You are currently viewing কমরেড জসিম মণ্ডলে প্রভাবিত ইমাম আলীর স্বপ্নঃ আলী সিদ্দিকী

কমরেড জসিম মণ্ডলে প্রভাবিত ইমাম আলীর স্বপ্নঃ আলী সিদ্দিকী

কমরেড জসিম মণ্ডলে প্রভাবিত ইমাম আলীর স্বপ্ন

আলী সিদ্দিকী

 

কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডলের চেতনার আলোয় গড়ে ওঠা আরেক অর্গানিক বিপ্লবীর কথা এখানে তুলে ধরতে চাই। সে ছিলো জসিম উদ্দিন মণ্ডলের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত। কমরেড জসিম যখন চট্টগ্রাম আসতেন, সে সব কাজ ফেলে  হাজির হতো তাঁর বক্তৃতা শুনতে। নিজেকে জসিম উদ্দিন মণ্ডল হিসাবে কল্পনা করতো এবং কথাবার্তায় চালচলনে নিজেকে কমরেড জসিম মণ্ডলের আদলে গড়ে তোলার প্রয়াস পেতো। স্বপ্ন দেখতো সেও একদিন জসিম মণ্ডল হয়ে উঠবে।

সেই স্বাপ্নিক মানুষটার নাম ইমাম আলী। বাংলাদেশের একবেলা খাওয়া না খাওয়া লাখো পরিবারের একটি পরিবারে তার জন্ম। আবাল্য দারিদ্র্যের বৈরীতায় বেড়ে ওঠা এই মানুষটি বুদ্ধি হবার আগে থেকেই সংসারের বোঝা কাঁধে নিয়ে দুঃখিনী মাকে সাহায্য করার জন্যে স্কুলে যাবার বদলে উপার্জনের যাঁতাকলে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে অবুঝ ভাইদের মুখে অন্ন জোগাতে মাকে সাহায্য করতে। অন্য আরো লাখো পরিবারের লাখো ইমাম আলীর মতো সেও হয়তো অনুলে­খ্য থেকে যেতো শুধু নিজ পরিবারকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে নিয়োজিত থাকলে, নিজ পরিবারের গন্ডীতে আবদ্ধ থাকলে। এমন লাখো কোটি নীরবে নিঃশেষিত জীবন যেমন অপাঙ্তেয় থেকে যায় তেমনি যেতো ইমাম আলীর জীবন। হয়তো আমিও এখন যা বলছি-যেভাবে বলছি সেভাবে বলা হতো না তার কথা। কিন্তু তার অতিসাধারণ জীবন এমন একটি ধারায় মিশে যায় যে, যা আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরার জন্যে আমার লেখনী সূর্যশিখায় সুতীক্ষ্ম হয়ে উঠতে চাইছে।

নব্বুইয়ের দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের বুকে জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসেছে সামরিক স্বৈরশাসন। জলপাই রংয়ের জংলী শাসনে পিষ্ট স্বদেশে প্রথমে জেগে ওঠে সচেতন ছাত্রসমাজ। মোজাম্মেলের রক্তধারায় বেগবান হয়ে উঠতে থাকে সামরিক শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন। ছাত্র আন্দোলনের স্রোতধারায় মিলিত হতে থাকে শ্রমিক-জনতার বহুমুখী আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ। আন্দোলনের এই তরঙ্গ সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে অতি সহসা। যে ঢেউ আছড়ে পড়ে শহরের রামপুর এলাকার তরুণ ইমাম আলীর বুকে। যে ঢেউ দারিদ্র্যের কষাঘাতে বিক্ষুব্ধ ইমাম আলীর চেতনাকে জাগিয়ে তোলে, যে ঢেউ তাকে টেনে নিয়ে আসে প্রবল সংগ্রামের সাগরে। ইমাম আলী জীবন সংগ্রামের নতুন ধারার পাঠ নেয় এলাকার আন্দোলনে যুক্ত ছাত্রসমাজের কাছ থেকে, এই অভাজনের মাধ্যমে। সে তখন কাজ করে বিটি সওদাগরের মোটর পার্টসের দোকানে, ঈদগাঁ কাঁচারাস্তার মোড়ে। লেখাপড়া হয়ে ওঠেনি তার। কিন্তু পড়ার অদম্য আগ্রহে সে জটিল ভাষায় লেখা সমাজবদলের আন্দোলনের বইগুলো পড়ে ফেলে অতিদ্রুত। নিজস্ব আদলে মানবজাতির ইতিহাস, সমাজবদলের ধারা সম্পর্কে চমৎকার ধারণা লাভ করে অল্প সময়ের মধ্যে। আন্দোলনের প্রাথমিক পাঠ নিয়েই সে সমাজ বদলের আন্দোলন সংগঠনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠে। পরিবর্তন আসে তার কথা-বার্তায়, যুক্তিতর্কে, চোখমুখের অভিব্যক্তিতে। সামরিক শাসনের আতঙ্কে দেশের মানুষ যখন নির্বাক তখন এক দুর্বিনীত সাহসের পাখায় ভর করে ইমাম আলী যুক্ত হয় বাংলাদেশের যুব আন্দোলনের পুরোধা বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সাথে। শুরু হয় অখ্যাত এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান ইমাম আলীর জীবনের সাহসী পদযাত্রা।

যুব ইউনিয়নের পতাকাতলে আসার পর থেকে ইমাম আলীর ব্যক্তিগত জীবনে আসে বিরাট পরিবর্তন। সে মোটর পার্টসের দোকানের কাজ ছেড়ে দিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার কাজে জড়িয়ে পড়ে। সে পাহাড়তলী, ডবলমুরিং, বন্দর ও কোতোয়ালী থানা এলাকায় সংগঠন গড়ে তোলার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিষিদ্ধ রাজনীতির তোয়াক্কা না করে সে অদম্য সাহসে পাড়া মহল­ায়, ওয়ার্ডে আর থানা এলাকায় সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করে। অসা¤প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দীপ্রমন্ত্রে দীক্ষিত ইমাম আলীর মুখ থেকে অগ্নিগর্ভ বক্তব্য শুনে সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষদের মধ্যে সৃষ্টি হয় নতুন উদ্দীপনা। দলে দলে যুবকরা সংগঠিত হতে থাকে যুব ইউনিয়নের পতকাতলে। জাতীয় রাজনীতিতে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে শুরু করলে ইমাম আলী প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নিতে শুরু করে। যুব ইউনিয়নের পাশাপাশি সে ছাত্র, শ্রমিক, দিনমজুর, রিক্সাশ্রমিক, নারী সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে অগ্রণী ভুমিকা পালন করতে থাকে। রামপুর, সরাইপাড়া, কাট্টলী , উত্তর ও দক্ষিণ আগ্রাবাদ, হালিশহর, দক্ষিণ পাহাড়তলী থেকে শুরু  সিটি কর্পোরেশন এলাকার অধিকাংশ ওয়ার্ড জুড়ে এক অনন্য কর্মতৎপরতায় ব্যাপকভিত্তিক সংগঠন গড়ে তোলে সে। ফলে এলাকার আপামর মানুষের কাছে  ইমাম আলী হয়ে ওঠে একটি প্রিয় নাম, একটি সাহসী সংগ্রামী মুখ এবং আন্দোলন সংগ্রামের একটি মূর্তমান প্রতীক।

রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের পাহাড়তলীস্থ কার্য্যালয়কে ভিত্তি করে ইমাম আলী একদিকে ফৌজদারহাট শিল্প এলাকায় শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলায় যেমন সক্রিয় ভুমিকা পালন করে তেমনি আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় নির্মাণ শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক, আঞ্চলিক ক্লাব প্রভৃতি সংগঠন গড়ে তুলে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। সাগরিকা শিল্প এলাকায় ইউসুফ টেক্সটাইল মিলের শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পুরো শিল্প এলাকা জুড়ে যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো ইমাম আলী তাতে নিয়ামক ভুমিকা পালন করে। শ্রমিক নেতা রফিকুজ্জামানকে এই আন্দোলন সংগঠনে ইমাম আলী যে সহায়ক ভুমিকা রেখেছিলো তা সে সময়ে সকলকে অভিভূত করেছিলো।  আন্দোলনকারী শ্রমিকদের শক্তি সাহস জোগানোর জন্যে লঙ্গরখানা খুলে দিনরাত তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে সে সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছিলো। তাছাড়া পাহাড়তলীস্থ আবুল বিড়ি ফ্যাক্টরীর শ্রমিকদের ইউনিয়ন গড়ার আন্দোলনে সে পালন করে এক নিয়ামক ভুমিকা। বিড়ি শ্রমিকদের আন্দোলনের পক্ষে রেলশ্রমিকদের একাত্মতা প্রকাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি একমাত্র ইমাম আলীর সক্রিয় প্রচেষ্টার কারণে সম্ভব হয়েছিলো। কিন্তু মালিকপক্ষ তথাকথিত স্বাধীনতার স্বপক্ষের এক শ্রমিকনেতার সাথে যোগসাজস করে সেই আন্দোলন ব্যর্থ করে দেয় পুলিশ আর গুন্ডাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে। যা বিড়ি শ্রমিকদের শোণিত ধারায় ঐতিহাসিক বিড়ি শ্রমিক আন্দোলন হিসেবে পরিচিত হয়। তাছাড়া বাগদাদ কার্পেট ফ্যাক্টরী, একে খান জুট মিলস্, পাহাড়তলী টেক্সটাইল মিলস্ থেকে শুরু করে চিটাগাং স্টীল মিলস্, ইস্টার্ণ রিফাইনারী শ্রমিকদের আন্দোলনে ইমাম আলী পালন করে এক অনন্য ভুমিকা।  যা তাকে ব্যাপক পরিচিতি দান করে এবং সাধারণ মানুষের একজন প্রিয়ভাজন তরুণ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

ইমাম আলীর প্রয়াণ

শ্রমিক আন্দোলনের পাশাপাশি জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠনেও ছিলো তার সক্রিয় ভুমিকা। যুব ইউনিয়ন চট্টগ্রাম নগর কমিটির সহ-সভাপতির পদ লাভের পর তার কার্যক্রম পুরো চট্টগ্রাম মহানগর জুড়ে বিস্তৃতি লাভ করে। চট্ট্গ্রাম মহানগরীর প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে সংগঠন গড়ে তোলার পাশাপাশি নিজস্ব রামপুর ওয়ার্ডে সিপিবি’র আঞ্চলিক শাখায় সহ-সম্পাদকের পদ গ্রহন করে সংগঠনের গণভিত্তি গড়ে তোলার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। তার দুরদর্শি রাজনৈতিক ভুমিকার কারণে সিপিবি রামপুর, সরাইপাড়া, হালিশহর, কাট্টলী ও উত্তর আগ্রাবাদ এলাকায় শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। রেল শ্রমিকদের প্রিয় নেতা এবং সরাইপাড়া ওয়ার্ড সিপিবি’র প্রতিষ্ঠাতা ইদ্রিস ভাইয়ের অক্লান্ত ও উদার সহযোগিতায় ইমাম আলী নিজেকে আঞ্চলিক প্রভাবশালী নেতা হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।

জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যে কোন কর্মসূচীতে – মিছিল কিংবা সমাবেশ কিংবা ১৫ দলীয় জোটের আঞ্চলিক সমন্বয় সভা গুলোতে ইমাম আলীর উপস্থিতি ছিলো অবধারিত। তার উজ্জ্বল উপস্থিতি যেমন সকলকে অনুপ্রাণিত করতো তেমনি তার অনলবর্ষী বক্তৃতায় উজ্জীবিত হতো উপস্থিত জনতা। সিপিবি নেতা জসিম মন্ডলের আদলে দেয়া তার কটাক্ষপূর্ণ ও হাস্যরস উদ্রেককারী বক্তব্য মানুষকে চলমান আন্দোলন সংগ্রামে অধিক পরিমাণে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহ জোগাতো। তাই দেখা যেতো জেলা পর্যায়ের যে কোন জোট কর্মসূচীতে ইমাম আলীর নেতৃত্বে রামপুর পাহাড়তলী অঞ্চল থেকে  বিশাল লাল পতাকার মিছিল লালদিঘীর সমাবেশগুলোতে অংশ নিতো। যা নব্বুই দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পূর্বে ছিলো অকল্পনীয়।

জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও শহীদ দিবস উদযাপনে সে ছিলো সর্বদা সক্রিয়। একাত্তরে পাকসেনা আর বিহারীদের হাতে নিহত সবুজবাগের শহীদদের কবরস্থানকে শহীদী মর্যাদা দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিবছর সে ব্যাপকভাবে কর্মসূচী নিতো। এসব দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে সে অর্জন করতো সংগ্রামের জন্যে প্রাণশক্তি। প্রতিদিনকার পত্রিকা পড়া ছিলো ইমাম আলীর সবচেয়ে বড়ো নেশা।  সকালে ঘুম থেকে উঠে দিনের টাটকা খবরের নেশায় সে পত্রিকার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তো। রাজনীতির খবরটাই ছিলো তার মূল আকর্ষন। প্রকাশিত সংবাদের মধ্য থেকে সে সংগ্রহ করতো তার রাজনৈতিক শক্তি-বলা ও অনুপ্রাণিত করার অকাট্য যুক্তি। তাছাড়া সে কর্মী সমর্থকদের মধ্যে বিক্রি করতো সাপ্তাহিক ’একতা’। একতা’য় প্রকাশিত রাজনৈতিক কলামগুলো ছিলো তার জাতীয় রাজনীতির গতিধারা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের অন্যতম মাধ্যম, তেমনি পাশাপাশি আন্ত-র্জাতিকতাবোধকে সুতীব্র  করার হাতিয়ার।  এছাড়াও ’মুক্তির দিগন্ত ’ পত্রিকাটি ছিলো তার খুবই প্রিয়।

প্র্রচন্ড আর্থিক অনটনের মধ্যেও তার সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখটি  সকলের কাছে ছিলো প্রিয়। পরিবারে লেগে থাকা অশান্তি কখনো তার উদ্যমের লাগাম টেনে ধরতে পারেনি।  পরিবারের বড়ো ছেলে হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে না পারার কষ্ট থাকলেও সে সবসময় তার চেয়ে খারাপ অবস্থায় যারা আছে তাদের কষ্টের কথা বলে নিজেকে আড়াল করতো। আন্দোলন সংগ্রামের এই ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে পরিবারের প্রয়োজনে তাকে বিয়ে করতো হলো। বৃদ্ধ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এবং ছোট তিনটি ভাইয়ের কারণে সে বিয়ে করতে রাজী হলো। খুবই ভালো মনের একটি মেয়েকে জীবনসঙ্গী পেয়ে সে খুশী হয়েছিলো এবং বউকে তার সংগ্রামী জীবনের সাথে একাত্ব করে নিয়েছিলো।

নব্বুইয়ে সামরিক শাসনের অবসানের পর মূলধারার রাজনৈতিক পরাজয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমাজতন্ত্রের পতনের কারণে বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতিতে নেমে আসে ব্যাপক ধস্ । বিভ্রান্তি আর অনিশ্চয়তার দোলাচালে প্রগতিশীল রাজনৈতিক শিবিরে নেমে আসে ভাঙনের তান্ডব। যা সম্ভাবনাময় হাজার হাজার নিবেদিতপ্রাণ তরুণের জীবন তছনছ করে দেয়। রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, লেজুড়বৃত্তি, গোষ্ঠীতন্ত্র একটি উদীয়মান বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়। নিঃশেষিত করে দেয় ইমাম আলীর সংগ্রামী উদ্যমকে। পথহারা পথিকের মতো সে আঞ্চলিক ও জেলা নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ করে আরো বেশী বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। বিভক্তি আর চক্রান্তের বিষবাষ্পে সে হয়ে পড়ে নিস্ক্রিয়।

এরপর শুরু হয় তার জীবনের আরেক অধ্যায়, পচনের অধ্যায়, আত্মধ্বংসের অধ্যায়। সে জড়িয়ে পড়ে এক অর্থপিপাসু কন্ট্রাক্টরের ব্যবসা আর অবৈধ, অনৈতিক কাজের সাথে। সংসারের সুখের জন্যে সে মরিয়া হয়ে ওঠে। তিন তিনটি মেয়ে সন্তানকে মানুষ করার জন্যে সে ছুটতে শুরু করে অর্থের পেছনে। ভূমি জরিপের কাজটি শেখাতে সে সহকর্মী কাজী আবু তাহেরের সাথে যৌথভাবে ব্যবসা চালু করলেও উলে­খিত কন্ট্রাক্টরের অশুভ থাবা থেকে বেরুতে পারেনি, পায়নি আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য। সে ক্রমশঃ নেশাগ্রস্থ হয়ে নিজেকে পুড়িয়ে খাক করে, বহু সাধনায় অর্জিত আদর্শ মানুষের ভাবমূর্তিকে ধূলোয় মিশিয়ে তিলে তিলে ধ্বংস করে নিজেকে। বিগত প্রায় দশ বারো বছর নিজের ওপর সীমাহীন অত্যাচার করে, সার্বিকভাবে নিজেকে নিঃশেষিত করে পুরো পরিবারকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে অবশেষে  ১৮ই জানুয়ারী, ২০০৭ ইংরেজীতে সকল যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে তার প্রিয় পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলো।

তার এই অকালে চলে যাওয়া আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, স্বপ্নভঙ্গ মানুষের কি নির্মম পরিণতি বয়ে আনে। আমাদের বিভেদ আর বৈষম্যপূর্ণ সমাজটি বদলানোর যে দুর্জয় স্বপ্ন ইমাম আলীকে সংগ্রামের দুর্মর পথে টেনে এনেছিলো সে স্বপ্ন মিথ্যা নয়। মিথ্যা নয় জাগরণের অমৃত বাণী। হয়তো বদলে গেছে সময়ের প্রেক্ষাপট, বদলে গেছে নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামের ধারা। কিন্তু থেমে যায় নি মানুষের চিরসাম্যের স্বপ্ন দেখা। বিশ্বসমাজে শক্তিধরদের পদতলে শক্তিহীনদের আর্তনাদ আজ চাপা পড়লেও তাদের মুক্তির আকাঙ্খা নিঃশেষ হয়ে যায় নি। যার দৃষ্টান্ত বিশ্বের দেশে দেশে আজ নতুন মাত্রায় ও আঙ্গিকে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইমাম আলীর এটুকু উপলব্ধি করার অবকাশ ঘটেনি। তার সময়ের বৈরীতার কারণে, ভেঙে পড়া দৃঢ়তার কারণে। কিন্তু সে তার সময়ে, তার মতো করে যে ভুমিকাটুকু পালন করে গেছে তা চিরদিন অক্ষয় হয়ে থাকবে। অমর হয়ে থাকবে ইমাম আলীও। কারণ তার উত্তরসূরীরাই তার অসমাপ্ত স্বপ্নকে সমাপ্তির পথে নিয়ে যাবে। আজ বা কাল।