You are currently viewing অগ্নিযুগের অগ্নিপুরুষ সতীশ পাকড়াশী > এম.এ আজিজ মিয়া

অগ্নিযুগের অগ্নিপুরুষ সতীশ পাকড়াশী > এম.এ আজিজ মিয়া

অগ্নিযুগের অগ্নিপুরুষ সতীশ পাকড়াশী
এম.এ আজিজ মিয়া

সাম্রাজ্যবাদী দানবের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে যাঁরা জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন, মৃত্যুর গর্জন শুনেছিলেন সঙ্গীতের মতো; তাঁদেরই একজন হয়ে কিশোর বয়সে ঘরবাড়ি ছেড়ে বিপ্লবীমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন সতীশচন্দ্র পাকড়াশী। জীবনপণ করেছিলেন অখন্ড ভারতের স্বাধীনতার জন্য। জীবনের অধিকাংশ সময় বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। জেল-জুলুম ও দ্বীপান্তর ভোগ করেছেন। আত্মগোপনে থেকে বিপ্লবের শিখা উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন; সে কাহিনী যেমন রোমা কর তেমনি চিত্তাকর্ষক।

কমরেড পাকড়াশী জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর নরসিংদী জেলার মাধবদী গ্রামে। পিতা জগদীশচন্দ্র ও মা সরোজিনী দেবী। তাঁর পিতামহ ছিলেন স্থল গোবিন্দপুরের সম্ভ্রান্ত পাকড়াশী পরিবারের সন্তান জগৎচন্দ্র ভট্টাচার্য্য পাকড়াশী। ছোটবেলা থেকেই সতীশচন্দ্র ছিলেন সহজ-সরল, ধীর-স্থির ও চিন্তাশীল প্রকৃতির। সাটিরপাড়ায় মামাবাড়িতে থেকে সেখানকার গ্রাম্য স্কুলে লেখাপড়া করেন। আগ্রহী হয়ে ওঠেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবকের কাজে। ১৯০৫-০৬ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উত্তাল সময়কালে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দিতে শুরু করেন। পরিচিত হন অনুশীলন দলের শীর্ষনেতা ব্যারিস্টার পি. মিত্র, পুলিনবিহারী দাস ও মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে। ব্যায়াম, লাঠি-ছোরা খেলা ও পরে বন্দুক-পিস্টল চালানো শিক্ষা করেন। ১৯০৭ সালে তিনি অনুশীলন দলে যোগ দেন।

১৯০৮ সালে ‘আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা’ শুরু হলে বিপ্লবী কর্মকান্ড অনেকটা ভাটা পড়ে এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। ১৯১১ সালে তিনি রিভলবার আনতে গিয়ে ধরা পড়ে এক বছর জেল খাটেন। তখন তিনি সবে এন্ট্রাস পরীক্ষা দিয়েছেন এবং বয়স মাত্র ১৮ বছর। পরের বছর ‘দিল্লি ষড়যন্ত্র মামলা’য় তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। ১৯১৪ সালে তিনি বিপ্লবী রাসবিহারী বসু এবং পরবর্তীকালে কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ, মহাবিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন, গণেশ ঘোষ, সতীশ দাস, কমরেড আবদুল হালিম, সরোজ মুখার্জী এবং আরো অনেকের সঙ্গে পরিচিত হন। আত্মগোপন অবস্থায় তিনি ঢাকা, কলকাতা, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোহাটি, ভুবেনেশ্বর প্রভৃতি স্থানে বিপ্লবী কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। অর্থ সংগ্রহে ডাকাতি করেছেন এবং বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারমধ্যে কুখ্যাত বসন্ত চ্যাটার্জী ও গুপ্তচর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক অন্যতম।
১৯১৮ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ১৯২১ সালে মুক্তি পান। রুশ বিপ্লবে অনুপ্রাণিত হয়ে এ সময়ে জেলে তিনি মার্কসীয় সাহিত্য পাঠে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ১৯২৩ সালে পাঁচ বছরের জন্য তিনি আটক হন এবং জেলখানায় ‘বিদ্রোহী গ্রুপ’ তৈরি করেন। ১৯২৯ সালে মেছুয়াবাজার থেকে তাঁকে অস্ত্রসহ আটক করে আন্দামানে নির্বাসিত করা হয়। আন্দামানে তিনি ছয় বছর জেল খাটেন। ১৯৩৬ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। ১৯৩৮ সালে মুক্তি পেয়ে প্রথমে তিনি মাধবদীর বাড়িতে নজরবন্দি থাকেন এবং পরে ঢাকা এসে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁরই উদ্যোগে দক্ষিণ মৈশুন্ডিতে কমিউনিস্ট পাঠচক্র, প্রগতি পাঠাগার ও প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ সংস্থাপিত হয়। এ ব্যাপারে তাঁর সহযোগী ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, সোমেন চন্দ প্রমুখ। ১৯৪০ সালে তিনি আটক হয়ে ১৯৪২ সালে ছাড়া পান। ১৯৪৩ সালে কলকাতা যান এবং কমিউনিস্ট পার্টির হিসাব সংরক্ষকের কাজ করেন। ১৯৪৯ সালে আবার গ্রেপ্তার হন এবং মুক্তি পান ১৯৫১ সালে। তাছাড়া ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধকালে তিনি দেশ-রক্ষা আইনে আটক ছিলেন।

কমরেড পাকড়াশী বিপ্লবী-কর্মকান্ড ছাড়াও বহু জনহিতকর কাজে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫১ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান শহীদ স্মৃতি সমিতির সভাপতি, ১৯৫৫ সাল থেকে আমৃত্যু পিআরসি-র কার্যকরী সদস্য, ১৯৫৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার সদস্য, কিশোর বাহিনীর সভাপতি ছিলেন। সোমেন চন্দ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও নকশাল আন্দোলন নিয়ে তিনি লেখালেখি করেছেন। তাঁর একমাত্র গ্রন্থ ‘অগ্নিযুগের কথা’।

শেষ জীবনে তিনি হাঁপানি রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ১৯৭২ সালে তাঁর কোমরে আঘাত পান। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে কলকাতার পি.জি হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ৩০ ডিসেম্বর সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস। ত্যাগ করেন।
জীবনে প্রথম পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এক বছর কারাদন্ড ভোগ করেন। সে স্মৃতিরোমন্থন করে তিনি লিখেছেন:
১৯১১ সালের মধ্যভাগে আমার উপর এক গুরুতর কাজের নির্দেশ এল। অনুশীলন দলের নরেন ঘোষ স্বয়ং আমাকে নির্দেশ দিলেন এবং আমিও সোৎসাহে তাঁর আদেশ গ্রহণ করলাম। ব্যাপারটা এই, প্রায় দশ মাইল দূরে এক স্থানে তিনটি ৪৫০ বোরের রিভলভার ও কতগুলো কার্তুজ আছে, সেখান থেকে অতি সন্তর্পণে সেগুলি আনতে হবে। সেগুলি আনতে গিয়ে আমি ধরা পড়লাম। পুলিশ আগেই রিভলভারের প্যাকেটটি পেয়ে যায়। (অগ্নিযুগের কথা; পৃ: ২৭)
বিপ্লবী কর্মকান্ডের বিস্তারকল্পে গোপনে তিনি কলকাতা, ঢাকা, ফরিদপুর চট্টগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, সিলেট প্রভৃতি স্থানে অবস্থান করেছেন। এ ব্যাপারে স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছেন:
অনুশীলন সমিতি (তখন গুপ্ত বিপ্লবীর সংগঠন) মাদারীপুর মহকুমায় আমাকে কাজ করার জন্য পাঠায়। পালং (বর্তমানে শরীয়তপুর জেলা) অন্তর্গত ভঙা গ্রামে মধ্য ইংরেজী স্কুলের শিক্ষকতার কাজে ব্রতী হয়ে ঐ অঞ্চলে দলগঠনের কাজে ঘোরাফেরা করতাম। দলের লোকেরা আমাকে স্কুলের কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ করে দেয়।* বিদ্রোহ ভাবোদ্দীপক পুস্তিকা স্কুলে, কলেজে, ছাত্রাবাসে, পাঠাগারে, রাস্তার পার্শ্ববর্তী আলোকস্তম্ভে (লাইটপোস্টে) গোপনে ছড়ানো হতো। এই পুস্তিকাগুলি বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি করে শিক্ষিতদের মধ্যে। (অগ্নিযুগের কথা, পৃ:৩২-৩৩)
১৯৩০ সালে রাজশাহী জেল জীবনের অসহনীয় কষ্ট অনুভূতির স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছেন:
আগস্ট মাসে রাজশাহীর জেলে নিয়ে আমাকে এক ক্ষুদ্র সেলে ফাঁসির আসামির জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে পৃথক করে রাখে। আর কোনো রাজবন্দীর সঙ্গে আমাকে মিশতে দিতনা। জেল থেকে পালাব এই সন্দেহে তারা আমাকে সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। বিশ্বের সকল সংশ্রবের বাইরে আলো-বাতাসহীন নির্জন কক্ষে একাকী প্রায় এক বছর থাকি। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো। একখানা বই অবধি সঙ্গী হিসাবে পাইনি। ‘রেপ’ কেসে (Rape Case) শাস্তিপ্রাপ্ত এক মওলবীকে পাশের কক্ষে আমার সাথী হওয়ার জন্য দেয়। লোকটি জেলার সাহেবের গুপ্তচর বলে সকল কয়েদীর ঘৃণ্য ছিল। যেমন করেই হোক, সকল দুরবস্থার মাঝে সব কিছু জয় করে আমি একটি পরিপূর্ণ আনন্দের অনুভ‚তিতে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম। কোনো দুঃখবোধই ছিলনা। শরীর মন সব যেন সবল হয়ে উঠেছিল।
“মন আমার ভরে ছিল কোন গন্ধে
হৃদয় আমার নেচেছিল কোন আনন্দে”
(অগ্নিদিনের কথা, পৃ: ১৪২)

১৯৩০-১৯৩৬ সাল পর্যন্ত কমরেড পাকড়াশী আন্দামান সেলুলার জেলে ছিলেন। সেখানে অবস্থানকালে তিনি কমিউনিস্ট কর্মীদের সংস্পর্শে আসেন এবং মার্কসীয় সাহিত্য পাঠের মধ্যদিয়ে নতুন চিন্তার আভাস পান। কমিউনিস্ট সমাজ ব্যবস্থাকে মার্কসীয় পন্থা হিসেবে গ্রহণ করেন। সে ব্যাপারে তিনি স্মৃতিচারণে লিখেছেন:
কিশোর জীবনে ভাবের আবেগে অন্তরে জিজ্ঞাসার উদয় হয়েছিল‘ এ জীবন দিয়ে কী করব? সেই জিজ্ঞাসার একটা উত্তর পেলাম এই সাগর-দ্বীপে “সংসার জীবনযাত্রার পথে ভগবানের কোনো স্থান নেই”। বিজ্ঞান ছেড়ে বৃথাই আমরা অন্ধ বিশ্বাসের উপর মানবের মুক্তি সাধন। কমিউনিস্ট সমাজব্যবস্থায় যার যথার্থ পরিণতি। এই নব বিপ্লবই সত্যিকার বিপ্লব।
সন্ত্রাসবাদী সংগ্রামে যেসব মৃত্যুর গর্জন শুনেছিলাম সঙ্গীতের মতো, কমিউনিজম-এর পথেও মৃত্যুকে তেমনি করেই বরণ করে নিতে হবে নইলে মুক্তি সুদূর পরাহত। মরণের রক্তরঞ্জিত পথেই বিপ্লবের রক্ত পতাকা উজ্জ্বল হয়। (অগ্নিযুগের কথা; পৃ: ১৬২)।

১৯৩৩-১৯৩৫ সালে ইউরোপে ফ্যাসিস্টশক্তির উন্মেষপর্বে লন্ডনপ্রবাসী কতিপয় ভারতীয় ছাত্র প্রগতি সাহিত্যচর্চার লক্ষ্য নিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করেন। ১৯৩৫ সালের শেষদিকে তাঁরা ভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘ গঠনের প্রক্রিয়া চুড়ান্ত করেন। ১৯৩৬ সালের ১০ এপ্রিল লক্ষ্মৌতে ভারতীয় কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী মিলে গঠন করেন ‘ভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘ’। সভাপতি মুনশী প্রেমচন্দ এবং সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ জহীর। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে ‘বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘ’ ও অন্যান্য রাজ্যে প্রগতি লেখক সংঘের শাখা গঠিত হয়। ঢাকাতে প্রগতি লেখক সংঘ-এর শাখা গঠনের জন্য সাজ্জাদ জহীর, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী ঢাকা আসেন এবং এ-ব্যাপারে কমরেড সতীশ পাকড়াশী, রণেশ দাশগুপ্ত, সোমেন চন্দ্র প্রমুখের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন। সে স্মৃতিচারণ করে কমরেড পাকড়াশী লিখেছেন:
নূতন গণসাহিত্য সৃষ্টির কাছে রণেশ দাশগুপ্তের উদ্যোগ, রচনা দক্ষতা ও জ্ঞানবুদ্ধি যথেষ্ট প্রখর। এই যুবক মেধাবী লেখকদের জোরেই আমরা ‘ঢাকা প্রগতি লেখক সংঘ’ গঠনের কাজে অগ্রণী হলাম। বিভিন্ন পাড়ায় অজানা লেখকদের সঙ্গে সংঘ গঠনের কথাবার্তা চল্ল। সোমেনের খুব উৎসাহ। মনের মত কাজ পেয়েছে। সনাতনী সাহিত্যের গোঁড়ামি এবার ভাঙ্গবে। সে তার পরিচিত অজানা অচেনা যুবক লেখকদের প্রগতি লেখক সংঘ টেনে আনল। (অগ্নিযুগের কথা, পৃ- ১৭৪)।
বাংলা প্রগতি সাহিত্য, প্রগতি লেখক সংঘ ও কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রতি সোমেন চন্দকে (১৯২০-১৯৪২) আকৃষ্ট করার পিছনে কমরেড পাকড়াশীই প্রধান ভুমিকা পালন করেছিলেন। তিনি আরো লিখেছেন:
আন্দামান-ফেরতা, টেররিস্ট দলের পুরোনো কর্মী বলে, সে প্রথমটায় আমার দিকে আকৃষ্ট হয়। প্রথম দিনের পরিচয়েই আমি তাকে বলি, সাহিত্য রচনার পথেও বিপ্লবের কাজ হয়। তুমি দেশের দারিদ্র্য-পীড়িত দুঃখী জনগণের আশা উদ্যমহীন জীবনের কথা দিয়ে জীবন্ত গণসাহিত্য তৈরি করো তাহলে তোমার ইপ্সিত স্বাভাবিক কর্মপথই ভবিষ্যৎ গণবিপ্লবের পথ প্রস্ততের সহায়ক হতে পারে। লেখার দিকেই তার বেশি টান এইটে বুঝেই ঐ কথা বলেছিলাম। সোমেন সব কথাই মনোযোগ দিয়ে শোনে কিন্তু কিছু বলে না। তবু তার আগ্রহটা বোঝা যায় (প্রাগুক্ত, পৃ.৪১)
১৯৩৬ সালে জেল থেকে বেরিয়ে কমরেড পাকড়াশী বেআইনি কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজে লেগে যান। দক্ষিণ মৈশুত্তির জোড়পুল লেনে গঠিত প্রকাশ্য পাঠাগার ‘প্রগতি পাঠাগার’ সংস্থাপন করেন। সেখানে মার্কসীয় সাহিত্য ও বিভিন্ন গ্রন্থাদি পাঠের ব্যবস্থা ছিল। বাংলাদেশে প্রগতি সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃত অকাল প্রয়াত সোমেন চন্দ (১৯২০-১২৪২) তাঁদের বাড়ি থেকে আসা-যাওয়ার পথে পাঠাগারটি দেখে আকৃষ্ট হন। একদিন ঢুকে পড়েন সেই পাঠাগারে। এর পত্র-পত্রিকা ও গ্রন্থাদি দেখে খুবই আহলাদিত হন। পরিচিত হন পাঠাগারের অন্যতম স্থপতি কমরেড সতীশ পাকড়াশীর সঙ্গেঁ। কমরেড পাকড়াশীই প্রথম সোমেন চন্দকে কমিউনিস্ট পার্টি, প্রগতি সাহিত্যচর্চা ও প্রগতি লেখক সংঘ-এর কর্মকান্ডে অনুপ্রাণিত করেন। সেই স্মৃতিচারণ করেন তিনি ‘সোমেন চন্দ’ প্রবন্ধে লিখেছেন:
বছর চারেক আগের কথা। ঢাকা বুড়িগঙ্গার তীরে বসে তরুণ যুবক সোমেনের সাথে এই কথাটাই হচ্ছিল। আগ্রহভরা গভীর প্রাণে সোমেন ভাবছিল ‘স্পেনে গণসমষ্টির জাগরণ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস’ আন্তর্জাতিক বাহিনী’ ব্রিটেনের গণ-সাহিত্যিক, ব্রিটেনের বিপ্লবী কমিউনিস্ট রালফ্ ফক্সের আন্তর্জাতিক বাহিনীতে যোগদান- স্পেনের জনগণের ধন-সম্পদের মালিক ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে- স্বাধীনতার সংগ্রাম- বিদেশী কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক ও রাজনীতিক কর্মীদের জীবন উৎসর্গ এই সব টুকরো টুকরো কথাগুলি একত্রে মিলিয়ে সোমেনের মনে এক অপূর্ব ভাব, বিস্ময় ও পুলকের সঞ্চার হল। সোমেন জিজ্ঞাসু ভরা প্রাণে বলে উঠল, ‘সাহিত্যিক ও মরণের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ল?’ আমি বললাম, অত্যাচার যখন চরমে উঠে, মানবতার বিকাশ যখন রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন কলম ছেড়ে তরবারি ধরতে হয়- বুকের রক্তে তখন নূতন সাহিত্য তৈরি হয়। (আগুনের অক্ষর, সোমেন চন্দ স্মারকগ্রন্থ, সম্পাদনা: কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত পবিত্র সরকার, পৃ:২০)।

কমরেড পাকড়াশীর একমাত্র স্মৃতিচারণগ্রন্থ ‘অগ্নিদিনের কথা’-তে ভুমিকায় কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ মূল্যায়ন করে লিখেছেন:
ঢাকাতেও অনুশীলন সমিতির শাখা স্থাপিত হলো। আমাদের সেই ১২-১৩ বছরের ছেলেটিও যোগ দিলো এই সমিতিতে। তারপরে তাঁর বয়স কিছু বাড়ল কাজের ভেতর দিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন অনুশীলন সমিতির নেতাদের একজন। বাংলার রাজনীতিক ক্ষেত্রে আজ তিনি’ আমাদের শ্রদ্ধেয় কমরেড সতীশ পাকড়াশী সুপরিচিত। ১৯০৫-৬ সালে তিনি কাজে নেমেছিলেন, আর আজ হচ্ছে ১৯৪৭ সাল। এই সুদীর্ঘ সময়ের ভিতর একদিনের জন্যও তিনি নিজের বৈপ্লবিক কর্মক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়াননি।…
অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝার ভেতর দিয়েও কি করে কাজে লেগে থাকতে হয় তা আমরা কমরেড পাকড়াশীর জীবন থেকে শিখতে পারি। এইজন্যেও রাজনৈতিক কর্মীদের বইখানা পড়া উচিত।
কমরেড পাকড়াশী মারা গেছেন তাও তিনযুগ হয়ে গেল। কিন্তু তাঁর স্মৃতি আজও এতটুকু মলিন হয়নি। লাল সালাম কমরেড।

তথ্যনির্দেশ
১) সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (প্রথম খন্ড)- সাহিত্য সংসদ, কলকাতা।
২) অগ্নিদিনের কথা – সতীশ পাকড়াশী, নবজাতক প্রকাশন, কলকাতা।
৩) অগ্নিযুগ – ডা. আবদুল বারি, মাদারীপুর।