তবুও কি গল্পগুলি আড়ালেই রয়ে যাবে?
মনজুরুল ইসলাম
লেখকের মননে অন্তরিত ভাবনা এবং সে ভাবনার উপস্থাপন শৈলী সময়ের সাথে সাথে কখনো উৎকর্ষ অর্জন করতে পারে, আবার কখনোবা একটি নির্দিষ্ট স্তরে অবস্থান করতে পারে। অথবা সে স্তরটি হয়ত স্থিত স্তর থেকে নিম্ন স্তরে পৌঁছতে পারে। তবে পুরো বিষয়টি নির্ভর করে লেখকের নিয়ত চর্চার ব্যাপ্তি ও সামাজিক আবহকে নিরীক্ষণের তীব্রতার ওপর। স্পষ্ট করে বললে, লেখকের অতীত পাঠ থেকে বর্তমান পাঠের উৎকর্ষগত পার্থক্য এবং নানামুখী জীবনাচরণ পর্যবেক্ষণ দৃষ্টির গভীরতা। পাঠ ও জীবনাচরণের ওপর লেখক যত পরিমাণে অনুধাবনের দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন ততই তিনি তার লেখার ওপর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হবেন। অর্থ্যাৎ লেখক নিজেই নিজের সৃষ্টিকে ভেঙ্গে পুনরায় অধিকতর সৌন্দর্যের প্রলেপনে তার সৃষ্টিটিকে প্রলেপিত করতে সক্ষম হবেন। সেটি হতে পারে গল্প, প্রবন্ধ কিংবা সাহিত্যের যে কোনো শাখা। তবে যে শাখাতেই হোক না কেন, ভাবের বিস্তার ও উপস্থাপনার অনুপম শৈলীর সমন্বয় যে সন্দেহাতীতভাবেই দীর্ঘকাল থেকে একটি স্বীকৃত মানদণ্ড তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
স্বীকৃত এই ভাবনাকে অবলম্বন করে যখন একজন লেখক বিশেষত গল্পকার, গল্প সৃজন করতে থাকবেন তখন হয়ত তার সৃজন প্রক্রিয়ায় অতীত এবং বর্তমান উপস্থাপনার মধ্যে একটি ইতিবাচক পার্থক্য প্রতীয়মান হয়ে উঠবে। উদাহরণস্বরূপ, শুরুর দিকের গল্প নির্মাণ প্রক্রিয়ায় ঘটনার প্রাধান্য দৃশ্যমান হলেও পরবর্তীতে হয়ত সেই ঘটনাটির উপস্থাপন ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হবে। এবং এটি হবার সম্ভাবনাই বোধকরি অধিকতর হবে যদি লেখকের মধ্যে অনবরত উদ্ধৃত বিশিষ্টতা দুটির কর্ষণ চলতেই থাকে। সেক্ষেত্রে তার রচনার প্রতি পাঠকের আগ্রহ বেড়েই যাবে, পাঠক যখনই তার লেখা দেখবেন তখনই তা গ্রোগাসে গিলত থাকবেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “ যে রসের পরিবেশনে মহারসিক জীবনের অকৃত্রিম আস্বাদনের দান থাকে সে রসের ভোজে নিমন্ত্রণ উপেক্ষিত হবার আশঙ্কা থাকে না (১)।’’
মিজানুর রহমান নাসিম, একজন গল্প লেখক। মাজহার জীবন সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা ‘লেখালেখির উঠান’। সে পত্রিকায় বিড়াল শিরোনামে গল্পটি পাঠের মাধ্যমে তার লেখার সাথে প্রথম পরিচয়। গল্পের শুরু থেকে শেষ অবধি পড়বার পর তীব্র এক দায়বোধ নিজের মধ্যে অনুভূত হয়েছিল অথবা গল্পকার দায়বোধটি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু কীভাবে?
বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে যখন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ, সমস্ত প্রাণীকূল ও প্রকৃতির প্রকৃত রূপকে নির্ভার পদচারণার সুযোগ করে দিতে সক্ষম হবে ঠিক তখনই মানুষ হিসেবে তাদের স্বকীয়তা প্রোজ্জ্বলরূপে প্রতীত হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মানুষের মাঝে সেই অনুভূতিলব্ধ দায়বদ্ধতাটি ক্রিয়াশীল নয় আজ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। এবং এ বিষয়টিই অত্যন্ত সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে“বিড়াল” নামীয় গল্পটিতে। গল্পকারের বয়ানে “পৃথিবী সত্যিই শুধু মানুষের দখলে। এখানে অন্যদের নির্ভার হওয়ার সুযোগ নেই। এখানে ইতর প্রাণীদের, বিড়ালের, পথ কুকুরের, শেয়ালের চোখের দিকে তাকালেই তাদের চোখের মনিতে ফুটে ওঠে অনুকম্পা প্রাপ্তির আশা। কিন্তু তারা যে প্রতিনিয়ত অনুকম্পা থেকে বঞ্চিত হয়ে উদ্ধাস্তু ফেরারীর মতো জীবন যাপন করে তারই সুনিপূণ উপস্থাপনা গল্পটি। গতানুগতিক ভাবনা ও পরিবেশনার থেকে স্বতন্ত্র এ গল্পটি যেন সূচনালগ্নে বর্ণিত শোভমান রচনার একটি আদর্শ উদাহরণ।
উপরোক্ত গল্পটির সূত্র ধরেই অতঃপর একে একে পড়া হলো গল্পকারের নিঘুমওয়ালা, সমাধি, গোধূলী রঙের গল্প, অন্তর্দাহ, পাতিপিসি, যুদ্ধ দিনে, দিগম্বর, প্রজাপতি এবং সর্বশেষ বাসন্তী গল্পটি। প্রতিটি গল্পের বর্ণনা বৈভব, উপস্থাপনা শৈলী, বিষয়ের বিচিত্রতা এবং বিশেষভাবে প্রতীকের ব্যবহার গল্পগুলি পাঠের উপযোগীতাকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে পাঠক তো অবশ্যই, লেখকদের ক্ষেত্রেও। এবার সেই উপযোগিতার যথার্থতাকে প্রমাণের নিমিত্তে সামনের দিকে এগুনো যাক।
নির্মোহ দায়বোধ এবং চরম নিঃসঙ্গতা যে একজন মানুষকে উত্তাল ঢেউয়ের মতো আন্দোলিত করতে পারে, চিত্তের গভীরে নিরন্তর জ¦লতে থাকা ক্ষোভগুলোকে অবলীলায় প্রকাশ করতে পারে– সেটির সত্যতা হয়ত গল্পের মুখ্য চরিত্র মহুবরের মতো হাজারো শ্রমিকের কণ্টকাকীর্ণ জীবনের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হতে পারে। পুঁজিপতিদের ভোগসর্বস্ব জীবনের প্রতি ঘৃণা লালন করেও তারা যে দায়বদ্ধতা থেকে বিন্দু পরিমাণ সরে আসেন না; এমনকি কর্তব্যের মাত্রাকে বলিষ্ঠ করতে কুকুরদের বন্ধু হিসেবে অবলীলায় গ্রহণ করেন তা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ‘নিঘুমওয়ালা’ গল্পটিতে। গল্পের অন্তিম অনুছেদে সে যন্ত্রণাক্লিষ্ট অনুভবটি ফুঠে ওঠে এভাবে “এ দুনিয়াতে ওরা ছাড়া (কুকুররা) কে আমাকে এমন সম্মান বা দয়া দেখায়, কে বিনে পয়সায় সঙ্গ দেয় রাতের পর রাত আর অভিশপ্ত নির্ঘুম রাতগুলোতে ঘিরে থাকে প্রেমিকার মতো। ওরা আছে বলেই কিনা ছিঁচকে চোরদের সামনে আমার বুড়ো হাঁড়ের তাগদটা বেড়ে যায়।’সমতার পৃথিবী নির্মাণের যে তাড়না মহুবরের মধ্যে দিয়ে গল্পকার পাঠকের বোধবৃত্তে স্থাপন করে গেলেন তা নিশ্চিতভাবেই অস্থির সমাজের একটি অভাবনীয় প্রতিবিম্ব।
একই সাথে অতীত হারিয়ে অতীতকে খুঁজে পাবার মধ্যে যে শুধুমাত্র বেদনামিশ্রিত নিঃসঙ্গতাই প্রাপ্তি হিসেবে ধরা দেয় তার একটি স্নিগ্ধতাময় সৃজন “সমাধি” গল্পটি। গল্পটি মূলত গভীর দুঃখবোধ থেকে উৎকলিত পূর্বাহিক ভাবনার একটি অনুপূক্সক্ষ বিশ্লেষণ; যেখানে স্থান পেয়েছে পরিবার ও প্রতিবেশের নস্টালজিক স্মৃতিচারণ। এবং এই স্মৃতিচারনের সাথে গল্পকারের অন্তর্গত চিন্তার তুলনামূলক দৃষ্টান্তের আখ্যান। এবং সেটি উন্মোচিত হয়েছে কখনো মোহনীয় সুরে, কবিতার চরণে, গল্পকারের জীবনবোধ কিংবা মূল্যবোধভিত্তিক চলচ্চিত্রের আরশিতে যা মোটা দাগে কল্পনার আবেদনকে করে তুলেছে অধিকতর ঐশ্বযমণ্ডিত।
প্রতিবন্ধকতার সীমানায় অবস্থান করেও জীবনের সমাপ্তি যে ভালোবাসা নামীয় একটি ফুলেল অনুভূতির স্থির বিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকে সেটিও অনাবৃত থেকেছে গল্পটিতে। গল্পকারের দৃঢ় বিশ্বাস এটিই যে, “ স্নিগ্ধ এক ভালোবাসায় জড়িয়ে আছে ওরা (বাবা–মা)। পাশাপাশি। কি অন্তহীন ভালোবাসা, এমন এক ভালোবাসা যার সমাপ্তি বা পথের শেষ নেই যদিও গ্লানি ও জরাগ্রস্ত দেহের কষ্ট দুনিয়াদারীর বেশির ভাগ সময় পার করতেন ওরা। পরস্পরের প্রতি ছিল কটাক্ষ এবং বিদ্রুপ, নিমেষেই আক্রমণ করতেন একে অপরকে। সব এখন এসে থির দাঁড়িয়েছে ভালোবাসার একক বিন্দুতে। ভালোবাসার কী অসীম আকর্ষণ। মরণকেও কী মমতায় জড়িয়ে থাকে। এই সব যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, মনে হল ঈর্ষা বা দুঃখ ভারাক্রান্ত মন দিয়ে পাশ থেকে উড়াল দিল এক দেবদূত–যেন পৃথিবী থেকে এই তার শেষ প্রস্থান। মাটিতে গড়া মানুষের ভালোবাসার কী মহত্ব।”
পক্ষান্তরে, এটিও সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত যে, দর্শন ভিত্তিক প্রগাঢ় ভালোবাসার অন্তরালে যদি সেই দর্শনকেই পুঁজি করে আত্মসিদ্ধি অর্জনের নিমিত্তে ভণ্ড ও মুখোশধারী নেতার কর্ম প্রতিফলিত হয় তবে তা প্রতিশ্রুতিশীল তরুণের বৈষম্যহীন পৃথিবী প্রতিষ্ঠার পথকে রুদ্ধ করে। যে প্রদীপ্ত তারুণ্য বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত থাকবে হয়ত সেই তারুণ্যই সময়ের ধারাবাহিকতায় স্ব–বৈপ্লবিক প্রচেষ্টাকে ঘৃণা করতে শুরু করবে। তার কাছে হয়ত এই প্রশ্নগুলোই প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে “নেতাদের সাউদগিরি খোঁজ নিয়ে দেখো। খোঁজ নিয়ে দেখেছো কোনো দিন? স্বর্গের দেশ গড়বে বলে নিজেরাই আগেভাগে ভোগে নেমেছে। তোমাদের বিপ্লবের টাকা এখন শেয়ার বাজারে খাটে বুঝলে! কোটি টাকার ফ্ল্যাটও ওদের নামে। বিপ্লব হলেই কি আর না হলেই কি, ওরা যা পাওয়ার তার সবটুকু পেয়েছে। মিছেমিছি তোমরা বোকারামেরা জীবন বিলিয়ে দিলে। আর দেখো গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। যারা তোমার সাথে মিছিল করেছে, আজীবন রাজনীতি করবে বলে ওয়াদা করেছিল, তারা এখন কেমন ফার্স্ট ক্লাস জীবন কাটাচ্ছে। ওদের কাছেও বিপ্লবটা ছিল মুখের বুলি। তুমিই শুধু বুঝলে না। নিজেকে প্রায় খরচ করে ফেললে। কি লাভ হলো! ভবঘুরে। বিয়ারিং। এই বয়সেও বিয়ারিং চলছো।”
এমন আত্মদগ্ধ যন্ত্রণার পাশাপাশি পরিবার ও ভালোবাসার মানুষটিকেও ন্যূনতম ভালোবাসা প্রদানের ক্ষেত্রে সংকুচিত হবার হতশ্রী ও খণ্ডিত মানসিকতা ক্রমাগত এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ধাবিত করবে এক সময়ের সংগ্রামী তরুণকে। আকাশের তারার মতো জ্বলতে থাকা তরুণ হৃদয়ের স্বপ্নগুলো কি এভাবেই মাঝপথে এসে আত্মহননের পথ বেছে নেবে–এমন একটি সর্বজনীন প্রশ্নই রেখে গেলেন গল্পকার তার “গোধূলী রঙের গল্প”গল্পটিতে। একই সাথে, এক সময়ের পূজিত দর্শনটিকে এমনভাবে তুলে ধরলেন যা ভবিষ্যত তরুণদের এমন স্বপ্ন বুননের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। ভুল বার্র্তা হিসেবেও পৌঁছে যেতে পারে বিপ্লবে অগ্রগামী তরুণদের কাছে।
বস্তুত যোগ্যতার মাধ্যমে ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতকরণের প্রচেষ্টা দোষের কিছু নয়, যদি সেই প্রচেষ্টার অন্তরালে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় লিপ্ত, সাধারণ মানুষের, মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবার ইচ্ছেটি তাদের মাঝে অনড় থাকে। কারণ পৃথিবীতে প্রকৃত সুখ অর্জন করতে হলে, সবাইকে নিয়েই তা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। অসুস্থ কিংবা অনুন্নত সমাজে সুখী হবার চেষ্টা করাই হবে–হাস্যকর, যেহেতু এ ধরনের সুখ সীমাবদ্ধ থাকে শুধু ভোগের মাঝেই। আমরা সব সময়ই ভুলে যাই, জীবনের মূল্য সবার কাছেই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আকুতি সবার মাঝেই দুর্বার। বস্তুত, সেটি প্রকাশ পায় নিশ্চিত মৃত্যে উপনীত হবার তীব্র মুহূর্তে। অর্থ কিংবা পদবী তখন আর কোনোভাবেই প্রভাবক হিসেবে কাজ করে না।
নাগরিক জীবনের বাস্তব আবহ থেকে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তের অনুভূতিগুলি কেমন হতে পারে তাই–ই গল্পকার তার সূ² পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে চিত্রিত করেছেন ‘অন্তর্দাহ’গল্পটিতে। নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী কর্মকর্তা যে কতটা অসহায়ত্বের সম্মুখীন হতে পারে তা পাওয়া যায় সেই কর্মকর্তার কণ্ঠেই। “এই অফিসের একজন কর্মকর্তা হিসেবে তার দায়, পদমর্যাদা স্রেফ তামাশায় পরিণত হয়েছে। ফুটপাতে বসে থাকা পঙ্গু ভিক্ষুকের চাইতেও সে এখন বড় দুর্ভাগা। কেউ এগিয়ে আসছে না। সে যেন মহাপাতক যুদ্ধবন্দী শক্র।”
মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তের চরম অসহায়ত্বের পাশাপাশি একজন নারী যে তার পুরো জীবনকালই কতটা নিদারুণ অসহায়ত্বের মধ্যে দিয়ে যাপন করে সেটি আমরা দেখতে পাই ‘পাতিপিস’ গল্পটিতে। একটি সম্ভ্রান্ত সনাতন পরিবারের বন্ধনগুলি কীভাবে এলোমেলো হয়ে যায় তার বর্ণনাটি বিধৃত হয়েছে ভিন্ন এক স্বরে যা গল্পটির উপস্থাপন ভঙ্গিকে প্রদান করেছে প্রাতিস্বিক স্বাতন্ত্র্য। গল্পের মূল চরিত্র পাতিপিসির বর্নাঢ্য প্রারম্ভিক জীবন এবং যন্ত্রণাময় জীবনের মধ্যে সীমাহীন প্রভেদের চিত্রটি গল্পকার বণর্না করেছেন রমুর মধ্য দিয়ে। এবং রমুর আবেগতাড়িত অনুভূতি যে পুরো সমাজের অনুভূতিপ্রবণ মানুষগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেছে সেটি নিঃসন্দেহ।
যাইহোক, যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি তাদের পরিবার কতটা উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে সময় পার করেছিলেন তারই একটি নিটোল বর্ণনা আমরা দেখতে পাই গল্পকারের ‘যুদ্ধ দিনে গল্পে। গল্পটিতে একজন স্ত্রী, স্পষ্ট করে বললে, গ্রামীণ সরল নারী তার প্রতিটি ক্ষণ কতটা মানাসিক নির্যাতনের ভেতর দিয়ে অতিবাহিত করেও মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর জন্য অপেক্ষা করেন, নিয়ত ¯স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে চলেন তার বাঁধাহীন ধারাবাহিক বর্ণনা বর্ণিত হয়েছে দীর্ঘ সময় পর মুক্তিযোদ্ধা মেয়ের স্মৃতিচারণে।বিশেষত, গল্পের একটি অনুচ্ছেদজুড়ে গল্পকার ভাস্করের মতোই এমন একটি মুক্তিযুদ্ধের চিত্রপট আঁকলেন যা যথার্থই হৃদয়স্পর্শী– “টাঙ্গাইল থেকে পাথালিয়া, পথে পগারে পড়ে আছে অসংখ্যা মৃতদেহ। শিয়ালে শকুনে টেনে হিঁচড়ে খাচ্ছে লাশ। পথের পাশে ঝোঁপ–জংলায় শিয়াল শকুনের টানাটানিতে মৃত নারীর পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে সন্তানের অর্ধগলিত দেহ। ধর্ষিত যুবতীর কাটা স্তন কুরে কুরে খাচ্ছে ভাগাড়ের কীট। পচা লাশের দুর্গন্ধে নাড়ি–ভুড়ি উগলানো বমিতে নাকাল হচ্ছে পথচারী। পুরো দেশটাকে বুঝি জাহান্নামের ভাগাড় বানিয়ে ফেলেছে পিচাশরা।” একইসাথে পূববর্তী কাহিনীর প্রেক্ষাপটে (Flashback) রচিত এ গল্পটিতে প্রবলপ্রতাপের সাথেই ব্যক্ত হয়েছে সেই সময়ের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, সামাজিক প্রতিবেশ এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের আখ্যান। তবুও পুরো গল্পটিতে বাঁক বদলের আয়োজন (( Twist) থাকলে হয়তো আরও অধিক শক্তিমত্তার সাথে পাঠককে প্রভাবিত করতে সক্ষম হতো গল্পটি।
দৃষ্টির তীর্যক গভীরতা পরবর্তী গল্পটিতে (দিগম্বর) প্রতীয়মান হলেও মূল চরিত্রের দ্বি–চারী ব্যক্তিত্বের প্রকাশ কাহিনীর বিশ্বাস যোগ্যতা সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয়েছে। যে ব্যক্তি অপরের অনুগ্রহ নিয়ে ঈদের চার পাঁচ দিন সময় অতিবাহিত করতে কুণ্ঠাবোধ করেন পক্ষান্তরে সেই একই ব্যক্তি কীভাবে প্রতিনিয়ত একজন সামান্য কর্মচারীকে অনুরোধ করে হাসপাতালের বেডে থাকবার আগ্রহ প্রকাশ করতে পারেন? গল্পকার এখানে যেন কিছুটা আরোপিতভাবেই কাহিনীকে টেনে নিয়ে চলেছেন গন্তব্যের দিকে। তবে পুনরায় যে বিষয়টির কথা বলতে হয় সেটি হলো গল্পকারের সমাজকে পাঠ করবার স্বকীয়তা এবং অন্ত্যজ শ্রেণীর জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ভাববার প্রতাপপূর্ণ ক্ষমতা।
“প্রজাপতি” গল্পটিতেও অনন্য এক ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়ে গল্পকার নিজের উচ্চতাকে উন্নতি করেছেন অন্য এক স্তরে। গল্পের মূল চরিত্র চারটি। আশ্চর্যজনকভাবেই, চরিত্রগুলোর প্রত্যেকই মৃত। এবং সীমানার ওপারে থেকে তাদের যে কথোপকথন তা চূড়ান্ত অর্থেই গভীর ভাবের উদ্রেককারী। পারিবারিক আবহের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবেগগুলো যেমন ফুটে উঠেছে গল্পটিতে, তেমনি বাদ যায় নি স্বকীয় সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কিত অমূল্য আলোচনা। তবে শাদা চোখে দেখলে হয়ত শুরুতেই গল্পটির দুর্বোধ্য উপস্থাপনা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠতে পারে তা স্পষ্ট। বিশেষত, স্রেফ গল্প হিসেবে যারা গল্পটিকে পাঠ করতে চাইবেন।
সর্বশেষ “বাসন্তী” গল্পটিতে গল্পকারের প্রান্তিক অঞ্চলের ভঙ্গুর আর্থনীতিক সচেতনতা ফুটে উঠেছে যেন ভঙ্গুর জনপদে বাস করতে থাকা সরল মানুষগুলোর সরলতার মতোই। টেকসই উন্নয়নের পরিবর্তে অস্থায়ী উন্নয়ন কার্যক্রমকে জিইয়ে রেখে দুর্দশার আকরে সতত নিমজ্জিত বঞ্ছিত জনগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে বছরের পর বছর ধরে জনপ্রতিনিধি, এনজিওকর্মী ও প্রশাসনের ব্যবসা করার যে আগ্রাসী প্রবণতা দৃশ্যমানতারই একটি শক্তিমান প্রচ্ছদ গল্পটি। পাশাপাশি বাসন্তীকে ব্যবহার করে সংবাদ কর্মীদের যে অতি আগ্রহী মনোভাব এবং এই মনোভাবই যে হাজারো বাসন্তীর কষ্টকে আড়াল করে রেখেছে সে বিষয়টিও দৃষ্টির অন্তরালে যায়নি গল্পকারের।
অন্যদের দুর্দশার কথা শুনে লাভ কি? হাইলাইট হবার মোক্ষম উপাদান তো বাসন্তী। গল্পকারের বর্ণনায় সহজেই ধরা পড়ে বাসন্তীর মতো অসহনীয় কষ্টেকাটানো শত নারীর দুঃখের আখ্যান। “কোনো কোনো দিন আগন্তুকরা হোঁচট খায়। বাসন্তীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এতদূর এসে লাভ কী হল? শুধু শুধু জেলে পাড়ার টিনের ছাপরা গোনে কি হবে? তখন দশঘরের দুর্দশার বয়ান শুনেও স্বস্তি লাগে না। মাঝপথেই বয়ানকারীদের থামিয়ে দেয়। দিদি শোনা যাবে আপনার কথা আগে কনত দেখি বাসন্তী দিদি কোথায়? ওনাকে একটু দেখে যেতাম। তখন বয়ানকারী উস্টো খায়। মনে মনে গজ গজ করে, ইমরা সোউগ এক এ, খালি বাসন্তীকে দেইখবের চায়। ঢং করি করি ছবি তুলবে। হামার কি কোনো দাম নাই।
আর বারংবার এমন হতশ্রী দুর্দশা প্রত্যক্ষের পর পুরো জেলে পল্লীরএকমাত্র শিক্ষিত পদ্মফুল সুখেনের অন্তর্করণে বয়ে যায় বিষাদের ঢেউ। ক্লান্তির অন্তিম পর্যায়ে যেন পৌঁছে যায় সে;‘এসব নিয়ে আমার তেমন কোনো কৌতূহল নেই। কারণ জানি বছরের পর বছর সবাই বাসন্তী পিস্তিকে দেখতে আসে আর তাকে নিয়ে ছবি তুলে। গত পঞ্চাশ বছর ধরে এই মফস্বলে আজব এক সৃষ্টি ছাড়া এই ছেলে পল্লীর মূক অনুভূতিহীন বাসন্তী পিসি। এসব দেখতে আমার ঘেন্না লাগে। আর ভীষণ আপদ মনে হয় ছবিতোলা আগন্তুকদের যারা আমাদের এই এতটুকু সম্বলের ঠাঁই বিবর্ণ জেলে পল্লীটিকে কি কদাকারভাবেই না চিড়িয়াখানা বানিয়ে ফেলছে।
মোটামুটি এই–ই হলো গল্পকারের তৃতীয় যাত্রায় প্রকাশিতব্য নিঘুমওয়ালা গল্পের সারাৎসার। প্রায় প্রতিটি গল্পেই পাঠকের মনোজগতে এক দিগন্তবিস্তৃত প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করে বিশেষ আগ্রহ নিয়ে পাঠ করি গল্পকারের ১ম ও ২য় গল্প গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ২৪ টি গল্প। এবং স্বাভাবিকভাবেই প্লট নির্বাচনের ক্ষেত্রে গল্পকারের মধ্যে দেখতে পাই সমাজ ও মনোজগতকে নাড়া দেবার এক প্রবলতম তাড়না। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, নিঘুমওয়ালা গ্রন্থের প্রতিটি গল্পেই যেখানে ভাবের অধিক প্রাধান্য লক্ষ করা গেছে সেখনে ভাব এবং ঘটনার প্রাধান্য দুটো বিষয়ই এসেছে আলাদা আলাদা ভাবে অপর দুটি গ্রন্থে। তবে নিঘুমওয়ালা গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্পে উপস্থাপনার চিত্রায়ণে যে অপার শিল্পবোধ এবং নির্ভুলতা চোখে পড়ে সেই সম বিশিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায় না সেই সব মানুষ এবং অক্টোবর ও অন্যান্য গল্পে। তবুও সামাজিক উপযোগিতা এবং পাঠকের অন্তরাত্মায় পাঠ পরবর্তী অমোঘ ক্রিয়ার স্ফুরণের ক্ষেত্রে গল্পগুলির ভূমিকা যে কোনো অংশেই কম হবে না তা সহজেই ব্যক্ত করা যায়। বিশেষত, সরলীকরণ পদ্ধতিতে লেখা গল্পগুলির সর্বজনীন অনুধাবন অজস্র পাঠকের কাছে যাবার একটি সুযোগ সৃষ্টি করবে লেখককে। এই যে স্বল্প সময়ের পরিবেশনের মধ্যকার পার্থক্য সেটির কারণ মূলত দীর্র্ঘ সময় অবধি লেখকের লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত না থাকা। তবে এই অসম্পৃক্ততাই যে আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করেছে তা নিঃসন্দেহ। কিন্তু কেন?
বার্ট্রাণ্ড রাসেলের ব্যক্তিগত লেখালেখির অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, একটি গ্রন্থ প্রকাশের পূর্বে তিনি পরিকল্পনা করতেন এবং পরিকল্পিত ভাবনাটিকে এমনভাবে বিশ্লেষণ করতেন যাতে তা অবচেতন মনে অবস্থান করতে পারে এবং ভবিষ্যতে অবলীলায় শব্দের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। How I write শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন এভাবে, It appeared that after first contemplating a book on some subject and after giving serious preliminary attention to it, I needed a period of sub-conscious incubation which could not be hurried and was anything impeded by deliberate thinking (4)
লেখক যখন প্রথম গল্পটি লিখলেন তখন তাঁর বয়স প্রায় পঞ্চাশ।অর্থ্যাৎ যাপিত জীবনের অমূল্য অভিজ্ঞতা, অবচেতন মনের স্থিত ভাবনার গভীরতা এবং দীর্ঘ পঠনের আস্থাশীল মনোবলকে সঙ্গী করেই তিনি লিখতে শুরু করলেন। এমন অবস্থায় গল্প বুননের ক্ষেত্রে অনভ্যস্ততাগত সীমাবদ্ধতা দৃশ্যমান হওয়া খুবই স্বাভাবিক। প্রকৃত অর্থে এই সীমাবদ্ধতা গল্পের মূলভাব অনুধাবনের ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি। তাছাড়া একজন আদর্শ লেখকের বিশিষ্টতাই হলো ক্রমাগত নিজের মধ্যে অন্তরিত শৈল্পিক বোধ, শাব্দিক ঐশ্বর্য এবং চেতনাগত দায়বদ্ধতাকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে তোলা– যেটি লক্ষিত হয়েছে গল্পকারের ধারাবাহিক গল্প রচনার ক্ষেত্রে। একটি বিষয় হয়ত এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যে, একেক বয়সের সৌন্দর্য যেমন একেকরকম, একইভাবে একেক বয়সের লেখার সৌন্দর্য একেক রকম । বিশেষত, সাধারণ পাঠকের কথা চিন্তা করলে এটি অবলীলায় ব্যক্ত করা যাবে যে, ঘটনা প্রধান গল্পগুলি তাদের নির্দ্বিধায় লেখকের গল্পগুলির মূল রস সিঞ্চনে সহায়ক হবে। উদাহরণস্বরূপ মুসাফির,অক্টোবর, অমল যে হাত সে ছুঁয়েছিল গল্পগুলিতে যেমন স্বতন্ত্র ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে তেমনি ম্ভন্যপায়ী ও পেচাঁ গল্পে প্রতিফলিত হয়েছে প্রতীকের বলিষ্ঠ ব্যবহার।
একই সাথে চাঁদমারীর কাব্য গল্পে প্রকাশ পেয়েছে একজন খাঁটি ও আত্মত্যাগী রাজনৈতিক কর্মীর আত্মদর্শনের প্রতি একনিষ্ঠ থেকে নিজেকে উজাড়ের অকৃত্রিম প্রয়াস। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে পর্যালোচনা করলে গল্পকারের হাওয়া, জোলোজীবন, শেষে ফরিদের প্রত্যাবর্তন, পথ অন্তহীন, জংশন, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, লোল, চিক্কুর গল্পগুলির উপযোগীতা প্রভাতের আলোর মতো দীপ্যমান হয় উঠে। গল্পগুলি একাধারে যেমন সাধারণ মানুষের হৃদয়ে ক্ষতের সৃষ্টি করবে পাশাপাশি সমাজের অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলিকে সমাধানের জোর বাস্তবতাকে তুলে ধরবে। তবে গল্পের শিরোনামে কাজ করবার কিংবা ভাববার সুযোগ ছিলো বলে মনে হয়েছে। যেমন শেখ ফরিদের প্রত্যাবর্তন গল্পটিতে যদিও শেখ ফরিদই ছিলো কেন্দ্রীয় চরিত্র, কিন্তু গল্পে শেখ ফরিদকে প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করে গল্পকার হাজারো শেখ ফরিদের যন্ত্রণাতীত সময়গুলিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। সেক্ষেত্রে গল্পগ্রন্থের শিরোনাম ‘সেই সব মানুষ’ কিংবা অন্য কোনো সর্বজনীন শিরোনাম হলে বোধহয় প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতাটি প্রবল প্রতাপের সাথে প্রতিষ্ঠত হতো। একই সাথে ‘সমাধি’ শিরোনামটি পুরো গল্পটিকে যেভাবে প্রতিনিধিত্ব করেছে সেভাবে কিন্তু ‘কান্না’ কিংবা ‘জংশন’ গল্পটি প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি।
একটি বিষয়ে মোটেও আশ্চর্য হই নি যে, এত স্বল্প সময়ে লেখক কীভাবে নিজেই নিজের সৃষ্টির সৌন্দর্যকে ছাড়িয়ে গেলেন। বোধকরি সেটি সম্ভব হয়েছে দীর্ঘ সময় অবধি লেখকের মস্তিষ্কে গ্রন্থিত শব্দের সাজানো বাগানের নির্মিতির কারণে। এবং সেটি লেখকের পরবর্তী জীবনের জন্যও একটি বিশেষ মহার্ঘ্য। তবুও জানবার আগ্রহ থেকেই পূর্বে প্রকাশিত গ্রন্থ দুটির সাথে বর্তমান গ্রন্থের উপস্থাপনার ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন বিশেষত উপমা (Simile)) এবং রূপকালংকারের (Metaphor)) অনবদ্য প্রয়োগ সেটি জানতে চেয়েছিলাম লেখকের কাছেই। কেননা,‘‘ফুলের কমনীয়তা, পেলবতা, বর্ণ ও গন্ধের সমগ্রতাকে পাঠকের উপলব্ধিতে জাগ্রত করা ভাষার সাধারণ সীমার মধ্যে সম্ভব নয় (৭)।” তাই ফরাসি সাহিত্যিক মালার্মে রূপকল্পের উপস্থাপনে যেমন প্রতীকের ব্যবহারে উদার হয়েছিলেন, তেমনি শব্দের পংক্তিমালার প্রয়োগ ও বিন্যাসে এনেছিলেন বিপুল বৈচিত্র্য। এ চেষ্টাটি বিশেষভাবে লক্ষ করা গেছে মিজানুর রহমানের গল্পে। এবং একই সাথে জানতে চেয়েছিলাম তাঁর গল্পে বাস্তব জীবনের প্রভাবের তীব্রতা এবং গল্পগুলির মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য নিরসনের ক্ষমতা। তার ফলাবর্তনটি ছিল এমন–
‘‘প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রকাশের পর কিছু দুর্বলতা বুঝতে পেরেছি। ভাষাকে আরও সমকালীন, সাবলীল ও সহজ করার প্রচেষ্টা ছিলো। উপমার পরিমিত কিন্তু গভীর ব্যঞ্জনাময় অলংকারে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে চেয়েছি। পাঠ ও বাস্তবতাকে আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে মনযোগী ছিলাম। আর গল্প তো জীবন–অভিজ্ঞতারই পরোক্ষ কথন। পাঠে এবং যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা–দৃষ্টিপাতে এটি একজন লেখকের ভাবনায় সিঞ্চিত হয়। লেখক সেগুলোকেই পুনঃনির্মাণ করেন নিজের মত করে।
সত্যি বলতে, আমার গল্পগুলি সামাজিক বৈষম্য নিরসনে কতটুকু প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে সেটি সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা কষ্টকর। তবে সেই অভীষ্ট লক্ষে যাতে পৌঁছতে পারি সেটি থাকে আমার প্রতিটি শব্দ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। বস্তুত, একজন লেখক যখন সমাজের ছবিটি ফুটিয়ে তুলতে চান তখন তাকে গভীর অভিনিবেশ করতে হয় সমাজের প্রকৃত স্বরূপটির চেহারা–চরিত্র অনুসন্ধানে। একটি দায় তার উপর বর্তায়। অসংগতিগুলো তখন সে দেখিয়ে দেয় এবং তার বিনির্মাণের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে। বিনির্মাণে উদ্বুধ্ব করে। এটি শুধু মানুষের প্রতি দায় না, সকল জাগতিক উপাদানের প্রতি দায়। লেখক সমাজের সচেতন সদস্য বিধায় সভ্য–শোভন সমাজই তাঁর আকাঙ্ক্ষিত।”
দসৌন্দর্যের উপলব্ধি যখন একজন লেখকের চিন্তার ডানাগুলিকে প্রতিনিয়ত সুন্দর থেকে অসীম সুন্দরের দিকে ধাবিত করতে থাকে ঠিক তখনই বোধহয় সীমাবদ্ধতা স্বীকারের প্রসঙ্গটি খুব স্বাভাবিকভাবেই লক্ষিত হয়। গল্পকার মিজানুর রহমানের এমন বোধ বোধহয় তাঁর সকল গল্পের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকেই প্রতিফলিত করে। তাছাড়া যে স্বল্প সীমাবদ্ধতার কথা বলা হচ্ছে সেগুলির সংশোধন মূল ভাবটিকে ঠিক রেখে অনায়াসেই করে ফেলা যেতে পারে। এতে করে বাংলা ছোটগল্পের ভাণ্ডারই বরং সমৃদ্ধ হবে। লঙ্গিনাসের মতে, ‘‘ক্রটিহীন মাঝারি মানসম্পন্ন রচনার চেয়ে ক্রটিযুক্ত উৎকৃষ্ট রচনাই শ্রেষ্ঠ। আর প্রকৃত প্রতিভাবানরা মোটেই ক্রটিহীন নন (৬)।” হোমার, পিণ্ডার এবং সোফাক্লেসের মতো লেখকরাও ত্রুটির বাইরে ছিলেন না। প্রকৃত অর্থে, অতি প্রতিভাধর সাহিত্যিকদের মধ্যে এমন ক্ষুদ্র অসামঞ্জস্য থাকা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। মূলত লেখক তার লেখনীর মাধ্যমে পাঠক কিংবা সমাজকে কতটা ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম হচ্ছে সেটিই মূল কথা। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছোট গল্পের সংজ্ঞা নির্ধারণে যে সত্যে উপনীত হয়েছেন সেটি হলো“ঘটনা, চরিত্র, বিষয় অবলম্বন যা–ই হোক তাকে একটি নিজস্ব জীবন–বোধিতে একটি দর্শনে একটি স্বগত ভাবলোকে পৌঁছে দেয়াই ছোট গল্পের কাজ” (২)। এবং সে কাজটি মূলত কৃতিত্বের সাথে সমন্বয় করেছেন গল্পকার। প্রথমত একজন দার্শনিক হিসেবে তিনি তার মননে বুনেছেন একটি নির্দিষ্ট দর্শন এবং সেই দর্শনটির আলোকোজ্জ্বল প্রভা ছড়িয়ে দেবার নিমিত্তে গ্রহণ করেছেন পরিপাশ্বের উপাদান। কেননা শুধু ঘটনা প্রধান গল্প হয়ত পাঠকের মনোজগতে স্বল্প সময়ের জন্য একটি প্রভাব ফেলতে পারে কিন্তু দর্শনকেন্দ্রিক গল্পের প্রভাবের সীমা হয় অতি বিস্তারী।
আমরা নিয়ত নানা ধরনের গল্প পাঠ করে থাকি। কোনো গল্পের শব্দশৈলী হয়ত আমাদের আকৃষ্ট করে অথবা আকৃষ্ট করে গল্পের প্লট। হয়ত কোনো গল্প মনোজগতে কোনো প্রকার ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি না করেই হারিয়ে যায় দূর অদূরে। আবার কোনো গল্প অনুভূতির মানচিত্রে এতখানি জায়গা দখল করে নেয় কিংবা দাগ কাটে যা কখনো বিস্মৃত হয় না। এবং এ ধরনের একটি গল্প কিংবা লেখাগুলিকে আমরা আমাদের সহযাত্রী হিসেবে ভেবে নিতে স্বস্তি বোধ করি। একই সাথে প্রতিকূল মুহুর্তে সেই গল্পের স্বাদ পূর্ণবার আস্বাদন করে জেগে উঠবার চেষ্টা করি। ডি. এইচ লরেন্সের একটি ভাবনা এক্ষেত্রে লেখকদের গল্প সৃজনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উদ্দীপত করবে বলে আমার বিশ্বাস। তাঁর ভাবনার সারমর্মটি মূলত এই– “একটি লেখাকে আমরা তখনই বিশুদ্ধ লেখা হিসেবে শনাক্ত করতে পারবো যদি সেই লেখাটি পাঠকালীন আমরা আমাদের শরীরে এক ধরনের শীতল বোধ অনুভব করতে সক্ষম হই (৩)।”
প্রকৃতই গল্পে স্থিত শব্দ এবং ভাব যদি পাঠকের অনুভূতির শিরা–উপশিরায় শিহরণ জাগাতে না পারে তবে সেটি সত্যিকার অর্থে গল্প কিনা তা সম্পর্কে প্রশ্ন রয়েই যায়। পার্ল এস বার্কের একটি গল্প পড়েছিলাম, তাও প্রায় বছর দশক পূর্বে। রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে। অনেক ঋদ্ধ গ্রন্থে সাজানো ছিল পাঠাগারটি।সে সময়ে রংপুরে ঘন ঘন অবস্থান করতে হত বলে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিই ছিল আমার সময় কাটানোর সঙ্গী। পড়বার পর যে গ্রন্থগুলি ভালো লাগতো নির্দিষ্ট সেলফে আলাদা করে রাখতাম যাতে পরবর্তী দিনে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। তবে বিশেষ কোনো গল্প বা প্রবন্ধ ভালো লাগলে ফটোকপি করে রাখতাম নিজের কাছেই। যাই হোক, বৃদ্ধ মাকে নিয়ে লেখা পার্ল এস বাকের সেই গল্পটি পড়ে এতটাই বিমুদ্ধ হয়েছিলাম যা মনে পড়লে আজও ডি এইচ লরেন্সের উপর্যুক্ত ভাবনাটির মতো শরীরে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ঠিক কি কারণে ফটোকপি করি নি এই মূহুর্তে মনে পড়ছে না। ভেবেছিলাম পরবর্তীতে ফটোকপি করবো। এই নির্দিষ্ট স্থানে রেখেছিলাম অনেকটা যতœ করেই। দুর্ভাগ্যবশত পরবর্তীতে সেই গ্রন্থটি আর খুঁজে পাইনি। এবং পরবর্তী তিন বছর রংপুর, ঢাকা বইমেলায় হন্যে হয়ে খুঁজে অতঃপর পেয়েছিলাম।
গ্রন্থটি খুঁজে না পেলে কী এমন ক্ষতি হতো? আর একটি গল্পের জন্য কেনই বা এত আকর্ষণ? কারণটি, মূলত মননকেন্দ্রিক প্রসন্নতা অর্জন এবং একই সাথে অস্থির ভাবের প্রশমন। এবং এমন অনুভব তৈরীর নেপথ্য কারিগর অবশ্যই গল্পকার এবং তার প্রভাব বিস্তারে সক্ষম লিখনী। উপর্যুক্ত প্রেক্ষিতটির মতোই গল্পের বিষয় নির্ধারণ, চরিত্র নির্মাণ, সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের পরিস্ফুটন, বহুমাত্রিক চিন্তাসূত্রের সম্মিলন এবং ইতিবাচক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপযোগিতা নির্মাণে গল্পকার মিজানুর রহমান যে সংঘবদ্ধ প্রকাশ ঘটিয়েছেন তা প্রকৃত অর্থেই গল্পগুলিকে পাঠকের মনোরাজ্যে জায়গা করে নিতে সক্ষম হবে হলে আমার যূথবদ্ধ বিশ্বাস।
ভাবতে অনেকটা অবাকই লাগে, মিজানুর রহমান সৃজিত এমন কিছু প্রভাব সম্পাতি গল্পের সাথে পরিচয় ঘটলো অনেকটা সময় পেরিয়ে, অনেকটা স্বল্পে দূরত্বে অবস্থান করেও। হয়ত অনলাইনকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার সুযোগ না থাকলে সেটিও ঘটতো না। বস্তুত প্রকৃত লেখকরা এমন নিভৃতাচারী হয়েই গল্প বুননে ব্যস্ত থাকবেন। তাদের মনোসংযোগের পুরো আধার জুড়ে শুধুই খেলা করবে শব্দ ও ভাবনার বিচিত্র কল্পনা। তাদের সৃষ্টিগুলোকে আলোর পাদ প্রদীপ নিয়ে আসবার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন যারা তাকে চিনবেন, জানবেন কিংবা তার লেখার গভীরতা সম্পর্কে অবগত থাকবেন। বিশেষত জাতীয় সংবাদ পত্রে কর্মরত সাহিত্যসেবীবৃন্দ। মানসম্পন্ন এমন গল্পের প্রকাশ সাহিত্যের সমৃদ্ধ সোপান রচনার অন্যতম শর্ত। নিম্নমানের কিংবা মানহীন সাহিত্য রচনা করে বিপুল প্রচারণার মাধ্যমে হয়ত স্বল্প সময়ের জন্য সাহিত্য সম্রাট হওয়া যায় কিন্তু দীর্ঘ সময়ের বিবেচনায় সেই সম্রাটের মুকুট টি আর থাকেনা। প্রশংসা কিংবা প্রচার প্রিয় সেই সাহিত্যিকের মৃত্যুর সাথে সাথে তার লেখাগুলিরও মৃত্য ঘটে। একই সাথে এমন আরোপিত সাহিত্য প্রচারের কারণে হোঁচট খায় জাতীয় গড় মানসিকতার প্রগতিগত ঐশ্বর্য।
তথ্যসূত্র:
১। সাহিত্যের মূল্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলামটর, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৪২।
২। ছোটগল্পের সীমারেখা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রকাশ ভবন, কলকাতা–৬, চতুর্থ মুদ্রণ আষাঢ়, ১৪১৯। পৃষ্ঠা–৩০।
৩। লেখালেখি তাদের ভাবনা, ডি. এইচ. লরেন্স, অনুবাদ, আফসানা বেগম, দিব্য প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, পৃষ্ঠা–৭২, ঢাকা।
৪। How I write by Bertrand Russell collected from www.pereestupriya.com/pdf Russell Bertrand.
৫। পার্ল এস বাক ও অন্যদের গল্প, অনুবাদ ইফতেখার রসুল জর্জ, ধ্রুপদী সাহিত্যাঙ্গন, ফ্রেব্রুয়ারি, ২০১৩, বাংলাবাজার, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৯–১৬।
৬। ধ্রুপদী সাহিত্যতত্ত্ব, প্লেটো, এরিস্টটল, হোরেস, লঙ্গিনাস, অনুবাদ বদিউর রহমান, অবসর, সূত্রাপুর, ঢাকা, এপ্রিল ২০১৫, পৃষ্ঠা–২০৭–২০৮।
৭। সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক তিনটি ফরাসি প্রবন্ধ,সাহিত্য ও সঙ্গীত, স্তেফান মালার্মে, অনুবাদ, মোহাম্মদ হারুন–উর রশিদ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলামোটর, ঢাকা,পৃষ্ঠা ৩৬।
৮। সেই সব মানুষ, মিজানুর রহমান নাসিম, ঐতিহ্য, বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৮।
৯। অক্টোবর ও অন্যান্য গল্প, মিজানুর রহমান নাসিম, ঐতিহ্য, বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
১০। “বিড়াল”মিজানুর রহমান নাসিম, লেখালেখির উঠান, সম্পাদক, মাজহার জীবন, লালমাটিয়া, ফাল্গুন ১৪২৬, ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ঢাকা, দ্বিতীয় সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৮২–৯১।
১১। পাণ্ডলিপি, নিঘুমওয়ালা, মিজানুর রহমান নাসিম।
মনজুরুল ইসলাম: শিক্ষক, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ।
========================