শাসিত দহন: ফোরা ফারোখজাদ
ঋতো আহমেদ
শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলেই ঢলে পড়লেন কুর্দি তরুণী মাহ্শাআমিনী। যার বয়স হয়েছিল মাত্র ২২ বছর। ইরানের নৈতিকতা পুলিশ তাকে বাঁচতে দিল না। বর্বর নির্যাতনের শিকার হলেন এই ২০২২ এর সেপ্টেম্বরে এসেও। প্রহৃত হয়েছিলেন। নির্মমভাবে তার মাথায় আঘাত করা হয়েছিল পুলিশ-কার দিয়ে। হাসপাতালে কোমায় ছিলেন তিন-তিনটে দিন। তার অপরাধ,পোশাক বিধি লঙ্ঘন। সঠিকভাবে হিজাব পরেন নি সেদিন। চুল বাতাসে উড়ছিল। ধর্মীয় অনুশাসন যখন রাষ্ট্রীয় শাসন, দমন ও দাবানোর হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় তখন তার ভয়াবহ রূপ হয়তো প্রত্যক্ষ করতে পারি আমরা এইভাবেই। আজ কয়েকদিন হলো ইরানের প্রদেশে প্রদেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে মানুষ। নারীরা তাদের হিজাব খুলে ফেলছেন। প্রতিবাদে চুল কেটে প্রতীকী পতাকা বানিয়ে উড়িয়েছেন। সেইসাথে রাষ্ট্রের বাহিনীও মুহুর্মুহু হামলে পড়ছে তাদের ওপর। ফলে এই এক সপ্তাহে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৭৬ জনেরও বেশী। যার মধ্যে আছে ২০ বছরের সেই তরুণী হাদিস নাজাফিও, যার খোলা চুল পেছনে বেঁধে সাহসিকতার সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দেয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তার পেট, ঘাড়, হৃৎপিণ্ড ও হাতে গুলি করা হয়েছে। নবারুণদা বলেছিলেন, ‘যখন দেখবে অন্যায় অবিচার আর শোষণ লাগামহীন হয়ে উঠবে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে, তখন মানুষ আর কোনও ইজম, ধর্ম বা গোষ্ঠীর ধার ধারবে না, সরাসরি পথে নামবে। ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নেবে। কোনও বুলেট, রাষ্ট্রযন্ত্র বা ব্যারিকেড তাদের রুখতে পারবে না।’ ইরানের আজকের মানুষের প্রতিবাদ, আজকের নারীদের বিক্ষোভ তো কেবল আজকের নয়। বহুদিনেরই পুঞ্জীভূত এই ক্ষোভ। মাহ্শা আমিনীহত্যা ঘটনার মধ্য দিয়ে যার বিস্ফোরণ ঘটেছে। পৃথিবীর মানুষের কাছে প্রমাণ হয়েছে ধর্মের চেয়ে—অনুশাসন আর বিধি নিষেধের চেয়ে মানব বড়, মানবিকতাই মূখ্য।
আবার, মানবিকতাপূর্ণ সেই ইরানের কথাই যদি ভাবতে চাই—প্রথমেই মনে আসে যেই নাম—গতকাল রাতে যাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পড়ছিলাম—হ্যাঁ, ফোরা ফারোখজাদের কবিতা। তেহরানের বিখ্যাত কবি ও চলচ্চিত্রকার। ধর্মীয় বিপ্লবের আগের সময়ের কবি তিনি। যাঁর কবিতায় আছে আত্মশুদ্ধির অগ্নি, আছে স্বৈর্যচেতনা আর আছে প্রশান্তিময়তা। ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতোই মনে হয় যেন তাঁর পঙক্তিগুলো শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। স্পষ্টতই মাত্র ৩২ বছরের জীবনে ইরানের রাজনীতি আর লিঙ্গ বৈষম্যে প্রচণ্ড বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। কবিতা পড়েই অনুভব করা যায় তাঁর কবিতা মানেই অগ্নিসংযোগ, তাঁর কবিতা মানেই গৃহদাহ। বুকের ভেতর এক রকম ভাঙন আনেন তিনি। ধ্বংস করে দেন। একেবারে নির্মূল করে ফ্যালেন। কিন্তু আবার তার পরপরই মনে হয়, কিছু একটা হয়েছে আমাদের, বুঝতে পারি অন্তর্গত অপরিহার্য সত্তাটুকুই কেবল রয়ে গেছে। নির্মেদ, নির্মোহ। আর, অনাবশ্যক সমস্তকিছুই ঝরে গেছে।
বিরহ/বিচ্ছেদ কিংবা প্রেমে পড়ার প্রাবল্যকে অদ্ভুতভাবে প্রকাশ করতেন তিনি। সিগারেট জ্বালানো কিংবা ছাই-ভস্ম, সুগন্ধির ধোঁয়া অথবা অগ্নিশিখা—এইসব ছিল তাঁর ইমেজ। ধূমায়িত কবিতার কবি তিনি। তাঁর কাছে “পোড়া পোস্তের” সাথে সংযোগ ছিল প্রেমিকের চুম্বন। বিবাহিত কোনও নারী যখন কোনও পুরুষের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হন কামনায়, তখন সেই বাহু হয়ে ওঠে লৌহের মতো ভারী এবং উষ্ণ। আবিষ্ট কণ্ঠেই তিনি বলেন, “আমাদের জীবন হয়তো সঙ্গমের পর আবারও এক সঙ্গমের মধ্যবর্তী সময়ের নিস্তেজ অবস্থায় একটা সিগারেট জ্বালানোর মতো বিষণ্ণ সুন্দর।” সিগারেটের ওই পড়ন্ত ছাইয়ের মতোই তিনি বিচ্ছিন্ন করে দ্যান আমাদের কামনাকে—যে কামনা জীবনের প্রতি, যে কামনা আমাদের প্রেমের তরে, ভুল ও অসংগত মানুষকে আকর্ষণের তরে। তাজা আগুনে জ্বলন্ত কাগজের প্রান্ত যেমন কুঁকড়ে যায়, তাঁর কবিতার স্তবকে স্তবকে তেমনি আমাদের কামনা পাক খেয়ে ওঠে। আমরা পাঠ করতে পারি—
মাতাল বাতাস এলেই খুলে দিই শরীর
স্নান করব আজ ঝর্নার জলে,
কিন্তু এই নিঝুম রাত কেবলই প্রলুব্ধ করছে আমায়
বিষাদময় গল্প বলতে।
সাত ভাইবোনের মধ্যে ফোরা ছিলেন তৃতীয়। জন্মেছিলেন তেহরানের কাছেই, ১৯৩৪ সালে। বাবা আর্মি অফিসার কর্নেল মোহাম্মাদ বাকের ফারোখজাদ আর মা তুরানের পরিবার ছিল তেহরানের শিল্প সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক। তাঁর বোন পুরানও লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন বেশ। আর তাঁর ভাই ফেরেইদৌন ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী। যিনি ১৯৭৯ এর বিপ্লবের আগে পর্যন্ত টিভি উপস্থাপক হিসেবেও কাজ করেছেন। এলিজাবেথ টি গ্রে তাঁর ইংরেজি অনুবাদের (ফারোখজাদের নির্বাচিত কবিতা) ভূমিকায় বাল্যকালের ফোরাকে অস্থির আর উগ্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন, তরুণ এই কবি তুমুল“সাহসী এবং বিদ্রোহী”। তাঁর ছিল এক স্বাধীন চেতনার ধারা। সমস্ত প্রকার কর্তৃপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ জানাতো সে।
১৬ বছর বয়সে দূর সম্পর্কের এক কাজিনের সাথে প্রণয়ে জড়িয়ে যান তিনি। তাঁর থেকে ১১ বছরের বড় ছিলেন কাজিন পারভিজ শাপৌর। তাদের দুই পরিবারের অমতেই বিয়ে-বন্ধনে আবদ্ধ হন তাঁরা এবং কিছুদিন পর তাদের এক ছেলে সন্তান জন্ম লাভ করে, যার নাম রাখেন কাম্যার শাপৌর। এতে অবশ্য সবাই ভেবেছিলেন এইবার হয়তো তিনি স্থিতু হবেন সংসারে। গতানুগতিক স্ত্রীদের মতোই পরিবারের একজন হয়ে উঠবেন। কিন্তু তাঁর রক্তে বইছিল কবিতা। লিখছিলেন অসংখ্য। পারভিজ তাঁকে উৎসাহ দিলেন। গেলেন তেহরান শহরে। বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকের সাথে দেখাও করলেন। কিছু লেখা জমা দিয়ে এলেন। “অবিন্যাস্ত চুল, কালি-দাগ লাগা দুই হাত, আর সেই হাতের আঙুলের ফাঁকে ভাঁজ করা টুকরো কাগজ নিয়ে এলো এক মেয়ে”— তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে এমনই বলছিলেন এক সম্পাদক। এরপর, কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর পরকীয়ার গুজব ছড়িয়ে গেল চারদিক। বিচ্ছেদ ঘটলো তাঁদের বিয়ের। জোরপূর্বক ছেলের তত্ত্বাবধানের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হল তাঁকে। এমনই এক পরিস্থিতিতে ২১ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতাবই বন্দী [১৯৫৫]।
আত্মপ্রকাশের এই সংকলনে যে কবিতাগুলো আমরা পেয়ে যাই হাতে, সেখানে শ্বাস নিতে গিয়ে বুঝতে পারি এ আমাদের পরিচিত প্রাণদায়ী অক্সিজেন নয় কোনোভাবেই, এ হলো কার্বন মনোক্সাইড। সাক্ষাৎ বিষ! যেখানে নিপুণ ভাষায় এক দম্পতির প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে, যাদের দুজনের মাঝখানে নেই কোনও আলো-হাওয়া। নেই প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়ার পর্যাপ্ত বাতাস। আছে কেবল অসুখী এক নারীর শ্বাসরোধী কান্নার শব্দ। যে শব্দগুলোর দিকে তাকালেই আওয়াজ শুনতে পান পাঠক, “আমি সেই মোম যার জ্বলন্ত হৃদয়/ প্রজ্বালিত করে সর্বনাশ।” এই বইয়েরই আরেকটি কবিতা আছে, “পাপ।” কবিতাটিতে একরকম বিস্ফোরণ আছে একটা।ফোরা এখানে বিস্ফোরণ ঘটান যে, “আনন্দময় একটা পাপ করেছি আমি।” কী সেই আনন্দময় পাপ? হ্যাঁ, কাম-ইচ্ছা। কবিতাটির শুরুই হয় নারীর যৌন কামনার আশ্চর্য সাহসী অভিষঙ্গে। “আনন্দময় একটা পাপ করেছি আমি/ উষ্ণ আর ভীতিকর এক আলিঙ্গনে।”
নাসের সাফারিয়ান ‘দ্য গ্রিন কোল্ড’ শিরোনামে ফোরা ফারোখজাদের জীবন, চলচ্চিত্র ও সাহিত্য নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন ২০০২ সালে। যেখানে আমরা ফোরার ভাই ফেরেইদৌনকে বলতে শুনি, “শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক এক পরিবারে আমরা বেড়ে উঠি। বেড়ে উঠি উগ্র পুরুষ-শাসিত এক সমাজে।” ফোরা ফারোখজাদের প্রথম অবাধ্য ওই বিয়ের কিছু দিন পূর্বে তাঁর বাবা তাঁর মাকে ছেড়ে দেন। অন্য এক মহিলাকে বিয়ে করেন। তখন সমাজের বড় একটা অংশ এই বিয়ে মেনে নেয়। তেমনি যে-কোনও পুরুষের বিবাহ বহির্ভূত প্রণয়গুলো আপত্তিকর হয় না সমাজে। কিন্তু ফোরার মতো কোনও মেয়ে যখন, যতো বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াক না কেন, তাঁর ক্ষেত্রে সেগুলো হয় সমাজে অগ্রহণযোগ্য অপরাধ। অনুবাদের ভূমিকায় গ্রে লিখেছেন, শতাব্দী কাল ধরে ফার্সি কবিতা প্রেমানুভবের দারুণ সূক্ষ্মতা নিয়েই রচিত হয়েছে ঠিক, কিন্তু সেসব কবিতায় বক্তা হিসেবে একজন নারীকে আমরা খুব কমই পেয়েছি। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে রক্ত-মাংসের প্রগাঢ় অনুভব সম্পন্ন এমন নারীকে আমরা তাঁর হৃদয়ের গভীর থেকে প্রকাশিত হতে কখনও দেখিনি। ”অন্যদিকে শোলেই ওয়াল্পের দৃষ্টিতে ফারোখজাদ তাঁর কবিতায় পুরুষদের, “উপস্থাপন করেছেন কখনও বিষয়বস্তু হিসেবে, কখনও প্রেম ও স্বপ্নবিহ্বলতা হিসেবে, আবার কখনও গভীর আসক্তি ও যৌন কামনার অভিপ্রায় হিসেবে। যা ছিল গতানুগতিক প্রকাশের একদম বিপরীত ও আধুনিক। আর যথারীতি তাঁর এই ফর্ম প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল তৎকালীন প্রাতিষ্ঠানিক গোষ্ঠীর দ্বারা। তাদের মতে এইসব কবিতা একেবারেই কোনও কবিতা হয়নি।”
চতুর্থ কবিতাবই অন্য জন্ম [১৯৬৪] এর ‘প্রেমের কবিতা’ শিরোনামের কবিতাটিতেও আমরা দেখতে পাই কী আশ্চর্য মাদকতায় তিনি এক আধুনিক নারীর যৌন কামনাকে তুলে ধরছেন বহমানতায়। “তোমার স্বপ্নে রাঙা আমার রাত, হে পুরুষ।” পড়তে গিয়ে পাঠের শুরুতেই কী আদ্ভুত দীর্ঘশ্বাসী প্রলাপবিলাপ বিকিরণের মুখে পড়ে যেতে পারেন পাঠক।“তোমার গন্ধে ও ঘ্রাণে ফেঁপে ওঠে স্তন […] হে পুরুষ, হে ত্বকের নীচের গোপন,/ শিরায় শিরায় বহে রক্তের দহন/ সোহাগে আদরে পোড়ে এই চুল/ পোড়ে গাল, দুঃসহ কামনায়।” কোনও কুয়াশা নেই, নেই লাজুকতা কিংবা চাপাহাসি হাসা। কামনার এমন যৌন আবেগকেযথাযথভাবে চিত্রিত করতে পেরেছেন তিনি। পড়তে পড়তে ওই কামনার ঘোরে ধ্বংস আর উর্বরতায় প্রসারিত করতে পারেন নিজেকে পাঠক।
এমনই উর্বরতা বোধের স্পর্শ তাঁর কবিতায়, ভাষার পরতে পরতে পাওয়া যায়— “পৃথিবীর শরীর ধুয়ে দেয়া বৃষ্টির মতো…ফসলের মাঠের চেয়েও ঢের প্রতুল তুমি,/ সোনালি শাখার চেয়ে ঢের ফল-ভার।” প্রেমিকের জন্য তাঁর এই স্তুতিগান—“তোমার জল আজ পূর্ণ করেছে আমার শুকনো হৃদয় স্রোত।” এখানে ব্যবহৃত রূপকগুলো পরিণত, ভেজা আর যথেষ্ট আকুল।যদিও এখানে এই প্রাকৃতির অনুষঙ্গের ইঙ্গিতময়তায় বাস্তবিক সুখানুভূতি রয়েছে,উজ্জীবন রয়েছে—তারপরওমনে হয় শেষ স্তবকে এসে কবিতাটি গাঢ় থেকে আরও গাঢ়তর হয়ে উঠেছে।
হে পুরুষ, কবিতার ঘোরে যে মিশিয়ে দিয়েছ আমায়
এতো যে আগুন ঢেলেই দিয়েছ কবিতায়
আমারই ভেতর কামনার জ্বর জ্বালিয়ে দিয়েছ তুমিই
তুমিই সে পুরুষ, আয়াতে আমার জ্বালিয়ে দিয়েছ আগুন জ্বালিয়েছ অগ্নি
প্রেম আর সহচর্য খুঁজে পাওয়া তখন কতোটা সম্ভব ছিল একজন নারী শিল্পকারের জন্য? পশ্চিমা সাহিত্য-বিশ্বেসমসাময়িক সিলভিয়া প্লাথের সঙ্গে তাঁকে তুলনা করতে দেখা গেছে প্রায়। কিন্তু সার্বিকভাবে সেটা সহজসাধ্যের চেয়ে অনেক দূরের। অবশ্য, দুজন কবির রচনাতেই প্রকৃতির অনুভূতিময় আহ্বানকে আকস্মিকতায় ভেসে যেতে দেখা যায় আরও বেশী নৃশংস নিবন্ধনে।যেমন, প্লাথ পড়লে মনে হয় ভ্রমর কখনও নিষ্পাপ নয়; আর ফারোখজাদে আছে প্রেম, অগ্নি আর শিল্পের মাঝে অনিবার্য ও আত্ম-ধ্বংসী এক সংযোগ। “জ্বর ১০৩০” কবিতায় প্লাথ যখন লেখেন, “আমি এক লণ্ঠন,” তখন আমাদের মনে পড়ে ফারোখজাদের “বন্দী”-তেও এমনই একটি কবিতার লাইনের কথা, যেখানে কথক নিজেকে “মোমবাতি” হিসেবে ঘোষণা করেন। প্লাথে “জুলাইয়ের পোস্ত” কবিতাটি শুরু হয় এইভাবে, “ছোট ছোট পোস্তগুলো, ছোট নরকগ্নিশিখা,/ কোনও ক্ষতিই কি করোনা?” এই পঙক্তিটি অনেকটা ফারোখজাদের প্রেমিকের চুম্বনের সেই “পোড়া পোস্ত”-এর ইমেজটির কথা মনে করিয়ে দেয়।
সবুজ রঙটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে বারবারই উঠে এসেছে ফারোখজাদের কবিতায়। সাধারণ দৃষ্টিতে সবুজকে আমরা বসন্তের প্রতীক, গাছগাছালি, জীবনীশক্তি কিংবা প্রাণময়তা বা তারুণ্যকে বোঝাতে ব্যবহার করি। কিন্তু ফারোখজাদের কবিতায় এইসবের বাইরেও সবুজকে আমরা পাই এক অদ্ভুত মোহময়ী বিষণ্ণতার বোধে। গ্রে’র অনুবাদে আমরা “গ্রিন ইলিউশান” নামের যে কবিতাটি পাই, কেউ কেউ সেটাকে ইংরেজি করেছেন “গ্রিন টেরর”। এ বিষয়ে নারীবাদী সমালোচক ফারজানা মিলানির একটি উদ্ধৃতি ছিল এইরকম— “শিল্পের খাতিরে যে সমস্ত কুরবান তাঁকে করতে হয়েছে এই কবিতাটিই তার সবচেয়ে মার্জিত বিবৃতি।” কবিতাটির প্রথম স্তবকটি যদি পড়ি—
সমগ্র দিন কেঁদেছি আমি আয়নায় দাঁড়িয়ে
আমারই জানালায় অর্পিত বসন্ত আজ
গাছেদের সবুজ বিভ্রমে
নৈঃসঙ্গের কোনও খোলস আর ঢাকতে পারছে না এই দেহ
ঠুনকো অহংদূষিত করেছে বাতাস
নিরালোকএই জগতের
তাঁর ওই প্রচলিত বিশ্বাস বিরোধী প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রতিবাদী আপসহীন মনোভাবের জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে জীবনে। নিজ সন্তানের তত্ত্বাবধানের অধিকার খুইয়েছেন। যে সম্পাদকের সঙ্গে গভীর প্রণয়ে জড়িয়ে ছিলেন তিনি, সেই প্রণয়ের ছদ্ম কাহিনী অপ্রীতিকর ছোট ছোট পর্বে পত্রিকায় ছাপা হচ্ছিল তখন। সময়টা ১৯৫৫ সালের গ্রীষ্ম। এমন ঘটনায়, বিব্রত আর ক্রমান্বয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ফারোখজাদ। স্নায়ুবৈকল্য দেখা দেয় তাঁর। পুরো একটা মাস মানসিক চিকিৎসালয়ে ভর্তি ছিলেন। সেখানে তাঁকে ভয়ংকর বৈদ্যুতিক শক থেরাপিও সহ্য করতে হয়। কবিতায় তাঁর এমন অকপট আত্মচরিত, যদিও, নানান দেশ, নানান ভাষা ও সময় অতিক্রান্ত হয়ে ছড়িয়ে গেছে—তবু আশ্চর্য হতে হয় ওই লাইনটায়—“ঠুনকো অহং দূষিত করেছে বাতাস”—যা অনেকটাই অপরিচিত আর বিস্ময়কর। কিন্তু সেও তো নির্দিষ্ট কোনও সৌন্দর্য, এমনকি আত্মমর্যাদাকেই তুলে ধরে এক বিশেষ ব্যক্তিগত অ-সুখীতায় যা প্রায়শই মেয়েলী বলে সংহিত।
ফরেস্ট্রিতে নিয়ন্ত্রিত দহন নামে একটা পদ্ধতি আছে। গাছেদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এটা করা হয়। পরিকল্পিত আগুন লাগানো হয় বনে। যেন হ্রস্য আর মৃত গাছ আর পচা শিকড়বাকড় পুড়ে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে ওঠে বনের তল। সেইরকমভাবে, দ্রোহী যেসব অনুষঙ্গ ফারোখজাদ তাঁর কবিতায় বারবার উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেন, যেমন, প্রকৃতির সবুজতা,— সে’সব যে সবসময়ই তাদের উর্বরতায় ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে— এমন নয়। আবার, আত্মশুদ্ধির, অগ্নিশিখার ধ্বংসাত্মক শক্তি— কাজ করে তাদের আপন নিয়ন্ত্রিত দহনে। ধ্বংস করে দেয় জীর্ণতা, রক্ষণশীলতা, আর ঐতিহ্যের স্থবির প্রভাব। অবশ্য, এই প্রক্রিয়াটি একজন কবির ক্ষেত্রে সবসময় সহজ ওঠে না। কিন্তু তারপরও, অঙ্কুরোদ্গমের একটা সম্ভাবনা ঠিকই থাকে। মৃত্যুর ২ বছর আগে, ১৯৬৫ সালে ইতালির চিত্রপরিচালক বেরনারদো বেরতোলুচির নেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফারোখজাদ বলছিলেন, “বুদ্ধিমান মানুষ সবসময় জীবনের বাহ্যিক উন্নয়নের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক অগ্রযাত্রায়ওএগিয়ে যান, চেষ্টা করেন তাঁর নৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধানের। খুব গভীরভাবেই ওই সমস্যাগুলোর কারণ অনুসন্ধান করেন তিনি আর নিজ স্বার্থেই তার সমাধানও বের করেন।” তাঁর কবিতা, বিশেষ করে প্রেম ও যৌনতার কবিতাগুলোয় তাঁকে সবসময়ই তীব্রভাবে সচেতন দেখতে পাই নারী ও পুরুষের পার্থক্যকারী অপশক্তির বিরুদ্ধে। ইরানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ মোসাদ্দেক সেই ’৫০ এর দশকের শুরুতে শাহ্, মোহাম্মাদ রেজার শাসনামলে ব্রিটিশ মালিকানাধীন তেল কোম্পানিকে জাতীয়করণ করেন। এর ফলে ১৯৫৩ সালে ইউএস এবং ব্রিটিশ সমর্থনে একটি সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় যাতে ইরানের সেই প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ মোসাদ্দেক পদচ্যুত হন। এরপর শাহ্ মোহাম্মাদ রেজা তখন আবারও ওই তেল কোম্পানিকে পুনর্বহাল করেন ১৯৫৪র কনসরটিয়াম এক্টএর মাধ্যমে। এই ঘটনা প্রবাহের পর থেকেই ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। কারণ, শাহ্ তখন থেকেই লেখক, শিল্পী আর বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের উপর তার দমন পীড়ন ক্রমান্বয়ে বাড়াতে থাকেন। সমগ্র ইরান জুড়ে দাঙ্গা হাঙ্গামা আর অশান্তি শুরু হয়ে যায়। এমনই পরিস্থিতিতে ১৯৬৩ সালের জুনে গ্রেফতার করা হয় আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমিনিকে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক প্রতিবাদ আর জনবিক্ষোভ দেখা দেয়। সেই সময়ে ফারোখজাদের প্রতিবাদী কবিতাগুলো রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিক্ষুব্ধ মানুষ তাঁর কবিতায় নিজেকে প্রকাশের পথ খুঁজে পান। একেকটা ইস্তেহার— একটা রাজনৈতিক চেতনার পথ হয়ে উঠতে থাকে তাঁর কবিতাগুলো। ১৯৬৪ সালে তিনি “গোলাপ” কবিতায় লেখেন, “একটা লাল গোলাপ ফুটে উঠছে/ লাল গোলাপ/ লাল/ পতাকার মতো খুলছে আর উত্তোলিত হচ্ছে।” তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত কবিতা “তোমার অনুসরণে,” যেখানে লিখেছিলেন, “তোমার পেছন পেছন আমরাও গিয়েছিলাম চত্বরে/ শ্লোগান ধরেছিলাম চিৎকার করে/ ‘… দীর্ঘজীবী হোক/… নিপাত যাক’।’’ এই কবিতাটিতে আমরা দেখতে পাই নিপুণভাবেই তিনি মেয়েসুলভ নির্মলতার ক্ষতকে জুড়ে দেন রাজনৈতিক নির্মলতার ক্ষতের সঙ্গে। আর তাঁর “হে রত্নখচিত ভূমি” কবিতাটির শিরোনাম নেয়া হয় শাহ্ এর আমলের জাতীয় সঙ্গীত থেকে। যেখানে তিনি তৎকালীন তেহরানের প্রাত্যহিক জনজীবনকে এঁকেছেন তীব্র ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে।
বিজয়!
রেজিস্টারে নাম লিখিয়েছি আমার
বিভূষিত করেছি নিজেকে, আইডি কার্ডে নাম গ্রহণ করে
আমার অস্তিত্ব বিশিষ্টতা পেয়েছে একটি সংখ্যায়
জাহান্নামে যাক #৬৭৮, ৫ নং এক্তিয়ার থেকে জারিকৃত, তেহরানের বাসিন্দা!
আর চিন্তার কিছু নেই
ও আমার মাতৃভূমির সদয় বক্ষ
অতীতের শান্তকারী, ইতিহাসের পূর্ণ গৌরব
সংস্কৃতি সভ্যতার ঘুম পাড়ানি গান
আইনের চিত্কারি-খেলনা…
সংস্কৃতির প্রতি প্রেমের ভালো দিকটি কী? ফারোখজাদকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। যখন সেখানে নিষ্ঠুর অতীত বিজড়িত। জড়িত অত্যাচারী আদল। পরবর্তীতে রচিত কবিতাগুলোয় তিনি রক্ষণশীল ফর্ম আর রক্ষণশীল রাজনীতির মধ্যকার আপাত প্যাঁচ নিয়ে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠেন। “বিজ্ঞান ও শিল্প এবং শ্রদ্ধা ও চাটুকারিতা বিষয়ে সবই পড়েছি আমি/ ‘সঠিকভাবে লেখা’র নৈপুণ্য তাই বুঝি।” তাঁর নির্মিত একমাত্র চলচ্চিত্র বাড়িটি অন্ধকার [১৯৬২] তে রাজনীতি, ফর্ম আর আত্ম’র নৈতিক উন্নয়ন চমৎকারভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। ২০ মিনিটের এই কাব্যিক অনুসন্ধান মাত্র ১২ দিনেই তৈরি করেন তিনি। যেখানে আমরা উত্তরপূর্ব ইরানের বাবাবাগী হাসপাতালে কুষ্ঠ কলোনির অভূতপূর্ব চিত্র দেখতে পাই। কুষ্ঠরোগীদের সহায়তার জন্য প্রকল্পটি চালু করা হয়েছিল। ফারোখজাদের প্রেমিক, এব্রাহিম গুলেস্তানের গুলেস্তান স্টুডিও থেকে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়। একটি দেশের অসুস্থতার সঙ্গে তার জনমানুষের অসুস্থতার সম্পর্ককে তুলে ধরা হয়েছে এখানে অদ্ভুত উদ্বেজক ধ্যানে। ফারোখজাদের কবিতার আবৃত্তির পাশাপাশি ভিডিও চিত্রে প্রবহমান থাকে গ্রাম্য মানুষের কুষ্ঠ রোগের সঙ্গে বসবাসের অসহায়তা। আর আছে চিকিৎসা সংক্রান্ত গুলেস্তানের বর্ণনা। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাবার পর ভূয়সী প্রশংসা কুড়ায়।
শুরুতেই আমরা এক মহিলাকে দেখতে পাই আয়নায় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন নিজের বিকৃত চেহারার দিকে। একটা অর্ধেক প্রতিবিম্ব। জঘন্য। আর বেদনাদায়ক, খুব, কারণ, দর্শক দেখতে পাচ্ছেন গুলেস্তানের মনোযোগ কেড়ে নেয়া বর্ণনায় একটা নিঃশব্দ ঘটনা নিদারুণভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। নির্দিষ্ট করেই চিহ্নিত করা হয়েছে, কুষ্ঠ রোগ, দারিদ্র্যের রোগ। যাকে প্রতিহত করা যায়, সম্পূর্ণরূপে সারিয়েও তোলা যায় যদি শুরুতেই এর সঠিক চিকিৎসা করানো হয়। বাচ্চারা খেলছে, তাদের মুখে-চোখে, সমগ্র শরীরে এই রোগ। এমনকি একটা দৃশ্যে দেখা যায় এক ক্লাশরুমে কিছু ছাত্রও আক্রান্ত। বড়দের মতো ওদেরও কারও একটা নাক নেই, একটা কান নেই। কুঁদার মতো তাদের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গ শক্ত হয়ে গেছে। আরেকটা দৃশ্যে দেখা যায় অনুষ্ঠান হচ্ছে—মনে হয় কারও বিয়ের অনুষ্ঠান। একটা লোককে নামাজ পড়তে দেখা যায়। এরপর, শেষের দিকে, আবারও সেই ক্লাসরুম, চকচকে আর কালো চোখের একজন শিক্ষক ছোট একটা ছেলেকে প্রশ্ন করছেন, “এইযে আল্লাহ্ আমাদেরকে বাবা-মা দিয়েছেন এ’জন্য কেন তাঁর শুকরিয়া আদায় করতে হবে?”
“জানি না আমি,” ছেলেটি উত্তর করলো। আর শিক্ষক বললেন, “আমিও না।”
মর্মান্তিক চলচ্চিত্র। দারুণ এর কম্পোজিশন। সত্যনিষ্ঠায় রাগত এর স্বর। ফারোখজাদ সেই সময়ে যে কবিতাগুলো লিখেছিলেন, যেগুলো আমরা তাঁর অন্য জন্ম কবিতা বইয়ে পাই, সেই আধুনিক কবিতাগুলোয় সচেতন বাম-ঝোঁকা রাজনীতি আর অগ্রসর নান্দনিকতার নিখুঁত সমন্বয় দেখতে পাওয়া যায়।এক সাক্ষাৎকারে তাঁর ভাই আমির বলেছিলেন, “ও আসলে এই শতাব্দীর মানুষ নয়। ও একুশ শতাব্দীর। তাঁর চিন্তা চেতনা আমাদের থেকে অন্তত একশ বছর এগিয়ে ছিল।”
১৯৬৭ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি, ফারোখজাদ দুপুরে খেতে গিয়েছিলেন তাঁর মায়ের বাড়ি। ফেরার সময়, পরে তাঁর মা তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, সেদিন ফারোখজাদের ঠোঁট দুটো ছিল অদ্ভুত শীতল—আসন্ন মৃত্যুর ইঙ্গিত যেন, এক বৃদ্ধা স্ত্রীর গল্পের মতো। মা তাঁকে থেকে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি হেসে, উপহাস করে বলেছিলেন, “আল্লাহ্ যা চান, তা-ই হয়।” গাড়ি চালিয়ে ফেরার পথে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি স্কুল বাসকে এড়াতে পারলেন না তিনি। সংঘর্ষে গাড়ি থেকে ছিটকে পড়লেন বাইরে। ফুটপাথের পাথর বাঁধানো কিনারায় লেগে প্রচণ্ড আঘাত পান মাথায়। এবং সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন।
জানাজার সময় তুষার ঝরছিল সে’দিন। সেই হাড় কাঁপানো কনকনে ঠাণ্ডায় শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তখন ইরানের গুণী ব্যক্তিবর্গ আর অসংখ্য অনুরাগী ভক্ত। এরও প্রায় এক দশক পর, ১৯৭৯ সালে দেশে ধর্মীয় বিপ্লব সংঘটিত হয়। নতুন ইসলামী সরকার তাঁর বইগুলো বাজেয়াপ্ত করে। কিন্তু কবিতার বই তো লাশ নয় যে তাঁকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যাবে। কবিতা নিজেই প্রাণের স্পন্দন নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে পাঠকের হৃদয়-রাজ্যে। ফারোখজাদ নেই, কিন্তু তাঁর কবিতাগুলো আজও সেই আগের মতোই পাঠকের হৃদয়-পৃষ্ঠায় রেখে যায় দহন দাগ।
ঋতো আহমেদ। ২৮.০৯.২০২২।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার @ রিয়েন সাসিন, এলিজাবেথ গ্রে।