কবি ফাউজুল কবির-এর মরমি চিন্তা বা ভাববিশ্ব: ‘একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল’
শোয়েব নাঈম
● ভূমিকা:
————-
প্রত্যেক কবির জেনেটিক উপাদানসহ নিজস্ব একটা ভূগোল থাকে, নিজস্ব দেশ থাকে। তাঁর মনের ভূগোল জুড়ে উপস্থিত থাকে জন্মভিটার জনপদ। কবির এই ভূগোলকে অস্বীকারের শাবল দিয়ে ভাঙতে গেলে শাবলটা ইতিহাসের স্থাপত্যে গিয়ে ঠেকে। ঠং ক’রে বিপদ-সংকেত বেজে ওঠে মনে…কারণ একটা ভূগোল মানে তো শুধুই একটা ভূখন্ড নয়, মগ্নতার উল্লাসে ভরা সংস্কৃতিও বটে। আবহমান জীবনধারার কালানুক্রমিক সুমধুর গার্হস্থ্য-জীবনের স্মৃতি এবং সময়ের নৃতত্ত্ব। সর্বজন স্বীকৃত নির্দিষ্ট ‘দেশ’ কথাটাকে দার্শনিক অর্থে ধরে নিলে, বলা যায় কবির নিজের একটি দেশ থাকলেও কবিতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত তিনি সীমানাহীন। ইন্দ্রিয়ানুভূতির বিশেষ আবহে এবং চিত্ররূপময় ব্যঞ্জনায় বলে ওঠা ‘একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল’— অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দর্শনধর্মী একটি দীর্ঘ কবিতা, যাহা কবি ফাউজুল কবির-কে সারাজীবন নিয়ন্ত্রণ করেছে দেখা আর না-দেখা মিশ্রিত উত্তীর্ণ অনুভবের বিচলিত আক্রমণে। শিল্পরুচির প্রচ্ছদে মলাটবন্দী বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকা কারুকর্ম ইলাস্ট্রেশানে ভরকরা একটি দীর্ঘ কবিতা। কাব্যিক স্পন্দনে লেখা কল্পনার না-হিস্টিরিয়া, না-ঘুমিয়ে থাকা জল-স্থল স্মৃতির এলবাম। ‘একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল’— দীর্ঘ কবিতাটি কোনো ভাবনায় নয়, আত্মার নিজস্ব শুদ্ধতার অনুভবে লিখেছেন। এক ফর্মার এই বইটিতে একটি কবিতাই গ্রন্থভুক্ত করেছেন, যেটির প্রকাশকাল— ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৭, প্রচ্ছদ ও ইলাসট্রেশান করেছেন শিল্পী চন্দ্রশেখর দে এবং ১৪টি অনুপর্বে ভাগ করা ২৯৪ লাইনে লেখা একটি দীর্ঘ কবিতা অন্তর্ভুক্ত আছে। অনুভূতিতে লেখা ১৪টি অনুপর্বের এই দীর্ঘ কবিতায় আছে কবির স্বভাবসিদ্ধ তিনটি বৈশিষ্ট্যের সংক্রমন— আছে বিস্তারের স্বভাবে, আছে বিশেষ প্রদর্শনের প্রস্বরে, আছে মহাব্যাপ্তির প্রসারণে। এই তিন স্বভাবসিদ্ধ বৈশিষ্ট্যের সংক্রমনে কবি জলের গহ্বরের দিকে ফিরে ক্রমাগত জীবনচেতনার ধারাভাষ্য দিয়েছেন স্তবকে স্তবকে। জীবনের স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের সাথে যোগ-অযোগ অভিজ্ঞতা এবং ব্যাকুলতা স্বয়ংক্রিয় দার্শনিকতায় এই কবিতাকে সংগতিপন্ন রেখেছে। জীবনকথার কালানুক্রমিক পৃষ্ঠাগুলি স্পর্শের অনুরূপ এক মরমি চিন্তা বা ভাববিশ্ব দর্শন বিনির্মাণ করেছেন এই কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে। স্মৃতিঘেরা অনেক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলতে বলতে, প্রিয়জনদের সাথে যাপিত যৌথ দিনগুলির আভাস দিতে দিতে, এই কাবিতার ‘আমি’ নিছক একজন মুক্ত ভাষ্যকার না-হয়ে, কবি নিজেকেও ক্ষতবিক্ষত করেছেন একজন সহ-মৃতের ভূমিকায়। তাঁর নিজের অন্তর্জগতের জিজ্ঞাসা এবং সম্পর্কের প্রযোজনায় এই কথাই বলে উঠেছেন কবিতার ক্রমিকতায় —
“[…] আমি কবি হবো? কে বলেছে ? তুমি?
আমি বৃক্ষ হবো? কে বলেছে ? তুমি?
তুমি সব জানো? তুমি হাত গুণো?… “
● কবিতার নামকরণ আলোচনা:
—————————— —————
একটি কাব্যগ্রন্থের নামকরণে এবং প্রচ্ছদ নির্ধারণের অভ্যন্তরে থাকে একজন কবির চিন্তা-ভান্ডারের আরেক গাঢ় অনুচিন্তন। নামকরণে, প্রচ্ছদে, কলাকৌশলের অনুষঙ্গে যেসব টেক্সটের ইংগিত বইয়ের মলাটে থাকে, বুককাভারে চোখ বুলিয়ে ঐ কবির চিন্তারমাত্রা নির্ধারণে যথেষ্ট আভাস পাঠকও পেয়ে যান। জলের উৎসারণ অনুভবে আর কবির অন্তরতম প্রদেশের ইমাজিনেশানে ‘একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল’— কবি প্রবল অনুভূতিময় আর চিত্ররূপময় ব্যঞ্জনার সদর্পে এই কবিতার নামকরণটি বিকশিত করেছেন। টানা দীর্ঘ বাক্যধর্মী এই নামকরণটি একমাত্রিক নয়, বাস্তবোর্ধের উর্ধবাস্তবে এই নামকরণটি হয়েছে বহুমাত্রিক; যাহা কবি ফাউজুল কবির— তাঁর কল্পনাপ্রতিভায় প্রিজমের বিচ্ছুরিত বহুমাত্রিক আলোর এক মহাবিস্ময়ের মতন পাঠকের বোধে ছড়িয়ে দিয়েছেন ! এই বহুমাত্রিক এমন নামকরণের মধ্যে কবি ত্রিস্তরীয় বিষয়কে সঞ্চারণ করেছেন। প্রথমস্তর— জলের আর্দ্র লিরিকে আছে প্রকৃতির আধিপত্য, দ্বিতীয়স্তর— অনুভবের বিচলিত আক্রমণ এবং তৃতীয়স্তর— কবির মরমি চিন্তা বা ভাববিশ্ব। প্রথমত— এখানে আধিপত্য’র যে উল্লেখ করা হয়েছে তা’ সর্বগ্রাসী অর্থে নয়, প্রকৃতির দৈনন্দিনতা থেকে প্রাত্যহিককে ছাড়িয়ে চিরন্তনকে ছোঁয়া— এ অর্থে ‘আধিপত্য’ বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত— অনুভবের বিচলিত আক্রমণ হচ্ছে জল থেকে পলল প্রাণ, প্রাণ থেকে প্রগাঢ়-প্রগাঢ়তম কবির অনুভূতি এবং তৃতীয়ত— ভাবনাগুলি স্পষ্ট হয়ে ক্রমশ পূর্ণতায় প্রাণবন্ত হয়ে অন্তরলোক থেকে বিশ্বলোকে সঞ্চরণশীল। অর্থাৎ প্রথমস্তরের, দ্বিতীয়স্তরের এবং তৃতীয়স্তরের সঞ্চরণশীলতা একটি বাক্যবন্দী করলে পাঠকের মননে প্রভাবিত হয় যে, জলে থাকে স্নিগ্ধ অনুরাগ, জলের সহজাত বর্ণীল তরঙ্গে থাকে জলীয় উল্লাস এবং ‘মুগ্ধমেলা’ তরঙ্গে থাকে ভাবনার আহ্বান। কবি ফাউজুল কবির জল-ভাবের আবেষ্টনির মাধ্যমে মহাভাবের প্রকাশ ও বিন্যাস ঘটিয়েছেন কবিতায় এমন নামকরণের মাধ্যমে। বলা যায় কবির জীবনের অঙ্কুরোদম অনুভূতির পঙ্ক্তি হচ্ছে ‘একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল’। কবির জীবন স্মৃতির উপভোগ্যতা ঘটেছে নদীর পটভূমিতে। এই নামকরণে যেমন আছে দর্শনেন্দ্রিয়ের ঘনত্ব, তেমন আছে জমাট ইমেজ ভর্তি পেইন্টিংয়ের মতো কাজও। ভাষাতীত অনুভবে এক অধরা সৌন্দর্য প্রকাশ করেছেন কবি বচনাতীত শব্দ দিয়ে এঁকে এঁকে। শব্দের রেখায় রাঙিয়েছেন নিপুণ চিত্ররূপময়তা, যা কল্পনায় পেইন্টিংসের মতো ভেসে ওঠে। স্মৃতিভরা দু-কূল প্লাবিত হাওয়া অক্ষর ভেঙে ভেঙে ধ্বনিমূল ঊর্ধ্বে উঠে, যখন কবি লেখেন— ‘একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল।’
কবিতার চলমানতা:
—————————-
এই কবিতায় শব্দ, বাক্য, যতি, পর্ব-বিভাজন, এক অনুচ্ছেদ থেকে অন্য অনুচ্ছেদে চলে যাওয়ার যুক্তি ও মুহূর্তগুলি লক্ষ করলে অনুভব করা যায়— কখনো সদর্থক, কখনো নঞর্থক মনে হয় কবি ফাউজুল কবির’কে ; কখনো তিনি নিছক একজন মানব, আবার কখনো তাঁর সত্তা মহাজাগতিক। তাঁর শব্দ থেকে বাক্যগুলি সৃষ্টি হয়েছে মাতৃপ্রতিম পক্ষপাতে, বৈষম্যহীন মমতায় এবং বোধের প্রযত্নে। সমগ্র কবিতাব্যাপী যেসব সঞ্চরণশীলতা আছে, অর্থাৎ অবিরাম কবিতার চলমানতা যেসব প্রশ্ন ও বিস্ময়চিহ্ন দ্বারা তাড়িত, তা কবির অশান্ত মনের বিচলন। যেমন—
“[….] পশ্চিমের লাল-বিকেল আমাকে ডাকে
দিগন্তের অসীম ছায়া আমাকে ডাকে
বলে, আয়, কাছে আয়, দ্যাখ
চোখের ভেতরে রোপণ করেছি
বিস্ময়ের মুগ্ধ-মেলা, অন্যতম চোখ….”
পাঠকের নজর কাড়ার কোন ভিখিরি বাসনা না-জাগিয়ে স্বগতভঙ্গিতে এই কবিতা বিস্তারে সৃষ্টি করেছেন ভাষাশৈলীর মখমল রূপ আর ধ্বনির কোমলতা। দীর্ঘ এই কবিতাকে ছোঁয়া যায় অর্থ পেরিয়ে-যাওয়া এক সংবেদ দিয়ে। যেখানে কবিতাটি অর্ধেক লিখেছে কবিমনের জলবায়ু, বাকি অর্ধেক তাঁর জীবনের শেকড়। যেন তাঁর দু’দিক-কাটা একটা পেন্সিল আছে— একদিক দিয়ে লিখলে মনের জলবায়ু আর অন্যদিক দিয়ে খোদাই করা জীবনের শেকড়। এই কবিতায় সৃষ্ট শব্দগুলির উৎস নিরাভরণ রহস্যের মতো, প্রতিবেশ-পরিবেশ যেন জীবন্ত ছবির মতো। শব্দগুলি গুঢ় কোনো অর্থময়তার ভিতরে নিজস্ব অভিব্যক্তির ভূমিকা রেখেছে। আলোচ্য কবিতাটির সত্যাশ্রয়ই নির্ভরশীলতা এই কবিতাকে সমসাময়িকতার মোড় থেকে চিরন্তনের অভিমুখে নিয়ে গেছে। নিয়ে গেছে কবি ফাউজুল কবির-এর মরমি চিন্তা বা ভাববিশ্বের অভিমুখে, যাহা কবিতাটি পরিসমাপ্তিতে পাঠকের বোধে এমন পরিণতি অর্জন করেছে। উদ্ধৃত কবিতাটিতে যেসব প্রতিবেশ-পরিবেশ আছে, তা একেবারেই প্রত্যক্ষ-করা ছবি, সচল জীবনযাপনের মধ্যে প্রায় সবারই চোখে দেখা এসব প্রকরণগুলি।
● কবিতার কাঠামো:
—————————–
সাহিত্যে ক্যাথার্সিস শব্দের ভাবানুবাদ হচ্ছে—
গভীর অনুভূতির কথা অন্যকে জানানোর ফলে মানসিক বিশুদ্ধতায় যে আবেগমুক্তি ঘটে। ব্যক্তিমননের বিশেষ্যপদ ‘উপলব্ধি’ হচ্ছে কবি ফাউজুল কবির-এর বোধের প্রমিত আয়ু। কবি ফাউজুল কবির শৈল্পিক ক্যাথার্সিস ঘটিয়ে সমগ্র এই কবিতায় প্রতিবিম্বের মতো ‘উপলব্ধি’— এই ইন্দ্রিয়লব্ধ বিশেষ্য পদটি এই কবিতায় একটি কার্যকরি শক্তিরূপে প্রবাহিত করেছেন। এই কবিতার সত্তায় নিজেকে স্পর্শিত ও আলোড়িত করে কবির মনের সকল জোর যেন, ‘উপলব্ধি’ এই শব্দে এসে ডুবে গেছে! যেন রূপ থেকে রূপান্তরের আরেক মনীষা আর অন্তর্দৃষ্টি। কবির এই অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ক্যাথার্সিস উপলব্ধি পাঠককে স্পর্শানুভূতি টেনে এনে রূপকে ছুঁয়ে দিয়েছেন রূপান্তরে। বিবেচনা থেকে পুনর্বিবেচনার মতো রূপকে ছুঁয়ে দিয়েছেন রূপান্তরে।যে অধিগম্যতায় উপলব্ধির কার্যকরি শক্তিতে রূপ থেকে যেসব পঙ্ক্তি রূপান্তরিত হয়েছে, সেগুলি হচ্ছে এরকম:
” আমি আগে আগে যাই। আর:
পেছনে শামুক ভালোবাসা
লাজুক চুপচাপ।
আমি হাঁটি সূর্যাস্তের দিকে
আর:
সবুজে বৃক্ষের মৃদু পায়ে
ভালোবাসা হাঁটে;
ভালোবাসারাও কি পা আছে
মানুষের মতো বৃক্ষদের মতো!
পশ্চিমের লাল-বিকেল আমাকে ডাকে
দিগন্তের অসীম ছায়া আমাকে ডাকে
বলে, আয়, কাছে আয়, দ্যাখ
চোখের ভেতর রোপণ করেছি
বিস্ময়ের মুগ্ধ-মেলা, অন্যতম চোখ ;
আমি থমকে দাঁড়াই, দেখি আশ্চর্য
আর:
ভালোবাসাও চমকে থমকে দাঁড়ায়।
ও ভালোবাসা, ভয় পেয়েছো?
ভয় পেয়ো না নদীর কাছে যাবো।”
কাব্যময় আবেগী সত্তায় ১৪টি অনুপর্বে ভাগ করা ‘একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল’-এর এই পঙ্ক্তিগুলি হচ্ছে প্রথম অনুপর্বের, যা এই কবিতার প্রারম্ভিক স্তবক। কবির মানসগঠনে এসব পঙ্ক্তিগুলি হচ্ছে উপলব্ধিজাত সার্মথ্যের সম্প্রসারণ, একই সত্তার দুই রকম উৎসারণ এবং রূপ থেকে ঘটে যে রূপান্তর, সেই সম্প্রসারণ হচ্ছে এরই উপযোগিতা।
(১) ‘আমি আগে আগে যাই’— ১ম লাইনটি হচ্ছে কবির উপলব্ধি।
(২) ‘আর:/ পেছনে শামুক ভালোবাসা’— ২য় লাইনটি উপলব্ধিজাত সার্মথ্যের সম্প্রসারণের রূপ।
(৩)’লাজুক চুপচাপ।’— ৩য় লাইনটি সম্প্রসারণ রূপের রূপান্তর।
(১) ‘আমি হাঁটি সূর্যাস্তের দিকে’ — ৪র্থ লাইনটি হচ্ছে কবির উপলব্ধি।
(২) ‘আর:/ সবুজে বৃক্ষের মৃদু পায়ে’— ৫ম এবং ৬ষ্ঠ লাইনটি উপলব্ধিজাত সার্মথ্যের সম্প্রসারণের রূপ।
(৩)’ভালোবাসা হাঁটে;’ — ৭ম লাইনটি সম্প্রসারণ রূপের রূপান্তর।
(২) ‘ভালোবাসারাও কি পা আছে’— ৮ম লাইনটি উপলব্ধিজাত সার্মথ্যের সম্প্রসারণের রূপ।
(৩) ‘মানুষের মতো বৃক্ষদের মতো!’— ৯ম লাইনটি সম্প্রসারণ রূপের রূপান্তর।
(১)’পশ্চিমের লাল-বিকেল আমাকে ডাকে
দিগন্তের অসীম ছায়া আমাকে ডাকে’—
১০ম এবং ১১তম লাইন হচ্ছে কবির উপলব্ধি।
(২) ‘বলে, আয়, কাছে আয়, দ্যাখ
চোখের ভেতর রোপণ করেছি’— ১২তম এবং ১৩ম লাইন উপলব্ধিজাত সার্মথ্যের সম্প্রসারণের রূপ।
(৩) ‘বিস্ময়ের মুগ্ধ-মেলা, অন্যতম চোখ’— ১৪তম লাইনটি সম্প্রসারণ রূপের রূপান্তর।
(১) ‘আমি থমকে দাঁড়াই, দেখি আশ্চর্য’—
১৫তম লাইনটি হচ্ছে কবির উপলব্ধি।
(২)’আর:/ ভালোবাসাও চমকে থমকে দাঁড়ায়’—
১৬তম লানইটি উপলব্ধিজাত সার্মথ্যের সম্প্রসারণের রূপ।
(৩)’ও ভালোবাসা, ভয় পেয়েছো?’— ১৭তম লাইনটি সম্প্রসারণ রূপের রূপান্তর।
(৪) ‘ভয় পেয়ো না নদীর কাছে যাবো’— ১৮তম লাইনটি হচ্ছে কবির দেখা আর না-দেখা মিশ্রিত উত্তীর্ণ অনুভবের বিচলিত আক্রমণ। এই অনুপর্বের এই লাইনটি কবি কোনো ভাবনায় নয়, আত্মার নিজস্ব শুদ্ধতার অনুভবে লিখেছেন।
আত্মগত উচ্চারণের রসায়নে, এভাবেই সমগ্র কবিতার ১৪টি অনুপর্বে কবি এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের সংক্রমন করেছেন। উপলব্ধির ১-তে আছে বিস্তারের স্বভাব, সম্প্রসারণের ২-এর রূপে আছে বিশেষ প্রদর্শনের প্রস্বর এবং ৩-এর রূপের রূপান্তরে আছে মহাব্যাপ্তির প্রসারণ। আর প্রতিটি অনুপর্বে ৪-এর মতন আলাদাভাবে সৃষ্টি করেছেন শুদ্ধতার অনুভবে বিচলিত আক্রমণ।
● কবিতার অভিঘাত:
—————————— —
কবিতার আবহবোধের দিক পরিবর্তন করে কবি ফাউজুল কবির এই কবিতায় নিয়তির মতো কিছু অভিঘাত সৃষ্টি করেছেন। কবিতায় সৃষ্ট অভিঘাতের অর্থ হচ্ছে ভাবের চমৎকার গতি পরিবর্তন। কবিতা যদি হয় কোনো রৈখিক আলো, তবে কবিতায় সৃষ্ট অভিঘাত হচ্ছে সেই আলোর অদৃশ্য তরঙ্গ। উদ্বেলিত রুচিতে, অনুসন্ধিৎসু মনোকৌশলে আর কবিতার সংবেদনশীলতায় কবি এই কবিতায় মনস্তত্ত্বের অভিঘাত উদ্ভাবন করেছেন। কবি অভিঘাতের প্রভাবটা স্নেহের উত্তাপের মতো ‘একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল’ এই কবিতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। কবিতার স্বয়ংক্রিয়তা থেকে জেগে ওঠে না অভিঘাত, এরজন্য প্রয়োজন বোধের ধারাবাহিক অপূর্ণতা এবং অতৃপ্তি। এই কবিতার অভিঘাতগুলি কবির যুক্তি ও মননে সমৃদ্ধ এক বিশ্লেষণী সত্তা। যে অভিঘাতে ‘বারোমাসি নদী’— কবির সুষুপ্তির গভীরতায় হয়ে উঠেছে জলপ্রশস্ততায় মোহময় নদী। সেখানে জল নয়, বয়ে চলে কলরবময় সময়।
“[…] আমাদের সামনে যে নদীটি আছে
তার নাম বারোমাসি
বারোমাসি নামে এই পৃথিবীতে আর কোনো
নদী নেই, থাকবেও না কখনো।
ও আমার ভালোবাসা…”
দ্বিতীয় অনুপর্বের এই পঙ্ক্তিগুলি কবির ঘনীভূত গভীরতায় জলের আয়নায় মনস্তত্ত্বের অভিঘাত এবং প্রিয়তম জলের কলরবময় অনুপ্রাস।
“[…] এখানে আমার শিশু মার্বেল কৈশোর
এখানে বসন্ত সাহার ঘুন্টি দোকান
এখানে দুপুর বেলা
এক আনার নকল-দানা খাওয়া।”
তৃতীয় অনুপর্বের পঙ্ক্তিগুলিতে অভিঘাত সৃষ্টি হয়েছে কবির বোধের ধারাবাহিক অপূর্ণতা এবং অতৃপ্তি থেকে। নিসর্গদৃশ্য অথবা মনুষ্যকেন্দ্রিক বিষয়ের অভিমুখ থেকে সৃজনক্রিয়ার রহস্য উঠে আসে এমন অভিঘাতে। এমন বিষয়ের অভিঘাত থেকে কবি ফাউজুল কবির তত্ত্বের বদলে শরীরকে ঘুড়ি বানিয়ে ওড়াউড়ি করতে চেয়েছেন। অথবা ‘বারোমাসি’ নদীর নিস্তব্ধ তল্লাটে সূর্য যখন একা টানে দাঁড়, জলচর্চার বুদবুদে কবি অমৃত চোখে দেখেন ভাষাহীন ভালোবাসা।
“[…]আমি কবি হবো? কে বলেছে ? তুমি?
আমি বৃক্ষ হবো? কে বলেছে ? তুমি?
তুমি সব জানো? তুমি হাত গুণো?… “
কবিকে তো জীবন-চরিতে নয়, কবিতায় খুঁজতে হয়! তাই অভিঘাতগুলি ক্ষয়িষ্ণু এক কবির আত্মগত কথার নির্যাস এবং জীবনের জন্য নতুন একটা মায়া তৈরি করে। মানুষের যাপনতন্ত্রের বিগত আর আসন্নের ব্যবধানকে সময়ের অভিঘাত বলে। ‘একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল’-এর সম্মোহিত এই আবেগগুলি হচ্ছে সময়ের অভিঘাতে সৃষ্ট চতুর্থ অনুপর্বের পঙ্ক্তি। কবির এই জীবনে এমন কিছু ফেরারি-বোধ আছে, যা থেকে এই কবিতায় চলমান অনুপর্বগুলিতে আরও কিছু অভিঘাত সৃষ্টি করেছেন। কবির কাব্য-বাস্তবতার অন্তর্গত বিষয়গুলি এই কবিতায় অভিঘাতে সৃষ্টি করেছেন। অভিঘাত থেকে সৃষ্ট পঙ্ক্তিগুলি কবিতার রূপক-উপমা সৃষ্ট পঙ্ক্তি থেকে
অধিক রহস্যময় হয়।
মরমি চিন্তা বা ভাববিশ্ব:
—————————— —-
‘একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল’ এর সৃজনশীলতা মরমি চিন্তা বা ভাববিশ্বের যে উত্তরাধিকার তৈরি করেছে, তা বিষয়গত গুরুত্ব নির্ধারণে এই কবিতার সবটাই নিবেদিত কবির মরমি চিন্তার ভাবজগতে। সময়ের ভেতর বিলীন এই দেহ এবং জীবনের ভেতর বিলীন এই হৃদয়― এসবের মধ্যে যাবতীয় দৃশ্যবাস্তবতা কিংবা ছায়াবাস্তবতা সবকিছুর মধ্যে নিজেকে অনুপস্থিত করতে করতে কবিতায় স্পষ্ট করেছেন তাঁর অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের দ্বন্ধ। তখন লেখেন এইসব গাঢ় এই পংক্তিমালা :
“[…] আমি নষ্টের ও কষ্টের কথা শুনতে শুনতে
নিজের ভেতরে নিজেই বৃদ্ধি পেয়েছি
দক্ষিণের জানালা খুলেছি
উত্তরের দরজা ভেঙেছি
স্বপ্নের ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছে” (পঞ্চম অনুপর্ব)
অন্তর্দৃষ্টিতে, বহির্দৃষ্টিতে, বাকশক্তিতে, শ্রবণশক্তিতে এবং সঞ্চালন শক্তিতে সমগ্র কবিতায় সৃষ্টি করেছেন― “…তোমাকে দিয়েই হবে হওয়ার কাহিনী..” (ষষ্ঠ অনুপর্বের পঙ্ক্তি)।
‘বাঁশখালীর গঙ্গাধর জলদাস’-এর জীবন ও জেলে পেশার মধ্যকার সম্পর্কের এক অভাবিত ভাষা আবিষ্কারের ক্রিয়ায় ক্রমে ক্রমে মেতে উঠতে উঠতে কবি জেলেপাড়ার ভাববিশ্বে মিশে গেলেন।
“[…] গঙ্গাধর আমাকে শোনাতো গান, ভাটিয়ালি:
কী সুন্দর, চমৎকার তার গলা
সমুদ্র উঠে আসতো দরাজ কন্ঠে
খেলতো উজান ভাটির কারুকাজ।”
( নবম অনুপর্বের পঙ্ক্তি)
ভাববিশ্বের দীপ্তি পাঠের পরিধিটুকু হচ্ছে এই ‘একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল’। ব্যক্তিকাল, মানবকাল আর বিশ্বকালের সম্পর্কের মধ্যে আছে অদম্যতার এবং আত্মস্থতার শিক্ষা, যা কবিকে নিয়ে গেছে সৃজনশীল মরমি চিন্তার দিকে। সমাজের মধ্যে প্রকৃতি, জীবনের মধ্যে মৃত্যু, ভরসার মধ্যে নিরাশা― এসবই কবির মরমি চিন্তার অন্তঃসার-অন্তঃশরীর-অন্তঃশীল ভাববিশ্ব।
●প্রশ্নের দ্যোতনা:
————————
এই কবিতায় যখন আত্মগত নির্ধারণের কোনো বর্ণনা করেছেন, সেখানেই কবি প্রশ্নের দ্যোতনা সৃষ্টি করেছেন। কবিতার অনেক অনুপর্বের শরীরের-স্বরে এই ‘?’ (প্রশ্নবোধক) চিহ্ন ছড়ানো আছে বলেই ঐসব পঙ্ক্তিগুলি হয়ে উঠেছে উপস্থাপনায় সংক্ষিপ্ততার নন্দনপ্রণালি। প্রকৃতির মধ্যে লীন হওয়ার আবেশ আর জীবন-স্রোতের মধ্যে নিজেকে বুঝতে চাওয়ার সন্ধিৎসা― এর নিরুপায় অভিমুখিতা হচ্ছে প্রশ্নের ইঙ্গিতময় দ্যোতনা প্রয়োগ। এই প্রশ্নগুলি থেকে কবি পেয়ছেন বোধের সামগ্রিকতা। আবার এসব প্রশ্নের চিহ্নগুলি কবির অধিচেতনা বা অধিবাস্তবতার সংগতির প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। অধিচেতনা বা অধিবাস্তবতার পঙ্ক্তিগুলি এরকম:
“[…] আমি কবি হবো? কে বলেছে ? তুমি ?
আমি বৃক্ষ হবো? কে বলেছে? তুমি ?
তুমি সব জানো ? তুমি হাত গুণো ?
ওই যে জাম গাছে বসে আছে একা
কাঠবেড়ালি, সে কি হবে বলতে পারো ?”
(চতুর্থ অনুপর্বের পঙ্ক্তি)।
উপস্থাপনায় সংক্ষিপ্ততার নন্দনধর্মী পঙ্ক্তিগুলি এরকম:
“[…] আমাকে কি হতে হবে সম্পূর্ণ সুন্দর ?
রূপে-গুণে কান্তিমান জমজ অর্জুন ?
আমাকে কি হতে হবে সুন্দরের মাঝি ?
সুন্দর কোথায় থাকে ? জীবনের বুকে ?
কে কাঁদে আমার বুকে না হওয়ার শোকে ? “
(চৌদ্দতম অনুপর্বের পঙ্ক্তি)।
এখানে প্রশ্নের ইঙ্গিতময় দ্যোতনা প্রয়োগের উদ্দেশ্য হচ্ছে― প্রশ্নে প্রশ্নে ছড়ানো সন্ধিৎসার আহ্বান, যেখানে আছে জীবনের ব্যাপ্তি আর মেদুরতা, স্তব্ধ আর রহস্যময়তা এবং শরীরের-স্বরে প্রশ্নগুলি ছুঁয়ে যায় আবহমান সময়ের প্রশান্তি।
● শেষোক্ত কথা:
————————
কবি ফাউজুল কবির-এর অস্তিত্বের কথন ‘একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল’ কবিতার কবিচেতনায় যে বোধটি প্রবাহিত আছে, তা হচ্ছে প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় যে নতুন জ্ঞান এবং নতুন বোধ, তাহা শিল্পিত রূপায়ণে নতুন অভিজ্ঞতাধর্মী ইতিহাসেরও জন্ম দেয়। কেননা কবিতার ইতিহাস হচ্ছে মানুষের চেতনা প্রসারের ইতিহাস। কবি ফাউজুল কবির ধ্যানমগ্নতায় এই কবিতার মাধ্যমে জীবনবোধের সকল মাত্রাকে, বিরল মনোভঙ্গিতে একটি মানবসত্ত্বার মধ্যে সফলভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন। যেখানে জীবনবোধের মানবসত্ত্বায় কেঁপে ওঠেন বাউলআত্মা― অতিজীবিত কাব্যপুরুষ ফাউজুল কবির।
ফাউজুল কবির
=======================