স্যাক্রিফাইস, স্যাক্রিফাইস
মোহাম্মদ কাজী মামুন
(১)
‘অবশেষে সময় হল?’ গুনে গুনে পাঁচটা বিপ বেজে যখন ছয়ে ঢুকল, মিন্টু থামাল যন্ত্রটাকে।
‘কী করব! তোমাকে যদি দেখাতে পারতাম, সারাটা দিন কী গেছে আমার উপর দিয়ে! কত যে চেষ্টা করেছি….কিন্তু পারিনি! সমস্যা হল, এখানে ভিডিও করা তো দূরে থাক, ফোন-টোনও জমা দিয়ে আসতে হয়…এমন খাইস্টা প্রফেসর আগে …’ ওপার থেকে ঝড়ের বেগে ভেসে আসছিল মিলির কথাগুলো, কোথায় যেন একটা তাড়া, যেন এখনই কেটে যাবে লাইন, আর টুটে যাবে কানেকশান!
‘ সমস্যার কিছু নাই! এত্ত বড় একটা ডিগ্রী, এত বিশাল একটা সুযোগ! এটুকু তো মেনে নিতেই হবে! বলি কী, আমায় নিয়ে এতটা ভেব না। এখানে তো অনেক লোকজন আছে। আমি ঠিক সামলে নিতে পারব। আর যদি মরে-টরে যাই, তাও কবর দেয়ার লোক অন্তত পাওয়া যাবে! চিন্তা কর না।’
‘এই …এই…তুমি ঠিক আছ তো? …শেয়ারে বড় ধরণের লস-টস খাও নাই তো আবার!..তোমার তো…’ মিলি শেষ করতে পারে না, ওপাশ থেকে কল বাটনটা যেন তার বুকের উপর প্রেস করেই কেটে দেয়া হয়েছে। আনমনে তাকিয়ে থাকে মিলি করিডোরের সাথে লাগোয়া এক চিলতে জানালাটার দিকে; লোকজনের কান ও চোখ এড়াতে সে চেপে এসেছিল এদিকটায়।
(২)
বাইরে বিশাল প্রান্তর, চেরি আর উইলো গাছেরা সারি বেঁধে নাচছে। অথচ সেই নাচের চ্যানেলটির উপর ভেসে উঠেছে একটি পায়চারি করা বছর পঁচিশেক যুবকের দৃশ্য। এই যুবকটির সাথে পরিচয় তার যুবতী হয়ে উঠার আগেই। হ্যাঁ, ভার্সিটি থেকে বেরুনোর আগেই তাদের দুজনেরই মনে হয়, এভাবে আর আলাদা থাকার মানে হয় না; তাদের নিয়তি এক সাথে বাঁধা হয়ে আছে; সুতরাং, সময় নষ্ট করাটা বড় ধরণের নির্বুদ্ধিতা হবে! এরপর ডিপার্টমেন্টের আটাশতম ব্যাচের বিয়ের ডেব্যুটা যখন মিলিকে দিয়েই হল, তখন হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে গেল পুরো ক্যাম্পাসে! কেউ দিল বাহবা, কেউ বা তিরষ্কার! আর চলল আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা যা ছাড়িয়ে, ছাপিয়ে গেল বাড়িঘর-রাস্তা-বন্দর, যে অবসরে তারা মধুচন্দ্রিমার দিনগুলি সেরে নিল এবং তারপর ক্যাম্পাসে আবার ফিরে এল।
মানুষ হাঁ করে থাকলো আরো কিছুদিন। কিন্তু হু হু করে বাতাস ঢুকছিল আর ফুলে যাচ্ছিল তাদের বাকযন্ত্র! তাই তারা আবার আগের মত হল, সবকিছু আগের মতই ঘটতে লাগল। এমনকি মিলি যে নিজের ডিপার্টমেন্টে মেধা তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছিল , তাও অটুট রইল। শুধু মিন্টুর কিছুটা পরিবর্তন হল, সে তার ডিপার্টমেন্টে আরো কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেল। তবু সেই হালকা-পলকা ডিগ্রিটা নিয়েই মিন্টু চাকরি জুটিয়ে ফেলল একটি বেসরকারি লজিস্টিক কোম্পানিতে। যৎসামান্য আয়কে বড় করতে মিন্টু বেছে নিল শেয়ার বিজনেসকে। আর যা হোক, কেউ অস্বীকার করবে না যে সে অঙ্কে ভাল ছিল।
মিন্টু যখন চাকরীটা পায়, তখন বাড়ির সবাই ‘না না’ করলেও গলা জড়িয়ে মিলি বলেছিল, “ঢুকে পড়, এক্সপিরিয়েন্স নিয়ে পরে আরো ভাল কিছুতে ঢুকবে।“ মিলি তখন স্কোলারশিপের ফাইনাল চিঠির অপেক্ষায়। মিলি জানে, চান্স তার মিলবেই; তার রেজাল্টকে ডিনাই করতে হলে তার পুরো ডিপার্টমেন্টটাকেই অস্বীকার করতে হবে। শেষমেশ, যখন কানাডার একটি বড় ভার্সিটি থেকে চুড়ান্ত ডাক এল, আর বিশাল পাখা নিয়ে প্লেনটা শাহজালাল বন্দর থেকে তাকে ডাকতে শুরু করল, মিলি আবার জড়িয়ে ধরেছিল মিন্টুকে, ‘মাত্র তো দুইটা বছর! তাছাড়া ছুটি মিললেই তো চলে আসতেছি!”
মিন্টু মুখ ফুটে কিছু বলেনি; শুধু যখন প্লেনের ডানা রানওয়েতে তীব্র ঘর্ষণ সৃষ্টি করে উপরে উঠার শক্তি সঞ্চয় করছিল, তখন তার মনে এসেছিল কথাটা, “জীবন তো এমনই… ভালবাসা মানেই তো স্যাক্রিফাইস… এই মিলন… এই বিচ্ছেদ…আবার মিলন…!” তারপর কী, আবার বিচ্ছেদ? না, সেটুকু আর ভাবতে চায়নি মিন্টু। বিমান থেকে পিঠ ঘুরিয়ে বাসার দিকে হাঁটা দিয়েছিল। কিন্তু যতই দিন গড়িয়েছে, বিন্দু শুধু মেঘের দিকে তাকিয়েছে; কিন্তু কোন মেঘদূতের সন্ধান যখন আর মেলেনি, সে মনে মনে আওড়েছে মন্ত্রটা – ‘স্যাক্রিফাইস, স্যাক্রিফাইস!’
অবশেষে দুইটা বছর শেষ হতে যাচ্ছিল, এই গত সপ্তাহ পর্যন্ত মিন্টু তা-ই জানতো। কিন্তু মিলির সামনে আরো একটি স্কোলারশিপ এসে দাঁড়িয়েছিল – তার অসম্ভব ট্যালেন্ট এবার তাকে ডাকছে লন্ডন থেকে। আর এই খবরটা যখন দিচ্ছিল মিন্টুকে, এক ফাঁকে এও বেরিয়ে পড়েছিল মিলির উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ থেকে, ‘বউকে নিয়ে গর্বিত হওয়া উচিৎ তোমার!” গর্বিত হয়েছিল মিন্টু, তবে সাথে সাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রটা আবার পড়ে নিয়েছিল, ‘স্যাক্রিফাইস! স্যাক্রিফাইস!’
এই স্যাক্রিফাইসের চড়া মূল্য ধরা ছিল বলেই কিনা, মিলি এরপর আরো দূরে চলে গেল! আগে দিন প্রতি দু’তিনটা কল বরাদ্দ থাকলেও, এখন একটা আস্ত সপ্তাহকে খামচি মেরে ধরেও কোন কল জুটছে না। এই স্কোলারশিপটা আগেরগুলো থেকেও প্রেস্টিজিয়াস, আর তার নিয়মকানুনও কড়া। মাঝে-মধ্যে অবশ্য মিলির এক-আধটা কল বিদ্যুত-চমকে দিচ্ছে মিন্টুর ওয়ালেটকে; আর একটা দিগ্বিদিক কালবৈশাখীর ঝাপ্টা এসে লাগছে মিন্টুর বুকে! আর মুচড়ে দিচ্ছে তার মনের মানচিত্র!
(৩)
এই নিয়ে টানা তৃতীয়বার ফোনের আর্তনাদ কোন সাড়া পেতে ব্যর্থ হল, আর মাথা ঠুকে পড়ল মিলির গোলাপি স্কার্টের ফুল তোলা জমিনটাতে। এমন কিছু ভারী নয়, কিন্তু সারা শরীর কেঁপে উঠে মিলির। কখন যে আগুনের হলকা বেরোয় সেখান থেকে! জ্বলন্ত লাভা যেন ফণা তুলে আছে! যেকোন সময় ফুঁসে উঠবে! আর গলিত কুন্ডে ভাসতে থাকবে মিন্টুর দেহখানা!
হাত-পা’গুলো পুরো অবশ হয়ে যায় মিলির! করিডোরের জানালাটা থেকে সে সরে আসে তীব্র একটা ঝাঁকুনি খেয়ে! তার দুচোখ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে! অল্পকিছুক্ষণেই যে ঘনঘোর বর্ষা নামতে থাকে সেখানে, তাতে একা একাই ভিজতে ভিজতে বেরিয়ে পড়ে সে মহাকাশের ইনকিউবিটরের মত দেখতে কম্পাউন্ডটা থেকে!
(৪)
বৈশাখি ঝড়ে লন্ডভন্ড শহর! খুব পুওর সিগনালের জন্য গতকাল মিলির লাইনটা কেটে যায়! এরপর তো ফোনের চার্জই চলে যায়! ততক্ষণে ঝড়ের হাওয়া তাকে হিপনোটাইজ করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। আসলে মিলির মধ্য দুপুর হলেও মিন্টুর ছিল মধ্যরাত। তারপর একটা মড়া-ঘুম দিয়ে উঠে সকালে যখন চার্জ দিয়েছে তার যন্ত্রটা, বন্যার স্রোতের মত হুড়মুড় করে ঢুকতে থাকে মিলির মিসকল মেসেজগুলো। তবে আরো চমক অপেক্ষা করছিল, ডাটা অন করতেই আলাদিনের দৈত্যের মত ভেসে উঠল একটা কল বার্তা হোয়াটসঅ্যাপে। আনন্দের থেকেও বেশী অবাক হয় মিন্টু! তার সারা দেহে একটি শিহরণের স্রোত বয়ে যায়! এ কি সত্যি? না কি স্বপ্ন?
বাটনটা শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে সে, আর সঙ্গে সঙ্গে ওপার থেকে ভেসে আসে মেঘদূতের বাণী, ‘ খুব জরুরী কথা – শেষ করার আগে দয়া করে কাটবে না। আমার কোর্ডিনেটরের সাথে কথা হল এইমাত্র। তোমার লন্ডনে আসার সব ব্যবস্থা করবেন তিনি। তোমার জন্য ভাল একটা জবও দেখবেন। এখন ভেবে দেখ, কি করবে তুমি! যদি তুমি না আস, তাহলে আমি ফিরে আসছি ঢাকায়। মানে, হয় তুমি লন্ডনে, না হয়, আমি ঢাকায়… এ দুটোর যে কোন একটাই শুধু হবে… এর বাইরে আর কিচ্ছু হবে না!“
ফোনের এপারে মিন্টুর মুখে কোন উত্তর যোগায় না; শুধু একটা অস্ফুট স্বর বেরিয়ে আসে যা তার নিজের কানেও প্রবেশ করে কিনা সন্দেহ, ‘স্যাক্রিফাইস, স্যাক্রিফাইস!’
(সমাপ্ত)
**********
মোহাম্মদ কাজী মামুনের জন্ম ফরিদপুরে। পৈত্রিক নিবাস শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলা, তবে মাদারিপুর জেলার শিবচর উপজেলায় অবস্থিত নানাবাড়িতেই শৈশবের আনন্দমুখর সময় বেশী কেটেছে। এসএসসি আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ, এইচএসসি ঢাকা কলেজ, বিবিএ ও এমবিএ (অনার্স) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্ট থেকে সম্পন্ন হয়েছে। এমবিএ পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার আগেই একটি বেসরকারী ব্যাংকে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে যোগদান, বর্তমানে ঐ ব্যাংকেরই একটি শাখার প্রধান হিসেবে কর্মরত। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে আর্থিক বিষয়াদির উপর আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় ও পেইজে কিছু ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছে। বাবা জাজিরা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। বাবার একটি ব্যক্তিগত ছোট লাইব্রেরী ছিল যার বই-পাঠ শৈশবেই সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে, আর কৈশোরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাথে যোগযোগ সেই সাহিত্যপ্রেমকে আরো উস্কে দেয়। এখন পর্যন্ত কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। দিবারাত্র নানান ভাবনা মস্তিষ্ককে আলোড়িত করে রাখে, লেখালিখির মাধ্যমে যাপিত সমাজ-জীবনে যৎসামান্য ভূমিকা রাখার আকাঙ্ক্ষা বাসা বেঁধে থাকে মনের গহীনে।
==================