You are currently viewing কেবা শোনাইল শ্যামনাম >  রাখি সরদার

কেবা শোনাইল শ্যামনাম > রাখি সরদার

কেবা শোনাইল শ্যামনাম 

রাখি সরদার

 

ক’দিন পর শ্যাম বিলাসিত মেঘ সরে গিয়ে, রূপালি চাঁদ ঈষৎ হাসিমুখে  উঠেছে। সেই অনন্ত জ্যোৎস্নার রূপ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎই রাতদুপুরে  জ্বর এল ঝমঝমিয়ে ! তাপে উত্তাপে দেহ পোড়ানো  

জ্বরের ভিতর পৃথিবীর সব পথ, সব ঘাস,সব ঘরবাড়ি তেতে ওঠে প্রলাপের সুরে !শরীর কাঁপছে,দুলছে আকাশ। সন্ধ্যামণির আলগা  ঝোপে ঝরে পড়ছে চাঁদের টুকরো। মাথার ভিতর ঝনঝন শব্দে উল্কাপাত চলছে । সমগ্র চেতনায়, সমগ্র শরীরে হামাগুড়ি দিয়ে নামছে জ্বরের ঘোর। জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে কোথাও যেন একটা ময়ূরী অতি কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল। সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তীব্র উত্তাপে ক্রমশ যেন হাল্কা পাখি দেহ হয়ে পড়ছি। তবে কী হাল্কা হতে হতে বাষ্প হয়ে যাব ! বিছানার চারিপাশ ঘিরে ধরছে নিরামিষ পিঁপড়ের সারি। গলা শুকিয়ে আসছে ,কোন শব্দ বের হচ্ছে না। এমন দুঃসহ মুহূর্তে কার শীতল হাতের পরশ কপালে উঠে এল ! কী স্নিগ্ধ ! তার নিঃশ্বাসে টলটলে চন্দন সুগন্ধ। শুকনো ঠোঁটে বুলিয়ে দিচ্ছে জলের প্রলেপ। বন্ধ চোখে সেই জলের সুস্বাদ গ্রহণ করতে করতে ঢুকে পড়লাম প্রাচীন স্বপ্নের ভিতর। 

 

কুলুকুলু শব্দে কোনো  বিশ্রুত নদী বয়ে চলেছে। নদীর পাশে ঘন শালবন। বনের ভিতর সুঁড়িপথ। জংলিগন্ধ। পথের পাশের একটি ঝোপ থেকে  রাশি রাশি  কুচো সাদা ফুল উড়ে গিয়ে ফুটে উঠছে  চাঁদের শরীরে ।   রাতচরা এক তক্ষক তক্ষিনীর বিরহে একটানা ডেকে চলেছে। একে তো চারিপাশে রাত্রির নির্জনতা তায় একতারার মৃদু ধ্বনি ! কে বাজায় ! দেখি , আমারই সম্মুখে হেঁটে চলেছে এক দীর্ঘদেহী পুরুষ । চাঁদের মিহিন আলোয় সেই পুরুষের সোনালি সবুজ নীলে মেশানো গাত্রদেহ যেন নীল বিজলি আলোকশিখা ! কাঁধের গেরুয়া উত্তরীয় হাওয়ায় উড়ছে । এমন ও হয় গায়ের রঙ ! একতারা বাজিয়ে বাজিয়ে এগিয়ে চলেছে গভীর থেকে গভীরতর বনের মধ্যে । আমি যত  তার পিছু পিছু যাওয়ার চেষ্টা করছি, দূরত্ব সেই একই। এমন পুরুষরূপের আকর্ষণে আমার শরীরের তাপ ক্রমশ  বাড়ছে তবুও প্রাণপণ তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছি –

                        হে অচেনা , আমার 

                        এই চঞ্চলা নারী অপরাধ ক্ষমা করো

                         একটিবার থামো … 

 

  মুহূর্তে সেই রাত্রিসহচর থমকে দাঁড়াল ,আমার দিকে মুখ ফেরাতেই সমস্ত শরীরের রক্ত চলকে ওঠে ! তুমি !

সু-প্রিয় !তুমি যে আমার পূর্ব জন্মের বান্ধব ! আমার চিরসখা ! কোথায় তোমার সেই সোনর বরণ গায়ের রঙ !

কবে থেকে একতারা বাজাতে শিখলে ! চুপ কেন ! মনে পড়ে এক শারদীয়ার শুক্লপক্ষ। মনে পড়ে বহু প্রাচীন

এক চেনা জনপদের কথা । রাজপাট । মণিময় সিংহাসন । সরোবরের পাশে নলিনীপত্রের ছায়ায় দুজনে শেষবারের মতো বসে। মনে পড়ে  অমাবস্যার রাত্রি। জীবন থেকে বাঁধন আলগা হওয়ার গল্প । সরে সরে যাচ্ছে পরিজন । আত্যহত্যার মতো কঠিন কাজ। এক হেমন্তের ভোরে  তীব্র হেমলকের বিষে তোমার শরীর হয়ে পড়ছিল ঘোর নীলবর্ণ । আমার দেহ ফ্যাকাসে ধূসর । চোখের নিখাদ অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে বেজে চলছিল ব্যথার ভৈরবী। কিছু কি  মনে নেই ! কিছু বলছ না কেন ! 

 

      হঠাৎ জোরে বাতাস বইতে থাকে । চারিদিক রাশি রাশি পাতা উড়তে থাকে। চোখে কী একটা উড়ে এসে পড়াতে এক পলকের জন্য  চোখ বন্ধ করেছি।  কী ঠাণ্ডা শীতল বাতাস গায়ে আছড়ে পড়ে। চোখ খুলতেই দেখি ভোজবাজির মতো সব পাল্টে গিয়েছে। কোথায় আমার পূর্বজন্মের সখা ! কোথায় বা সেই নির্জন অরণ্য ! এক বিরাট পুস্করিনীর পাশে  আমি দাঁড়িয়ে। ফিনফিনে চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখি কে একজন পুরুষ উন্মুক্ত দেহে  ভাঙাচোরা এক ঘাটে বসে ছিপ ফেলছে । তার ক্ষমাসুন্দর বুকের পৈতে হাওয়ায় দুলছে।আশ্চর্য !

এমন নিঝুম রাতে কে ছিপ ফ্যালে ! তাও ব্রাহ্মণ ! বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতে শুনতে পাই জলে কলসি 

ডোবানোর শব্দ ! শব্দ লক্ষ্য করে দেখি এক তন্বী ,শ্যামা , শিখরদশনা ঘাটে এসে জল ভরছে তো ভরছে। রাতদুপুরে এসব কী ঘটছে! একসময় সেই অঙ্গনা একঝলক মধুর  চাহনি ছিপফেলারত পুরুষের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সেই নারী ধীর পদক্ষেপে হেঁটে যায়।সেই পুরুষ প্রেমবিগলিত স্বরে উচ্চারণ করে ‘যত নিবারিয়ে চাই  নিবার না যায় রে।’ পরমুহূর্তে ছিপ ফেলে উঠে দাঁড়ায়।  কোথাও কিছু নেই ঝুপ করে আকাশের উজ্জ্বল ডাবের মত চাঁদটি মেঘের  কালীদহে ডুবে গেল। মেঘে মেঘে বিদ্যুৎ বাজে। মধুমাসের আকাশ মুহূর্তে ভরা শ্রাবণ মেঘে উপমিত । পলাশের গাছ হয়ে উঠল পুষ্পময় কদম শাখা। ঝড় উঠছে , ঘন বৃষ্টির ফোঁটায় অদূরের পুকুর ,দীর্ঘদেহী পুরুষ ঝাপসা থেকে ঝাপসাতর। কি আশ্চর্য ! এত বৃষ্টি ঝরছে অথচ আমার শরীরে কোন জলের দাগ  নেই ! এই  অন্ধকারে আমার দু’চোখ কি নিঝুম মরীচিকা দেখছে !

 

মাথার ভিতর তখনও থমকে পুষ্করিণীর জল ,শিখরদশনার চোলির আড়ালে অস্ফুট কটিতট।একতারা বাজিয়ের ময়ূর রঙ গাত্রবর্ণ। এই অন্ধকারে  এখন আমি কোথায় যাই ! কার এক দৃপ্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পাই  – 

 

                          এস ,হাত ধরো।

                          এই হাতে প্রাচীন পিরিতিসকল জমতে জমতে

                          অতিমধুর  পলাশের আঘ্রাণ 

                          ঝরে পড়ছে চাঁদের  সুষমা 

                          এই হাতে আজও প্রতীক্ষা করে বসন্তের হাওয়া …

 

কোনও কিছু দৃষ্টিগোচর হয় না।  অন্ধকারে কেবল একটি হাত খুঁজে পাই।সেই হাতে হাত রাখতেই ঝাঁ ঝাঁ অন্ধকার পেরিয়ে নিমেষে এসে দাঁড়ালাম প্রাচীন এক মন্দির চত্বরে ! প্রধান মন্দির ঘিরে আরও দুটি মন্দির । 

 

   কোথায় মেঘ ! কোথায় বৃষ্টি ! কোথায় বা সেই হাত! বাতাসে  সুগন্ধি ধুপ ধুনোর গন্ধ ভেসে আসছে । কেউ কোথাও নেই অথচ মনে হচ্ছে  এইমাত্র কেউ যেন মন্দিরে দেবতার আরাধনা করে গিয়েছেন । মৃদুবৎ প্রদীপের  আলোর রেখা ধরে  প্রধান মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কী রূপ দেবীর ! কৃষ্ণবর্ণা কষ্টিপাথরের 

দেবীমূর্তি । মুদ্রিত নয়না ,চতুর্ভুজা। সুদর্শন একটি  বীণা এক হাতে ধরে ,অপর হাতের কনকচাঁপা আঙুল দিয়ে  বাজনারত। তৃতীয় হস্তে একটি প্রাচীন পুঁথি , চতুর্থ হস্তে  জপমালা। কণ্ঠ জড়িয়ে চাঁপা ফুলের মালা। 

এতো দেবী বাসুলী ! এ আমি কোন মৃৎস্বপ্নে ডুবে ! কোন যুগে এসে পড়েছি !আমার ভাবনাকে খানখান করে

এক গম্ভীর অথচ সুরেলা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে । কেউ যেন অদূরেই কোথাও কোনো কিছু পাঠ করছেন। দেবীকে প্রণাম জানিয়ে সেই শব্দ অনুসরণ করে এগিয়ে যাই।মন্দিরের পাশেই ইটের হাড় পাঁজর বের হয়ে থাকা  একটি ঘর। সেই ঘরের ভিতর থেকে শব্দটি ভেসে আসছে । ঘরের মাঝে একটি প্রদীপ জ্বলছে ।  মেঝেতে ছড়িয়ে রাখা তালপাতার পুঁথি । প্রদীপের আলোয়  একজন পুরুষ  হেঁট হয়ে তালপাতার একটি  পুঁথিতে লিখছেন আর সেই লেখা আকুল কণ্ঠে  উচ্চারণ করছেন –

      

                            সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।

                 কানের ভিতর দিয়া             মরমে পশিল গো

                           আকুল করিল মোর প্রাণ ।।

 

আমি কী শুনছি ! কী দেখছি ! এ কোন শতকে এসে পড়েছি ! ইনিই কি সেই চির বিরহি পুরুষ চণ্ডীদাস !

ইনিই  কি সেই বিখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা ! এমত উচ্চারণে  সেই পাঠরত পুরুষ আমার দিকে দৃকপাত না করেই আকুল কণ্ঠে বলে উঠলেন ‘ শ্রীমতী !’  সেই উথালিপাতালি কণ্ঠস্বর মরমে এমন তীব্রভাবে প্রবেশ করল যে  সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারালাম। যখন চোখ মেললাম ,দেখি বিছানায় শুয়ে। জানালা গলে 

সোনালি রোদ্দুর ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। টিভিতে প্রোগ্রাম চলছে কবি ,সাহিত্যিকদের নিয়ে । একজন অচেনা কবি পাঠ করছেন –

                              কি মোহিনী জান  বধু কি মোহিনী জান । 

                              অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন ।। 

========================================