একটি মৃত্যু ও একটি সকাল
সত্যজিৎ সিংহ
শীতকালে অপ্রস্তুত বৃষ্টির পর সবকিছুতে একটা উদাসি ভাব আসে। ধুলোয় ধূসর গাছের পাতাগুলি বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে চিকচিক করে কাপে। ঘন সবুজ পাতার উপর রোদ পড়লে চোখে এসে ঝাঁঝ লাগতে পারতো । আরামে চোখ বুজে আসতো তখন। আজ রোদ নাই। উঠবে হয়তো একটু পরে। কুয়াশা তেমন নাই । বাতাস বইছে। ঢেউ এসে লাগছে শরিলের উপর। বয়ে যাওয়া হু হু বাতাসের বিপরীতে সাঁতার কাটলে মনে হয় ঢেউ দিতে দিতে ছেলেবেলা চলে আসবে এই ভেজা ন্যাড়াক্ষেতের উপর। অথচ ছেলেবেলার কোন ঘটনাই এ মুহূর্তে রামিজের মনে পড়ে না। কাজে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিল। নলডরি গ্রামে আজ তার কাজ। ইউনিয়ন বাজার সংলগ্ন বাড়ি।
হু হু করা শীতে সাইকেল চালিয়ে সে রবিরবাজার হয়ে নলডরি পাকা রাস্তা বরাবর যাচ্ছিল। সুনসান রাস্তা। বৃষ্টির পর ভেজা পিচে সাইকেল চালানোর মজাটাই আলাদা। রাস্তার দু পাশে আগে বড় বড় মেহগনি আর কড়চ গাছ ছিল। কদিন আগে এখানকার মেম্বার চেয়ারম্যানরা মিলে গাছগুলি কেটে ফেলেছে। গাছগুলি থাকলে আরো ভাল লাগতো। গাছের ছায়াঢাকা রাস্তা হঠাত উদাম হয়ে গেলে সাইকেল আরোহীর নিজেরও একটু বেসেব লাগে। মনে হয় যেন আচমকা মাথার উপর থেকে চাল উড়ে গেছে। শূন্য আকাশের নীচে নিজেকে নিঃস, একা মনে হয়। রামিজ রাস্তার দু পাশে তাকিয়ে শূন্য ন্যাড়াক্ষেত, ক্ষেতের ওপাড়ে কুয়াশাঢাকা গাছগাছরা, ভিটাবাড়ি দেখে । তার আরো উদাস উদাস লাগে। এরকম মাঝেমধ্যে হয়। তখন তার ছেলেবেলার নানা দৃশ্য মনে পড়ে। কিন্তু আসলে কোন দৃশ্যই চোখের সামনে একটুর জন্য দাঁড়িয়ে থাকছে না এই মুহূর্তে। মোবাইলে চলা কোন ছায়াছবির ফরোয়ার্ড বাটনে চাপ দিয়ে রাখলে মুরুগের তাড়া খাওয়া মুরগি পাখা তুলে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে দৌড়ানোর মতন দৃশ্যগুলি যেভাবে চোখের সামনে থেকে খালি দৌড়াতে থাকে ঠিক সেরকম অনুভূতি হচ্ছে তার।
মনটাকে একটু বিশ্রামে রাখার দরকার। তার তাই মনে হয়। লোহার পুল পেরিয়ে এসেছে। ইট ভাট্টাও বাঁয়ে রেখে এল। সামনে একটু খোলা হাওয়া চারিদিকে। নির্জন ভিজা রাস্তা। বৃষ্টিস্নাত। ঠান্ডা বাতাস এসে ঝাপট দিচ্ছে চোখেমুখে। পায়ে রাবারের স্যান্ডেল। শীত যদি শরিলের একটু খোলা অংশ পায় সেখানে এসে কাঁকড়ার মতন কামড়ে ধরে। তবু সে জুতা মুজা পরবে না। এইগুলা পরলে তার চান্দি আরো গরম হয়ে যায়। তার চাইতে এই একটু ঠান্ডা লাগলো খোলা পায়ে – অভ্যাস হয়ে গেছেতো, খারাপ লাগে না।
ডানে কালী মন্দির। নতুন করে বানানো চলছে। রাস্তার পাশে ইট বালুর স্তুপ। তার বাম দিকে খোলা ক্ষেত। শূন্য, ন্যাড়া, ফিকা হলদে রঙের প্রকৃতি। রামিজ এ জায়গায় এসে থামে। বামে শূন্য ন্যাড়ার ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে তার মনে কি আসে কে জানে, রাস্তার ডানদিকে পিচের খোয়ার বাইরে গিয়ে সাইকেল স্ট্যান্ড করে রাখে। তারপর রাস্তার বামদিকে , জমিন থেকে রাস্তার উচ্চতা প্রায় ছয় সাত ফুট হবে। শক্ত পাড়। সে রাস্তা থেকে নেমে যায় জমিনে। মোটামুটি ভালই বৃষ্টি দিয়েছে ভোরের দিকে। ন্যাড়াক্ষেতের ছোট ছোট অসমান জায়গায় পানি জমে গেছে। রামিজ এই ঠান্ডার মধ্যে রাবারের জুতাসমেত পা ভেজায় বৃষ্টির জলে। খোলা পায়ে পানি লাগা মাত্র গোটা শরিলে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। শিরশির করে কেঁপে উঠে রোমকূপ ।
এত সকাল কামে না গেলে এমন কিছু হবে না। দু একদিন একটু দেরি হতেই পারে। সে না গেলেও যে কাম থেমে থাকবে এমন না। তার বয়সে আর ব্যাক্তিত্বে আসলে জুগালির কাম মানায় না। কত ছোট তার চাইতে, এরা মিসতরি হয়ে ফাইফরমাশ দিচ্ছে, ভালো রুজি করছে। অবশ্য তাকে সব মিসতরিই সমীহ করে। পদে ছোট হতে পারে। কিন্তু ফাইফরমাশ খাটায় না তাকে দিয়ে। চাইলে সে মিসতরি কবেই হতে পারতো , পারতো না ! আসলে বান্ধা কাম তার ভাল লাগে না। যখন যা পায় তাই সে করতে ভালোবাসে। একলা মানুষ। কত টাকাই বা লাগে এক পেট চালাতে। সাব বাড়ির সমিলে হিসাব কিতাবের কামও সে করে দেয় মাঝেমধ্যে । ম্যানেজার কুমিল্লার। বাড়ি চলে গেলেই বেচারি যাওয়ার আগে রামিজকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়। সে সেটা ভালমতই সামাল দেয়। দিনের রুজি যা আসে তাই পায়। সমিলে ম্যানেজাররা নামে মাত্র। উপরি তাদের জুটে না তেমন। যাই বা আসে তা বড় কামলা ছোট কামলারা ভাগাভাগি করে আসলে থাকে না কিছুই। দিনশেষে উলটা ম্যনেজারের পকেট থেকে চা খাওয়াতে হয়। রামিজের কামেকাজে খুশি হয়ে সাব বাড়ির ছোটসাবজাদা তাকে পুরা দায়িত্ব নিতে কয়েকবার বলেছিলেন, সামনে পেলে বলেন এখনো। তাকে দায়িত্ব দিলে মালিকের লাভটা হল , কারখানায় কোন গন্ডগোল নিয়ে মালিকের টেনশন নিতে হয় না। এলাকার ছেলে বলে নয়, খুব দ্রুত মানুষকে যার যার দায়িত্ব দিয়ে কাজ আদায় করতে দক্ষ সে। এই গুণটা তার যে আছে সে জানে। সমিলে শুধু নয়, বাজারে লেবু মিয়া ডাক্তারের হ্যাচারির হিসাব নিকাশের কামও সে করে দেয় । আবার মাঝেমধ্যে সাওন্ড বক্সের দোকানদার সুকেন্দুর সহকারি হয়ে স্পিকার, মাইক ,বক্স নিয়ে নানান জায়গায় গেছে। কোন কামে ভাল না লাগলে এখনো যায়। চা পান ভাড়াভুড়া দিয়ে সুকেন্দু যা দেয়, মন্দ না, চলে যায় আর কি ।
চোরাই বাতাস দিচ্ছে। রাস্তায় থাকতে বুঝা যায় নি। তার গায়ে জ্যাকেট আছে । সাইকেল চালালে খোলা কান দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকে। মাঝেমধ্যে তীব্র বাতাসে কানের পর্দা কাঁপিয়ে দেয়। চিন চিন ব্যাথা করে। তবু সে কানটুপি পরবে না। এইটা পরলেও তার চান্দি গরম হয়ে যায়।
চারপাশে বেশ কিছু জায়গা নিয়ে খোলামেলা প্রকৃতি। আজ বৃষ্টির পর কুয়াশা কম দেখা যাচ্ছে। অন্য দিনের মতন ঘোলা দুধের দৃশ্য নাই। রোদ মনে হয় আজ একটুক্ষণের জন্য হলেও দেখা দেবে। বৃষ্টি দিয়ে কুয়াশা কাটিয়ে দিয়েছে তো। আশপাশের ভিটাবাড়িগুলোর উপর কুয়াশা যেন পাতলা রেশমের জাল ফেলেছে উপর থেকে । আবছা আবছা ভাসা ভাসা। আইলের উপর বসলে মন্দ হতো না। কিন্তু ভিজা আইল, জুতা খুলে তার উপরও পাছা ফেলে বসা যেত। সেটাও সম্ভব না, শীতের বৃষ্টির পানি জমিনে সামান্য যা জমেছে সেটা দেখে লোভ সামলাতে পারে নি। জুতাসহ ভিজিয়ে দিয়েছে। আপাততো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই থাকবে।
জ্যাকেটের প্যাকেট থেকে খোলা কাগজে বাঁধা সিগ্রেট আর লাল রঙের লাইটারটা বের করে। হাতের তালু নেতিয়ে পড়ছে শীতে। সিগ্রেটটা ধরিয়ে সে দুই হাতের তালু হালকা ঘষবার মন স্থির করে। এখন বেইল কটা বাজতে পারে। ঘর থেকে সাড়ে নয়টায় বেরিয়েছিল। দশটার আশপাশ হবে। মোবাইল বের করে ঘড়ি দেখতে ইচ্ছা করে না। আজ কাজে যাবে নাকি যাবে না তা নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ও না। থাকুক একটু সময়।
সিগ্রেটে টান দিতেই সকালবেলায় খেয়ে আসা গরম ভাতের সাথে ডিমভুনার ঘেরানটা ঢেঁকুর দিয়ে মুখে চলে আসে। তরকারির স্বাদটা মুখে ফের আসতেই তার সাময়িক বিষণ্ণতা অল্প সময়ের জন্য যেন পাশ ফিরে থাকে। দারুণ রান্না হয়েছিল। কড়া ঝাল, পেঁয়াজ কম, রসুন একটু বেশী, সাথে বাঁধাকপি কুচি করে কাটা । রাঁধতে খুব একটা মন্দ নয় সে।
ডিম ভুনার ঘেরাণ ধীরে ধীরে জিভ থেকে বেয়ে বেয়ে পাকস্থালীর নীচে চাপা পড়ে যেতেই ফের তার পুরান বেমারটা চাগিয়ে উঠে। অথচ আহামরি এমন কিছু না। স্মৃতির ঝাঁকা থেকে আচমকা ঝাঁকার মুখ ফস্কে ধুপ ধাপ ধুপ ধাপ আপেলের ঢল মাটিতে পড়ে। এখন কোন ফলটা হাতে নেবে –এই ঢলের মধ্য থেকে সে দিশা করতে পারে না। সব গুলাই সমান। রঙ, সাইজ, স্বাদ- একই।যে আপেলের ডাটার কাছে লাল প্রজাপতি আলতো করে দাঁত দিয়ে কামড় বসিয়েছিল, আসলে সেটাই খোঁজে সে। সব আপেল মাটিতে ফেলে একটার পর একটা বাছতে পারতো। কিন্তু করে না। কয়েকটা নাড়াচাড়া করার পর তার ক্লান্তি চলে আসে।
******
চন্নি রাতে একবার হঠাত করে আউলা ঝাউলা বাতাস দিল। কার্ত্তিক মাসের চ্যাপা গরমের দিন। আসমান ঝকঝকা। চাঁদ তার খোপ থেকে বেরিয়ে বগুলা পাখির মতন ধবধবে সাদা ,বিশাল একজোড়া ডানা বের করে পুবদিকে বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে উড়তে আরম্ভ করে দিয়েছে। বাতাসে কাচা মাটির ভুরভুরা গন্ধ। উঠানজুড়ে বাঁশঝাড় , ঘন কাঠালগাছ। দিনের বেলাতেও ছায়া ছায়া থাকে। রোদ পড়ে কম। গন্ধরাজের কড়া গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারে। এই ফুলের ঘ্রাণ শুকে শুকে আটালি সাপ চলে আসে। পাখি ডাকে- কাঠল পাকে কাঠল পাকে। কাঁঠালের সিজন নয়, তবু ডাকবে। এই পাখি বারো মাস ডাকে । নির্জন উঠানে চাটাই পেতে একা বসে থাকে শিশু রামিজ। ন্যাংটা। সাপের কথাটা তার মাথায় আসতেই সে আরো গুটিয়ে আসে। মাটির বেড়ার ঘর। টিনের পেটানো দরজা। হাট করে খোলা। হু হু বাতাসে ঘরের দুই পাল্লার টিনের দরজা “কা……ত কা……ত” শব্দ করে একবার ভাঁজ মেলে তো আরেকবার বন্ধ হয়। ঘরের ভিতর একটা লেমটন জ্বলা। কাঁঠালের বাকলের মতন ধুসর ,আবছা আলো। মাটির দেয়ালের রঙের সাথে আলোটা মিলেমিশে গেছে। যেন ঘর নয়। নির্জন অরণ্যের ভিতর এক মাজার। শিশু রামিজের সামনে এবার গন্ধরাজ ফুলের গাছের আড়াল থেকে দুইটা সাদা শাড়িপরা নারীর আবছা শরিল উদয় হয়।
ঠিক সে মুহূর্তে বাঁশঝাড় নুয়াতে নুয়াতে উঠানের উপর পড়ে যায় প্রায়। কাঁঠাল গাছের পাতা সর সর সর সর করে আচমকা ঝরতে থাকে। তুমুল বৃষ্টির মতন। যেন বড় কোন মেশিনের পেট থেকে ফর ফর করে সবুজ পাতা লাল পাতা ধূসর পাতা একসাথে ঘরের চালে , দেয়ালে ,খোলা উঠানে এসে আছড়ে পড়ছে। কার্ত্তিক মাসের অমন ভালাসাংগা দিনে হঠাত বৈশাখি বাতাস আসল কেন। ছোট্ট রামিজ এইসব দৃশ্যের মধ্যে পড়ে ঘোরগ্রস্ত হয়ে যায়। সে ভয়ে “আম্মা আম্মা” ডাক দিয়ে কাঁদতে শুরু করে। দৌড়ে উঠান থেকে বারান্দা –বাতাসে জোড় লেগে যাওয়া দরজা হাট করে খুলে ঘরের ভিতর ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় । কাঁঠালের বাকলের রঙ ক্ষয় হতে হতে একটা বিন্দুতে এসে ঠেকেছে। ঘরের ভিতর দমকা বাতাস ঢুকে। দরজার চৌকাঠ ধরে ন্যাংটা রামিজ প্রায় অন্ধকার হয়ে আসা চিরচেনা তাদের ঘরের ভিতর চেয়ে থাকে। আম্মা আম্মা বলে জোরে চেঁচায় । মাজারের নিস্তব্ধতা তার সামনে। মানুষ মরে গেলে বোধ হয় আলোর আর দরকার পড়ে না। অন্ধকার আর মৃত্যু কি যমজ ভাই ! একজন ডাকে অপরকে ! আয় ভাই আয় ! রামিজের কান্না কি একটুক্ষণের জন্য থেমে যায় !
জানে, তার আম্মা ঘরে নাই। বাজারে গেছে। মসলা পিষতে । আর একটু বড় হওয়ার পর সে জানতে পারবে ,তার আম্মা শুধু মসলাই পিষতো না । রাবেয়ার মা যে কাম করতো তার আম্মাও তাই করতো। কিন্তু মাত্র ক বছরের শিশুকে এইভাবে একা ,শূন্য ঘরে রেখে কোন মা কি পারে রাতেরবেলা বাহিরে থাকতে ! ঘরের দেয়ালে লটকানো কাবা শরিফের ফটো ,কাচের ফ্রেমে বাঁধা- বাতাসে দুলে। আলনায় রাখা সাদা জরির এক টুকরা কাপড় বাতাস এসে আছড়ে পড়ায় উড়ে যায়। মনে হয় সাদা বগুলা পাখি দেয়াল ফুড়ে বেরিয়ে যাবে। যেন কাপড়ের টুকরাটা তার মাকে বাজার থেকে তুলে আনবে। যেভাবে আলিফ লায়লার রানি কুহেকাফ থেকে তুরকিস্থান পর্যন্ত গিলাবে চড়ে পাড়ি দেয়।
লেমটনের মুচি মুচি আলো , কাঁঠালের বাকলের মতন ক্ষয়াটে ধূসর যার রঙ, প্রায় নিঃশেষের পথে। পুরা অন্ধকার হয়ে গেলে হয়তো অন্ধকারই রামিজকে গ্রাস করবে। তার পিছন পিছন ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে সাদা শাড়িপরা দুই নারী, যারা এইমাত্র গন্ধরাজ গাছের তলে উবু হয়ে বসে চামগাছের বড় টুকরার উপর লোহার যাতা দিয়ে হলুদ মরিচ পিষছিল। রামিজ মসলা পিষার শব্দটা শুনতে পায় নি নাকি অস্পষ্ট একটা কিছু শুনেছিল ! বাতাসের তোড়ে সে শব্দটা হারিয়ে ফেলেছিল হয়তো। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা রামিজের নাকে এসে এইবার বাটা হলুদ মরিচের ঝাঁঝ এসে ঝাপট মারে। তার নাকের ভিতর সুড়সুড় করে মসলার স্রোত ঢুকে পড়ে। এইবার শুরু হয় আচমকা স্রোতের ঢল থেকে বাঁচবার জন্য বাচ্চা কাচ্চা হাড়ি পাতিল কুকুর মেকুর দলিল দস্তাবেজ দেনমোহরনামা অলংকার নিয়ে ছুটাছুটি। হাচ্চি … হাচ্চি…হাচ্চি……। অনবরত হাঁচি দিতে দিতে পরে কি হয় ,বাদ বাকী আর মনে নাই তার।
*****
সে যখন পরবর্তীতে নিজেকে আবিষ্কার করে , দেখে শুয়ে আছে পাশের বাড়ির সে চাচি বলে ডাকতো যে নারীকে, তার খাটে। ছনের চাল। মাটির বেড়ার উপর ঘরের বর্গা গলে ঢুকে পড়েছে কয়েক টুকরা রোদ। কোনোটা ছোটখাটো পরোটার মতন। কোনোটা সিংগারা। কোনোটা আবার বেখাটা বেগুনির মতন। রোজা মাসে ইফতারির সময় বাজারে বেগুনি বেচে। তার মা সন্ধ্যার আগে আগে কাম কাজ শেষ করে ঠোঙায় করে বেগুনি পিঁয়াজি চানা আনতো ।মচমচা বেগুনির সে কী স্বাদ ! গরম পুলাবের সাথে ডিমভুনার ঝোল সাথে মচমচা বেগুনি ! আহা !
আস্তে আস্তে বাড়ির কলরব শুনা যায়। এ বাড়ির ছেলেমেয়েরা, যারা তার বয়সী, খেলার সাথী- তারা কথা বলে। পাকঘর থেকে রুটির খামি করবার শব্দ আসে। পিঁড়ির নীচের দিক পরিষ্কার করে বাঁশের চোঙা দিয়ে রুটির আকার দেয়া হচ্ছে। মাটিতে পিঁড়িটা সমান জায়গা পায় নি। চোঙা আগে পিছে করলে বারবার পিঁড়ির কোণা শক্ত মাটিতে পড়ে শব্দ করছে। ঠক ঠক ঠক ঠক। কিন্তু রামিজ এ বাড়িতে কেন ! তার নিজের বাড়িতে সে কেন নাই ! গত রাতে তার মা কি তবে আর বাজার থেকে ফিরে নি ! এরকম হয় নি কোনদিন । এশার আযানের পরপরই তার মা চলে আসতো। তার মায়ের কি কোন দুর্ঘটনা ……বলাতো যায় না। তবে এমনি কোন বেমার আজার তার মায়ের শরিলে নাই।
আট বছরের একটা বাচ্চার জন্য তার মার ফেলে চলে যাওয়াটা দুর্ঘটনা নাকি জীবনের স্বাভাবিক একটা অংশ- এটা আসলে বড় হওয়া পর্যন্ত তেমন করে তাকে প্রভাবিত করতে পারে না। তার জানাশুনা কত জনের মা এইভাবে বাচ্চা ফেলে আরেক সংসারে গিয়ে উঠেছে। বাচ্চা পয়দা করছে। এটা হতেই পারে। তার নানী না থাকলেও সে মনে করে তার বড় হতে তেমন কোন অন্তরায় হতো না। আট বছর বয়সী ছেলে , যে হাত দিয়ে ভাত তুলে খেতে পারে , হাগলে ধুইতে পারে – তার জন্য গোটা দুনিয়াটাই হল নিজের বাড়ি ঘর। পিছুটান না থাকায় সে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারে।
কয়েক বছর পর তার মা যখন গর্ভকালীন অবস্থায় মারা যায়, খবর পেয়ে সে মায়ের লাশ দেখতে গেছিল । তার সৎ বাপ তাকে সামনাসামনি পেয়ে একটিবার ভাল মন্দ কোন কিছুই জিজ্ঞেস করে নি। কপালের ডানদিকে ভুরুর ঠিক আধা ইঞ্চির চাইতেও আরো কম উপরে এক ফালি কাটা সেলাইর দাগ। প্রায় এক আঙুল বরাবর লম্বা – চিরে মাথার চুলের দিকে ঢুকে গেছে। তাকে দেখলেই তার কাটা দাগটা সবার আগে চোখে পড়ে। যেন তাকে জানার প্রধান নিশান এটাই। মাথাভরা চুল, মার্বেল খেলায় গুট্টি নিশানা করার আগে , ভেজা বালির উপর স্থির , নিষ্কম্প ,জ্বলজ্বল করা ভীড়ের মধ্যে একা , কালো মার্বেলের মতন চোখ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কি হবে না হবে বুঝবার কোন উপায় নাই। যেন চোখের ওপাড়ে লাল দাউদাউ করা এক জঙ্গল ছাই থম ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শাদা ফর্সা মুখ, খাড়া নাক। তার মা যে ঘর ফেলে আট বছরের অবোধ বাচ্চা ফেলে এটার সাথে ঘর করেছে তার একমাত্র কারণ কি তার রুপ। মানুষ রুপের জন্য এত পাগল ! এইটা জানার পরও যে এই লোকটা এর আগে তিন বিয়া করেছে। তিন বউয়ের এক বউ পালিয়েছে আরেকজনের হাত ধরে। অন্য বেটিমানুষ জানুক কিংবা না জানুক, অন্তত তার মায়েরতো বেটামানুষের চাল চরিত্র সন্মন্ধে একটু বেশী জানবার কথা ছিল। ছিল না ! যে বেটিমানুষ নিজের শরিল বেচে প্রতিদিন নানান জাতের বেটামানুষের সাথে শোয়, সে বেটামানুষ সন্মন্ধে জানবে নাতো কে জানবে ! কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেটি রুপের মোহে ঘর বাড়িতো ছাড়লই, নিজের জীবনও দিল। “যা চুতমারানি মর গিয়া !”
****
মরা বাড়ি হলে ভীড় ভাট্টা, কান্নাকাটি ,চিল্লাচিল্লি এইসব থাকবে – এটাই স্বাভাবিক বলে আগে থাকতে এরকম একটা দৃশ্য রামিজ চোখের সামনে গেঁথে রেখেছিল। গিয়ে দেখে বৃষ্টিধুয়া উঠানে একা একজন মুরুব্বি লাকড়ির চেয়ারে বসা। মাথায় টুপি। ময়লা সাদা পাঞ্জাবি গায়ে। ইটের বাড়ি টিনের চাল। প্রায় সুনসান নৈঃশব্দতা। বিশ্বাস হয় না এ বাড়িতে কেউ মরেছে।
উঠানের চারপাশে ঘন সবুজ চাল কুমড়ার ঝাড় । মাটি থেকে এমন লতিয়ে উঠেছে- বারান্দার পুরো সামনা অংশ ছেয়ে গেছে ঝোপে। এইসব কি তার মায়ের হাতে লাগানো ! মনে হয় না। তার মা ক্ষেত গিরস্তি একদম পছন্দ করতো না। সব সময় টাওনের বাসা বাড়ির সাহেবের বউদের মতন পরিপাটি হয়ে থাকতে ভালবাসতো। মুখে স্নো পাওডার মাখা সব সময় । ঠোটে লিপিস্টিক মাখতো লুকিয়ে । মুরুব্বি কেউ সামনে পড়লে আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে কথা বলতো। চুলের খোঁপা যখন ভাঙতো মনে হতো বিশাল এক ঝাঁক চিরকারি পাখি আসমান থেকে আচমকা ঢেউ খেলিয়ে মাটিতে নামছে। এত সুন্দর চুল ছিল তার মায়ের। বিশাল গোছা। রাতে ঘুমের সময় বেলী ফুল ঘ্রাণের নাড়িকেল তেল মাখতো। গোটা ঘরটা ফুলের ঘ্রাণে ভেসে যেতো । রামিজ ভয় পেতো তখন। তার মনে হতো এই তেলের ঘ্রাণ শুকে শুকে হয়তো বিষধর আটালি তাদের ঘরের ভিতর চলে আসবে। লেমটনের হলুদ সোনালি আলোর ভিতর সে বিছনা থেকে তার মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতো। দেয়ালে লটকানো ছোট আয়নার সামনে। পাকা পেঁপের মতন ধবধবে গায়ের রঙ। শরিলে শাড়ি নাই। বুকের উপর কালো পেটিকোট। আসলে ওইটার নাম পেটিকোট না। রামিজ বড় হয়ে জেনেছে। তার পড়ালেখা না জানা মা ব্রাকে বলতো পেটিকোট। আর পেটিকোটকে সায়া। মাটিয়া রঙের সায়া আর কালো ব্রা পরা লম্বা নারীটা কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মায়ের চিরচেনা শরিল থেকে আলাদা হয়ে যেতো যেন। ছোট্ট রামিজ বালিশ থেকে মাথা তুলে বসে যেতো । নিশুতি রাতজুড়ে যে পাখিটা ডাক দিয়ে দিয়ে উড়ে বেড়ায় তার নাম গাওয়ালি ভাষায় বলে কাঠল পাকে পাখি। এই পাখির শুদ্ধ নাম আজও জানে না রামিজ। কাঁঠালের সিজন মাত্র দুই মাস থাকে। কিন্তু এই পাখি ডাকে সারা বছর। সকালে দুপুরে নিশুতি রাতে। যতবার শুনো কোনবারই তার ক্লান্তি লাগে না। হলুদ আলোর মধ্যে তাদের মাটির দেয়ালের ঘরে আলিফ লায়লার অপরুপ সুন্দরী যে নারী নগ্ন হয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছে সেটা যে আসলেই ভ্রম নয় বাস্তব – “কাঁঠল পাকে” পাখির ডাকটা ভেসে আসলেই ঘোর কাটতো তার। বাতাস বইছে হু হু করে। আশ্বিন মাসের ভরা চন্নির রাত। ঘরের বর্গা চুইয়ে চন্নির আলো ঢুকছে উচ্ছল করা এক ঝাঁক সাদা ধবধবা সরপুঁটির ঘাই দেয়ার মতন।
রঙিন একটা শাড়ির নীচে লাশ রাখা। হতে পারে সাদা কাপড় এ বাড়িতে নাই। লাশের উপরে সাদা কাপড় দিতেই হবে এমন নিয়ম আছে কি ! জানা নাই তার । বারান্দায় শোয়ানো। কাঁচা বাঁশের চাটির উপর রাখা। রামিজকে সকালবেলায় যে নারী ফোন দিয়েছিল সে হয়তো তার মায়ের স্বামীর দুই নাম্বার বউ। এক নাম্বারও হতে পারে । কণ্ঠের মধ্যে অদ্ভুদ একটা নেশা আছে। শুনলে ঘোর ঘোর ভাব লেগে থাকে। কালিয়ারা মাছ যেভাবে ঘাই দিতে দিতে অতল জলের নীচে হারিয়ে যায়, আর তার পিছন পিছন মরণের ফাঁদে আটকা পড়তে ধাওয়া করে যে মানুষ- তাকে কি আর ডাঙার রুপকথা দিয়ে ভোলানো যায় ! ভোলানো সম্ভব ! রামিজ কি একটু হলেও অস্বীকার করতে পারে সে আসলে তার মায়ের লাশ দেখতে যতটা তার চাইতে একটু কম হলেও অন্ততো সিকি পরিমাণ আরেকটা আশা নিয়ে এখানে এসেছে । কেন ? সেই কণ্ঠের মধ্যে কি এমন আছে যে সে ধাওয়া করতে করতে মরণফাঁদ পর্যন্ত পেড়িয়ে যেতে রাজি আছে। আজ সকালে যে নারী তাকে ফোন দিয়েছিল তার কণ্ঠ কি সত্যি সত্যি সে যেরকম কল্পনা করছে সেরকম ছিল ! নাকি এইসব আসলে তার নিজের তৈরি করা ভ্রম !
তার মা যেদিন তাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিল- তখন কার্ত্তিক মাস ছিল ঠিকই, কিন্তু আচমকা দমকা বাতাস, উতলা চন্নি , কাঁঠাল পাতার ঝড় এইগুলা সত্য কিনা তা নিয়ে আজো সে এর কোন কূল কিনার করতে পারে না। পরদিন সকালে সে তার নিজের বাড়ির উঠান গিয়ে দেখে কাঁঠাল পাতা এখানে ওখানে দু চারটা পড়ে আছে, যেভাবে প্রতিদিনই পড়ে থাকে। কিন্তু সেতো আশা করেছিল পাতার ভারে পুরা উঠান সাফ করতে গোটা দিন লাগতে পারে । নাকি কেউ ঝাড়ু দিয়ে ফেলল ! কিন্তু কার অত ঠেকা পড়েছে নিজের বাড়িঘর, গিরস্তি ফেলে অন্যের উঠানভরা কাঁঠালপাতা ঝাঁট দিয়ে সাফসাফা করে দিতে ! তোলপাড় করা দমকা বাতাস আর আউলা চন্নি নিয়ে সে অসংখ্যবার প্রতিবেশী চাচিদের খালাদের জিজ্ঞেস করেছে। তার কথা শুনে তারা উলটা হেসেছে। “কার্ত্তিক মাইয়া দিনো বৈশাখ মাইয়া তুফান আইব কিলা ! পাগল না কিতা ইগু ! “
****
নাকের নথটা না থাকলে হয়তো তার মাকে সে চিনতোই না। চাপাচুপা ভাঙা, চোখের নীচে ঘন কালির আস্তর লেপা। সেই কোমরছাপানো চুল কোথায় ! ক গাছি পাটের শুকনো সুতলি অবশিষ্ট আছে। এই তার মা ! খোলা বারান্দায় চাটির উপর শোয়ানো । রঙিন ময়লা একটা শাড়ি দিয়ে আপাদমস্তক ঢাকা। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে তার মায়ের এ পক্ষের তিন সন্তান। তিনটাই মেয়ে। পেটে যে এসেছিল সেও মেয়ে কিনা কে জানে ! সবচাইতে বড়টার বয়স কত হতে পারে ! বারো তেরো। অবিকল বাপের চেহারা। খাড়া নাক, বড় বড় গোল চোখ। রামিজের দিকে স্নেহভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। এখন পর্যন্ত রামিজকে কেউ এসে কিছু জিজ্ঞেস করে নি। এ বাড়িতে যে একটা মানুষ মারা গেছে ,পরিবেশ দেখে তা বুঝবার কোন উপায় নেই। বাড়ির ভিতর থেকে কোন এক মহিলার গলা শুনা যাচ্ছে। কাউকে বারেবারে সাধছে ভাত খেয়ে ফেলার জন্য। একটু পরে মিয়াসাব আসবে , কোরান শরিফ পাঠ হবে, ভীড় বাড়বে, খাটিয়া আসবে, লাশ তুলা হবে। এইতো শেষ ! বাঁশি বেজে গেছে। মরতে হবে একদিন সকলকেই। একটুর জন্য কি রামিজকে ভাবনায় ফেলে দেয় ! মৃত্যু এই একটা জিনিস , ধনী গরীব যেই মুখামুখি হোক, উদাসী করে দেয় মুহূর্তের জন্য।
বাকী বোনগুলির দিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তাকানোর আর প্রয়োজন মনে করে না। তার মায়ের পেট থেকে বের হওয়া মানেতো তার বোন – তাই না ! কিন্তু বাপতো আলাদা। কিছুক্ষণের জন্য তার মগজের গু আবার তাকে উতলা করে দিতে চায়। বড় মেয়েটা কেমন ঢ্যাব ঢ্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দরজার চৌকাঠে হেলান দেয়া। সাদা একটা জামা গায়ে। দুধ দেখা যাচ্ছে না। তার বুক সমান খাড়া হয়ে আছে বাকী বোনগুলো। হয়তো দুধ উঠি উঠি করছে। কিন্তু রামিজের মগজের গু’র দলা এইবার কিছুক্ষণ এক জায়গায় এসে থামে। হঠাত ফিনকি দিয়ে তলপেট থেকে মগজে চলে গিয়েছিল। একটু শান্ত হলে তার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। বাকী বোন দুইটা উদলা গায়ে। একটার নাক দিয়ে ঝোল পড়ছে। দুজনেই প্রায় পিঠাপিঠি। একটার কান বরাবর আরেকজন। শরিলে ময়লা স্পষ্ট। মার অবর্তমানে এদের যে অযত্ন আর অবহেলার মধ্য দিয়ে বড় হতে হবে –এইটা কি রামিজকে একটুর জন্য হলেও সাময়িক চিন্তার মধ্যে ফেলে দেয় ! তার মগজ থেকে কি গু’র দলা টিওবওয়েলের পিস্টনের নীচের দিকে নেমে যাওয়ার মত এক টানে তলপেটের মধ্যে চলে গেছে ! তিনজোড়া অসহায় পশুর চোখ তাকে কি একটুক্ষণের জন্য কাতর করে দেয় ! কিন্তু যার কণ্ঠ তাকে এতদূর ধাওয়া করে এনেছে সেই নারীটি কোথায় ! রামিজ আসলে কি চায় ! ঐ নারীর সাথে সংগম করার কল্পনা তাকে আসার পথে কি উতল করে দেয় নি ! একটু পরে যে লোকটার সাক্ষাত সে পাবে , যার কপালের কোণায় গভীর কাটা দাগ , তার দ্বিতীয় নাকি তৃতীয় বউকে ভাগিয়ে নিয়ে সে কি তার মাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে চায় ! মগজে ওইটা আবার উঠে গেছে । সে আসলেই দ্বিধায় পড়ে গেছে, তাকে নারী কণ্ঠ কেউ ফোন দিয়ে তার মায়ের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল কিনা । মোবাইলে নাম্বার ছিল। ব্যাটারি বদলাতে গিয়ে ডিলিট হয়ে গেছে সব। তলপেটের গিজ গিজ করা গু মাথায় উঠে তাকে সত্যি সত্যি হয়তো পাগল বানিয়ে ছাড়বে।
****
সিগ্রেটের জ্বলন্ত আঁচ হাতের চেটোয় এসে লাগলে রামিজ চমকে উঠে। দুই টান দিয়ে সেই যে মনটা চলে গেল নানান বাঁক পেরিয়ে স্রোতহীন নদির গর্ভে , একে ফেরানো এতটা সহজ নয় এখন। মাঝেমধ্যে এমন হয়। মনে হয়, তার শরিলের ভিতর দশটা কুকুর ঘুম থেকে উঠে ছড়িয়ে পড়ে নানান প্রান্তে। কেউ আর তার ডাকে মুখ ঘুরিয়ে সাড়া দিতে চায় না। সে কেবল তাদের পিছনে ছুটতে থাকে ছুটতে থাকে। মন যেন এক অবাধ্য কুকুর।
আজ আর কামে যাবে না রামিজ। দেরি হয়ে গেছে এমনিতেই। ফোন করে জানানো উচিত অবশ্য , সে যে আসবে না। কিন্তু সে যে ফোন করবে না এটাও জানে সে। মিসতরিও জানে তাকে কোন অজুহাত দেখাবে না রামিজ। এখন সে বাড়িতেও যাবে না। মেঘলা আকাশ। রোদ আজ আর উঠবে বলে মনে হয় না। দূরের বাড়িগুলোর উপর কুয়াশা লটকে আছে, যেন ধূয়ার ওপাড়ে বিস্মৃত কোন গ্রাম।
প্রায় বিশ মিনিট সাইকেল চালিয়ে রামিজ নিজেকে আবিষ্কার করে ,সে দাঁড়িয়ে আছে পিরের বাজার। সামনে হাই ইশকুল । ইশকুলের সামনা রাস্তা দিয়ে একটু এগোলেই সুবল ডাক্তারের বাড়ি, সে বাড়ির পরের বাড়িটাই তার মৃত মায়ের বাড়ি। সে আবারও তব্দা লেগে যায়। এ পথে তো তার আসবার কথা নয় ! তারতো সেই ন্যাড়াক্ষেত থেকে উঠে বাড়ির পথে ফিরবার কথা। সেতো সে পথেই যাচ্ছিল । লোহার পুল পেরিয়ে বামে সাব বাড়ির নতুন ইট ভাটা পেরিয়ে ডাইনে পোস্টাফিস ফেলে বাজার হয়েইতো তার বাড়ির পথ – তাই না ! কিন্তু লোহার পুল পাড়ি দিয়ে সাব বাড়ির ইটভাটা মুখি রোডে না গিয়ে সে কেন ডাইনে কাচা রাস্তা দিয়ে ঢুকে ঘরগাঁও হয়ে গনিপুর হয়ে লংলা কলেজের সামনের রোডে এসে নামল ! আজব ! মেইন রোড ছেড়ে এতক্ষণ গ্রামের এবড়োথেবড়ো কাচা রাস্তা দিয়ে যে এতক্ষণ এলো, ডাইনে বায়ে নোয়াখালি ব্রাম্মণবাড়িয়া থেকে আসা টিনের বেড়া দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকা বস্তি , বস্তির হই হল্লা কাউমাউ কি তার চোখে পড়ে নি ! এইগুলাতো তার নিত্যদিনের আসা যাওয়ার পথে পড়ে না । ঐ নারীর কণ্ঠ তাকে এতটা বেভুলা করে দিল যে একটু আগে লংলা কলেজের সামনে মেইন রোডে পড়তেই একটা চলন্ত ট্রাক তার গা ঘেষে প্রচন্ড তুফানের মতোন ছুটে গিয়েছিল, মাত্র এক ইঞ্চি সামনে পেলে তাকে পিষে কিমা কিমা বানিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখতো, অথচ অদ্ভুদ কান্ড – সে টেরই পায় নি । পরে পিছন ফিরে ট্রাকের ড্রাইভার তাকে চিক্কার দিয়ে গালি না দিলে সে জানতোই না।
পিরেরবাজার, হাই ইশকুলের সামনে ,যেখান থেকে শুরু হয়েছে কাচা রাস্তাটা, যে রাস্তা দিয়ে সামান্য এগোলেই তার মৃত মায়ের বাড়ি- বন্ধ টং দোকানের খালি বাঁশের বেঞ্চে এক পা রেখে সাইকেলের সিটে বসা রামিজ সামনে কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যাওয়া নির্জন রাস্তাটার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ।
=================