You are currently viewing হীরকদ্যুতি >  লিপি নাসরিন

হীরকদ্যুতি > লিপি নাসরিন

হীরকদ্যুতি 

লিপি নাসরিন

জানালার বাইরে অক্টোবরের শেষ ভোর সাদা হয়ে আসছে। গতরাতে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে প্রায় সারা রাত ধরে। সকাল কালচে চাদরে মুড়ে ছিলো। বাতাসের বেগ বেশি না তবুও অস্পষ্ট ভোরে কলাপাতা দুলে যাচ্ছে অবিরাম।

লোকটা টংঘর থেকে বেরিয়ে চওড়া আইলের উপর দাঁড়ায়, বাতাসে ওর লুঙ্গি পায়ের সাথে লেপ্টে থেকে আবার ছড়িয়ে পড়ছে। লোকটা আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখে নিয়ে লুঙ্গির খুঁট শক্ত করে বাঁধে। এদিক ওদিক ভালো করে দেখে নিয়ে ভেড়ির পাশেই প্রস্রাব করতে বসে। কাজ সেরে উঠে নিচু হয়ে টংঘরের বেড়ার দরজা গলে আবার ভিতরে ঢুকে পড়ে। একটা থলে হাতে নিয়ে দরজাটা লাগিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে আইল ধরে হাঁটতে থাকে। থলের ভেতর একটা লোহার আস্তরণ পড়া প্লাস্টিকের পানির বোতল, একটা কাঁথা আর কিছু ঢেঁড়শ। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করলে লোকটার দৌড়ে ট্রাক গ্যারেজের পিছন দিকটায় উঠতে গিয়ে পা পিছলে যায়। কোন রকমে সামলে নিয়ে গ্যারেজ পার হয়ে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে গিয়ে ঢোকে। দোকানদার কেবল উনুনে আগুন দিয়ে চায়ের জল চড়িয়েছে, জলের নিচে বুদবুদ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। লোকটা পাশে পাতা তক্তপোশের এক প্রান্তে জড়সড় হয়ে বসে।

দোকানদার পঁচিশ-ছাব্বিশের এক যুবক। ভোর হতে না হতেই  কাঠের দোকানটার পাল্লা খুলে উনুনে কাঠ দিয়ে সামান্য কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়, প্রতিদিন সে একই কাজ করে। আবছা অন্ধকার সাদা হতে হতে চা পিপাসু কজন বয়স্ক মানুষ ফজরের নামাজ শেষ করে দোকানে ভিড় জমায়। 

হুম, তাইতো শুনলাম। কাল সকালে নাকি ঝড়ের আসল মাইর শুরু হবে। কেউ একজন বললো।

হালকা বৃষ্টির ছাঁট মাটির উনুনের গায়ে এসে লাগছে। আগুনের শিখা এদিক ওদিক দিয়ে বাতাসের আলিঙ্গনে ব্যস্ত। দোকানি একটা পলিথিন পেপার দিয়ে সামনের দিক আড়াল করে দিয়েছে কিন্তু কাজ হচ্ছে অল্পই।

তোর চা হতি আর কতক্ষণ লাগবে রে? মকবুল একটু দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জানতে চায়।

এই তো হয়ি এলো, বলে একটা পিরিচে দুখানা বড় সাইজের বিস্কুট মকবুলের দিকে এগিয়ে দেয়। দোকানি ছেলেটা জানে এই বিস্কুট খেয়ে মকবুল চা না খেয়ে যেতে পারবে না।

নাহ্ আজ আর চা খাবো না। অন্ধকার হয়ে আসতিছে, বাড়ি যাই।

ও মকবুল ভাই তুমি বিস্কুট খেতে থাকো আমি ততক্ষণে চা ঢালতেছি।

মকবুল বিস্কুটে কামড় বসাতে বসাতে আরো দুজন মাথায় গামছা জড়িয়ে দোকানে ঢোকে।

দোকানের উত্তর-পশ্চিম কোণে বাঁশের চটার পাতাটন করে তার গায়ে মোটা পলিথিন বাঁধা। বাতাসের চামর,পলিথিন ফুলে উঠে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে বারবার।

শুনতিছি দেশে নাকি দুর্ভিক্ষ হবে ,সেই বয়স্ক ব্যক্তি আবার কথা বলে ওঠে  সকলের নীরবতা ভেঙে। অন্য আরেকজন সেই কথার খেই ধরে। জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া তারপর ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির কারণে সবকিছু নাগালের বাইরে যাবে। এবার বিলের ঘেরে মাছের বাড়া নেই, ভারি বৃষ্টিতে যদি বিল ভাইসে যায় তাহলে জমির মালিকগোরে হারির টাকা দেবো কী কইরে?  আমাগের আর উপায় থাকবে না।

দোকানি ছেলেটা একথা শুনে বলে,  ও চাচা সত্যি কি দুর্ভিক্ষ হবে?

তাইতো শুনতিছি কদিন ধরে, রাশিয়া যুদ্ধ বাধায় দেছে তাই তো এতো জিনিসপত্রের দাম।

তারা যুদ্ধের কথা টিভিতে শোনে। মকবুল চায়ে চুমুক দিতে দিতে এসব শোনে কিন্তু কোন কথা না বলে চা শেষ করে উঠে পড়ে।

বয়স্ক ব্যক্তিরা তখনো ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে ঠোঁট লাগিয়ে চলেছে।

মকবুল গয়েছদ্দির ভাগাড়ে গিয়ে  ডানে বাড়ির পথ ধরে। দুমুঠো মুখে দিয়ে সুপুরি ঘাটায় যাওয়া লাগবে। রমেছা তখন কোটা থেকে একটা করে মুরগি বের করছে আর পেটের নিচে টিপে টিপে দেখছে ডিম দেবে কিনা।সেদিন খড়ের গাদায় তিনটি ডিম পেয়েছিল সে। মোরগগুলো ঝটপট করে ওর পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো।

নাহ্ আজ রমেছা ডিমের কোন হদিস পেলো না। দোতলা কোটার নিচে থাকে পাঁচটা হাঁস। দরজা খুলে দিতেই  মাখানো ভাত খুড়ো খেয়ে ওরা পাশের ডোবায় গিয়ে পড়ে। কোটার দরজার কাছে ভিতরে তাকাতেই দেখে কোণার অন্ধকারে দুটো ডিম মুক্তোদানার মতো পড়ে আছে। ওর চোখ খুশিতে ঝলমল করে ওঠে। মকবুল ততক্ষণে কোন রকমে দাঁড় করানো ইটের ঘরের বারান্দায় উঠে ঘরের দরজার শিকল খোলে। ছয় বছরের মেয়েটা তখনো ঘুমে কাতর।

মাগো, ও মাগো ওঠো। সকাল হয় গেছে। আমাগের ঘাটে যাতি হবে না।

মেয়েটা ঘুম চোখে আব্বা বলে আবার চোখ বন্ধ করে।

মকবুল রাত জাগার ক্লান্তি মুছতে মাথায় সরষের তেল মেখে সরদারদের পুকুরের দিকে হাঁটা দেয়। 

রমেছা থালায় পান্তা ভাত বেড়ে তাতে গতকালের রান্না করা বাসি পুঁইশাকের তরকারি, একটি পেঁয়াজ আর একটা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে  বারান্দায় মাদুর পেতে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে। মেয়েটা ওঠে এসে মায়ের কোলে বসে।

এই যে মা উঠেছে দেখতিছি, আমার কাছে আস মা, মকবুল মেয়েকে কাছে নিয়ে ভাত মাখাতে থাকে। 

দেখিছো রমেছা মাইয়ের গায়ের রঙ কেমন কাঁচা হলুদের মতো হয়েছে ঠিক আমার মায়ের মতন সৌন্দর্য। রমেছা বাধা দিয়ে বলে থাক মা- বাবার সন্তানের সৌন্দর্যের প্রসংশা করতি নেই। 

সব আল্লাহতালার ইচ্ছে।

তাইতো, তুমি ঠিক বলিছো। মকবুল ভাতের লোকমা মুখে তোলে।

আজকে ঢেড়শ আর কুঁচো চিংড়ি নিষ্টি করবা, কতদিন খাই না। ধলের মধ্যে আছে দেখো। চিংড়িগুলো এখনো লাফাচ্ছে, আমার মা খুব পছন্দ করতো। বড্ড অসময়ে মা আমার চইলে গেলো।

থাক ও কথা মনে করে দুঃখ করতি হবে না। সাত সকালে মার কথা মনে হতে মকবুলের মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

আজকে হাসে দুইটা ডিম পেড়েছে , ডিম আর আলুর ঝোল করি আজ।

মকবুল কিছু একটা ভাবে। ঘরখানা এখনো ঠিক করতে পারিনি। ঘেরে পাহরাদারি করে যে টাকা দেয় তিনজনের সংসারে তাও কুলিয়ে ওঠে না। সারারাত জেগে সকালে আবার ঘাটে যায় নৌকা চালাতে। সবখানেই প্রতিযোগিতা। সে শুনেছে নদীর উপর নাকি সরকার ব্রিজ বানাবে তাহলে নৌকায় যাত্রী পার করে যে দুটো পয়সা আসে তাও বন্ধ হয়ে যাবে। জমি বলতে এই ভিটাটুকু ছাড়া আর কিছু নেই। ঘরটা প্লাস্টার না করলে ইট খুলে পড়বে। দুর্বল গাঁথুনি,  অনেকদিন হয়ে গেল।

স্বামীর মুখের নাড়াচাড়া কমতে দেখে রমেছা বলে, কী হলো? কিছু ভাবতেছ?

ডিম একটা রান্না করো পেঁয়াজ দিয়ে ভাইজে আর একটা বেঁচে দিও। রমেছা কিছু না বলে উঠে গিয়ে রান্নাঘর থেকে একটা ছোট ঝুড়ি হাতে ফিরে এসে স্বামীকে দেখিয়ে বলে,  এই দেখ পাঁচটা ডিম, তোমার ওতো ভাবা লাগবি না। আজ দুইডা রান্দি। 

মকবুল আর কথা বাড়ায় না। তার মনের মধ্যে উথাল পাতাল চিন্তার ঢেউ দোলে। কদিন ধরে  আকাশটা ঝিম মেরে পড়ে আছে, ঘাড় গুঁজে থাকা বকের মতো করে। সবাই বলছিল ঝড় হবে। গতবার একটানা বৃষ্টিতে ঘের ভেসে গেলো। দুমাসের মাইনের টাকা সে পায়নি। তার তখন কাজও তেমন ছিলো না। ঘাটে অনেক নৌকা সে তুলনায় মানুষ পারাপার কম। ঘাট মালিকের দুষ্টুপনাতো আছেই সে সাথে। এ বছর যদি আবার তেমন হয়। এ বাড়ি সে বাড়ি দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাতে হবে। মকবুল উঠতে গিয়েও যেন উঠতে পারে না। মাছ উঠে গেলে ধান হবে তখন কাজ চলবে। কিছুদিন আবার বসা। তার পায়ের তলার ভিত্তিভূমি কেঁপে ওঠে, হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরতে গেলে যেন সবকিছু দূরে সরে যেতে থাকে। তবু উপায় খোঁজে মুক্তির, বেঁচে থাকার। মকবুল আর দশটা খেটে খাওয়া মানুষের মতো না। তার নিজস্ব একটা স্বপ্নের জগত আছে। কোথায় যেন সে শুনেছিল স্বপ্ন খোদাতালার ভাষা তাই তাকে বাস্তবে রূপ দিতে মানুষকে পরিশ্রম করতে হয়। সে সেটা বিশ্বাস করে। মেয়েকে সে মানুষের মতো মানুষ করবে সেজন্য মকবুলের পরিশ্রমে কোন বিমুখতা নেই।

সে ভেবে রেখেছে নদীর উপর ব্রিজ হলে একটা দোকান করবে রাস্তার পাশে, তাতে তার আয় যেমন হবে তেমনি নানান মেজাজের মানুষের সাথে তার আলাপ জানাশোনা হবে।

সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালিন তার মা মারা যায়। তারপর দুই ভাইয়ের সংসারে কতো কষ্ট করে মানুষ হয়েছে। মকবুলের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

কী হলো তোমার? আসমার আব্বা। রমেছা স্বামীর হাতের বাহু ধরে নাড়া দেয়। মকবুল ঝাপসা চোখে ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে থাকে।

রমেছা একটা গামছা স্বামীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, তাড়াতাড়ি বাড়ি আইসো, আমরা একসাথে খাবো। রমেছার ডিম রান্নার উচ্ছ্বাস চোখে মুখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। 

ঠিক আছে, বলে পা বাড়াতেই আবার ফিরে আসে মকবুল।

কী হলো ফিরে আইলে যে?

আজ একটা স্বপ্ন দেখিছি রাতে। যখন একটুখানি চোখ দুটো লাগি এলো তখন। মনটা বড় উতলা রমেছা। খারাপ না ভালো বুঝতি পারতিছি নে।

ভালো স্বপ্ন হলি  আল্লাহ্ দেখায় আর খারাপ স্বপ্ন হলি শয়তান দেখায়। রমেছা কৌতূহলী হয়।

কী স্বপ্ন দেখিছো?

আমরা একটা খনির সন্ধান পাইছি।

খনি? রমেছার বিস্ময় জাগে। সেইডা কী?

আহা শোননি কখনো? খনির মধ্যে অনেক দামী জিনিস থাকে, যেমন কয়লার খনি, সোনার খনি।

রমেছা ফিক করে হেসে ওঠে। তা তুমি কোনডা পাইলে? কয়লা না সোনা ?

তুমি আমারে উপহাস করতিছ তাই না?

শোন, দেখলাম তুমি আর আমি একটা টর্চ নিয়ে খনির ভেতরে হাঁটতিছি। চারিদিকে অন্ধকার, আবার কখনো কালো, কখনো চকচকে আলো।

তাহলে কালোটা কয়লা আর চকচকেটা সোনা, বলেই রমেছা এবার জোরে হেসে ওঠে।

এই দেখ তুমি আমারে আবার উপহাস করতিছ। যাই আমি বেলা বাইড়ে যাচ্ছে।

শোন আসমার আব্বা, স্বপ্ন স্বপ্নই। বেশি ভাইবো না, আমারগা স্বপ্ন সত্যি হয় না কখনো। শুধু সত্যি হয় কালোটা, আলো কখনো আসে না।

মকবুল স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তুমি বিসমিল্লাহ বলে রওনা দাও। সব বালা মসিবত দূর হয়ে যাবে।

দুপুর গড়াতেই মকবুল ঘাট থেকে ফিরে আসে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। সব পরিবহনের ভাড়ার মতো নৌকায় পারাপারের ভাড়াও বেড়েছে। মানুষ নিত্য প্রয়োজন ছাড়া কেউ আর শখ করে নৌকায়  উঠে এপার ওপার করে না। তাছাড়া ওপারেও এখন বড় মোকাম বসেছে। কেবল অফিস, আইন-আদালত বা বিশেষ প্রয়োজন  ছাড়া কেউ তেমন আগের মতো এপারে আসে না। আর আজ তো সারাদিন থেকে থেকে বৃষ্টির নেশায় মজেছে আকাশ। বাড়ি ফিরে মকবুল জোরে জোরে রমেছাকে ডাকতে থাকে। কানের দুলটাকে গামছার খুঁট থেকে বের করে চোখের সামনে মেলে ধরে মকবুল। আলো আঁধারির মাঝে বোঝার চেষ্টা করে এটা কাঁচ নাকি হীরা। ঘোর ঘোর মেঘ এসে সূর্যটাকে আড়াল করে,  কখনো ফিকে রোদে দুলটা চকচক করে ওঠে, কখনো জমাট প্লাস্টিকের মতো থিতিয়ে পড়ে। রমেছা স্নান শেষে ভিজে কাপড়ে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে স্বামীর এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে একেবারে থ বনে গেছে। মকবুলের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। তার স্বপ্নের সাথে এই কুড়িয়ে পাওয়া দুলের কোন সম্পর্ক আছে কি না তাই যেন পরখ করে দেখে নিচ্ছে সে। উপরের অংশের নিচে ঝুলে আছে একদোলা হীরে। মকবুল অবশ্য হীরে  কখনো দেখেনি তবে শুনেছে কাঁচের মতো দেখতে যার থেকে দ্যুতি বের হয়। রমেছা কাছে এসে স্বামীর হাতে ধরা দুলটার দিকে তাকিয়ে দেখে। কোনে পেলে এটা? মকবুল স্বপ্ন থেকে ফিরে আসে ,তার চারপাশে ছুঁতে যাওয়া জিনিসগুলো আবার থরথর করে কেঁপে ওঠে। চোখে যেন আঁধার ঘনিয়ে আসে। দুলটা হাতের তালুতে নিয়ে বলে সকালে যাবার সময় বড় রাস্তার ধারে পড়ে থাকতি দেকে কুড়ায় নিলাম।

দেখ তো এটা সোনার কি না?  রমেছা শরীরের ভিজে কাপড় নিংড়ে নিয়ে বলে তা তো বুঝতি পারতিছি নে। রঙটাও দেখতিছি বেশ মজবুত।

সোনার হলিও হতে পারে। বড় ভাবি বলতি পারবে। মকবুল হা হা করে ওঠে, না না কাউরে বলবার দরকার নেই। যদি এটা সত্যি সোনা হয়, নিচের অংশটা দেখিয়ে বলে, যদি এইটা হীরা হয় তাহলে অনেক দাম হবে। আমি হাটখোলায় গিয়ে মতি স্বর্ণকারকে দেখাই নেবো। কাউরে এই দুলের কথা বলা যাবে না। রাস্তা দিয়া হাজারে হাজারে মানুষ চলাচল করে। কার না কার। জানাজানি হলি যে কেউ এসে দাবী করতি পারে।

তবে কারোর যদি সত্যি হারায় গিয়ে থাকে আর প্রমাণ দেয় তাইলে আমি ফেরত দিয়া দেবো। পথে পাইছি বলে চুপ করে থাকবো না, উপযুক্ত প্রমাণ দিলি দিয়ে দেবো। 

সেদিন  রাত গভীর হতে না হতেই প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলো সাথে বজ্রবৃষ্টি। কোথায় চড়াৎ করে শব্দ হতেই মকবুলের ঘুম ভেঙে যায়। মকবুল উঠে ঘরে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালাতে গিয়ে দেখে বিদ্যুত নেই। টর্চটা মাথার কাছ থেকে নিয়ে জানালাটা অল্প একটু খুলে দেখে উঠোন ভরে উঠেছে জলে। রান্নাঘরের পাশে লাগানো দুটো পেঁপে গাছ উপুড় হয়ে আছে। মকবুল হাঁস-মুরগির কোঠায় লাইট মারে। পাতলা কাঠের পাল্লাগুলো ঠিকঠাক আছে দেখে স্বস্তি পায়। কিন্তু মকবুলের ভয় হচ্ছে প্রচণ্ড, যদি নৌকার কাছি খুলে এই ঝড়জলের মধ্যে নৌকা ভেসে যায় তাহলে তো সর্বনাশ। জানালা লাগিয়ে তক্তপোষে এসে রমেছাকে ডাকে।

শুনতিছ, ও আসমার মা বলে গায়ে হাত দিয়ে জোরে ঝাঁকি দেয়। ঘুমের মধ্যে  রমেছা ধড়ফড় করে উঠে বসে। সে ধাতস্থ হতেই মকবুল বলে ,আসমার মা, আমার নৌকাডা বোধহয় ভাইসে গেলো। রমেছা কিছু বলার আগেই প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়ার আওয়াজ। সে দুহাতে কান ঢেকে কলেমা পড়ে।

আমি কি যাবো ঘাটে ,গিয়া দেখবো কী অবস্থা?

তোমার কী মাথা ঠিক আছে? এই অবস্থায় কী বলতিছো তুমি, ঘাটে যাবা মানে? নৌকা ভাইসে  যায় যাক, তুমি শুয়ে পড়, যা কপালে আছে তাই হবে। ঘোরকিস্টি অন্ধকার আর এইরাম ঝড়ের মধ্যি আমি তোমারে কিছুতেই যাতি  দেবো না।

মকবুল অস্থির হতে হতে শুয়ে পড়ে। কারো চোখে ঘুম নেই কিন্তু দুজনের মুখে কোন কথাও নেই। এক অজানা বিপদের সংকেত নিয়ে স্বামী- স্ত্রী দুজনে ভোর হবার অপেক্ষায় থাকে। তারপর টানা তিনদিন অশ্রান্ত বৃষ্টিপাতে জনজীবন ঘরে প্রায় বন্দী হয়ে রইলো। ভোরে বৃষ্টির মধ্যেই মকবুল ঘাটে গিয়ে তার নৌকাটা ঘাটে দেখেনি। বেশ কিছুদূর হেঁটেও কোন সন্ধান না পেয়ে ফিরে এলো। এদিকে মাছের ঘের সব জলের তলায়। যে যার ঘের সামলাতে ব্যস্ত,  মাছ এরই মধ্যে অনেক বেরিয়ে গেছে বলে সবাই বলাবলি করছে। মকবুল তার মালিকের ঘের বাঁচাতে কাজে লেগে পড়লো।

খারাপ আবহাওয়া কেটে গিয়ে আকাশ ঝলমল করে উঠলো। প্রকৃতির যেন স্নান সেরে পবিত্র হয়ে উঠেছে। আকাশ ভরে রোদের হাসি। আরো দুদিন পর কে একজন খবর দিলো মকবুলের নৌকাটা ভাঙা অবস্থায় মাছখোলার গাঙপাড়ে পড়ে আছে। একদিন পর আরো একটা খবর এলো তার কাছে, মাছের ঘেরে কাজ করার সময়। বাড়িতে কজন অচেনা মানুষ এসে মকবুলকে খুঁজছে। তাদের সাথে মাইক, ক্যামেরা। মকবুল অবাক হয়ে ভাবলো কারা এলো? সে হন্তদন্ত হয়ে কাজ ফেলে বাড়ির দিকে ছুটলো। মকবুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই রমেছা দৌড়ে স্বামীর কাছে আসে।

আসমার আব্বা, দেখো কারা আইছে, তোমারে খোঁজে, বলে আমরা নাকি কী সব পাইছি। মকবুল কিছু বলার আগেই একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করে ,আপনি মকবুল সাহেব? জে, বলে উত্তর দিতেই সাংবাদিক নিজের পরিচয় দিয়ে বলে, আমরা জানতে পেরেছি আপনি একটি হীরকখন্ড পেয়েছেন। আপনি হীরকখণ্ডটি কোথায় পেলেন এ সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে জানতে চাই। এর মধ্যে একজন ক্যামেরা তাক করেছে তাদের দিকে। মকবুল আকাশ থেকে পড়ে, হীরকখন্ড? আমি তো কিছুই বুঝতে পারতিছি না। রমেছা বারান্দায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মেয়েটা ওর গা ঘেঁষে দাঁড়ানো। এক দুজন করে মকবুলের বাড়ির বারান্দায় ভীড় বেড়েছে। 

সেটি দেখতে কতো বড়ো, কেমন রঙের? আমরা ওটার ছবি তুলতে চাই ইত্যাকার প্রশ্নে মকবুল একেবারে নাকাল। রমেছা ভয় পেয়ে আগেই টিনের বাক্স থেকে দুলটা বের করে এনেছে। সেটা মকবুলের হাতে দিতে ও সেটা সাংবাদিকদের দেখায়। কিন্তু তারা তো আসল হীরা দেখতে চায়, এটা তো একটা ইমিটেশনের দুল। কিন্তু আসল হীরা কী, কেমন, কোথায় আছে মকবুল তার কিছুই জানে না। পরদিন জাতীয় দৈনিকে ছাপা হলো মকবুলের হীরকখন্ড কুড়িয়ে পাবার সে কাহিনি। 

মকবুল তার কিছুই জানে না। কিন্তু দশে দশে কথা দশখান হলো। হুলস্থূল পড়ে গেলো  চারিদিক। দেশে হীরার খনি পাওয়া গেছে!  একজন জানে সেটি কোথায় কিন্তু সে জানাচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচার হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। সম্ভবত ঐ মকবুল লোকটি একটা বড় গ্যাঙের হয়ে কাজ করছে। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, রমেছা দুলটা মেয়ের কানে পরিয়ে দিয়েছিল খেয়ালের বশে। মেয়ে সেই এক কানে দুল  পরে খেলতে গিয়েছিল। বৃষ্টি ধোওয়া আকাশের উজ্জ্বল সূর্যকিরণে নিচের অংশটুকু থেকে উজ্জ্বল দ্যুতি বের হচ্ছিল আর সেই দ্যুতিতে পাড়াপড়শির চোখ গেলো ঝলসে। এক কান দু কান  হতে হতে তা রাষ্ট্র হলো হীরকখন্ডে এবার নড়েচড়ে বসে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। ব্যাপারটা তো হেলাফেলার বিষয় নয়। আরো দুদিন পর একদিন মাঝরাতে  মকবুলের অসারি আমকাঠের দরজায় ধাক্কা। ঘুম জড়ানো চোখে দরজা খুলে বাইরে আসতেই দেখে ফুটফুটে চাঁদের আলোয় তার ছোট্ট উঠানটায় পুলিশ দাঁড়িয়ে। মকবুলের পিছন পিছন রমেছাও উঠে আসে। আসমা হয়তো তখন হীরের দুল কানে পরে স্বপ্নের দেশে সাথীদের সাথে খেলছে। বাবা তাকে বলেছিল হীরের দুল গড়িয়ে দেবে।

মকবুলের আর কিছু বুঝতে বাকি থাকে না। তার ভিত্তিভৃমির নিচে চোরাবালি সরতে থাকে,  আঁকড়ে ধরা অবলম্বনগুলো কাঁপতে কাঁপতে দূরে সরে যায় । রমেছা ডুকরে কেঁদে ওঠে। মাঝরাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে স্বজন,পড়শি কেউ কেউ উঠে আসে মকবুলের উঠোনে। তারা পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করে। রমেছা ঘর থেকে দুলটা এনে পুলিশের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, এই নেন দারোগা সাহেব আপনাগের হীরের খনি। আমার স্বামী কিছুই জানে না। তারে নিয়া যাবেন না।

মকবুল যেন বোবা হয়ে গেছে। শুধু বুঝতে পারছে তার স্বপ্ন এবার সত্যি হতে চলেছে।

====================

*********************************