এথলেটসের ডায়েরি
স্বপঞ্জয় চৌধুরী
১.
প্রতি ভোরে সায়লব খোলা মাঠটায় জগিং শেষে হাঁটু মুড়ে মেডিটেশনে বসেন। তার চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একদল মেঘ। মেঘের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে একটি সাদা পাখির ঠোট। মেঘ সরে গেলে পাখিটিও অদৃশ্য হয়ে যায়। এ যেন এক অচিন পাখি। মাঠ ঘেঁষেই একটা পাহাড়ের মতো টিলা। টিলার উপরেই ডিটেকটিভ সায়লবের চেম্বার। প্রতিদিন নানা ধরণের মানুষ আসে তার চেম্বারে। একেক জনের একেক সমস্যা। মাঝে মাঝে সায়লব নিজ দায়িত্বেও রহস্যের জট খুলেন। যে ঘটনাতে তিনি রহস্যের গন্ধ পান সেখানেই ছুটে যান তার টিমের সদস্য রাচী সিনহা, ভূষণ শেঠ আর নম্রতা পালকে নিয়ে। রাচী সিনহা চোখে একটু কম দেখেন তবে তার শ্রবণ শক্তি খুব প্রখর; ভূষণ শেঠ পালোয়ান টাইপের প্রতিদিন আটটা ডিম খান। সাড়ে তিনশো বুক ডাউন দেন। তার হাত থেকে অপরাধী পালিয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য কাজ আর ন¤্রতা পালকে ডায়েরি লিখতে ও পড়তে ভালোবাসেন। তার সখ হচ্ছে নানা মানুষের ডায়েরি পড়া, ভ্রমণ আর রহস্য মুভি দেখা। আর ডিটেকটিভ সায়লব মাঝারি গড়নের লোক, চুলগুলো বাদামি, চোখগুলো নীলবর্ণের তার ভেতরে একটা ভীনদেশী–ভীনদেশী ভাব আছে।
নম্রতা উঁচু টিলা থেকে দৌড়ে দৌড়ে এলেন সায়লবের কাছে। স্যার– আপনাকে চেম্বারে না পেয়ে এখানে ছুটে এলাম। আমার বান্ধবীর ভাই এথলেট তরুণ আত্মহত্যা করেছে। সায়লব ধ্যান ভেঙে চোখ মেলেন। তারপর মাঠের পাশের এক বেঞ্চি থেকে তার হলুদ রঙের টাওয়াল নিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করেন– কোন তরুণ? যে এশিয়ান হাই জাম্পে গোল্ড মেডেল জিতেছিল। নম্রতা মাথা নেড়ে বললো–হ্যাঁ, ভাইয়াটা খুবই ভালো ছিল। যখনই বাসায় যেতাম তার মুখে একটা হাসি লেগে থাকতো সবসময়। কিন্তু গত কয়েক মাস থেকে তার চাল–চলনে একটা পরিবর্তন আসে। তার পরিবারও এর কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেনি। সকালের নিউজের হেড লাইনে এসেছে দেখুন। খবরের কাগজটি সায়লবের দিকে বাড়িয়ে দেয় নম্রতা । সায়লবকে খানিকটা চিন্তিত দেখায়। সে খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে পত্রিকায় ছাপানো ছবিটি দেখছেন। এর ভেতরেই জগিং করতে করতে এদিকেই এগিয়ে আসেন ভূষণ শেষ। একটু স্মিত হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে– বসের মুখে চিন্তার রেখা।
হুম– একটু চিন্তাতো হচ্ছেই। পত্রিকা থেকে চোখ সরাতে সরাতে বলেন সায়লব।
নম্রতা ফোন বেজে উঠে। তরুণের বাবা বরুণ সাহার ফোন। ফোনের ওই সাইড থেকে ভেসে শব্দ ভেসে আসে। আমার ছেলে আত্মহত্যা করতে পারে না। তোমরা আমার ছেলের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করো মা।
– আপনি কোন চিন্তা করবেন না আঙ্কেল , আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। আমাদের বস সায়লবের সাথে কথা বলুন।
জ্বি, আদাব, প্রাইভেট ডিটেকটিভ রবার্ট সায়লব বলছি।
তরুণের বাবার কণ্ঠে কান্না। সে নিজেকে সামলাতে পারছেন না। তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।
– জ্বি হ্যাঁ আমরা আজ বিকেলেই আপনার বাড়িতে আসছি।
২.
বিকেল বেলায় সায়লব, রাচী, ভূষণ ও নম্রতা নিহত তরুণের বাড়ি গেলেন। হলুদ রঙের আটতলার এ্যাপার্টমেন্ট। তরুণরা থাকেন একদম আটতলাতেই। কলিংবেল চাপা হলো। একটা অদ্ভূত শব্দ ভেসে আসলো কলিং বেলের শব্দে। কিছুটা হরর মুভির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো। তরুণের ছোট বোন নিহা দরজা খুললো। দরজা খোলা মাত্রই ন¤্রতাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল যেন। পুত্রশোকে পাথর হয়ে আছে মা। যেন বিধ্বস্ত স্ট্যাচুর মতো গৃহকোনে পড়ে আছে। বাবা তার আবেগ সামলে নিয়ে কথা আরম্ভ করে।
– এতো প্রাণোচ্ছ্বল, চঞ্চল ছেলে আমার এই গত ছয়মাসে কীভাবে পরিবর্তন হয়ে গেলো। দেশের জন্য যে এতো বড় অর্জন বয়ে আনলো তার এই করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছিনা বাবা।
– তরুণ কোন রুমটাতে থাকতো? আমরা একটু যেতে চাই ওর রুমে।
সবার হাতেই হ্যান্ড গ্লাভস। ঘড়ের প্রতিটি জিনিস খুটিয়ে খুটিয়ে দেখা হচ্ছে। তরুণের গিটার, পানি খাওয়ার গ্লাভস, স্কিপিং এর দড়ি কিছুই বাদ যাচ্ছে না। কিন্তু সন্দেহ করার মতো কোন কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। বিছানার চাঁদর সরাতেই রাচী চমকে উঠলো। একটা রক্তমাখা ব্লেড সাদা কাগজ দিয়ে মোড়ানো।
–স্যার, এই দেখুন।
– এটা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠান।
–আচ্ছা তরুণ ইউনিভার্সিটির কোন কোন বন্ধুর সাথে মিশতো।
– তরুণের বাবা মাথা চুলকে চিন্তা করছে। ওর বন্ধু বলতে তেমন কেউ ছিল না। তবে ওর এক বান্ধবী ছিল।
মাঝে মাঝে আসতো আমাদের বাসায়। খুব বেশিদিনের পরিচিত বান্ধবী না।
–ওর বান্ধবীর ভেতর কোন অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেছেন কখনো?
– না তেমন কোন অস্বাভাবিকতা দেখিনি। তবে একটা বিষয় অদ্ভূত লাগতো। ও যখনই আসতো। তরুণের জন্য
একটা আপেল নিয়ে আসতো। তরুণ আপেল খেতে পছন্দ করতো।
–একটা আপেল। ডায়েরিতো নোট করে নিচ্ছে নম্রতা ।
– ভূষণ শেষ খাটের তলায় বুক ডাউনের ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। একবার উঠছে, আরেকবার নামছে।
– সায়লব একটু বিরক্তির স্বরে বলছে, ভূষণ বাবু এটা আপানার বুক ডাউন দেয়ার জিমনেসিয়াম না।
– ভূষণ বাবু বুক ডাউন থামিয়ে উঠি দাঁড়ায়। যেটাকে আপনি বুক ডাউন ভাবছেন বস। সেটা আসলে
ইনভেস্টিগেসন নট বুক ডাউন।
–খাটের তলায় দেখুন একটা আধা খাওয়া আপেল আর তার একটু দূরে একটা ছেড়া কাগজ।
তরুণদের বাসার কাজের মেয়ে মায়া ঝাড়– নিয়ে আসে। খাটের তলা থেকে কাগজের টুকরো আর আধা খাওয়া আপেলের টুকরো বের করে একটা ঝুড়িতে ভরে।
সায়লব চোখের ইশারায় রাচীকে কাজের মেয়েকে ফলো করতে বলে। রাচী মায়াকে ফলো করে রান্না ঘরে যায়। মায়া দেশলাই ঘষে আগুন ধরিয়ে কাগজটি পুড়ে ফেলতে চাচ্ছে। রাচী থাবা মেড়ে কাগজটি মায়ার হাত থেকে নেয়। ময়লার টুকরি থেকে আধা খাওয়া আপেলের টুকরোটিও একটি সাদা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে নেয়। কাগজটি সায়লবের হাতে দেয়া হয়।
কাগজটিতে ইংরেজিতে লেখা ছিল – I am not rapist.. সায়লব কাজে দু’ আঙ্গুলের টোকা দিয়ে বলে ইয়েস দিস ইজ দ্যা ক্লু। কাগজটি কোনো ডায়েরি থেকে ছেড়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কাগজের উপরের অংশটিতে ছাপার অক্ষরে তারিখ দেয়া আছে ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। আপাতত এই আলামতগুলো সাথে নিয়ে সায়লব এর ডিটেকটিভ টিম তরুণদের বাসা থেকে বের হয়ে যায়।
৩
ফরেনসিক ল্যাবে কাজ করছে ডাঃ ইব্রাহিম ইবু। ডাঃ ইবুর কাছে গিয়ে সায়লব চুপিচুপি কী যেন দেখছেন।
–আচ্ছা ডাঃ ইবু এই আধাখাওয়া আপেলের গায়ে একটু হালকা রক্ত দেখতে পাচ্ছেন কী?
–হুম। ডিএনএ টেস্টে পাঠিয়েছিলাম। একটা মেয়ের রক্ত– হয়তো তার দাঁতের সেন্সিটিভিটির সমস্যা আছে এবং নিহত তরুণের এনজাইম পাওয়া গেছে। তবে আরো একটা বিষয় সন্দেহ করছি যা আরেকটি টেস্ট করলে পরিস্কার হওয়া যাবে।
– নম্রতা ম্যাগনিফাইং গ্লাভস গিয়ে হাতের লেখাগুলোকে ভালোভাবে দেখছিল। ডায়েরিটার হদিস পাওয়া গেলে অনেক রহস্যের জট খুলতো।
– ভূষণ বাবু ও রাচী কাল আপনারা তরুণের ভার্সিটিতে যাবেন। খুব গভীরভাবে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করবেন।
– বস আমার পুষ আপ করার যন্ত্রটা নিয়ে যাব কী? যদি ইনভেস্টিগেশন করতে গিয়ে আমার জিম এন্ড ডিম খাওয়ার সময় পার হয়ে যায় তাই কিছু সেদ্ধ ডিম আর ছোট খাট একটা ডাম্বেল নিয়ে যেতে চাই।
– ওহ! ভূষণ বাবু বি সিরিয়াস।
– ইয়েস স্যার, আই আম অলওয়েস সিরিয়াস বস।
পরদিন সকালে ভূষণ শেঠ আর রাচী সিনহা ভূষণের বঙ্গরত্ম বিশ^বিদ্যালয়ে গেলেন। সেখানে তারা অধ্যক্ষের রুমে তরুণ সম্পর্কে নানাবিধ প্রশ্ন করলেন। শেষ কবে তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করেছেন সেই খাতার রেজিস্ট্রার দেখলেন। তরুণ সর্বশেষ ৭ ফেব্রুয়ারিতে ক্লাস করেছিলেন। ডায়েরির ছেড়া পাতাতেও ৭ ফেব্রুয়ারি লেখা। অর্থাৎ এই তারিখে নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছিল যার কারণে তরুণ আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয়েছিল।
–আমরা কি তরুণের ক্লাসরুমটি ভিজিট করতে পারি?
– অবশ্যই।
ভূষণ বাবু ক্লাসে গেলেন সাথে আছে অধ্যক্ষ। সবাই উঠে দাঁড়ালেন।
– উনারা প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তোমাদের সাথে কিছু কথা বলবেন।
– আচ্ছা তোমরা কী বলতে পারো তরুণ কোথায় বসতো
একজন ছাত্র আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ওই যে কর্ণারের খালি ডেস্কটাতে। ওখানে ও সবসময় বসতো। আমরা ওর সম্মানার্থে ওখানে কাউকে বসতে দেইনা। তিনদিন হলো তরুণ নেই। যেন মনে হচ্ছে তিন বছর ওকে দেখিনা। অন্য একজন ছাত্র হুহু করে কেঁদে উঠলো। ভূষণ বাবু এই অতি উৎসাহী ও অতি দরদী ছাত্রটিকে একটু সন্দেহ হলো।
–সরি তোমাদের ডিসটার্ব করলাম। আচ্ছা আমরা আজকে আসছি তবে।
ভূষণ বাবু সায়লবকে ফোন দিলেন। সায়লব আসলেন তরুণের ভার্সিটিতে। সায়লব, রাচী, ভূষণ আর নম্রতা করিডোরে দাঁড়িয়ে আছেন। তারা ক্যাম্পাসের মাঠের দিকে তাকিয়ে আছেন। কয়েকজন ছাত্র দৌড় প্রতিযোগিতা করছেন। একজন দৌড়ে ফার্স্ট হলেন। আরেকজন হাই জাম্প দিচ্ছেন।
– মিঃ ভূষণ চলুন আজ একটু খেলাধূলা করি।
– ইয়েস বস হোয়াই নট। আমি কলেজ লাইফে হাই জাম্প চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। রেসেও ছিলাম সেরা। আমার ভেতরে সেই বিশ বছরের তরুণ ছেলেটি জেগে উঠেছে।
ভূষণ বাবু মাঠে গিয়ে ছেলেদের সাথে হট্টগোল বাধিয়ে দিলেন। পাঞ্জার চ্যালেঞ্জ দিলেন। তোমাদের ভেতর যে আমাকে পাঞ্জায় হারাতে পারবে তার জন্য রয়েছে স্পেশাল গিফট।
রাচী কানে কানে বলে– আপনি গিফট পাবেন কোথায়।
– আরে মিস রাচি, আমি হারবোও না গিফটও দেবনা।
ভার্সিটির পাশেই ছিল একটা বাগান। বাগানের ভেতর পাতা বাহার গাছের ভেতর থেকে কী যেন একটা বই সদৃশ কিছু দেখা যাচ্ছে । গাছের পাতা সরানো মাত্র নম্রতার চোখ দুটো চকচক করে ওঠে।
–স্যার এই দেখুন ডায়েরি।
–কোন স্টুডেন্ট দেখার আগে ডায়েরিটা ব্যাগে ঢুকান।
একজন আয়া ঘটনাটি দেখে দৌড়ে কাকে যেন খবর দিতে যাচ্ছেন।
–নম্রতা, ফলো হার।
আয়াটি বাথরুমে গিয়ে শ্যামল নামের স্টুডেন্টটিকে কল দিচ্ছেন। শ্যামল ভূষণের সাথে পাঞ্জা লড়ায় ব্যস্ত। নম্রতাকে দেখে আয়াটি চমকে উঠলো।
৪.
সবাই রাতে চেম্বারে মিটিং এ বসেছেন। ফরেনসিক রিপোর্টে আপেলের সাথে আরেকটি মারাত্মক মাদকের সন্ধান পেয়েছেন। যার নাম এলএসডি। এটি যেকোন যুবককে মুহূর্তের ভেতর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিয়ে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করতে পারে। নম্্রতাকে ডায়েরিটি পড়তে দেয়া হয়েছে। ডায়েরির পাতা উল্টাচ্ছেন আর শিহরিত হচ্ছেন, ব্যথিত হচ্ছেন ডায়েরির লেখাগুলো দেখে।
ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা: আজ ২০ নভেম্বর ২০১৪ আমি দেশের হয়ে খেলে এশিয়ান গেমসে স্বর্ণ পদক পেয়েছি। আজ আমার জীবনের একটি স¥রনীয় ও গৌরবের দিন। এই দিনটিকে আমি উদযাপন করছি আমার পরিবারের সাথে। এক থেকে চার পৃষ্ঠায় তার স্বর্ণ জয়ের পেছনে কঠোর শ্রম ও অধ্যাবসায়ের বর্ণনা দিয়েছেন।
ডায়েরির পঞ্চম পৃষ্ঠা: নিবেদিতাকে আমি মনে মনে পছন্দ করি। ও কি সেটা জানে। এখন আমি স্টার । এখনই মোক্ষম সময় ওকে প্রপোস করার। স্বর্ণ জয়ের পর বন্ধুরা সবাই খুশি হয়েছে। অভিনন্দন জানিয়েছে কিন্তু শ্যামল কী খুশি হতে পারেনি। ও আমার দিকে কেমন যেন এক হিংসাত্মক চোখে তাকিয়ে ছিল। ওর চোখের ভাষায় আমি চরম হিংসা দেখেছিলাম। যেদিন আমি নিবেদিতাকে প্রপোস করি। নিবেদিতা আমার প্রপোসে হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বললো না। আবার সে যে আমাকে অপছন্দ করে সেটিও কিন্তু তার আচরণে বোঝা যায় না। আসলে শাস্ত্র তাই বলে– নারী রহস্যময়ী।
ডায়েরির বিশতম পৃষ্ঠা– শ্যামলের হিংসাত্মক রুপ দিনকে দিন প্রবল হতে থাকে। আমাকে পেছন থেকে নানাবিধ নোংরা স্লেজিং করে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করে। আমিতো ওর সাথে কোন শত্রুতামূলক আচরণ করিনি কখনো। আমার গোল্ড মেডেল জেতা, ভালো ফলাফল, নিবেদিতার প্রতি দূর্বলতা কোন কিছুই যেন ও মেনে নিতে পারছেনা। তাই খেলার মাঠে প্রায়ই গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে আসে।
ডায়েরির আটষট্টিতম পৃষ্ঠা: নিবেদিতার সাথে আমার সম্পর্ক এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। ও যেকোন দিন আমাকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে ফেলবে মনে হচ্ছে।
ডায়েরির সত্তরতম পৃষ্ঠা( ৭ ফেব্রুয়ারি) : আজ আমার জীবনের সবচেয়ে কলঙ্কতম দিন। আমাকে নোংরাভাবে ফাঁসানো হয়েছে। আয়া নসিমনকে দিয়ে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি নিবেদিতার দেয়া আপেল খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই। এরপর কী ঘটে মনে নেই। চোখ খুলে দেখি নসিমনের কাপড় ছেড়া, আমাকে এলোপাথাড়ি ভাবে মারলো সবাই। আমি যতই বললাম –তোমরা আমাকে মারছো কেন? আমি কোন দোষ করিনি। সিসিটিভির ফুটেজ চেক করে দেখো , বিশ্বাস না হলে। কিন্তু সিসি ক্যামেরাটাও রুম থেকে হাওয়া করে দিয়েছে। এসব শ্যামলের কাজ । নিবেদিতার কাছ থেকে আমাকে দূরে সরানো জন্য। আমার এতদিনের সম্মান ও সুনামকে ধূলোয় মেশানোর জন্য ও এতটা নিচে নামতে পারলো। আমাকে ও ঘৃণা করে। আমার জন্য ও আর কখনো আপেল আনবে না। দু’জনে শেয়ার করে আর কখনো আপেল খাওয়া হবে না। ওহ! গড আমাকে মৃত্যু দাও।
ডায়েরির আশিতম পৃষ্ঠা: আজ অনেক রক্ত ঝড়িয়েছি। ব্লেড দিয়ে হাতটাকে ক্ষত বিক্ষত। ভার্সিটির সহপাঠীরা আমাকে রেপিস্ট বলে। পাড়া প্রতিবেশিরা তাদের স্কুলগামী ছোট ছোট বাচ্চাকেও আঁচলের তলে লুকায় আমাকে দেখে। কিন্তু পৃথিবীকে আমি জোড়ে চিৎকার করে বলতে চাই– – I am not rapist, I am not rapist. এরপর এ বাক্যটি সে বহুবারই লিখেছে এবং পৃষ্ঠা ছিড়েছে। যার অংশই খাটের তলায় পাওয়া গিয়েছিল।
কিন্তু ডায়েরিটা ভার্সিটির বাগানে গেল কীভাবে? রহস্য থেকে যায়।
গভীর রাতেই নম্রতার ফোন। সায়লবের মোবাইল বেজে উঠলো। স্যার, সত্যিকারের কালপ্রিটকে খুঁজে পেয়েছি কাল আবার ভার্সিটিতে যেতে হবে।
৫.
পরদিন ভার্সিটিতে যাওয়া মাত্রই সায়লবদেরকে তাড়া করবার জন্য লাঠিসোঠা নিয়ে আছে শ্যামলের সাঙ্গ পাঙ্গরা। ভূষণ বাবু তার গোঁফে হাত দিয়ে বলে কী শ্যামল চন্ডাল তোমার খেলা আজ শেষ। ইউ আর দ্যা মার্ডারার। ভূষণ বাবু তার শক্তিশালী পেশির জোরে এক ঘুষি বসিয়ে দেয় এক সন্ডার চোয়ালে। দাঁত উপড়ে চলে আসে। এই ঘটনা দেখে বাকীরা দৌড়ে পালায়। পুরো ভার্সিটিতে ও শুধু রংবাজি, চাঁদাবাজি, র্যাগিং– ই নয়। মারাত্মক মাদক এলএসডিরও একজন ডিলার। ওকে গ্রেফতারের ফলে বেরিয়ে আসছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। ও যেদিন তরুণ আত্মহত্যা করে সেদিন তরুণের ব্যাগে রাখা আপেলে বেশিমাত্রায় এলএসডি মিশিয়ে দিয়েছিল আর তখন ওর ডায়েরির কিছু লেখা দেখতে পেয়ে তা জানালা দিয়ে বাইরে বাগানের দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। এল এস ডি মাদকের ফলে মস্তিষ্ক বিকৃত ঘটে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয়। এটি আত্মহত্যা নয়, হত্যা বলেই আদালতের কাছে প্রমাণিত হবে হয়তো।
সায়লব প্রতিদিনের মতো আজকেও সকাল বেলা জগিং শেষে ধ্যানে বসেছেন। তাকে প্রদক্ষিণ করে যাচ্ছে একদল মেঘ। মেঘের ভেতরে উঁকি দিচ্ছে একটা হীরামন পাখি। সহসাই ভূষণবাবু দৌড়ে এসে আজকেও তাঁর ধ্যানভগ্ন করলো। আজকের হেডিং– ডিটিকটিভ সায়লব এন্ড কোং এর বদৌলতে ধরা পড়লো মাদক সম্রাটেরা। সায়লব তার ব্যাগ থেকে একটি টিফিন বাটি বের করে ভূষণ বাবুর দিকে এগিয়ে দিলেন। যাতে আছে আটটি সেদ্ধ ডিম । নম্রতা আর রাচী এই কান্ড দেখে হো হো করে হেসে উঠলো।
স্বপঞ্জয় চৌধুরী।
কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও কথাসাহিত্যিক।