তিনবছরের পুত্র কোলে বাবার বাড়ির আঙিনায় দাঁড়ায় বুড়ি। চাপা স্বভাবের মেয়েটির ভিতরে অদ্ভুত এক ইচ্ছে তোলপাড় করে। ইচ্ছে করে আঙিনার মাটি কামড় দিয়ে খেয়ে ফেলে। বাবা, মা, চাচা, চাচী, ভাই, ভাবি সবাই জড়িয়ে জড়িয়ে কাঁদে। বুড়ি আর কাঁদে না। এতদিন এতকাল সে কত যে কেঁদে ভাসিয়েছে কে তার হিসেব রেখেছে! সে সবাইকে বলে

-হইছে আর কান্দেন না। আমি কয়টাদিন খালি আনন্দ খুশি করমো, খাওয়া দাওয়া করমো আর ঘুমামো। দুনিয়ার সক্কল ঘুম আমি এই কয়দিনে ঘুমায় নেমো। 

 
ওর মা চাচী সবাই ওর কথায় সায় দিয়ে বলে-

-হ্যাঁ মা, হ্যাঁ। সেই মোতোনে হইবে। তুই কি কি খাবু খালি কইস।

নাইওরি বেটি, নধরকান্তি নাতীর, আদর যত্নের খামতি হয় না। বুড়ি ছেলে কোলে বড়বাড়ি গিয়ে বড় আম্মার সাথে দেখা করে আসে। বড় আম্মাও খুব খাতির যত্ন করে। পরে বড় আম্মা, বুড়ি, ওর ছেলের কাপড় চোপড়, খাবার দাবার পাঠিয়ে দেয়। বুড়ির ছেলে অসম্ভব চঞ্চল, দুরন্ত। বুড়ি ছেলেকে চোখে চোখে রাখে। আবার বাড়ির সবাইকে অনুরোধ করেছে ওকে দেখে রাখতে। সবাই তা করছেও। কিন্তু ঈশ্বরের রায়… 

(৫)
মোজাম্মেল মিয়া থানায় মামলা দিয়েছে। দিয়েছে বুড়ির বাপ কাশেম আর তার মেয়ের বিরুদ্ধে। এরা ষড়যন্ত্র করে মোজাম্মেল মিয়ার নাতীকে, তার বংশধরকে হত্যা করেছে। মোজাম্মেল মিয়ার উন্নতি এরা সহ্য করতে পারে নাই, এইসব নানা অভিযোগ দিয়ে কেস ফাইল করেছে। এবং থানার ওসিকে হাত করে পুলিশ নিয়ে কাশেমের বাড়িতে হাজির হয়েছে। কাশেম ও তার মেয়েকে গ্রেপ্তার করে থানায় নেওয়ার হুকুম হয়েছে। সংবাদ পেয়ে কাশেম তার পুত্রেরা এবং বাড়ির সব পুরুষ মানুষ পালিয়ে গেছে।
কেবল এই সংবাদ পেয়ে কাশেমের সর্বংসহা মেয়ে বুড়ি অপেক্ষা করছে তৃতীয় ঈশ্বরের রায়ে কখন পুলিশ এসে,  ওকে নিয়ে হাজতে বা জেলখানায় পুরবে! অগণিত মানুষের আনাগোনা, বাড়ির স্বজনদের আহাজারি আর ওর সহ্য হচ্ছে না। কেবল ওর শিরায় শিরায়, কোষে কোষে এক বীভৎস দাবানল। 
সে ক’দিন ধরে অপেক্ষা করছে কেন তার শ্রবণেন্দ্রিয় অকেজো হয়ে যাচ্ছে না! কেন তার দৃষ্টিশক্তি অন্ধ হয়ে যাচ্ছে না! কেন তার আত্মা খাঁচা ছাড়া হচ্ছে না। কত অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। কত অপরাধ তার। এই অপরাধের বিচার করছে কতজন বিচারক! সে বিচারের কতরকম রায়!

কিন্তু কেউ একটিবার ওকে বুকে জড়িয়ে ওর অতল গহীনের শূণ্যতাকে স্পর্শ করতে চেষ্টা করে নাই। একটিবার বলে নাই- বুড়ি! তোর যে সবই হারিয়ে গেল। কেউ বোঝে নাই সে একজন মা। মায়ের বুকের ভেতর কেমন অগ্নুৎপাত হয়।

  
সে অপেক্ষা করছে সর্বশেষ ঈশ্বরের দূতরা তাকে নিয়ে যাক জেলখানার অন্ধকার কুঠুরিতে, যেখানে অনন্ত নিঃশব্দতা।
সে কেবল একা হতে চায়। একেবারে একা। স্বামীর নির্মম মারের জন্য নয়, জেলের ভয়ে নয়, একা হয়ে একটিবার জলের আয়নায় ঝাঁপিয়ে পড়া দুরন্ত সন্তানের মুখ মনে করে কাঁদতে চায় বুড়ি।

======================