You are currently viewing নাটক: পরীগাঁও > বদরুজ্জামান আলমগীর

নাটক: পরীগাঁও > বদরুজ্জামান আলমগীর

পরীগাঁও

বদরুজ্জামান আলমগীর

নাটক

ছেলে ঢোল বাজায়। ঢোল বাজায় আর নাচে।

শঙ্কর। এই শঙ্কর।

নাচেন স্যার, নাচেন। ফিলিমের গান কন-

এক বালিশে দুইটি মাথা, ছোট কইরে কেন কওনা গো কথা

এক বালিশে দুইটি মাথা, ছোট কইরে কেন কওনা গো কথা

ঘুমাইলা ঘুমাইলারে বন্ধু পান খাইলা না, ঘুমাইলা ঘুমাইলারে

বন্ধু পান খাইলা না, না না না।

এক বালিশে দুইটি মাথা, ছোট কইরে কেন কওনা গো কথা

ঘুমাইলা ঘুমাইলারে বন্ধু পান খাইলা না, ঘুমাইলা ঘুমাইলারে

বন্ধু পান খাইলা না, না না না।

গাঙ্গের কূলে সইর্ষার ভুলে জাত কূলমান গেলরে

ছাড়ো ছাড়ো ছাড়ো বন্ধু বান্ধি মাথার চুলরে

হইলো এ কি প্রাণসখা দুইজন তবু লাগে একা

প্রেমের নেশায় মনের বাগান উঠে মাতিয়া

ঘুমাইলা ঘুমাইলারে বন্ধু পান খাইলা না, ঘুমাইলা

ঘুমাইলারে বন্ধু পান খাইলা না, না না না।।

শঙ্কর, ঢোল বন্ধ কর।

সাব্বির, তুই এমন করছিস ক্যান?

ভাল্লাগছে না। চল চলে যাই।

কী পিচ্চিদের মত কথা বলিস!

ভয় পাইচস কী-না ক। চাপাচাপি করিস না মাগার, জান খালি কইরা ক। যদি ভয় পাস তয় কোন বাড়িতে তোরে রাইখা আহি।

ঘুইরা ব বেটা। আসমানের চান্নিটা দেখ। হালায় শারমিনের পাছার লাহান ফুইটা আছে। খালি চাইয়া দেখ।

সত্যি সাব্বির, এমন জোছনা আমি আমার জীবনে আর কোনদিন দেখিনি। মনে হয়, আমরা বুঝি হাশরের মাঠে আছি, শীত লাগে, এমন চান্নিতে আমার শীত লাগে।

হাকিম ভাইকে বলে আসা দরকার ছিল। কোনদিকে এসেছি তাকে বলে আসিনি। বলে এলেই হতো আমরা নদীর পাড়ে যাচ্ছি, রাতে ফিরবো না। শুধুশুধু একজনকে দুশ্চিন্তায় রাখা ঠিক হচ্ছে না। তাছাড়া আমরা এখানকার কিছুই চিনি না, জানি না।

অতো চিনবার কী দরকার হইলো মাগার। আমার নাম বইলা দেখিস- সব সালায় চিইনা লৈবো, খালি চিনবো কী-রে ভসকাইয়া যাইবো। পুরান ঢাকার জগলু, সব সালা-ই এখন ঢাকায় চক্কর মারে, ঢাকা হইলো গিয়া মক্ষীরানি। ফাউ চিল্লাচিল্লি করিস না, রাইত হইতাছে, ঝিম মাইরা থাক।

আপনারা থাকেন, মৌজ করেন। কোন অসুবিধা নাই। আমাদের মন-দিল ভালো না, দিনের বেলায় আসেন।

মনের কী হইছে মাগার- দিলের ভিত্রে ওয়াকার ইউনুস বোলিং করবার লাগছে?

জগলু, চুপ থাক। ফাজলামির একটা সীমা থাকা দরকার। ওদের সঙ্গে ফালতু কথা বলছিস কেন?

বড়ভাই, আমি আপনাগো মনে চোট দিছি- শক পাইছেন?

না ভাই, আমরা কিছু মনে করি নাই। দিনে আসেন।

এখানে আর কী দেখবেন? দিনে বাজারের দিকে যান। ইস্কুল কলেজ আছে, কথা বলার মানুষ পাবেন।

আর দেরি করতে পারবো না ভাই। এতোক্ষণে ভিকচান মনে হয় ফুলে উঠছে।

ভিকচান কে- কী হইছে তার?

ভিকচান আমার ষাঁড়। শখ করে ষাঁড়ের নাম রাখছি ভিকচান। ২বছর ধরে নজর দিচি। ষাঁড় পালতে গিয়া নিজের ঈমান নষ্ট করচি। মাইনষের ধানক্ষেত কেটে খাওয়াইচি। ষাঁড় জব্বর বাড় দিচিল।

ষাঁড়ের হইচে কী?

এখন থেকে বেশি দূরে নয়, ওই তো ওইখানে।

একটা জঙ্গল দেখা যায়- দেখা যায় না?

বাঁশঝাড় আছে- গাবগাছ- ওই লম্বা দেখা যায় একটা তালগাছও আছে। তার পাশ দিয়া একটা চিকন রাস্তা, ওই রাস্তায় ঠিক দুপুরবেলা, খাড়া দুপুরবেলা সময়টা ভালো না- আমার ষাঁড় ভিকচানকে লৈয়া বাড়ি যাই। কিন্তু আচানক, এক্কেবারে তাজ্জব- আমার কাছ থেকে আপনি যতোদূর- ঠিক অতোটা দূরে- একজন উনি ফোঁস করে খাড়া- রে বাপ, প্রথমদিকে উনি-কে বেশি নজর করি নাই। ঠিক দুপুরবেলা সময়- সময়টা দোষী, উনিকে না দেখে আমি আমার ছায়ার দিকে চাই; মনটা ঝাড়া দিয়া উঠে, আমি ধরধর করে ঘামতে থাকি- আরে, আমার ছায়া গেল কই, আমি একটা মানুষ, কিন্তু আমার ছায়া নাই! আমি অকূলান হইয়া যাই- চিল্লাইয়া কই- দিলুয়ার, দিলুয়ার! এই যে দিলুয়ার- আমার বাল্যকালের দোস্ত- আমরা খড়ের দুই মাথা কামড় দিয়া পানিতে ডুব দিচি, তারপর দোস্তি করচি- লোকেরে পানবাতাসা খাওয়াইচি। আমার মাথা ঘোরে, আমি বিদিশায় চিল্লান দিয়া উঠি- দিলুয়ার, দিলুয়ার। হে তো আশেপাশে নাই, আসবে কোত্থেকে? এতোক্ষণে দুনিয়া একবিন্দুতে সার- সাপ আর ভিকচান, ভিকচান আর সাপ- জাতিলা সাপ- ভিকচান আর উনি। উনি বলে- ফোঁস। ফোঁস। ফোঁস। আমার ভিকচান মাটি আঁচড়ায়, শিং ধারায়। একসময় দেখি, খালি জঙ্গলে নয়, মাটির উপরে নয় খালি- লড়াই বাঁধে শূন্যে, মাটি আর সাততবক আসমানে লড়াই শুরু হয়ে যায়। ফোঁস। ফোঁস : হাম্বা। হাম্বা।

সাপে কাটলে কী প্রাণীকুল বাঁচে ভাইজান? আপনারা মনামনি ডাক্তারি বই পড়চেন। আমার ভিকচানরে ইন্ডিশন দেন। ১৩ মাইল দূরে মোনসোবিদা গ্রাম, শুনছিলাম সেখানে সাপের ওঝার বাস। এতোদূর হেঁটে গেচি- পা ফুলে গেচে আমার, কিন্তু ওঝা পাই নাই- কবিরাজ নাই।আমার ষাঁড়ের বিষ কে নামাইয়া দিবে?

ছোটকালে সাপের ওঝার মন্ত্র শুনচিলাম- কোনদিকে গেলে ভিকচানের ওঝারে খুঁজে পাই-

কালিরে কালিরা কালকূটো কাজলমুখা

আগে নামে কালকূটা নাগের বিষ।

পিছে ডাকে ধুরা মেজ্জা মেজ দ্যাশ

কালকূটা নাগের বিষ উভনালে যায়

মনসার স্মরণে বিষ ডুরির মধ্যে আয়।।

ডাক্তারের কাছে নিয়া যান। ডাক্তার খবর দেন।

আগে বাড়ি গিয়া দেখি।

কার্বোলিক এসিড নিয়ে আসা দরকার ছিল।

তোমার মাথা। কার্বোলিক এসিড নয়, তোর দরকার পটাশিয়াম সায়ানাইড।

আমি কি সারারাত থাকবো সাব?

শঙ্কর তুই সারারাত থাকবি। ভয় পাইলে ঢোল বাজাবি, হা।

জে স্যার।

শঙ্কর, তুই ঢাকা যাবি?

হ, যামু।

ঢাকায় জানি তোর কে আছে?

আমার পিশামশাই- যোগেন্দ্র ঋষিদাস। আমি কোনদিন যাই নাই। যে টেইন ঢাকা যায় সেই টেইন দেখচি আমি- কাসার বাডির মতন রঙ। শুনছি এমনই এক গাঙ্গের ধারে সদরঘাট আছে- ঢাকা শহরে সদরঘাট আছে একটা- সেইখানে আমার পিশামশাই জুতা সেলাই করে। শুনছি সাহেবরা বকশিস দেয়, আর রঙ তেরিবেরি হইলে চড় মারে।

চিনবে, সে-ও জগলুরে চিনবে মাগার। রাজা, উজির, নাজির, কৌটাল, ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, মুচি- আমি সকলের আব্বাজান, বড় আব্বা।

বিড়ি শেষ হইয়া গ্যাছে- হাই থট চিন্তা লাগা। ইয়াসিন, তুমি এমন চেটের বাল আব্দুল্লাহ হইয়া বসে আছো কেন? ডাইল মারছে নাকি? তোমরা তো আবার ইন্টেলেকচুয়াল- আঁতেল, বোতল- তোমাদের গতিবিধি বুঝে উঠতে সময় লাগে- তোমরা এই কোক, এই শ্যাম্পেন।

না, না ইয়াসিন সবসময় ইয়ার্কি মারিস না।

তুই লিজার সঙ্গে গেঞ্জাম করলে, বেহিসাবি ডাইল মারলে, বললে- একদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাবো। ব্যস, আর তো কোন সমস্যা নাই- হাকিম ভাইকে বললাম, হাকিম ভাই তার নিজের বাড়ি নিয়ে এলো।

দেখা হয়নি- নদীনালা, খালবিল, ধূলামুলা দেখা হয়নি? তুই বল- সবই হয়নি? আর কী বাকি আছে? সারাদিন ভোঁভোঁ করে ঘুরলাম, চক্কর মারলাম- আল্লাহর কিড়া, এইবার বাইচালি থামাও। এখন রাত বাজে ৩টা- জগলু, আর ফাজলামি করিস না।

ফাজলামি না সাব্বির। আমি আর চকবাজার যামু না। শালা বাস্টার্ড শাকিল আমারে খুঁজবার লাগাইছে- আমারে ছেদানির লাগি নতুন মাল আনছে।

ফাউ ইনফরমেশন। কী কস, আসল খবর- শাকিল কাট মারার ধান্দায় আছে। ইটালি চলে যাবে।

তুই জানিস না। মিরপুরের ব্রো ডেরেক ওরে শেল্টার দিচ্ছে। কিসলু হালায় বেঈমানি না করলে আমার একটা পশমও ছিঁড়বার পারতো না। শঙ্কর। শঙ্কর। ও শঙ্কর, ঘুমাস নাকি- শঙ্কর!

কোন শালায় আমারে ডাকে। হেই।

শঙ্কর!

কোন বান্দির পুত?

শঙ্কর।

কে? ও, আপনি- সাব, সাব!

শোন।

মাফ করে দেন স্যার। পেটে মাল বেশি পড়ে গেচে। কী কন সাব কন, আবার কন।

জোরে চিল্লান দে। কলিজা ফাটাইয়া চিল্লান দে শঙ্কর।

কার নামে চিল্লান দিমু স্যার?

নাম নাই, ধাম নাই। এমনিই চিল্লা।

হোই… হোই…

আরো জোরে চিল্লা- বুক দুই চিলতা হয়ে যাক। জোরে চিল্লা।

ওই… ওই… হোই… হোই…

টর্চ মারে। টর্চ মারে। ২টা টর্চ। চান্নির ভিতর টর্চ। এই টর্চের নিয়ত ভালো না। সাব্বির, সাব্বির, ওই সাব্বির। ভয় পাচ্ছিস?

না, ভয় পাচ্ছি না। আননেসেসারি কিছু গোলমাল বিশৃঙ্খলা হবে।

ধুর মিয়া, রাখো তোমার গোলমাল।

কে? কে আপনারা? টর্চ মারবেন না।

এখানে চিল্লাচিল্লি করে কে? আপনারা কে- বাড়ি কোথায়, কোত্থেকে আসছেন?

নিশিন্দা।

নিশিন্দাতলা।

নিশিন্দাতলা। নিশিন্দাতলা কার বাড়ি?

আবদুল হাকিম মীর।

ও। এতো রাতে গাঙ্গের উপর কেন? কী দরকার?

ঘুরতে আসছি।

ঘুরতে আসছেন। আপনাদের সাথে মীর বাড়ির কাদির আছে না-কী?

না।

কাদির নাই। কাদির ছাড়া মীর বাড়ির লোক এতো রাতে গাঙ্গের মরা বালুর উপর টাঙ্কি মারে- বিষয় কী?

আমরা ঢাকা থেকে আইবার লাগছি। হাকিম ভাইদের বাড়িভি মেহমান।

মেহমান। এইখানে তো আমি কোন গেস্টরুম দেখি না। মেহমান এতোরাতে গাঙ্গের উপর কী করেন? রাত বাজে সোয়া তিনটা। আপনারা এখানে কী করেন?

হাঁটতে হাঁটতে বিকালে এদিকে আসছিলাম, এখনও যাওয়া হয় নাই।

আপনারা কই যান? আপনাদের গ্রামের নাম কী?

আমার বাড়ি! আছে আশেপাশেই। চিনবেন না। আপনারা মেহমান। হাকিম মীরের গেস্ট- আমাদেরও কুটুম। যাউগগা, এতোরাতে বাইরে আড্ডাচারি করা ঠিক না। যান, আপনারা বাড়ির দিকে যান। রাতে এখানে দেখার কিছু নাই।

আসমানে চান্নি উঠচে- বালুর উপর খাড়াইয়া দেখবার লাগছিলাম।

আপনার বাসা ঢাকার কোন মহল্লায়?

চকবাজার।

ইসলামপুরের ইকবালকে চিনেন?

হ চিনি। ইকবাল তো এখন ফিউজ হইয়া গ্যাছে। মহল্লায় ওরে কুত্তায়ও পুছে না। নতুন পোলাপান গজাইয়া উঠছে- চোখে বিজলা নাই, ফেরোশাস।

আপনাদের কাছে ম্যাচ আছে?

আছে।

ইসলামপুরে এখন লিয়াকত আর ফাইজাম ফর্মে উইঠা গ্যাছে।

বিড়ি দেন।

বিড়ি নাই। বাংলা ফাইভ।

দেন।

ওস্তাদ, বালুজুরিকান্দায় উপরের দিকে লাইট মারে, আমাদের যাওয়া দরকার।

তুই সিঙ্গেল দে। খাড়াইতে ক। আমরা আসতেছি।

বস, সিঙ্গেল মিস হয়- মিসকমিউনিকেশন মারে।

চুপ করে থাক মিরাশু।

ওস্তাদ।

চুপ। একদম বোবা। একটা কথা কোবি না। আমার মাথা টনটন করে।

আবার সিঙ্গেল মারচে। সিঙ্গেল থেকে ট্রাবল মারচে। গরু বাছুর হুড়াহুড়ি গুতাগুতি লাগাইছে।

মিরাশু, সার্কাস পার্টির সঙ্গের মতন লাফালাফি করতাচস ক্যান?

ওস্তাদ, ঝাড়ি মাইরেন না ওস্তাদ। আমার মনে হয় হাসেনালি সিঙ্গেলের অর্থ আন্ডারস্ট্যান্ডিং করতে পারে নাই। হাসেনালি মনে করচে পুলিশের লাইট।

অতো ফুলকিরমি হইচে ক্যান- খাড়া বলছি। খাম্বার মতন খাড়াইয়া থাক।

ফিরেকবার উল্টাপাল্টা লাইট মারে, ওফ! রাতের মধ্যে গরু চিনাডুলি ক্রস করতে অইবো। আমি যাই।

খাড়া বলছি।

আপনি ইসলামপুরের ইকবালের কথা বলছিলেন- তারে চিনেন কীভাবে?

আমার নাম নেকবর। অনেকদিন পুরান ঢাকায় ছিলাম। ইকবালের সঙ্গে পরিচয় হইছিলো।

বড়ভাই, কিছু মনে নিবেন না- হে আপনার পরিচিত মানুষ। ইকবালের গ্রুপ মার খেয়ে ফেলছে। হেরা ফিউজ হইয়া গ্যাচে। যদি ঢাকায় আহেন, নাম বইলা দেই- আমার নাম জগলু- চকবাজার থেকে পোস্তাগোলা মোড়।

আপনারা ঢাকার মানুষ। গ্রাম দেখতে আসছেন। মেয়েছেলের নেশা আছে?

এইকথা বলেন ক্যান?

অনেকের তো এই খাসিলত গলার মালা।

এই নেশা থাকলে গ্রামে আসার দরকার আছে? তরতাজা মাগুরমাছ আর টাটকা পালঙ শাক সবই ঢাকার বাজারে সবার আগে পাওয়া যায়। আমার সোনার বাংলা…

আপনি আল্লাহর কাছে কী চান- বেহেশত না আগুনের দাউদাউ, জান্নাতুল ফেরদাউস না হাবিয়া দোযখ?

দোযখে জাহান্নাম।

কেন?

আল্লাহ যেন ৭০জন হুরের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেন।

এ আমার মনের কথা অন্তরে আছে। শাবাস।

এতো রাতে আপনি কোথায় যান?

গরু আনতে।

কিসের গরু?

ওই দেখেন, টর্চ মাইরা সিঙ্গেল মারে। আমি যাই।

কিসের গরু বললেন না।

আপনারা কী পুলিশের লোক?

আপনি কী বলেন- আমরা পুলিশের লোক হবো কেন?

আমিও ভাবতেচি- পুলিশের লোক হবার তো কথা নয়। যদিও পুলিশের লোক হলে আনন্দের কথা। আমার মাথায় ঢুকতেচে না- হঠাৎ আপনাদের পুলিশের লোক মনে হইলো কেন? আকাশে তো চান্নি আছে, তাই না?

জি।

আমার নিজের টর্চ নিজের মুখেই মধ্যেই ধরি- এই দেখেন, আমার নাম নেকবর আলী- এইপথে শত শত গরু পাচার হয়। কোন অসুবিধা নাই- মাসে মাসে বড় সাবের সাথে দেখা করি। এই জায়গাটা কিন্তু ভালো না।

কোন জায়গাটা?

যেখানে দাঁড়াইয়া আছেন। যে-কোন ঘটনা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

কারা ঘটায়?

বাদ দেন। নামে নিশানায় সবকিছু জানার ইচ্ছাটা বাদ দেন। আছে, নানা আউলিয়া আছে।

দিনের বেলায় কী করেন?

কিছুই না। হাত-পা গুটাইয়া বইসা থাকি।

আমরা সারাবিকাল থেকে অনেক কাজ করেছি।

কী কাজ?

প্রথমে বালু জড়ো করেকরে অনেকটা উঁচু ঢিবি বানিয়েছি, তারপর একজন আরেকজনের আড়ালে চলে গ্যাছি। দুইজন ঢিবির দুইদিকে- মাঝখানে ইয়া উঁচু ঢিবি- মনে হচ্ছিল আমাদের মাঝখানে এক হিমালয়ের চূড়া- এই দূরত্ব একজনমে কোনদিন আর ভাঙা যাবে না।

সাব্বির।

ইয়াসিন।

জগলু।

আমরা কতোটা উপরে উঠেছি?

অনেক। অনেক। হিসাবের বাইরে।

এটা কী কাঞ্চনজঙ্ঘা?

না। ঢাকার শহর। জিপিও’র মোড়ে জিরো পয়েন্ট।

পুরান ঢাকা নাই?

কমলাপুর স্টেশন কই- সদরঘাটের স্টিমার নাই?

স্টিমার যায় বরিশাল- বরিশাইল্লা মনু।

স্টিমার যায় চাঁদপুর- হেতেনে নোয়াখালি যাইতোন নো?

মামুর বেটা তুমি রাশশাই যাবা কোনদিন, মামুর বেটা?

ময়মনসিঙ্গা ফহিন্নির পুত কিস্তা কোইন্না কেরে?

না, না সব মিসমার। সব ঢাকা শহর। সব খোলা আর ঢাকা ঢাকার শহর। ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইচে, লাল লাল নীল নীল বাত্তি দেইখা আশা ফুরাইচে। এটা মতিঝিলের ২৬তলা।

ইয়াসিন। ইয়াসিন।

লিজা, আমি ইয়াসিন। তুমি এই পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থেকো না। বাইরে এসো।

তারপর ৩জন তিনদিক থেকে পাহাড়ে উঠতে থাকি; কিন্তু পাহাড় আমাদের নেয় না, আমরা কোন উঁচুতেই উঠতে পারি না, উপরে ওঠা আমাদের ভাগ্যে নেই।

আমাদের পায়ে পায়ে একপর্যায়ে বালুর পাহাড় ভেঙে পড়ে। আমরা আবার একজন আরেকজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাই। এতোদূরে অঙ্কের জটিল সমীকরণ, জ্যামিতির কম্পাস, গাড়ির বুক ছিদ্রকরা হুইসেল পেরিয়ে এখানে বালুর পাহাড়ের উপর এসে জড়ো হই- তবু সামান্যতম আড়ালও পাই না।

আগে কোনদিন জানিনি- নৈকট্য এতোবড় কারাগার। দূরত্ব চাই- একফালি দূরত্ব।

একহাত দূরেই দেখতে পাই- সাব্বির, এই যে সাব্বির।

এই তো ইয়াসিন।

আর ওই যে জগলু।

তোর মুখ আমার সহ্য হচ্ছে না- একদম দেখতে ইচ্ছা করছে না।

তুই একটা ক্রিমিনাল।

একেকটা ক্রাইম একেকটা মক্ষিরানী। রাণী মৌমাছি বসে থাকে একলা- চুলটানা বিবিয়ানা। শতশত পুরুষ মৌমাছি হুড়মুড় করে তার উপর ভেঙ্গে পড়ে।

অপরাধের শক্তি নিরঙ্কুশ, অখণ্ড চাক্ষুষ- নাগপাশ, তোকে আমাকে একসঙ্গে বেঁধে রাখে।

আমরা তো ডাইল মারি, লাল পানি মারি- আপনি কোন বাগিচার রসিক চান- আপনি এতো রাতে বাইরে কেন?

ঘুমাইতে গেলে পিঠ ব্যথা করে, জাইগা থাকলে তলপেটে পেশাবের চাপ হয়, বোঝেন না- পেশাবের চাপ! তাই বাইরে বাইরে ঘুরি, চক্কর দেই। আমি লোকগল্পের কালো কাউয়া- আগুন আনতে গেচিলাম- আগুনে ডানা পুড়ে গেচে, পাখা ছারখার হয়ে গেচে আমার। হ।

কে যাও অন্ধকারে কে এমন তারার পাশে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদো

কে এমন বাবার কোমরের ব্যথায় দানা দানা অশ্রুপাত করো

মেঘের নাকাড়ায় শঙ্খ বাজিয়ে রাত্রির কেশর কাঁপিয়ে কে তুমি

আগুনের গোলাপজল ছিটিয়ে বালুর পাহাড়ে দাঁড়াও আবারো

কে যাও অন্ধকারে কে এমন তারার পাশে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদো।।

কালো কাক- ওই যে কালো কাক জাতে উঠতে চায়। নদীতে সে ঠোঁট ধোবে, শূচি হবে, তারপর চড়ুইয়ের বুকের দুধ খাবে।

কাক আনন্দ গৌরবে ডানা ঝাপটায়। চোখ তার আনন্দ ছলছল করে। মাথা ঘুরিয়ে নামিয়ে এদিক ওদিক চায়। নদীর বুকে পানিতে ঠোঁট বাড়ায়। নদী সজ্ঞান সুদীপ্র শীতল। নদী বলে, আমি পাহাড়ের পবিত্র সরোবর থেকে বহমান, তার ফলেই দেখো আমি কতো নৃত্যবতী। নিবিড় আর ব্যাপ্ত। আমার জলে কতো সাধু-সন্ত সিনান করে, তুমি তাতে ঠোঁট ধুয়ো না- আমি অশূচি হবো। তুমি একটি মাটির পাত্র নিয়ে এসো- আমি জল তুলে দিই। তাই তো। কাক যায় কুমারের কাছে। কুমার বলে, আরে কালো কাক! তুমি তো এসেছো, বাহ্, তুমি এসেছো- আমি বড্ড খুশি হয়েছি- এসো হে, এসো এসো। কাক বলে, কুমার ভাই, কুমার ভাই, দাও বাটি দাও, দাও। নদী থেকে জল তুলি, ধুই ঠোঁট- তবে খাই চড়ুইয়ের দুধ। কুনার বলে, তা বেশ তো, বেশ বেশ। আমাকে একটু মাটি এনে দাও, তবেই হলো- সামান্য মাটি, তোমাকে বাটি বানিয়ে দিচ্ছি। কাক যায় অপার ধরিত্রী মাটির কাছে। কাক বলে,

মাটি ভাই, মাটি ভাই- দাও মাটি,  গড়বো বাটি

ভরবো জল, ধুবো ঠোঁট, খাবো চড়ুই বুকের দুধ।

মাটি বলে, আমি তো আমার নিজের মাটি তুলতে পারি না। ওই যে ওদিকে দেখো- একটি ষাঁড় দেখা যায়, তার তীক্ষ্ণ শিঙ আছে। ষাঁড়কে বলো মাটি তুলে দিক। কাক বলে, তাই তো! কাক এবার যায় ষাঁড়ের কাছে।

ষাঁড় ভাই, ষাঁড় ভাই দাও গুঁতা তুলো মাটি

গড়বো বাটি তুলবো জল তাতে ধুবো ঠোঁট

তবে আমি খুশি হবো খাবো চড়ুই বুকের দুধ।

ষাঁড় বলে, আমার ভীমের শক্তিবল ছিল বটে, এখন বড় ক্লান্ত। ক্ষুধায় লড়তে চড়তেও পারি না। তোমাকে মাটি তুলে দেবো কাক ভাই। তার আগে আমার খাবার ব্যবস্থা করো- ওই দেখো নাদুসনুদুস রাখাল। তার কাছে গিয়ে বলো- আমার খাবার ব্যবস্থা করো। তোমার মাটি আমি তুলে দেবো, তিন সত্যি। এবার কাক রাখালের কাছে যায়। রাখালকে সব বিত্তান্ত বুঝিয়ে বলে।  রাখাল উত্তর করে, আমি ষাঁড়কে খাবার দেবো। কিন্তু কাক ভাই, আমার কাছে যে ঘাস কাটার কাঁচি নাই। তুমি কামার বাড়ি যাও। কাক অতঃপর কামারের কাছে যায়। বলে,

কামার ভাই, কামার ভাই দাও কাঁচি রাখালকে দিই

রাখাল কাটবে ঘাস, খাওয়াবে দশাসই এই ষাঁড়

ষাঁড় দেবে গুঁতা তুলবে মাটি নিবো তা কুমার বাড়ি

কুমার বানাবে বাটি সেই বাটিতে তুলবো আমি জল

সেই জলে ঠোঁট ধুয়ে খাবো চড়ুইয়ের দুধ হাস্য টলোমল।

কামার বলে, আমার কাছে আগুন তো নাই। তুমি যাও গেরস্ত বাড়ি-নিয়া আসো আগুন- তাতেই তোমাকে আমি কাঁচি বানিয়ে দিই। কাক যায় গিরস্থ বাড়ি। গিরস্থ বউ ভাত রান্না করে- উনুনে আগুন লকলক করে। কাক বলে, গিরস্থ বউ, আমাকে আগুন দাও। ঠিক আছে কাক, তুমি অনেকটা পথ উড়ে তো এসেছো, আগুন দেবো তোমায়; কিন্তু তুমি আগুন নেবে কীভাবে কাক? আমার ঘরে বাড়তি লাকড়ি যে নাই। কাক আনন্দে লাফিয়ে ওঠে- কেন, এই যে আমার পাখা! আমার পাখায় আগুন নিবো। যেই কথা, সেই কাজ- নিজের ডানায় আগুন নিয়ে কাক কামার বাড়ির দিকে ওড়ে। আকাশেই কাকের পাখ আগুনে দাউদাউ জ্বলে ওঠে।

পুড়ে যাচ্ছি, পুড়ে যাচ্ছি মিরাশু। গোকুলপাড়া দিয়া মানুষ যায়, ডাক দে।

দৌড় মারবে।

ডাক দে।

ওই কেডাও- কেডা তুমি?

এই শুয়োর, এটা তো শালা দুলাভাইয়ের ডাক দিলে।

ওই, তোমরা এদিকে আসো।

আমাদের ডাকাডাকি করবেন না। আমরা মহিষবেড়ের মানুষ। এখানে আক্কাস দফাদারের ছেলে সাদেক মিয়াও আছে- সরকারের খাস লোক।

কথা বাড়াবি না- একমিনিটের মধ্যে আয়। কথা কম। সরকারের লোক পোন্দাও? না আইলে খবর আচে। দৌড়।

সাদেক মিয়া কে?

আমি।

এই কথা আর কোনদিন বলবা না যে তুমি সরকারের লোক। ঘাড়ে মাথা থাকবে না। সরকারি লোক মারাও!

আপনারা কোত্থেকে আসচেন?

সেগেন্ড শো।

কিসের সেগেন্ড শো?

সেগেন্ড শো বই দেইখা আসছি।

মহিষবেড়ের শওকতকে চিনো?

জি চিনি। সুন্দরসান্দর মানুষটা- ফজলি আমের লাহান সুন্দর। ওয়ালি চাচার ছেলে। খুব ভালো মানুষ। মাঝেমাঝে বাড়ি থাকে না- কই জানি যায়, মিটিঙ করে।ওয়ালি চাচা আমাদের বাড়ি আইসা পানপোন খাইয়া যায়। আমাদের ভাতিজা ভাতিজা বইলা খাতির করে।

তোমাদের মধ্যে কেউ বিয়াশাদী করচো? শরম পাইও না- বলো।

জি?

বিয়া করচো?

আমার বাড়ি ভুবেশ্বর। আমি শাদী করচি।

তোমার নাম কী?

আমার নাম- আমার নামডা জানি কী- ওই ফালু, আমার নামডা জানি কী?

মিরজালি।

জি, জি, মিরজালি, আমার নাম মিরজালি মিয়া।

কৌরাল ডাকে।

রাত অনেক হইচে।

বহুদিন পর কৌরালের ডাক শুনলাম।

কৌরাল নয়।

কৌরাল না! তাহলে কী?

মানুষ। কাজিমুল্লাহ।

মানুষ কৌরালের মত ডাক দেয়?

দেয়। কিন্তু ওইসব বাদ দেন।

মিয়া ভাই, ঢাকায় আপনার বাসা কোন জায়গায়?

নাজিমউদ্দিন রোড- চানখাঁর পুল- ইউনিভার্সিটির কাছে।

সব্বোনাশ! ইউনিভার্সিটিতে নাকি দিনেদুপুরে মানুষ খুন করে ফেলে?

ছেলে-মেয়েতে খুব প্রেম ভালোবাসা করে।

ওই একই কথা।

ওই মামু, মামু।

শিয়াল যারে, শিয়াল যা।

ধর, ধর, সামনে আইল, সামনে আইল।

ভাইজান, আপনাদের সবার বাসা কী একপাড়ায়, একলগে?

না। দুইজনের বাসা পুরান ঢাকায়। একজনের বাড়ি পয়সার মাল জায়গায়- বনানী, আগে ছিল হাতির পুল।

আমার একভাই থাকে গুলশান। আমি কোনদিন যাই নাই। ওইডা নাকি ঢাকা শহরের হেডমাস্টার- চৌধুরী বাড়ি। সিনেমাতে যখন শওকত আকবর নাইটড্রেস পইড়া বাইর হয়- তখন তার বাড়ি থাকে গুলশান- কী আলিশান বাড়ি একেকখান, বাপরে বাপ, খালি বড়লোক, হুদা বড়লোক, ইশ!

নিজের বাসা?

নিজের বাসা-ই। মালিকের।

চাকরি করে?

জি।

কী চাকরি?

মজার চাকরি- উত্তম কাজ। খালি খাওয়া আর ঘুম।

সে কী রোগী?

না না কী কন। মালিকের তো বিরাট বাসা- ঘোড়ার দৌড়ে একদৌড়। বাসায় ১০টা কুত্তা। সব কুত্তার ইংরেজি নাম- আলফি, বেন্ডিট, কেপটেইন, ডাস্টিন, গ্যাজেট, হান্টার, পেনিলোপ, স্যাসি, ডরোথি, ইয়াঙ্কি- এতোবার শুনচি- আমার এক্কেরে ঠাডা মুখস্থ।

ওরে বাপ, শ্বাস ফেলো, দম নাও একটু।

বাসাবাড়ি সব কুত্তা-ই পাহারা দেয়, আর ভাইয়ের কাম খালি কুত্তা পাহারা দেওয়া। গরু রাখালের চেয়ে অনেক সহজ কাম। আর কুত্তা অসুস্থ হইলে ভাই মাত্র২/১ দিন, বড়জোর ২/৩ দিন কুত্তার বদলে বাড়ি পাহাড়া দেয়। মালিক জানে- ভাই কী ডেঞ্জেরাস সাহসী ছিল- ভাই জেলে ছিল এই খবরও মালিকের জানা। তাই ভাইয়ের বেতন ভালো স্যার।

মালিক কী করে?

বড় অফিসার আছিল। একবার নাকি কী এক কোম্পানি খুইলা কোটি কোটি টাকা কামাই করচে- মাত্র একবছরে কোটি টাকা। এইবার বোঝেন- তার কী ক্ষমতা।

নেকবর ভাই কী চিনেন?

হ চিনি। তোমার ভাইয়ের নাম মানিক।

জি। আপনি কেম্নে জানেন?

আন্দাজ করে বললাম।

ভাই আগে বাড়ি আসতো না- লুকাইয়া পলাইয়া থাকতো, কী নাকি পার্টি করতো। আমি জানি না। আপনি জানেন?

তোমার হাতে কী?

পোটলা।

কিসের পোটলা?

জিলাপি। জিলাপির পোটলা- গুড়ের জিলাপি। খাইবেন?

কার লাগি আনছো। লজ্জা পাও কেন- বলো, কার লাগি গুড়ের জিলাপি আনছো?

মরিয়ম। আমার পরিবার।

তোমার পরিবারের লাগি আনছো?

জে না, আমার লাগি।

তোমার লাগি?

এইডা বড় শরমের কথা।

শরমের কথা হইলে বলো, অবশ্যই বলো।

বড় শরমের কথা।

বলে ফেলো। শরমের কথা না বললে পেট ফুলে যায়। বলে ফেলো।

বড় শরমের কথা ভাইজান, আমি বলতে পারবো না। ফালু!

মিরজালি আপনার ছেলে হিসাবে খুব ভালো।  আপনার কোন বেড রেকর্ড নাই। লেখাপড়াও জানে- বাংলা বই, কিতাব পড়তে পারে। খালি জরিনাকে একবার একটা প্রেমপত্র দিয়েছিল। ওইটাও সম্পূর্ণ মিরজালির দোষ ছিল না। একদিন জরিনা করে কী- আপনার পাকা পুকুরঘাটে এসে বসে, টানা টানা চোখে কাজল পরে জরিনা মিরজালিকে চোখে টিপ দেয়, এখানেই শেষ নয়, জরিনা একখান গানও গায়- নিশীথে যাইও ফুলবনে রে ভোমরা, নিশীথে যাইও ফুলবনে।

তারপর?

তারপরও মিরজালি নিজেকে সামলে নেয়, নিশিতে মিরজালি ঘরের বাহিরে যায় নাই, কেবল একটি প্রেমপত্র লেখে- তুমি আমার ঘুম কাড়িয়া নিয়াছো জরিনা, আমার ঘুম তুমি হারাম করিয়া দিয়াছো। মিরজালির মনে বড় একটা দাগা ভাইজান, জরিনাকে মিরজালি বিয়া করতে পারে নাই।

কোন ব্যাপার না। কতো আইবো, কতো যাইবো। শরমের কথাটা কি- সেটা বলো।

যে মেয়েকে বিয়ে করে মিরজালি, তার আদব লেহাস ভালো, ডৌলনকশাও মাশাল্লাহ খারাপ না।

আচ্ছা, শরমের কথাটা বলো।

জি, জি৷ আজ আমরা বেচুইনকান্দির হিকমত মৌলানা সাবের কাছে গেছিলাম একটু দাওয়াই আনতে। সামান্য একটা ব্যাপার- কতো ডাক্তার কবিরাজ দেখানো হইলো, কিন্তু আরোগ্য হয় নাই। আজ মৌলানাসাব জিলাপি-পড়া দিচেন, গুড়ের জিলাপি। দেখা যাক, কদ্দূর কী হয়।

আসল কথাটি বলো, ডানে বামে ঘুরতেচো কেন?

মরিয়ম- মিরজালির পরিবার খুব ভালো মেয়ে- রংটা কেবল কালো। আমাদের মিরজালি মিয়া তো একনাম্বার ফর্সা- ইংরেজ। হলে কী হবে- বড় লজ্জার কথা।

কী কথা সেটা কন মিয়া।

ঘুমের মধ্যে সেই জরিনা মেয়েটা সুন্দর করে মিরজালির ঘরে আসে, হাত ধরে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। বলে, মিরজালি মুতো, মুতো। ঘুম থেকে উঠে মিরজালি দ্যাখে- বউয়ের কোল দরিয়া- মিরজালি বউয়ের কোলে মুতে দিয়েছে- রোজ রাতে ভাইজান, প্রতিরোজ।

মিডেল ইস্টে পাঠিয়ে দিন, মরুভূমির দেশ, পানিটা কাজে লাগবে।

তোমার নাম কী?

রবিউল আওয়াল।

কী নাম?

রবিউল আওয়াল। আমি সিনেমা বই চলচ্চিত্র দেখি নাই। ওয়াজ নসিহত শুনে আসছি। বাড়ি থেকে একসাথে বের হইচি। আক্কাসকে বলছি- আক্কাস, আমাকে ফিরতি পথে মাহফিল থেকে নিয়া যাইও। আমাকে তারা ওয়াজ নসিহতের মাহফিল থেকে নিয়া আসছে। আমি দরুদ শিখে আসছি:

সালাতু সালাম গো আমার

দরুদে সালাম গো আমার

কইয়ো নবী মোস্তফায়

তোমরা যদি যাও গো মদিনায়।

মদিনার পূর্ব পাশে ছোট্ট একখান

পাথর আছে গো

সেই পাথরে চুমা দিলে, সেই পাথরে চুমা দিলে

একটি গুনাও থাকে না

তোমরা যদি যাও গো মদিনায়।

তুমি বড় হইয়া কী করবা?

গরু জবাই করবো।

মাশাল্লাহ!

বড়ভাই, বড়ভাই বহু সহ্য করচি, আর না। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে পড়ছে- আর সহ্য করতে পারি না।

আরে কি হলো, হঠাৎ চিল্লাও ক্যান?

না ভাই, আর না। দেখেন ওরা কুককুক করে হাসে।

ক্যান, হাসে ক্যান?

মিরজালির লজ্জার কথা বলছি তাই। আপনি এর একটা বিহিত করেন।

আবার হাসে। এক যাঁতা দিয়া ধরবো।

আমি ছাইড়া দিবো বাঞ্চোত?

আরে আরে এটা কী- মারামারি শুরু করছো?

আমার গ্রামের ইজ্জত।

মহিষবেড়ের লোকের গায়ে হাত তুলছোস- এত্তোবড় সাহস, এত্তোবড় কইলজা। তারে মত সোজা করে ফেলবো, আমারে চিনস?

ভাইজান, ধরবেন না। আমি বাপের নাম ভুলাইয়া ছাড়বো।

ভুবেশ্বর গ্রাম নিয়া মশকরা করো, নারিঙ্গি ছুটাইয়া দিবো।

মহিষবেড় গ্রামের লজ্জার কথা কম আছে? আমরা হাসাহাসি করি?

মহিষবেড়ের লজ্জা কী?

আছে। সবাই জানে। লজ্জার ব্যাপার। বলাবলি করি না।

এখন বলতে অইবো। ভাবছিলাম ঢাকার মেহমান আসছে, উনাদের সামনে আমাদের মানইজ্জত নিয়া টানাটানি করবো- এটা ভালো দেখায় না।

কী ঘটনা! হা হা। ভিতরে চুলকায়। বলে ফেলো, বলে ফেলো।

মাইরা ফেলচে।

শঙ্কর ঢোল বাজাও, ঢোলের সঙ্গত দাও।

দৌড় মারছে সাব, দৌড় মারছে।

যাও কই- বাব্বারে যাও কই?

কী ঘটনা বলো। শঙ্কর, ঢোলের সঙ্গত কই?

বলতেই হবে ভাইজান?

হ।

আপনারা বেয়াদবি নিবেন না। বলতে গেলে বড় শরমের কথা।আবার ওই যে নিজেদের মধ্যে ঘটনা। লজ্জা লাগে। মহিষবেড়ের উত্তর দিকে এক ছোট পাড়া আছে- এইডারে কয় পাকুড়তলা। পাকুড়তলার একটা ঘরে থাকে রব্বানি আর রব্বানির মা হালিমন। রব্বানির বাপে গেচিল পাকিস্তান- বড় সংগ্রাম করে গেচিল, মোজার ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতো। পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ।  ফোরকান সকস মেনুফেকচারিং কোম্পানি। গ্যাছে তো গ্যাছে, মেলাদিন তার কোন খোঁজখবর নাই। রব্বানি আপনার তখন ছোট- নাবালেগ বাসকিনা মেয়েছেলে। ছোট মেয়ে রব্বানিকে সাথে নিয়ে হালিমন বানু দিন গুজরান করে। কিন্তু রাত্রে তারে কেডায় খালি উৎপাত করে, ঘরের চালে ঢিল মারে। এইরকম উৎপাত সইতে সইতে একদিন হালিমন বানু কয়- ঘরে আইলেই তো অয়, নিশিরাইতে কুহু কুহু ডাকে দুই চোক্ষের পাতা এক করবার পারি না। কাল আইসো, ঘরের দরজা ভিতর থেকে খোলা রাখবো!

রে, ফিলিম তো জইমা উঠতেচে মনে কয়।

পরদিন রব্বানির মা হালিমন ভিতর থেকে দরজা খুলে রাখে। রাত দেড়টায় জিঞ্জিরার সেন্ট গায়ে মেখে নাগর ঘরে ঢোকে- কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, আমি আসচি হালিমন, হিহিহি, আমি আসচি। আমার গলা শুকাইয়া আসে, এক গেলাশ পানি দাও হালিমন, আগে কলিজা ঠাণ্ডা করি, হিহিহি। একটু পর নাগর চিল্লান দিয়া ওঠে, মুখ দিয়া জান বাইর হইয়া আসে, তবু গলার স্বর চাপা- মাইরালছে, মাইরালছে, উফ!

কী হইছে, কী হইছে?

নুনু কাইটা ফেলছে। নুনু কাইটা ফেলছে।

কার? কার?

নাম কই না, নাম কই না- সিরু মিয়া, সিরু মিয়া।

শঙ্কর। শঙ্কর।

বাজা, বাজা, ঢোলে বাড়ি দে।

আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি

ইরান তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি

নয়নেরই বাণ দিয়ে গো যৌবনেরই দোল দিয়ে গো

নূপুরেরও তালে তালে তোমায়  আমি বেঁধেছি

জানি জানি ওগো তোমারে যে বেঁধেছি

আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি।

শঙ্কর। শঙ্কর।

জি সাব, বলেন।

বন্ধ কর। বাজনা বন্ধ কর।

দেখ, দেখ ওইদিকে কী সসার নামছে?

নেকবর ভাই, নেকবর ভাই দেখেন। ওইদিকে কেটায় বুঝি দৌড়াইবার লাগছে।

কাজিমুল্লাহ। কাজিমুল্লাহ। কাজিমুল্লাহ গাছ থেকে নেমে আসছে।

গাছ থেকে নেমে আসছে! এতো রাতে কে গাছ থেকে নেমে আসছে!

ভেজাল আছে না-কী?

না, ভেজাল কিছু নাই।

আপনি ঘামছেন- ছটফট করছেন কেন?

ভয়ের কিছু নাই। আপনারা চলে যান। আপনাদের সঙ্গে দেখা হলো, আলাপ পরিচয় হলো।আমার ভালো লেগেছে। আপনাদের কোন আদর আপ্যায়ন করতে পারি নাই।

আপনার কী হয়েছে নেকবর ভাই? শরীর খারাপ লাগছে? তাহলে আমরা চলে যাই।

না, আপনারা থাকেন। আমার পিঠে ব্যথা, শরীরের প্রতিটা জয়েন্টে পেইন আছে আমার।

কী হইছে মাগার, ভয় পাইছেন- লাইফ রিক্স হইছে? ভছকাইয়েন না, জগলু হালায় আছে- ফুটা কইরা দিমু।

এখন রাতের তিনপ্রহর। সে বহু বহু পুরনো দিনের কথা। এই গাঙ- গাঙ্গের বালু- যে বালু দিয়া আপনারা পাহাড় বানাইচিলেন, বালুর পাহাড় আর একসাথে থাকে না- বালু ঝুরঝুর করে ভাইঙ্গা পড়ে। এখানে একদিন কাকের চোখের মত কালো পানি ছিল, আর কালো শীতল পানির শিথানের উপর রাতের এই প্রহরে কৌরাল ডেকে উঠতো। একে একে ঘুম ভেঙ্গে যেতো সবার, আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠতো সবাই। হাট করে দরজা খুলে যেতো সবার, আর ওই যে আসমান- আসমান ভরে যেতো লাল, নীল পরীর ডানায়, তামাম সংসার ভরে যেতো পাখায়, রঙে, আশায়। আপনারা কী দেখতে পান? আমি দেখি- লাল, নীল পরীদের ঝাঁক। এ গ্রামের কোল ঘেঁষে তারা নদীর ভরা জলে নামতো- তারা নৃত্যকোলাহল করে উঠতো। এ-গ্রামে, এমন গ্রামেই তো পরীদের হাট বসতো- আকাশ থেকে নেমে আসা পরী, আমাদের মনের ঘোর থেকে নেমে আসা পরী! এ নদী- আমাদের যাদুকাটা নদী- এখন কেবলই বালু খসখস করে।

চলেন, হাঁটাহাঁটি করে আসি- বাড়ির দিকে যাই।

দেখেন, ওই জিনিসটা বেজান দৌড়াদৌড়ি করবার লাগাইছে মাগার।

সময় ঘনিয়ে আসছে। আর কতোক্ষণ পরেই কাজিমুল্লাহ কৌরালের ডাক দিবে। বহুদিন থেকে পরী আসে না। কিন্তু কৌরাল ছিল। রাতের তিনপ্রহরে কৌরাল ডেকে উঠতো- ক… ক… ক…। এখন আর কৌরালও নাই। কাজিমুল্লাহ আছে। কাজিমুল্লাহকে আর্মি- পাকিস্তানের আর্মি নয়- বাঙলাদেশের সশস্ত্র আইনের পা ধরে নিয়ে যায়। আর এমন টর্চার করে…

নেকবর ভাই, নেকবর ভাই।

টর্চার ক্যাম্প থেকে বের হয় কাজিমুল্লাহ। বন্ধুরা কমে যেতে থাকে, সবকিছু কেমন ঝিমিয়ে যায়, ছিমছাম স্বাভাবিক হয়ে আসে। মঈনুল, হারিস, কাউসার, গোলাপ, মুতা, সবুক্তগীন, পরিমল,  নিভস্বা, হাবিব, কামাল, ফরিদা, জহির, লক্ষ্মী, জয়ন্ত, মারুফ- তাদের কাউকে সে আর আগের মত পায় না। পুকুরে একটা বড় ঢিল ছুঁড়লে যেমন পানি কেঁপে কেঁপে একটা বড় ঢেউ তোলে, আবার একটা সময়ে আস্তে আস্তে পানির ফলাগুলো স্থির হয়ে বসতে থাক, একসময় আর মনেই হয় না- এখানে এতোবড় একটা ঢেউ উঠেছিল। জল আগের মতই হয়তো স্থির হয়ে বসে, কিন্তু ঢিলটি তখনও শ্বাস নেবার জন্য পানির নিচে ছটফট করে, কিন্তু কেউ তাকে দেখে না- দেখবার সময়ও করে উঠতে পারে না। কাজিমুল্লাহও ঠিক ওই ঢিলটার মত হয়ে যায়- সবার আড়ালে হাঁসফাঁস করে, ছটফট করে, কিন্তু দম পায় না। কাজিমুল্লাহ একসময় পাগল হয়ে যায়- সম্পূর্ণ উন্মাদ। আমি গরু পাচার করি- কাজিমুল্লাহ গাছে গাছে থাকে- আর কৌরালের মত ডাকে- রাতের প্রহরে প্রহরে কাজিমুল্লাহ কৌরাল ডাকে। তোমাদের মধ্যে কে জানি ওয়াজ নসিহত শুনে আসছো?

আমি।

তোমার যেন কী নাম?

রবিউল আওয়াল।

তুমি বড় হয়ে কী করবা?

গরু জবাই করবো।

এই আমার ছোরা। লও, তোমার হাতে লও।

কী কন, এইসব কী কন ভাই?

হ। আমারে জবাই করো।

হায়, কী কন!

হ। গরু জবাই করা অরেকটিস হোক। করো।

ক… ক… ক…

আহারে কাজিমুল্লাহ ডাকে। এ গ্রামের আকাশে কী আবার ভিড় করে উড়েউড়ে আসে- সব দুয়ার কী হাট করে খুলে যায় আবার- শনশন করে কী তীব্র হাওয়ার শিস ওঠে দেখো!

কে বেজান দৌড়ে দৌড়ে যায়।

কাজিমুল্লাহ।  কাজিমুল্লাহ।

ক… ক…ক…। ক… ক… ক…।।

*==**==**==**=*