You are currently viewing ‘অলীক মানুষ’-  ব্যক্তিজীবনকে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে স্থাপন এবং বিমূর্তায়ন।  লিপি নাসরিন 

‘অলীক মানুষ’-  ব্যক্তিজীবনকে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে স্থাপন এবং বিমূর্তায়ন। লিপি নাসরিন 

‘অলীক মানুষ’-  ব্যক্তিজীবনকে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে স্থাপন এবং বিমূর্তায়ন।

লিপি নাসরিন 

মানুষগুলো কি অলীক নাকি অলৌকিক? আমার কেবল মনে হয়েছে সব চরিত্র অলৌকিক। কোথা থেকে হাজির হয় অসম্ভব সব মায়া আর মোহগ্রস্ততা নিয়ে  তারপর  হারিয়ে যায় আবার আসবে বলে। পীর সৈয়দ ওয়াদিউজ্জামান যিনি উচ্চারণ ভ্রমে হয়ে হয়েছেন বদিউজ্জামান- এক  আশ্চর্য চরিত্র যার পুরা নাম সৈয়দ আবুল কাসেম মুহম্মদ বদিউজ্জামান আল-হুসেইদি আল-খুরাসানি,  তাঁর চরিত্রকে ব্যবচ্ছেদ করলে বেরিয়ে আসবে এক দ্বিধান্বিত রক্ত মাংসের মানুষ। তথাকথিত পীরতন্ত্রে তাঁর বিশ্বাস নেই, তিনি যেখানে পীরের থান পান ভেঙে ফেলেন। ওহাবি মতাদর্শে বিশ্বাসী  সৈয়দ বদিউজ্জামান ফরাজি আন্দোলনের কথা শোনে, সেই আন্দোলনে নিজের একাত্মতা ঘোষণা করে। এক সময় আন্দোলন ফিকে হয়ে আসে এবং অঙ্কিত চরিত্র যেন তাদের গতিপথ পাল্টে নেয়। সৈয়দ বদিউজ্জামান ওরফে বদু পীরকে সংসারের মোহমায়া বাঁধতে পারে না তবে যেখানেই যাক সংসার তাঁর সাথেই থাকে। উপন্যাস শুরু হয়েছে সৈয়দ বদিউজ্জামানের ছোট ছেলে সৈয়দ শফিউজ্জামান ওরফে শফির আত্মস্মৃতি লেখার মধ্য দিয়ে আর শেষ হয়েছে প্রতিবন্ধী মেজো ছেলে সৈয়দ মনিরুজ্জামানের নাতির উপন্যাসের পটভূমিতে প্রস্থান দিয়ে । মসজিদে দিনের পর দিন সংসার ফেলে দিনযাপন মৌলানা সৈয়দ বদিউজ্জামানের স্ত্রী  সাঈদার মধ্যে জন্ম দিয়েছে এক ক্ষার মিশ্রিত অভিমান। এক ঝড় জলের রাতে তাই ঐশ্বরিক ক্ষীণ দাম্ভিকতা ফেলে তাঁর ভেতরে জেগে ওঠা কামনার আগুনকে নেভাতে কাদামাটির জলে নেমে এলেন মৌলানা বদিউজ্জামান, কিন্তু সাঈদা তার আজন্ম লালিত বিনীত সম্ভ্রম আর ভয় ঝেড়ে ফেলে স্বামীর প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আর সেই গ্রামের  আরেক পরনারী ইকরাতুনকে নিয়ে স্বামীকে করল চরম অবিশ্বাস। মৌলানা সৈয়দ  বদিউজ্জামান স্বামীত্বের অধিকার নিয়ে ধর্মের কথা শোনাতে গেলে সাঈদা চরম তাচ্ছিল্যভরে বলে ওঠে,’ ওসব বুলি মসজিদে শোনান গিয়ে আমার কাছে নয়।’ বদিউজ্জামান সেই যে ঘর ছাড়লেন আর ফিরে আসলেন অনেকদিন পর ,অনেক ঘটনার জন্ম দিয়ে। 

ছোট ছেলে সৈয়দ শফিউজ্জামানকে তিনি পাঠশালার ভর্তি করিয়ে দিয়ে এক সময় আব্দুল বারি  চৌধুরীর হাতে তুলে দেয় ছেলের সমস্ত ভার।কোন গভীর গোপন কারণে তিনি ছেলেকে মক্তবে ভর্তি না করিয়ে পাঠশালায় দিয়েছিলেন তা একমাত্র তিনিই জানেন কিন্তু ক্রমে পাঠক ঠিকই বুঝে নেয় তাঁর ভেতরে লুকিয়ে আছে অন্য এক মানুষ যাকে কিনা শাস্ত্রীয় অনুশাসনের আড়ালে তিনি লুকিয়ে রেখেছেন।

এখানে লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এক অনন্য সাধারণ ছবি এঁকেছেন উপন্যাস জুড়ে। যে শফি ছোটবেলায় বাবার নানা রকম ঐশ্বরিক ক্ষমতার শুনে শুনে বড় হয়েছে সেই শফি ব্রিটিশ হটানোর উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে নাম লিখিয়ে একের পর এক দেশি জমিদার, ব্রিটিশ নাগরিককে হত্যা করে। উপন্যাসের আরেক নারী দরিয়া বানু ,সাধারণ চাষার ঘরের মেয়ে, বিয়ে হয় এক ভূস্বামীর সাথে যে আব্দুল বারি চৌধুরীর জ্ঞাতি। মৌলানা সৈয়দ বদিউজ্জামান মৌলাহাট  গ্রামে প্রথম যেদিন আসেন পরিবার নিয়ে সেদিন এই দরিয়া বানুর বাড়িতে তাঁদের খাবার আয়োজন হয়। দরিয়া বানুর  দুই যমজ মেয়ে দিলরোজ এবং দিলরুখ। ঘটনার পরিক্রমায় দিলরুখকে ভালোবেসে ফেলে শফি।সেটি বারি চৌধুরী এবং দরিয়া বানু উভয়ে জানতো কিন্তু শফির হঠাৎ বারি চৌধুরীর কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়ায় কাহিনি মোড় নেয় ভিন্ন পথে। বড় বোন দিলরোজের বিয়ে হয় মৌলানা বদিউজ্জামানেরর বড় ছেলে, যে বাবার মতোই মৌলানা হয়ে ফিরেছে কিন্তু কট্টর ইসলামপন্থি নুরুজ্জামানের সাথে এবং দিলরুখের বিয়ে হয় সৈয়দ বদিউজ্জামানের প্রতিবন্ধী মেজো ছেলে মনিরুজ্জামানের সাথে। দিলরুখ বরাবরই বড় বোনের বিপরীত কিন্তু এই বিয়ে তার জীবনকে স্তব্ধ করে দেয়। মায়ের প্রতি এক প্রচণ্ড অভিমানে সে মায়ের আত্মহত্যার খবর শুনেও থাকে নির্বিকার। দিলরোজ ওরফে রোজি ধীরে ধীরে বালিকা বধু থেকে গৃহিণী হয়ে উঠলেও দিলরুখ তা কোনদিন পারেনি। এভাবে লেখক হরিহর আত্মা দুই যমজ বোনের মধ্যে এক দৃশ্য ও অদৃশ্য স্বার্থের প্রাচীর তুলে দিয়েছেন। দিলরুখ প্রতিদিন একটু একটু করে পালাতে থাকে স্বামী নামক এক জন্তুমানুষের কামার্ত আক্রমণের কাছে তার অবশ শরীর রেখে দূরে বহুদূরে। রুখু তার মা দরিয়া বানুর শরীরের এক অদ্ভুত গন্ধের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমোতে পারে না সেকি আতরের গন্ধ নাকি অন্য কিছু,  নাকি এক জ্যোৎস্না রাতে তার মায়ের আত্মহত্যার আবছায়া মথিত মৃত্যুঘ্রাণ!! মূলত দরিয়া বানুর আত্মহত্যা ছিলো নিজের মেয়ের সর্বনাশের মানসিক যন্ত্রণার পরিসমাপ্তি।

মাঝখানে কাহিনির বেশ খানিকটা অংশ জুড়ে শফির অনুপস্থিতি পাঠককে ব্যস্ত রাখবে তার খবর জানার জন্য। পাঠকের আকর্ষিত মন ব্যস্ত হয়ে উঠবে হরিণমারার হাইস্কুলে কিংবা নবাববাড়ির কাছারিতে কী করছে শফি দেওয়ান আব্দুল বারি চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে সেই খবরে।

সমগ্র উপন্যাস জুড়ে প্রকৃতির সাথে এক ঐশ্বরিক ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে রাখা হয়েছে পর্বে পর্বে। সবই প্রকৃতির রীতিশুদ্ধ নিয়ম কিন্তু তা পাঠককে এক অতীন্দ্রিয় আবেগের ক্ষণিক বিভ্রমে  ডুবিয়ে রাখে। সৈয়দ  বদিউজ্জামান তাঁর এই ছোট ছেলে শফিকে সব সময় অন্য চোখে দেখেছে।কখনো তাঁর মনে হয়েছে শফি যেন অন্য কোন মানুষ , তাঁর ঔরসজাত নয় এবং শফির মধ্যে সে তাঁর অন্তর্নিহিত সত্তাকে দেখতে পায়, অথচ শফির শেষ পরিণতির জন্য তিনি নিজে অপরাধবোধে জর্জরিত হয়েছেন। এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড় শক্তি প্রতিটা চরিত্র আপন বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত । যখন যে চরিত্রের ভেতর লেখক কলম চালিয়েছেন সেটিই হয়ে উঠেছে মুখ্য পাঠকের কাছে, পাঠক সেই চরিত্র নিয়েই মেতে থেকেছেন। তৎকালিন সামাজিক- রাজনৈতিক বাস্তবতা, ব্রিটিশ বিরোধী সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা, ব্রাহ্ম আন্দোলন, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক ,হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের  হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা  সব কিছুই অত্যন্ত গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। পড়তে পড়তে পাঠক এক সময় ঢুকে পড়ে নবাবি শান-শওকতের মধ্যে। নবাব বাহাদুরের কেল্লা, আগাছা আর মসে জড়ানো পুরানো প্রাচীর, দেউড়ি, নবাবের আশ্রিতদের বাসস্থানের বর্ণনা, এখানে সেখানে ভেঙে পড়া একতলা দোতলা বাড়ি, সরু গলিপথ পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয় ক্রমক্ষয়িষ্ণু এক অভিজাত সমাজ ব্যবস্থার নিচে।

দিলরুখের সাথে  প্রতিবন্ধী মেজো ভাই মনিরুজ্জামান ওরফে মণির বিয়েকে কোনদিন মেনে নিতে পারেনি শফি।  প্রচণ্ড ঘৃণায়  তার মন ভরে ওঠে এই ভাইয়ের প্রতি। দিলরুখকে হারানো তার অশান্ত মন একের পর এক নারীসম্ভোগে মেতে ওঠে অবদমিত কষ্টকে পাথর চাপা দিতে। মানুষ কি জন্মলালিত সংস্কারকে একেবারে ত্যাগ করতে পারে? শফির একাকী নিভৃতের একান্ত মানসিক অবস্থা তাকে সবসময় মনে করিয়ে দিয়েছে সে পীর বদিউজ্জামানের (গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো তার বাবাকে অলৌকিক ক্ষমতাধারী পীর ভাবে আর ঐশি

নিদর্শন দর্শনের আশায় উর্ধ্বাকাশে তাকিয়ে থাকে) ছেলে। সে যেখানেই গেছে সেখানেই মানুষের সশ্রদ্ধ সমীহ পেয়েছে পীরের ছেলে বলে। শফি সেই সমীহকে অন্তরে উদযাপন করেছে একান্ত নিভৃতে। কখনো কখনো জীবনের কোন খেয়ালে তার মনে হয়েছে তার বাবার ঐশ্বরিক ক্ষমতা তাঁকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করে চলেছে যেন। একের পর এক ইংরেজ বা তাদের তাবেদার দেশি জমিদারকে হত্যা করার পরও তার ধরা না পড়া সেই বিশ্বাসকে যেন দৃঢ়মূল করেছে। মানুষের যে সত্তা তাকে একাকী দংশন করে, তাড়িত করে নেই সত্তাই খোঁজে নিভৃত নিরাপত্তা নিজেকে লুকিয়ে ফেলার জন্য। তাইতো  স্বাধীন নাম্নী ব্রাহ্ম পল্লীতে আসা মেয়েটির সাথে জমিদারপুত্র হাজারিলালকে দেখে শফির আবেগের যে বিস্ফোরণ তাতে তার মনে হয়েছে তার বাবার প্রেরিত কোন কালো জিন যেন তাকে জোরে একটা থাপ্পড় মেরে এক হিন্দু যুবতীর প্রতি মোহগ্রস্ততাকে কাটিয়ে দিতে চাইছে। আর এক জ্যোৎস্না রাতে জঙ্গলের মধ্যে ভাঙা বাড়ির বারান্দায় শুয়ে দুই সাপের মেটিং দেখে তার ভয়ার্ত শরীর-মন বারবার তার বাবার ঐশ্বরিক ক্ষমতার কাছেই যেন নত হয়ে পড়ে। মানুষ যতই স্বাধীন আর সভ্য বলে নিজেকে দাবি করুক না কেনো পূর্ব সংস্কার বা পূর্বপুরুষের সংস্কার বা সামাজিক রীতি থেকে একেবারেই হয়তো বের হতে পারে না কিন্তু শফি নিরন্তর চেষ্টা করেছে সেই উৎস থেকে নিজেকে ছিঁড়ে ফেলতে। শফির নিরুদ্দেশ সংবাদে মা সাঈদা বেগম একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যায়, শফির কথা বাড়িতে কখনো উচ্চারিত হতো না কিন্তু, রুখু  খোঁড়া পীরের মাজারের-যেখানে সাঈদা তার পীরতন্ত্র বিরোধী স্বামীর অগোচরে প্রতিবন্ধী ছেলের সুস্থতা কামনায় শিরনি  দিতে যেতো রাতের অন্ধকারে, কাছে এক প্রকাণ্ড বটগাছের শীর্ষে ধূসর নীলাকাশে কাকে যেন খুঁজে বেড়াতো। মূলত সাঈদা ছিলো বদিউজ্জামানের আপাত কাজকর্মের বিরোধী হয়তো সংসারের প্রতি স্বামীর উদাসীনতা তার মধ্যে জন্ম দিয়েছিল হতাশা। একসময় সাঈদার ইনটুইশন সত্যি বলে প্রমাণিত হয়। ইকরাতুন নাম্নী পিঙ্গল চোখের এক নারী যাকে ডাকাত আব্দুল কুঠো ভাগিয়ে এনেছিল, বদিউজ্জামান সাঈদার সংসার থেকে সরে গিয়ে তাকে বিয়ে করে। জীবনের অনিবার্য সত্যগুলোকে অস্বীকার করতে করতে বদিউজ্জামান এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়ায় যেখানে তার শাস্ত্রীয় জ্ঞান, জাগতিক আচার আর রক্ত-মাংসের মানুষের কামনা-বাসনা নিয়ে শুধুই একা। আর তার এই একাকিত্ব তাঁকে ধাবিত করে ইকরাতুনের শরীরে দিকে অথচ এই ইকরাতুনকে সবাই ডাইনি বলে যে তন্ত্র-মন্ত্র  তাবিজ-কবজ করে বেড়ায় এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে, তারই প্রেমে পড়ে সৈয়দ বদিউজ্জামান। তাইতো তাঁর মুখ নিঃসৃত সেই সত্যকথন,’  শাদা জিনগুলো তাকে আসমানে শাহী তখতে বসাইল কিন্তু তার দিল বনু-আদমের থাকিয়া রইল, উহা গোশত আর খুন দ্বারা তৈরী।’ এক সময় ইকরাতুনকে ধর্মের পথে আনতে না পেরে সমাজের চাপে তাকে তালাক দেয় কিন্তু  তাকে ভুলতে পারেনি কোনদিন। ইকরাতুনের জন্য  তার অন্তর কাঁদে তাইতো দুই হাতে মুখ ঢেকে তিনি কাঁদেন আর বলেন, ‘পরওয়ারদিগার! হে কুলমখলুকাতের মালেক! বনু আদমের মৃত্তিকা নির্মিত এই অজুদের ভিতরে তুমি কী গোপন চীজ স্থাপন করিয়াছ যে সামান্য ধাক্কায় তার সমুদায় জিন্দেগী কাঁপিয়া ওঠে? হতভাগিনী কাহিন আওরত! কেয়ামতের পর হাশরের ময়দানে আমি উহার জন্য নেকির অর্দ্ধাংশ দানে তৈয়ার রহিলাম।’

ইকরাতুন বদিউজ্জামানের ঔরসজাত কন্যাকে লালন পালন করে একা। ঘটনাক্রমে এইখানে এক মাস্তানবাবার আবির্ভাব যিনি কিনা এক পাগলা সাধক এবং এই পাগলা সাধক আর কেউ নন তিনি পীর সৈয়দ বদিউজ্জামানের ছোট ভাই সৈয়দ ফরিদুজ্জামান যাকে সুফিবাদ ও পীরতন্ত্র বিশ্বাসের কারণে চুল কেটে জুতা মেরে সংসার থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল বদিউজ্জামান ওরফে বদু পীর।

জাহের আর বাতেনের দ্বন্দ্ব বদিউজ্জামানকে যেমন তেমনি শফিকেও ঘিরে রেখেছে সমস্ত উপন্যাস জুড়ে। এক অদ্ভুত মনস্তাত্বিক জটিলতা বদিউজ্জামান এবং শফিউজ্জামান এই দুই চরিত্রের মধ্যে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন, প্রকৃতপক্ষে তাবৎ মানবকুলের মধ্যেও কি তা নয়। শরীর শরিয়ত, ছায়া মারেফত,শরীর না থাকলে ছায়াও থাকে না। একসময় শরীর অদৃশ্য হয়ে যায় আর ছায়া সত্য হয়ে দাঁড়ায়। নরবধ শফির কাছে নেশার মতো হয়ে যায়; ইংরেজি শেখা, প্রকৃতিচর্চা, ব্রাহ্ম সমাজের সাথে সম্পৃক্ততা কিছুই তাকে থিতু হতে দেয়নি। মানুষের মুক্তি,শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ যেন তার একমাত্র অভিলাষ  তাই তো একটা পর্যায়ে শফি ছবিলাল হয়ে কৃষ্ণপুরে  সাত টাকা মাসিক বেতনে গোবিন্দরাম সিংহের গোমস্তার চাকরি করে আর হয়ে ওঠে কৃষক আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা । শফি ওরফে ছবিলাল তখন মায়ের কাছে হিন্দু, পরিত্যজ্য  আর বাবার কাছে মুর্দা কিন্তু নিপীড়িত মানুষের কাছে সে এক অলৌকিক দেবদূত কৃষ্ণাশ্বরোহী, নেমে এসেছে আকাশ থেকে যে পথিমধ্যে লুণ্ঠিত  অর্থ বিলিয়ে দিতো অসহায় নিচু জাতের দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে। লোকে যাকে প্রণাম করতে উদ্যত হলে বলতো, ‘অই বৃক্ষ দেখ,যাহা ঋজু, যাহা ছেদিত বা দগ্ধ হয়; কিন্তু স্বেচ্ছায় নত হয় না, যাহা ভূমির জন্য কাহাকেও রাজস্ব দেয় না। তোমরা বৃক্ষের নিকট শিখ। আর তোমরা নদীর নিকট শিখ, যাহা গতিশীল …।’ 

এই উপন্যাসে পাঠক খুঁজে পাবে সেই সময়ের কিছু পত্রিকার কাটিং যেখানে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম অবদানের  বিভিন্ন দিক নিয়ে সংশয়মূলক প্রতিবেদন আছে। 

কখনো বদিউজ্জামানের বয়ানে, কখনো শফির বয়ানে সমস্ত আখ্যান এগিয়েছে এক অসাধারণ সাবলীল কিন্তু দার্শনিক আবহে। কোরান আর বেদের সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক আলোচনা,সন্ত্রাসবাদ আন্দোলন থেকে ধর্মতত্ত্ব,  সিপাহী বিদ্রোহ থেকে  ওহাবী-ফরাজি আন্দোলন, মুসলমানদের ধীরে ধীরে ধীরে নিজস্ব লুপ্ত ঐতিহ্যকে ফিরে পাওয়ার তাগিদ আর যুক্তির নিরিখে ধর্মকে বিশ্লেষণের এক অপূর্ব সম্মিলন যা এর চরিত্রগুলোর মধ্যে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে লেখকের অসাধারণ বর্ণনা নৈপুণ্যে। এক কাহিনির মধ্যে তিনি জন্ম দিয়েছেন একাধিক উপকাহিনি যা পাঠককে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় উপন্যাস জুড়ে । এখানেই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ অনন্য। এই উপন্যাসের মতো আরেকটি উপন্যাস আমাকে ভীষণ টেনেছিল সেটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ কিন্তু ‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসের যে আবেদন সেটি একেবারেই ভিন্ন- তার আখ্যান ভিন্নতা এবং বর্ণনার অভিনব চমৎকারিত্বে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ পর্যায়ে পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে এক পরিবারকে ঘিরে গড়ে ওঠা এ উপন্যাসে চিরায়ত ভারতীয় সমাজের লৌকিকতা, ধর্মের নামে এক ধরনের অলৌকিক বিশ্বাস, হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতি, সমাজে প্রচলিত মিথ সবকিছুর মধ্যে দিয়ে লেখক সমাজকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং এটি তিনি করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তাঁর মুসলিম এবং  হিন্দু এই দুই সংস্কৃতির সাথে  নিজস্ব নিবিড় অভিজ্ঞতার দরুণ। 

উপন্যাসের চরম ক্লাইমেক্সে পাঠক অভিভূত হয়ে পড়ে যখন মৃত ফরিদুজ্জামান পানির উপর ভেসে এসে বদিউজ্জামানকে একজন বদ, ঘৃণিত ব্যাক্তি বলে অভিহিত করে কেন না- লেখক সে কথা উচ্চারণ না করলেও পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না, বদিউজ্জামানের এতিমখানায় পালিত জুলেখা- যার সাথে তাঁর মেজো ছেলে অসুস্থ মনিরুজ্জামানে ছেলের বিয়ে হয়ে যায়, আসলে তাঁরই ঔরসজাত ইকরাতুনের কন্যা। বদিউজ্জামান যেন সেভাবেই দেখতে পায় মৃত ভাইকে যে কিনা বিয়ের মজলিসে এসে হাজির হয়েছিল শুধু জুলেখা যে বদিউজ্জামানের ঔরসজাত কন্যা  সেটি জানানোর জন্য কিন্তু পীরতন্ত্র বিরোধী অনুসারীরা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলে পড়ে গিয়ে ফরিদুজ্জামানের মৃত্যু হয়। এই সংবাদ জানার পর থেকে সৈয়দ বদিউজ্জামান ওরফে বদু পীরের মধ্যে ভাবান্তর ঘটে, এক ধরনের প্রচণ্ড পাপবোধ তাঁকে ধীরে ধীরে ধীরে গ্রাস করে এবং মসজিদের এক কোণে মশারি টানিয়ে সেই যে তিনি ঈশ্বরের ক্ষমাপ্রার্থী হলেন আর বের হলেন লাশ হয়ে। ততদিনে বদিউজ্জামান বদু  পীর হয়ে, কিংবদন্তি মিথ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে লোক থেকে লোকান্তরে মানুষের মুখে মুখে কথায় ও দোহায়।

এক সময় নিজের কাছে একা হয়ে যাওয়া বদিউজ্জামানের প্রচণ্ড একাকিত্বে মনে পড়ে ছোট ভাইয়ের কথা। সে কি সত্যি আল্লাহ্ প্রেমিক যে নিজেকে মাশুক বলতো? প্রেরিত পুরুষ ছাড়া আর কারো কি সেই যোগ্যতা আছে? এইখানে আমরা বদিউজ্জামানের এক অস্থির সংশয়ারোপিত মনের সন্ধান পাই। 

বদিউজ্জামান সৃষ্টিকর্তার সন্ধান করেছেন প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে একাকী অপার বিস্ময়ে। প্রকৃতির নানান রূপে, ভিন্ন দোলাচলে তাঁর কখনো মনে হয়েছে এ কি সত্যি তাঁকে দেখানো কোন ঐশ্বরিক নিদর্শন? যে পীরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি জেহাদ ঘোষণা করে ঘুরে বেরিয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রাম আর নগরে সেই পীরতন্ত্র যাঁতাকলে  তাকে পিষ্ট  করেছেন তার অনুসারীরা প্রতি পদে পদে। আর নিরশ্বরবাদী শফি যে কিনা প্রচলিত ধর্মের মুণ্ডুপাত করে মানবধর্মকে উর্ধ্বে স্থান দিয়েছিল, সেও কি তার উৎস থেকে বিচ্যুত হতে পেরেছিল? জেলের নির্জন প্রকোষ্ঠে বসে সে তখনো বিশ্বাস করতো গরুর গাড়ির পিছনে হাঁটতে হাঁটতে  সেই উলুখড়ের জঙ্গলে  সে শাদা জিন দেখেছিল যে তাদেরকে পথ দেখিয়ে দিয়েছিল কিংবা তার ভিতরে হয়তো এক সুক্ষতম দোলা বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের সীমান্তে ! শফির কর্মফলতত্ত্বে বিশ্বাস নেই কেননা যুক্তি সেখানে রোহিত কিন্তু  জীবন এক অপার রহস্য তা সে বিশ্বাস করে।

কাহিনি বর্ণনা পরিক্রমায় পাঠকের জন্য আছে আরো এক বিস্ময়কর কথোপকথন  যখন বৃদ্ধ দিলরুখ তার নাতনি কচির কাছে তার জীবনের গল্প বলছে। কচি তন্ময় হয়ে শুনছে তার ছোট দাদা শফির কথা আর প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছে দিলরুখকে। একটা ডায়েরি যা শফি জেলে বসেই লিখে গেছে সেটি দিলরুখ যত্ন করে বাক্সে ভরে রেখেছিল একদিন সবার অগোচরে সেই ডায়েরি উঠোনে আগুনে পুড়িয়ে দিলরুখ তার  প্রতিবন্ধী স্বামীর- যাকে সে কোনদিন ভালোবাসতে পারেনি, কবরে গিয়ে নিজের কাছেই নিজে জবাবদিহি করে।

ভাষার যাদুময় প্রক্ষেপ, প্রতিকীকরণ, চরিত্র নির্মাণ, বর্ণনাশৈলি সাথে ইতিহাস, দর্শন, সমাজতত্ব,ধর্মশাস্ত্র সব মিলিয়ে এ এক মহাকাব্যিক উপন্যাস যা মৌলিক এবং অভিনব বিশেষ করে আমার মনে হয়েছে এক কবি এখান থেকে তুলে নেবে তার কবিতার অজস্র চিত্রকল্প। লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভাই সৈয়দ খালেদ নোমানের সাথে কথোপকথনে জেনেছিলাম উপন্যাসটি লেখক ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার সম্পাদকের আমন্ত্রণে অনেকটা খেলার ছলে লিখতে শুরু করেছিলেন। বেশ কয়েক পর্ব লেখার পর তিনি লেখা পাঠানো বন্ধ করেন তখন ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলাভাষী পাঠক চিঠি লিখে লেখককে অনুরোধ করেন লেখাটা পুনরায় শুরু করার জন্য। এই অভাবনীয় সাড়া পেয়ে লেখক আবার ধারাবাহিকভাবে লেখা পাঠাতে থাকেন আর  বাংলা সাহিত্যে সংযোজিত হলো এক কালজয়ী উপন্যাস যা সত্যিই বিরল এবং ব্যতিক্রম। এই উপন্যাসের মূল দুই চরিত্রের একজন সৈয়দ বদিউজ্জামান যাকে লেখক এঁকেছেন তাঁর দাদার আদলে এবং অন্যজন সৈয়দ শফিউজ্জামানের চরিত্রটি তাঁর বাবাকে মাথায় রেখে। 

আঙ্গিকের দিক থেকেও ‘অলীক মানুষ’ বাংলা সাহিত্যে একমেবাদ্বিতীয়ম-এমন ঢঙে বাংলা সাহিত্যে আর একটিও উপন্যাস লেখা হয়েছে বলে জানা নেই। শতবর্ষব্যাপী ঘটনা বিস্তৃত হয়ে আছে এই উপন্যাসে।

এই উপন্যাস নিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে এতো বিস্তৃত লেখার আছে যা শেষ হবে না বরং পাঠক নিজেই পড়ে নিবে সেই আশাবাদ ব্যক্ত করি।

 

এই উপন্যাস সম্পর্কে লেখক নিজেই বলেছেন, ‘আসলে অলীক মানুষ বলতে আমি বুঝিয়েছি মিথিক্যাল ম্যান। রক্ত-মাংসের মানুষকে কেন্দ্র করে যে মিথ গড়ে ওঠে, সেই মিথই একসময় মানুষের প্রকৃত বাস্তব সত্তাকে নিজের কাছেই অস্পষ্ট এবং অর্থহীন করে তোলে। ব্যক্তিজীবনের এই ট্র্যাজেডি ‘অলীক মানুষ’-এর মূল প্রতিপাদ্য। উপন্যাসটিতে ইচ্ছাকৃতভাবেই কোনো কালের ধারাবাহিকতা রাখিনি। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। এই আখ্যানে প্রকৃতপক্ষে শুধু দুটিই চরিত্র—ধর্মগুরু বদিউজ্জামান এবং তাঁর নাস্তিক পুত্র শফিউজ্জামান। এই দুটি মানুষ নিয়ে আমি এক ধরনের খেলা করতে চেয়েছি। একজন মনে করেন, মানুষের নিয়ন্তা ঈশ্বর, অন্যজন ধারণা পোষণ করেন যে মানুষ নিজেই তার নিয়ন্তা।’ (সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ : অলীক মানুষ-এ আমি স্বেচ্ছাচারীর আনন্দ পেয়েছি, কোরক, শারদীয় ১৪০০ বঙ্গাব্দ)

এই গ্রন্থরচনার প্রেক্ষিতে লেখক আমাদেরকে আরো জানান, ‘আমার মনে শুধু এটুকু চিন্তা ছিল ব্যক্তিজীবনকে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে স্থাপন এবং বিমূর্তায়ন।… এই উপন্যাসে আমি অনেক দেশি-বিদেশি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছি – সে-সব উদ্ধৃতি ভাষায় বিভিন্ন। আমি কখনই পণ্ডিতি দেখাতে চাইনি। আসলে বিমূর্তায়নের প্রয়োজনে উদ্ধৃতিগুলিকে আবহসংগীত হিসাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছি।’

 

উপন্যাসটির জন্য তিনি চারটি পুরস্কার পেয়েছেন : ভূয়ালকা পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার এবং সুরমা চৌধুরী মেমোরিয়াল আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার।

এই উপন্যাস পড়তে পড়তে আমি গাড়িতে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে আধো ঘুম আর আধো জাগরণে চলেছি মুর্শিদাবাদের পথে। হঠাৎ চারিদিক জাগিয়ে ভোর এলো, আমি নেমে পড়লাম বহরমপুর বাস স্টেশনে। ঐ অলৌকিক অলীক মানুষগুলোর গল্প আমাকে ঘোরের মধ্যে  এক পরাবাস্তব জগতে নিয়ে ফেলে। আমি হাঁটি, চলি কিন্তু মানুষগুলো আমার থেকে দূরে যায় না কখনো।