অনুমেঘার মন
সৌমেন দেবনাথ
মন অভুক্ত থাকলে অভুক্ত মনের মানুষ অনেক কিছু করে ফেলে। মনের মধ্যে আঁধার থাকলে আঁধার আলয়ে বাস করা মানুষ অকর্ম করে ফেলে। মনের মধ্যে হাহাকার থাকলে, শূন্যতা থাকলে আকাশে মেঘদলের জমা হওয়া লাগে না, বিনা মেঘেই ঝড় বয়ে যায়। মনের মধ্যে একরাশ আঁধার থাকলে তার আঁধার রাতে ভয় লাগে না। খরা গাঙ এক ফোঁটা জলতৃষ্ণায় মরে, কিন্তু কেউ তা উপলব্ধি করতে পারে না। যে হৃদয় হৃদয়ের ছোঁয়া পায় না, সে হৃদয় হয়ে উঠে ঊষর; যে হৃদয় একটু প্রেমরস পায় না, সে হৃদয়ে বারো মাসেই চৈত্রের খরা। পথ না পেলে পথভ্রান্ত বিপথে যায়। পথের দিশা কেউ না দেখলে পথহারা মানুষ পথ পায় না, পথিক হয়ে উঠে না। ঘরে চাঁদ থাকলে মানুষ আকাশের চাঁদ দেখে না, ঘরমুখী হয়। সাথের সঙ্গীর সুন্দর সঙ্গ পেলে মন প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়ে, রাতের কলির সন্ধানে কেউ বের হয় না, খোঁজে না নবকলি।
নিকষ আঁধার রাতের ভোর হয়েছে। নিয়তির নক্ষত্র নিয়মিত না জ্বললেও মিটিমিটি আলো ছড়ালো। বড়ো অনাড়ম্বরভাবে জীবনের কাঙ্ক্ষিত কাজটি সেরে নিলো স্বপ্নীল। অনাড়ম্বরতায় কেউ সোনার টুকরো পায় না। স্বপ্নীল খোঁজেনি বেশি স্বপ্নের সারথি হবে যে তাকে। সবদিক না ভেবেই ডুব দিয়েছিলো সে, কিন্তু মুক্তো নিয়েই উঠেছে ডাঙায়। অমূল্যকে, অতুল্যকে খুঁজে পাওয়া যায় না, ধরা দেয়। খুঁত খুঁজতে গিয়েই নিখুঁত পাওয়া যায় না। মনে-প্রাণে সুন্দর চাইলে সুন্দর মেলে, স্বার্থ নিয়ে সুন্দর খুঁজতে গেলে সুন্দর মেলে না, হয়তো সৌন্দর্য মেলে। অনুমেঘাকে দেখে তার মুগ্ধতার শেষ নেই। প্রিয় মানুষটার মুখটা কেমন হবে এই ভাবতেই তার জীবনের ত্রিশ বসন্ত কেটে গিয়েছে। সেই প্রিয় মুখটি এত নিষ্কলুষ শান্ত, স্নিগ্ধ হবে ও কল্পনাও করেনি। একটি সুন্দর মুখের দিকে তাকালে এতটা প্রশান্তি মেলে সে জানতোই না। লোকের ভালোবাসা দেখতে দেখতে বড়ো হওয়া স্বপ্নীলের জীবনেও যে একটি মায়াবিনী তন্বী নির্ঝরিণীর ছায়া পড়বে তা তার অকল্পনীয় ছিলো।
চাওয়ার চেয়ে বেশি পাওয়া হলে আলাদা করে আর কিছু চায় না কেউ। পাওয়াটাকে পরম প্রাপ্তি ভেবে নিলে সেই পাওয়াতে প্রচণ্ড তৃপ্তি আসে। পাওয়াটা পূর্ণতা পেলে মানুষ শুদ্ধতায় ফেরে। পাওয়ার ভেতর তৃপ্তির কথা থাকলেই কঠিন হৃদয়ের মানুষও কোমল হৃদয়ের হয়ে যায়। প্রতিটি হৃদয় ভালোবাসা কাতর। হৃদয় যদি ভালোবাসার কোমল স্পর্শ পায়, তবে পবিত্র হয়ে উঠে। অতীতের যেকোনো কর্মের গন্ধ-দুর্গন্ধ বিশ্লেষণ করে নতুন শপথে পথ চলে। অপ্রাপ্তির ঢেকুরে দুর্গন্ধ থাকলেও প্রাপ্তির ঢেকুরে থাকে কেবল সুগন্ধ। চুপসে যাওয়া একটি মনে বসন্ত সমীরণ বয়ে যায়। প্রাপ্তির আনন্দে আত্মহারা স্বপ্নীলের মনে কেবলই উচ্ছ্বাস, উল্লাস, উৎফুল্লতা। মনের ভেতর বয়ে যাওয়া প্রবাহ যেন নদীর বয়ে চলা প্রবাহের চেয়ে বেশি। বড়ো বিগলিত কণ্ঠে অনুমেঘাকে তাই সে বলে, আমার অনুভূতি জুড়ে তুমিই, আমার অনুভূতি তুমি, তোমাকে ঘিরে আমার অনুভূতির শেষ নেই।
অনুমেঘা মিষ্টি হেসে বলে, অনুভূতি তো প্রকাশ করো না। অনুভূতি, আবেগ এসব চেপে রাখতে নেই। তাতে দম বন্ধ হয়ে যায়।
স্বপ্নীল নিষ্পলক চোখে অনুমেঘাকে দেখে। তার মিষ্টি হাসি, মিষ্টি কথা আর কথা বলার ধরন পবন সেজে হৃদয়ে আলতো পরশ দিয়ে গেলো। কথার উত্তর না দিয়ে থমকে গিয়ে মানুষটার মুখাবয়বে চেয়ে থাকলো। তারুণ্যে ভরা টলমলে মুখে আলোর বিচ্ছুরণ। স্বচ্ছ উদ্ভাসিত টানাটানা দীঘল দুটি চোখে মায়ার বিচ্ছুরণ। কথা বলার ধরনে বিপুল আনন্দ পেলো স্বপ্নীল আর বললো, আমার বাড়তি কোনো চাওয়া নেই, তোমার সঙ্গ থেকে কখনো আমাকে বঞ্চিত করো না। আমি অঢেল কিছুই চাই না, আমার সামান্য একটু মায়া দরকার, সামান্য একটু আদর দরকার। আমার সামান্য কিছু আনন্দ চাই।
অনুমেঘা ঠোঁটে একটু লজ্জিত হেসে বলে, হাত ধরার মানুষের অভাব নেই, হাত ধরে শেষ পর্যন্ত পথ চলা মানুষের বড়ো সংকট।
কথাটি শুনতেই স্বপ্নীল অনুমেঘার হাত শক্ত করে ধরলো। অনুমেঘা আবার একটু হেসে বললো, হাত শক্ত করে ধরা মানেই কিন্তু শক্ত বাঁধন নয়। হাত ধরার মধ্যে মমতা থাকতে হয়, দরদ থাকলে হয়, মায়া থাকতে হয়, সৌন্দর্য থাকতে হয়, মাধুর্য থাকতে হয়, বিশ্বাস থাকতে হয়, থাকতে হয় প্রতিশ্রুতিও।
এই কথা শুনতেই স্বপ্নীল হাত ছেড়ে দিলো। এবার অনুমেঘা স্বপ্নীলের হাত ধরলো আর বললো, হৃদয়ের খাদ্য হৃদয়। হৃদয় তার রশদ পাবে হৃদয়ের স্পর্শেই। হাত ধরতে ধরতেই তো হৃদয়ের ধরা মেলে। হৃদয়ে হৃদয় মিশে গেলে হাত কী ধরার প্রয়োজন পড়ে!
স্বপ্নীল নিশ্চল পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলো তার মন মানসীর কথা শুনে। একটা মানুষের চেহারার চেয়ে একটা মানুষের কথা কত বেশি সুন্দর আর হৃদয়গ্রাহী হতে পারে সে বুঝতে পারছে। হৃদয়ে বিরাজ করা সত্য বাক্য মুখ দিয়ে না বললে অস্থির লাগে। তাই স্বপ্নীল বললো, তুমি ভীষণ সুন্দর!
অনুমেঘা কথাটি সহজে নিলো না। উত্তরে বললো, সুন্দর তো দেখার বিষয় না। সুন্দর উপলব্ধির বিষয়। বাহ্যিক সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দিয়ে তো আমরা মনের সৌন্দর্যকে বড্ড অবহেলা করি। হয়তো প্রশংসায় ভাসাতে চাঁদের সাথে তুলনা দেবে, বাস্তবিকে মন রাঙাতে বাহুডোরে রাখলেই চলে। বাস্তবে আনন্দে ভাসাতে একটু মধুর খুঁনসুটি করলেই চলে।
অনুমেঘার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো স্বপ্নীল। বুঝে নিলো অনুমেঘাকে হৃদয় থেকে দখল করতে হলে কথায় না, কাজে পারঙ্গম হতে হবে। কথার কাব্যিক ফোয়ারায় অনুমেঘার হৃদয় জয় দুঃসাধ্য হবে। চলে যাচ্ছিলো সে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো অনুমেঘা। একটা মানুষের সাথে দুই দিনের পরিচয়, অথচ কী মায়া জন্মে গিয়েছে তার প্রতি। রাগ দেখিয়ে চলে যাচ্ছে বলে লেপ্টে ধরতেও লজ্জা লাগলো না। ধীরকণ্ঠে বললো, ভালোবাসো না আমায়, বলো?
স্বপ্নীল বললো, না ভালোবাসার কারণ খুঁজলে কী আমি পাবো!
অনুমেঘা বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে বললো, ভালোবাসলে যাকে তার কথায় বিরক্ত হচ্ছো কেন? হও তুমি রাগী কিংবা সাহসী, আমায় কেন রাগ দেখাবে? আমি না তোমার হৃদয়ের একটা অংশ!
স্বপ্নীলের রাগের হৃদয়ে প্রস্রবণ বয়ে গেলো। গলে গেলো মোমের মতো। ভেতরে জমা ক্ষোভ উবে গেলো কর্পূরের মতো। রাগ জন্মাবে, ক্ষোভ জন্মাবে; রাগ-ক্ষোভ প্রিয় মানুষের কাছে কি বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায়? হৃদয়ে হৃদয়ে যে মিল তা তো অদৃশ্য সংযোগ। একটুতে টানাপোড়েন হবে, একটুতেই মিলে যাবে। অনুমেঘা হয়ে গেলো আরও সাবধান, বিশেষ করে কথা বলার ক্ষেত্রে। একটা মানুষের ভেতর তো সবকিছু থাকে না, তার ভেতর থেকে সব ভালো বেরও হবে না। অন্তরের সাথে অন্তরের মিল থাকলে ঐচ্ছিক কিছু বিষয়ে অমিল থাকলেও জীবনটা সুন্দর কেটে যাবে। আরেক জনের ভেতর সব সুন্দর না চেয়ে নিজের ভেতরের অতি সুন্দর কিছু বিষয়কে পাত্তা না দিলেই সম্পর্ক মধুর হয়ে উঠে৷ পৃথিবীতে তো সেই ধনী যার সুন্দর মন আছে। সুন্দর মন নিয়ে প্রিয় মানুষটির সামনে থাকলেই তো স্বর্গ নেমে আসে পৃথিবীতে। বৈষয়িক চিন্তা সম্পর্কে দ্বন্দ্ব ডাকে, দুর্গন্ধই ছড়ায়। ভালোবাসায় শুধু প্রিয় মানুষটির প্রতিনিয়ত উপস্থিতিই যথেষ্ট, আর অন্য কিছু না।
স্বপ্নীল গিয়েছে কাজে। খুব মেহনতের কাজ করে সে। সারাদিন পরিশ্রম করে। আর এদিকে বাসায় দুটি বিষয় নিয়ে খুব ভাবছে অনুমেঘা। তার অধিকাংশ সহপাঠিনীর বিবাহ হয়েছে জাঁকজমকভাবে, তারও খুব ইচ্ছা ছিলো তার বিবাহও হবে খুব জাঁকজমকভাবে। স্বপ্নীলের বাধার কারণে সেটা হয়নি। তাকে ঘরের বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। প্রতিবেশিনীদের সাথে মিশতে দেওয়া হয় না। এই দুটো বিষয়ে তার খুব আক্ষেপ। তবে এসব বিষয়ে ‘কেন’ প্রশ্ন সে করে না। এইসব প্রশ্ন সম্পর্কের উত্থান পথে বাধা। ভালোবাসায় বেঁধে বেঁধে বেঁচে থাকতে অনেক প্রশ্নের উত্তর শুনতে হয় না। অন্যকে খুশি করার কারণ যেমন নিজেকে খুঁজতে হয়, তেমনি নিজেকেও খুশি রাখার কারণ নিজেকেই খুঁজতে হয়। অন্যের ভালোর সাথে তুলনা করতে গেলে নিজেদের ভেতরের অনেক ভালো বিষয়ও চোখে পড়ে না। সম্পর্কের উন্নতি কখনো কারও সাথে তুলনা করে সম্ভব নয়। সম্পর্কের উন্নতি হয় নিজেদের ভেতরের অনেক ত্রুটি দৃশ্যমান হওয়া সত্ত্বেও না দেখার ভান করে। নিজেদের মনের অনেক চাওয়াকে নির্মম হাতে ছেঁটে ফেলে দিলেই সম্পর্কের ভেতরের তিক্ততা কেটে যায়, এসে ভর করে মধুরতা।
দিন শেষে বাড়ি এলেই বাচ্চা শিশুর মতো দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে স্বপ্নীলকে অনুমেঘা৷ কী কী বলবে সব ভুলে যায়। বাসায় তৃতীয় ব্যক্তিটিও নেই, তাই লোকলজ্জার ভয় নেই। প্রাণপুরুষটাকে দেখলে হৃদয়ের সেতারা সপ্ত সুরে বেজে উঠে। জীবনের জন্য একটা সঠিক মানুষের খুব প্রয়োজন। সঠিক মানুষটা পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। অনুমেঘা ছাড়ে না স্বপ্নীলকে। স্বপ্নীল প্রাপ্তির উচ্ছ্বাসে মহান স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
চোখের মায়ায় চেয়ে যে সম্পর্কের উত্থান হয়, ধন-সম্পদেও সে সম্পর্ক হয় না। চোখের সেই ভাষা পড়ার জন্য মনে গভীর ভালোবাসারও দরকার। টাকা-পয়সা দিয়ে যা যা হয় না, মন বিনিময়ে তার চেয়ে বেশি কিছু হয়। যেখানে ভালোবাসা থাকে না সেখানে সম্পর্কও থাকে না। যেখানে ভালোবাসা থাকে, সেখানে দুঃখ-কষ্টেও আনন্দে বাস করা যায়।
পুরুষ মানুষ মাত্রই বাসায় থাকলে শার্ট বা গেঞ্জি শরীরে রাখে না। কিন্তু স্বপ্নীল কখনো আগলা শরীরে থাকে না। এই বিষয়েও অনুমেঘার মনে ‘কেন’ প্রশ্ন জাগে। কিন্তু কেন যেন প্রিয় মানুষটাকে কোনো প্রশ্নই সে করতে চায় না। যদি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মনোক্ষুণ্ণ হয় এই ভয়ে। যদি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কষ্ট পায় এই ভয়ে। কৌতূহল থেকে একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে গিয়ে যদি সম্পর্কের মধুরতায় প্রভাব পড়ে, তবে সে প্রশ্ন না করায় উত্তম।
কিন্তু একদিন অসতর্কতার কারণে শার্ট খুলে ফেলে স্বপ্নীল। অনুমেঘার চোখ আটকে যায় স্বপ্নীলের পিঠের কাটা দাগে। দৌড়ে এসে কাটা দাগে মমতাস্পর্শ দিয়ে বলে, কী করে কেটেছিলো? কত বড়ো ক্ষতের চিহ্ন! কত কষ্টই না পেয়েছিলো!
অনুমেঘার চোখে জল চলে এলো। প্রিয় মানুষের পিঠের একটা পুরাতন ক্ষত চিহ্ন দেখে কান্না করে দেয় যে মানুষটা, সে মানুষটা কী পরিমাণ ভালোবাসে প্রিয় সেই মানুষটাকে সহজেই অনুমেয়। বললো, তখন তোমার সাথে থাকলে আমি সেবায় কমতি রাখতাম না। বলো না গো, কীভাবে কেটেছিলো?
স্বপ্নীল অনুমেঘার চোখের জল মুছে দিয়ে বলে, কান্না করছো কেন? কত আগে কেটেছিলো! ছোটোবেলায়। ছিলাম একটু ডানপিটে। পড়ে গিয়ে কেটেছিলো। চোখের জল ফেলো না। আমার কাছে তোমার চোখের জলের অনেক দাম।
নাকে কান্না করে অনুমেঘা বললো, তোমার সামনে ছাড়া কার সামনে কান্না করবো? তোমার সাফল্যে আমি কান্না করবো, তোমার কষ্টে আমি কান্না করবো। আর তুমি ব্যস্ত থাকবে আমার কান্না থামানোর জন্য।
স্বপ্নীল একটু হাসে আর বলে, অল্পতেই চোখে জল আসা মানুষকে সবাই কষ্ট দিতে ভালোবাসে।
অনুমেঘা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে, আমাকে কষ্ট দিতে পারবে কি তুমি? আমি বিশ্বাসই করি না তুমি আমাকে কষ্ট দেবে!
স্বপ্নীল বললো, যদি কষ্ট দিয়ে ফেলি, আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না তো?
অনুমেঘা চোখে চোখ রেখে বলে, তোমাকে ছেড়ে যাবো কেন আমি? মায়ায় আটকে গেলে কেউ সহজে বের হতে পারে? স্রষ্টার কাছে আমার কোনো চাওয়া নেই, তুমি আছো আমার তাই।
এই বলে অনুমেঘা স্বপ্নীলের দিকে নিষ্পলকে চেয়েই থাকলো। প্রিয় মানুষকে যতই দেখা হয়, ততই দেখতে মন চায়। প্রিয় মানুষের কোনো বহিরঙ্গের খুঁত তখন খুঁত থাকে না, বিউটি স্পট হয়ে যায়। প্রিয় মানুষের অন্তরে কোনো খুঁত থাকলে তাও মিষ্টিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। প্রিয় মানুষের মুদ্রাদোষও আর মুদ্রাদোষ থাকে না, হয়ে যায় একান্ত প্রিয় বিষয়। অনুমেঘা বললো, গ্রামের শংকর জেঠার ছেলে অক্ষর বিরক্ত করতো, উত্যক্ত করতো। কলেজে যাওয়ার পথে কেশব জেঠার ছেলে সৌপ্তিক বিরক্ত করতো, বাজে নজরে তাকাতো, অশ্লীল ইঙ্গিত দেখাতো, অনুসরণ করতো; খুব ভয় পেতাম। কলেজেও তিন চারটে ছেলে বিরক্ত করতো। দল বেঁধে তারা বদমাশি করে বেড়াতো। অন্য ছাত্রদের উপর টর্চার করতো। ওসব সন্ত্রাসদের দেখলেই ভয় পেতাম। যেদিন যেদিন কলেজে গণ্ডগোল হতো বাবাকে ডেকে নিয়ে তারপর বাবার সাথে বাড়ি ফিরতাম। এসব কারণে ছেলেদের সম্বন্ধে বাজে ধারণা ছিলো। এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যারা করে বেড়ায় তাদের প্রতি আমার খুব ঘৃণা। কিন্তু তোমার ঘরে আসার পর ছেলেদের সম্বন্ধে আমার ধারণা একেবারেই বদলে গিয়েছে। উচ্ছন্নে যাওয়া পুরুষদেরই সামনে বেশি দেখা যায়। বেশিরভাগই ভালো, তারা কাজ করে, মেহনত করে। প্রত্যেকটি কর্মঠ পুরুষ প্রত্যেকটি নারীর চোখে আইডলই। যদি জানতাম তুমিও ওমন বখাটেপনা করে সমাজের চোখে কীট হয়ে গিয়েছেো, তবে কবেই আত্মহত্যা করতাম!
চিন্তায় পড়ে গেলো স্বপ্নীল। বললো, মেঘা, এখানে রোজগারটা কমে গিয়েছে। দূর শহরে গেলে রোজগার বাড়তে পারে। আমার সাথে শহরে যাবে?
অনুমেঘা বললো, তুমি মানুষটা ভালো। তোমার সাথে নিরুদ্দেশে যেতেও আমার দ্বিধা নেই। তোমার সাথে হারাতেও আমার সংকোচ নেই। তোমার সাথে যমালয়েও যেতে পারি নিয়ে যদি যাও। তুমি থাকলে পাশে শত প্রতিকূল পরিবেশেও আমি নিরাপদ থাকবো।
অনুমেঘার কথা শুনে বিস্মিত হলো স্বপ্নীল। একটা মানুষ তার উপর কতই না নির্ভরশীল, তাকে কতই না বিশ্বাস করে, তাকে ঘিরেই কতই না স্বপ্নের জাল বোনে!
একসাথে থাকে সারাক্ষণই দুজন। তারপরও দুজনের মধ্যে মতভেদ হয় না। মতের সাথে মতের অনৈক্য নেই। স্বপ্নীলের পছন্দের খাবার রান্না করে, যদিও স্বপ্নীলের কিছু পছন্দে অনুমেঘার দ্বিমত আছে, তবুও তা প্রকাশ করে না। প্রিয় মানুষের পছন্দকে নিজের পছন্দ করে নিয়েছে। স্বপ্নীলের পছন্দের পোশাকই সে পরে। হাতের কাজ দুজনই মিলেমিশে করে। অনুমেঘার মতো শান্ত-নিরুদ্বিগ্ন সঙ্গিনী পেয়ে স্বপ্নীলেরও আনন্দের শেষ নেই। প্রাপ্তির প্রতি প্রচণ্ড সন্তুষ্টি তার। স্বপ্নীলের বুকে মুখ লুকিয়ে আছে অনুমেঘা। নিরাপদ আর পরম মমতার আশ্রয়। স্বপ্নীল বললো, আমাকে এত ভালোবাসো কেন?
অনুমেঘা বিরক্ত প্রকাশ করে বললো, ভালোবাসতে কারণ লাগে নাকি? ভালোবাসতে উপলক্ষ লাগে নাকি? মানুষটা তুমি তো সঠিক, ভালোবাসবো না কেন? এখন একটা সঠিক মানুষ খুঁজে পাওয়া বড্ড কঠিন।
স্বপ্নীল আবার বললো, আমার ভেতর বেঠিক কিছুই পাও না?
অনুমেঘা তদাপেক্ষা বিরক্ত হয়ে বললো, তোমার ভেতর আমি বেঠিক কিছু খুঁজবো কেন? এসব প্রশ্ন করছো কেন? তোমার উষ্ণ ওম কী আমায় নিতে দেবে না! চুপ থাকো। আদর দাও, আদর খাবো, আমি আদরখেকো।
স্বপ্নীল আবার বললো, আমাকে এত ভালো লাগার কারণ কী?
অনুমেঘা বললো, সবাই জীবনে একটা ভালো মানুষ চায়, পায় না। সবাই প্রিয় মানুষের কাছ থেকে প্রিয় মুহূর্ত চায়, পায় না। সবাই বিশ্বাসী মানুষের সান্নিধ্যে থাকতে চায়, পারে না। আমি তোমার থেকে সব পেয়েছি। জীবনে তোমার মতোই একটা মানুষ চেয়েছিলাম, যে আমার সব কষ্ট দূর করে দেবে, শুধু স্বপ্ন দেখাবে, ভালোবাসা দেবে। তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই আমার জন্য আনন্দদায়ক।
স্বপ্নীল অনুমেঘাকে বুকে চেপে রাখলো। পোষা প্রাণীর মতো অনুমেঘাও স্বপ্নীলের বুকে লুকিয়ে থাকলো। স্বপ্নীল টুকটুক শব্দে বললো, আমার তো রোজগার কম।
অনুমেঘা উত্তরে বললো, আমার চাহিদা কম। পয়সায় সুখ মেলে না।
স্বপ্নীল আবারও বললো, আমি তো দেখতেও সুন্দর না।
অনুমেঘা বললো, পথচলার সঙ্গী সুন্দর যত না হতে হয়, তার চেয়ে বিশ্বাসী হতে হয় বেশি।
স্বপ্নীল বললো, যদি কখনো তোমার বিশ্বাসভঙ্গের কারণ হই?
অনুমেঘা বললো, তুমি কত মিষ্টি মনের একটা মানুষ, ঠক হতে পারোই না। তোমার হৃদয়টা আমি পড়তে পারি। স্বচ্ছ কাচের মতো সুন্দর।
স্বপ্নীল আবার বললো, অতিরিক্ত সরল-সোজা মানুষ ধোকা খায় বেশি। নিজের সবটা দিয়ে অন্যকে ভালোবাসতে নেই। নিজেকে উজাড় করে নিজের চেয়ে কাউকে ভালোবাসলে ঠকতে হয়।
অনুমেঘা বললো, দিলে তুমিই তো ধোকা দেবে। দিও, ঐশ্বর্যের মতো উপভোগ করবো।
স্বপ্নীল বললো, তুমি কেমন যেন! যেমন তেমন না। আমার প্রতি কোনো ক্ষোভও নেই।
অনুমেঘা এবার বললো, ক্ষোভ আছে। আমাকে ঘোরাতে নিয়ে গেলে না কোনোদিন। এমনকি প্রতিবেশীদের সাথেও মিশতে দাও না।
স্বপ্নীল যুক্তি দিয়ে বোঝাতে থাকলো, মেঘা, তুমি গ্রামের মেয়ে। সবার সাথে মিশতে আগ্রহী। শহরের মানুষ কেউ কারও সাথে মেশে না। এমনকি পাশের রুমের মানুষের সাথেও যোগাযোগ রাখে না। মানুষ কানপড়া দেয়, মন ভেঙে দেয়, বদ বুদ্ধি দেয়।
অনুমেঘা বললো, ঠিক আছে, তুমি চাও না আমি কারও সাথে মিশি, মিশবো না। তুমিই আমার শতজনের সমষ্টি। শত উপায়ে তোমাকে দেখবো।
স্বপ্নীল বললো, অভিমান করে বললে?
অনুমেঘা বললো, তোমার উপর আমার অধিকার আছে। অধিকার না থাকলে তো অভিমানও করা যায় না। তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোই আমার জীবনের সুন্দর সময়, শ্রেষ্ঠ সময়। জীবনের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি তুমি। আমাকে ধরে আছো, ধরে রেখেছো। তোমার থেকে এক চিমটি আদরও আমার কাছে ফেলনা নয়।
পরের দিনের কথা। স্বপ্নীল কাজে গিয়েছে। বাসায় নানান কাজে ব্যস্ত অনুমেঘা। এক প্রতিবেশিনী এলেন। এসে অনুমেঘাকে বেশক্ষণ মনোযোগ সহকারে দেখলেন। তারপর বললেন, সুন্দর নষ্ট করে যারা তারাই সুন্দরের ভাগিদার হয়। সমাজের আপদ যারা, সমাজের শ্বাপদ যারা তারাই আবার সব সুন্দর পায়। যার যোগ্য যে নয়, তার ঘরেই সে যায়। স্বপ্নীল কি তোমাকে উঠিয়ে এনে বিয়ে করেছে?
হঠাৎ এমন কথা শুনে অনুমেঘা বললো, কী বলছেন এসব?
মহিলা বললেন, স্বপ্নীলের সাথে থাকতে তোমার ভয় করে না?
ভীষণ চিন্তিত হয়ে অনুমেঘা বললো, ভয় লাগবে কেন? যেভাবে বলছেন আমার স্বামী যেন হিংস্র বা বিষাক্ত প্রাণী!
মহিলা বললেন, তারচেয়েও ভয়ংকর ছেলে। নষ্টরা মিষ্টি কথা বলে তাই বুঝতে পারছো না। কৌশলী ছেলে বলে চিনতে কষ্ট হচ্ছে। তার আসল চেহারা সামনে ভাসলে বাঘ দেখার চেয়েও বেশি ভয় পাবে।
অনুমেঘা থমকে গেলো। বিস্তারিত জানার জন্য বললো, পরিষ্কার করে বলবেন কী বলতে চাচ্ছেন?
মহিলা বললেন, সাবধানে থেকো, তোমার বাবা-মা কবে না জানি সন্তানহারা হন। স্বপ্নীল তো সন্ত্রাস বাহিনীর লিডার। অনেকগুলি নারী কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত। কত মানুষকে মেরেছে তার ঠিক নেই। কত মানুষের বাসায় ডাকাতি করেছে তার ইয়ত্তা নেই। নিজেও তো কোপ খেয়েছে! শোনো, স্বামীসুখের চেয়ে স্বীয় প্রাণ আগে। প্রাণ নিয়ে পালিও, নতুবা কবে মারা পড়বে। ইজ্জত তো গিয়েছেই, জানটাও যেন না যায়।
মহিলা চলে যেতেই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। আজ বুঝতে পারছে তার বাইরে যাওয়া নিষেধ কেন ছিলো? আজ বুঝতে পারছে অতি অনাড়ম্বরতায় কেন সে বিবাহ করেছিলো! সুখের সংসার ক্ষেত্রটা মুহূর্তের মধ্যেই শ্মশানের মতো ভূতুড়ে হয়ে গেলো। ভীষণ ভয় লাগছে তার, চার দেয়াল যেন তাকে চেপে ধরবে।
এমন সময়ই স্বপ্নীল বাসায় ফিরলো। অনুমেঘা দূরে সরে চলে গেলো। স্বপ্নীলকে দেখে আজ তার ভয় লাগছে। বাঘের মুখের আহার হয়েই এতকাল ছিলো ভাবতেই শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। নিজের চোখ দুটোও ভয়ে বড়ো হয়ে গিয়েছে। স্বপ্নীল অনুমেঘাকে সান্ত্বনা দিতে কাছে আসতে চাইলেই চিৎকার করে অনুমেঘা বললো, আমার ভয় লাগছে, কাছে আসবে না। তোমার শরীরে রক্তের গন্ধ। তুমি পাপী, তুমি দোষী। তুমি লম্পট, তুমি কামুক। তুমি নারীর শরীর চেনো, নারীর চরিত্র হরণ করো। তুমি অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন করো। তুমি মানুষকে আঘাত করো। তোমার হৃদয় নেই। তুমি দূরে থাকো, তুমি মানুষ নও। তুমি জঘন্য, তুমি পশু অপেক্ষা নিকৃষ্ট। তুমি আমাকে ঠকিয়েছো, তুমি আমাকেও ভালোবাসোনি, তুমি আমাকেও ব্যবহার করেছো। সরে যাও সামনে থেকে, নতুবা মেরে ফেলো।
দিনশেষে ফেরা কর্মক্লান্ত স্বপ্নীল এসব কথা শুনবে প্রস্তুত ছিলো না। যে অব্যক্ত কথাগুলো বলবে বলবে করতে করতে বলতে পারেনি সেই কথাগুলোয় আজ মহীরুহ রূপ নিয়েছে। স্বপ্নীল বললো, তুমি জেনেছো সত্যটা, কিন্তু তুমি আছোও সত্যের সাথে। এভাবে আমাকে ভয় করো না। আমার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিও না। আমাকে দূরে ঠেলে দিও না। আমার কেউ নেই, আমি বড়ো একা। আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি না, তুমি আমার কাছে পবিত্রতম।
স্বপ্নীলের চোখে জল চলে এলো। সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই অনুমেঘার। সে গুছিয়ে নিলো। তারপর স্বপ্নীলের সামনে দিয়েই বের হয়ে চলে গেলো। পুরনো ক্ষত দেখে যার হৃদয় ক্ষত হয় সেই অনুমেঘাই একটা আস্ত মানুষকে ক্ষত-বিক্ষত করে চলে যাচ্ছে।
না জানলে মানুষ সন্ত্রাসীকেও ভালোবাসে, জানলে মানুষ ভালো হয়ে যাওয়া মানুষটিকেও ছেড়ে চলে যায়।
ঝিকরগাছা, যশোর
===============