কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের পদাবলী
জেবুন্নেছা জ্যোৎস্না
কবিতা কি কেবলই শব্দের ঝংকারে ব্যবহৃত কথার অলংকারনামা, নাকি মাত্রার ব্যাকরণে কঠিন বিধি-নিষেধ নামা, অথবা বোধেরও গভীরে বয়ে যাওয়া কুল কুল শিহরণের এক অজানা তৃপ্তি? আমার কাছে অযাচিত শব্দের বাহুল্যের চাইতে, কবিতা বরং অর্থবহুল এক তাৎপর্যের তর্জমা! কিছু কিছু কবিতা সাময়িক চমকালেও বোধের গভীরতা ছাড়াই হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে অরোরা -বোরিয়ালিস অথবা রংধনুর মোহে; কিন্তু রুমী, শেখ সাদী, কবি নজরুল, রবীন্দ্রনাথ অথবা জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো তাৎপর্যময় কবিতা গেঁথে থাকে মানুষের মননের মন ও মননের অভিকর্ষে!
আমিও তেমনি অভিভূত হয়ে গেলাম বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতা চয়নে-
“শুধু মৃতদের গল্প কত আর কাঁধে ঝুলে যাবে
এবার নিষ্কৃতি পেলে, শান্তি অন্বেষণে মহাকাশে
গিয়ে, দু’টুকরো লোহা ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে দেব
অসহ অসীম শব পুড়ে হোক ছাই পুড়ে ছাই।” —
সমাজ সংস্কারের এমন দ্রোহ বাণী যা আমাকে কৈশোরে আপ্লুপ্ত করেছিল কবি কাজী নজরুল ইসলাম, আর এতো বছর পর কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের, ‘ভোরের মন্দির’ বইটি পড়ার পর আমার ভেতর যেন সেই পুরনো তড়িৎ গতির অনুভবটা ফের আবার টের পেলাম— হ্যাঁ তাইতো, আমি যেন তৃষিত ছিলাম দীর্ঘ দুই দশক ঠিক এমন সব কবিতা পড়ার জন্যে!
কবি, নাট্যজন ও অনুবাদক বদরুজ্জমান আলমগীরের অনুরোধে কয়েকটি বই বাংলাদেশে থেকে নিয়ে আসি। বদরুজ্জমান আলমগীরসহ কবি, লেখক ও মনমানচিত্র সম্পাদক আলী সিদ্দিকী ভাইও বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের ‘ভোরের মন্দির’ বইটি আনতে পেরেছি কিনা এবং এনে থাকলে যেন বইটি মেইল করে পাঠিয়ে দিই। আমার একটু খটকা লাগলো, এই বইটার জন্য তাঁদের দুজনেরই এতো অধীর আগ্রহ কেন? আর এর উত্তর পেতে একদিন জবে যাওয়ার সময় হাতে করে বইটি নিয়ে ট্রেনে বসে পড়া শুরু করি। আর মূহুর্তেই আমার চোখ আটকে যায় ভোরের মন্দিরের গভীর মগ্ন মদিরতায়! যেখানে জীবন আর মৃত্যু যর্থাথই টুকরো পাতার তরবারিতে ঝনঝন বেজে চলে! কবি বিষ্ণু বিশ্বাস তাঁর ‘ভোরের মন্দির’এ কবিতার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে দিয়েছেন জীবন -মৃত্যুবোধের এক অভূতপূর্ব নির্যাস! আর সে স্বাদ নিতে নিয়োজিত হতে হয় পাঠকের পঞ্চ ইন্দ্রিয়কেই!
মহৎ প্রাণ মাত্রই পালাতে চায় সামাজিক বিতৃষ্ণায়, অন্যায়ে! কবি বিষ্ণু বিশ্বাসও তাঁর যৌবন বয়সের তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আহত হয়েছেন বারবার, তিনি পালিয়ে গেছেন সভ্য সমাজ থেকে শেকড়ের সংশোধনে! আর তাইতো তিনি গতানুগতিক কাব্যের বাহিরে অসামঞ্জস্যের বিরুদ্ধে এক দুর্নিবার প্রত্যয়ের অঙ্গীকারে লিখেছেন,
“শহর পালাবে আদিভূমে, যেখানে সূচনা চেতনার” —
কিন্তু যেখানে অনাহুত কাকের প্রবল আধিক্য, সৃষ্টিশীল মানুষ নিরুপায় হয়ে মুক্তির সাধনায়, সমন্বিত সমাজের বাসনায় মাটি খুঁড়ে, বালি তুলে, জল তুলে জীবনে এক সমলয় স্পন্দনের প্রতীক্ষায় থাকে! প্রাণের কি গভীর মুক্তির আকুতি বর্ণমালায় গেঁথেছেন তিনি সেসব পংক্তিতে:
“ আদি পিতা, তোমার আদ্যাধ্বনিকল্লোল
অবিনশ্বর শব্দের আজ চাঁদের হাট, দ্যাখো,
স্বর্গত্যাগী ফুল ঝরেছে বকুলের বনে
ধূসর মেহগনি ফাটিয়েছে সমস্ত ফল
আমরা মাটি খুঁড়ি, তুলি বালি, তুলি জল
মাটির গভীর থেকে সমলয় নৃত্যে আসে
বালির আড়ালে ধ্বনি,
মুক্তি, সাধনা, শক্তি” !
মানুষের চিরন্তন আকাংখা মুক্তি, কবি বিষ্ণু বারবার মুক্তি চেয়েছেন তার কবিতাতে। এখনও যে গুটিকতক কবি-লেখক স্রোতের উল্টো দিকে যেয়ে অসীম সাহসে ক্ষয়িষ্ণু সমাজের অবক্ষয় বদলে দেবার সংকল্পে কলমে বিপ্লবের কথা বলেন, কবি বিষ্ণু বিশ্বাস তাঁদেরই অন্যতম একজন! আজ যখন কবি- লেখকরা সত্যের স্বকীয় সত্তা রেখে অন্যায় শাসনের বশ্যতা স্বীকার করে, তখন কবি বিষ্ণু বিশ্বাস স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন কবিতার স্ফুলিঙ্গে। তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে, অতি গোপন তন্ত্রের গভীরে, রোমকূপের রোমন্থনে, নিউরণের ছটায় বিদ্যুৎ ঝলকে নাড়িয়ে দেয় দুঃসময়কে, সমূলে! বদলে দেয় গতি তারুণ্যের অভিব্যক্তিকে! সমসাময়িক সামাজিক সমস্যাকে তিনি স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁর কবিতাতে:
‘ সময়ের খোলা চোখ, অস্ত্রের সাধনা তোমার
প্রগতি, গতি, পথ এবং পাথেয়-সৌন্দর্যের
শিল্পের সামগ্রিকে নিমগ্ন শিল্পী হাঁটু ভাঙ্গা কাদাখোঁড়া পাখি, সামগ্রী, শব, শব, শব আমি শবের অধিপতি।
‘এগারো জন মৃত সংঘর্ষে’।
‘ওদের কবর দাও’
‘ধর্ষিতা সাতটি মেয়ে
রক্তাপ্লুত, রক্তনিঃস্ব’—
ভোরের মন্দিরে কবি জীবন থেকে মৃত্যুর মৃদ্যু স্থানান্তরের প্রক্রিয়ার পরতে পরতে তিনি তীব্রভাবে ব্যক্ত করেছেন সময়ের তীক্ততা! মৃত্যুর এমন মনোমুগ্ধকর বিশ্লেষণ করতে যেয়ে কবি শিশিরকে অভিহিত করেছেন অমিয় জলের বাস্পে; পাঠকের উদগ্রীব জিহ্বা যেন উষার অরুণিমায় পান করতে চায় সে সুস্মিত অমিয়কে! কবির সমগ্র চেতনা সে ক্ষীণ শব্দের ঝংকারে ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় মৃত্যুর অতলে, আর সঙ্গে আমিও যাই যেন! আমার চোখের, জিহ্বার, শ্রবণের গ্রন্থি গুলো যেন ভোরের মন্দির থেকে সবটুকু ভাললাগার অনুভূতি সিঞ্চন করে নেয় কানায় কানায় পরিপূর্ণ! এ যেন আমারই না বলা কথা-
“তখনও অনেক বাকি ভোর
অন্ধকার এবং অমেয় জলের বাষ্পে
টুকরো পাতার তরবারি বেজে চলে
ঝনঝন।
অতর্কিতের গুনে গুনে প্রহর
ঘুমিয়ে গিয়েছে কর্ণ
তার উন্মীলিত চোখে হলদে জ্যোতির্লোক
হয়তো তখনই জেনেছিল নিদ্রাচ্যুতি মৃত্যু” !
অথবা,
“শব্দ নাচের মুদ্রায় দেখেছ
ঝরে পড়া পাখির স্বর, বহুবার
বহু মৃত্যুর পরে পুনর্জন্ম চিতাগ্নির
ভিতর; আজ গল্পের অবশেষ
ধূপ-ঘৃত-গন্ধের সাথে পোড়া মাংস এখুনি শেষ হবে”।
( শেষকৃত্য)
জীবন -মৃত্যু -সংশয় – আততায়ীর হাতে খুন হওয়ার ভয় বিষ্ণুকে তাড়িয়ে যেন প্রস্ফুটিত হয়েছে তাঁর কবিতার পংক্তিতে! মৃত্যু, তিনি যেন দেখেছেন খুব কাছ থেকে গভীর ভাবে আর আহত হয়েছেন বারে বারে! অহরহ এ মৃত্যু উপত্যকায় শবের শরীর তাঁর কবিতায় বর্ণিত হয়েছে শ্বাশত সত্য’র প্রতিকৃতিতে; আর এ ঘৃর্ণিত গলিত কান্নার কষ্ট দলা পাকায় অসহায়ের মতো আমাদের কন্ঠের দ্বারে!
‘ভোরের চিলের ডানায় উড়ে যাবে শব
শূন্যে, সমুদ্রে
নিরঙ্কুশ কাকের আধিপত্যে সৌন্দর্যের মড়ক
শহর, পালাবে আদিভূমে
যেখানে সূচনা-চেতনার’ —
(ভোরের মন্দির)
“ ঊনশত মৃত্যু পেরিয়ে মৃত্যুর শাদা হাত তখন উদ্বেলিত আর জীবিতের মতো সহস্রের এক সবুজ হাত মুষ্টিবদ্ধ!
ওয়াগন ভর্তি লাশ, মানুষের, সমুদ্রসন্ধানী” !
অথবা,
মাঝে মাঝে মনে হয় কখনও নিশ্চয়
খুন হব আমি
লাল রক্তধারার বলিষ্ঠ এক স্রোত
আলতার আল্পনায় রাঙাবে একখানা পাতা যার রঙ মূলত হলুদ,
যে মূলত ঝরা।
এইখানে
একটি গল্পের শুরু এবং সারা-ও হতে পারে-। কিন্তু চলুক না রক্তস্রোত”!
আবার কখনও তাঁর মনে হয়েছে, না তিনি বেঁচে আছেন! এই যে মাটি – শস্য, সূর্য – আলো, আনন্দ -জল সবই যেন ভোরের পবিত্র এক মন্দিরে, জীবন -মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তাঁকে আলোড়িত করে গেছে বারে বারে —
“মাটি ফুঁড়ে ওঠে কিম্ভূত পুরুষকার
আমি মরি নাই, আমি জীবিত
আমি মরি নাই, আমি জীবিত
কোথাও কে তখনই বাজিয়েছিল, বেজেছিল ঘণ্টা
সূর্যপত্র ঝরে ঝরে স্বর্ণমূর্তির মতো
শস্যকান্তিদেবতা?
জলের মতো গানের মতো তরল হলুদ কুমারী
আনন্দ
নেচেছিল, কোনো ভোরের মন্দিরে নেচেছিল কি
ভোরবেলা?
দক্ষ শিল্পীর মতো সাধারণের প্রাণের চাওয়াকে তিনি নিগূঢ় ভাবে কবিতার শরীরে চাক চাক বসিয়েছেন চমৎকার ভাবে।
তাঁর উপমা সকল অন্য অনেক লেখকের চাইতে ব্যতিক্রম, যেমন: বহুল ব্যবহৃত জলের কুলকুল শব্দকে এড়িয়ে তিনি বলেছেন জলজ গম্ভীর শব্দে-; প্রতিসরিত আলোর রেখাকে তিনি বর্ণিত করেছেন গাজনের ঢোলের রুদ্র নৃত্যে! দুঃসময় থেকে মুক্তির আশায় তিনি প্রকৃতির সাথে জাগতিক ছেলে – মেয়েদের তুলনা করতে লিখেছেন,
আমাদের ছেলেরা সাগর সন্তান
মেয়েরা সমুদ্রে চলে নদীর মতন”—। পড়া যাক উপমার প্রাচুর্যে ভরা অসাধারণ সে কবিতার অংশবিশেষ :
“উড্ডীন, বঙ্গোপসাগর
ঢেউয়ের সংঘর্ষে ঢেউয়ের স্ফূর্তি নোনতা বালির স্ফুরণ স্ফটিকী
গভীর সমুদ্রঘূর্ণি ঘুরে ঘুরে
উড়ন্তচাকতির মতো নামে ধীরে ধীরে সংকটাবর্তে;
জলজ গম্ভীর শব্দে, ঝংকৃত
মিশ্রিত, শব্দের আকাশ এবং আলো
গাজনের ঢোলের রুদ্র নৃত্য
লৌকিক প্রতিবিম্বের যেন বজ্রকণ্ঠ:
উঠে পড়ো,
বেঁধে নাও দড়াদড়ি
স্বর্গ মর্ত্য
স্বর্গের মর্ত্যরে দেবী ও দেবতা
থাকো জাগ্রত
সময় বুঝে নেবে দুঃসময় দুর্মুক্তি
প্রথানির্দিষ্ট
আমাদের ছেলেরা সাগর সন্তান
মেয়েরা সমুদ্রে চলে নদীর মতন”!
আবার, চাঁদের স্তন, সূর্যের আঁধারে জ্বলে, ঝরে পড়ে শূন্য, এবং শূন্যের ছায়া, নীল ঘাসের দিন ও রাত , স্বপ্ন উঠে যায় চাঁদের চোখে — উপমা গুলি একেবারেই ব্যতিক্রম ধর্মী, যা কবি বিষ্ণুর ভেতর থেকেই উদগিরীত হয়েছে।
“দাঁড়াল বিশাল ওক সূর্যের বিপরীতে
চাঁদের স্তন, হলদে পাখির ডানা
সূর্যের আঁধারে জ্বলে, ঝরে পড়ে
শূন্য, এবং শূন্যের ছায়া।
মৃত্যুর বহু আগে সে ছিল
ধরা যাক আছে নীল ঘাসের দিন ও রাত
সূর্য নিভে গেলে সপ্তর্ষি পুকুরের জলে
রৌদ্রাভ জলের ফুল; স্বপ্ন উঠে যায় চাঁদের চোখে”!
(জল)
কবি বিষ্ণু বিশ্বাস পড়তে যেয়ে হঠাৎ পাঠক স্বাদ পায় যেন জীবনানন্দের পংক্তির অভিব্যক্তিতে, কিন্তু যথেষ্ট স্বতন্ত্র্য ভঙ্গিতে, আধুনিক কবিতার সকল দাবী মিটিয়ে। আহ্ কি অসাধারণ হৃদয় নিংড়ে লিখেছেন তিনি—
“হলুদাভ বিছানায়, মৃত্তিকা রঙের খাটে দুজনে শুয়েছি পাশাপাশি কিন্তু ব্রহ্মহংসীর মতো সে উড়ে গেছে দূর সাগরের তীরে
যেখানে নক্ষত্র ভাঙে, ঢেউয়ে ঢেউয়ে ধুয়েছে সে শরীরের বালি আর ধুলো তুলো আর তুষারের শাদা-কিংবা আপন নগ্নতা।
তার নগ্ন দেহে তবু চিক চিক করে বালি, ধূলি রক্তবর্ণা —
আমি তার রঙ থেকে রস নিঙড়ে আনি সূর্যোদয়ে
জীবন জীবন শুধু বাঁচে চারিদিকে
সকল বস্তুতে আলো সকল বস্তুতে আহা অন্ধকার জ্বলে”!
( প্রজন্ম)
খুবই অসাধারণ একটি কবিতা, নীল কৈ:
“ গল্পের শেষ ওরকমটি ছিল না মোটেই, তোমার মনে নেই। সেদিন ছিল রাত্তির-জ্যোৎস্নার। শোনো, আবার বলি, সেদিন ছিল জ্যোৎস্নার রাত্তির-জোনাকিরা কেন যে হঠাৎ আন্দোলনের মতো কেঁদেছিল উথালপাথাল যদিও আমারও আর মনে পড়ে না। তাদের কান্নার জলে চৈত্রেরমাঠ গেল ডুবে। ভেসে এলকোথা থেকে শত শত নীল কৈ-
তাদের নীল ডানা আর লাল দৃষ্টি জ্বলে, জলের ভিতরে। তুমি আমি আর আরো বহু কথা কইনি কোনো সেদিন গেয়েছি গান-সমুদ্রের আকাশের আগুনের। অন্তত তুমি এবং আমি, না জেনে
কী সম্পর্ক সমুদ্রের আর আকাশের আর আগুনের। তারপর থেমে গেল জল-কান্নার-জোনাকির নীল ডানা ও লাল দৃষ্টির জল নেমে গেল-
জেগে উঠল ভূমি।
তারপর বহুদিন আমরা গান গাইনে কোনো শুধু গল্প করি নীল কৈ-নীল কৈয়ের।” ( নীল কৈ)
“ জায়গা ছিল না কোনো কথা বলবার, শুনবার। সমুদ্রের ধারে যেতে পথের বাদাম গাছগুলি মিহি কথার কৌতুকে পাথর ফুলের ধাক্কা দিল আমি কী বলেছিলাম, তোমরা শুনেছ যারা বেশি শোনাবে-একটুখানি। আমি ভুলে গেছি জন্ম আছে। কিছু যন্ত্রণার কথা যেভাবে বলেছি মনে নেই, একটু আনন্দ কথা, রয়েছে গোলাপি স্তম্ভে স্থির অন্ধ থেকে চোখে জেগে সমুদ্রবালির স্তূপে, দেখি।”
(বলবার ছিল)
“ তুমি চলে যাবার পরে সকালে আমিও গিয়েছি তোমার চুলের ছায়ায় ফুলের রেখার টান ছিল। যাওনি অনেক দূরে জানি
আমারও হয়নি যাওয়া বেশি দূর
এক পথের মোড়ের কথা মনে আছে শহরের যেইখানে
রাস্তাটি নদীর মতো বাঁকা
সন্তান ও সন্ততিতে ভাঙা
এবং একা” ( হাওয়া)
আমার কাব্য তৃষ্ণার বুভুক্ষাতে, কবি বিষ্ণু বিশ্বাস সেই চিরন্তন সত্য, শক্তির আলো, মৃত্যু যাকে পরাজিত করতে যেয়ে টেনে নিয়ে গেছে জীবনের অনেক গভীরে, আর তিনি সেখান থেকে আজঁলা ভরে থোড়ায় থোড়ায় সঞ্চয় করেছেন জীবনের অভয় অমৃতকে! যুগ সেরা এ কবি আমার দৃষ্টিতে এক খাঁটি প্রাণ, যে মৃত্তিকার বর্ণে মিশে গেছে প্রকৃতির সব কিছুতে, আর সুধা দিয়েছে কবিতা প্রাণ পাঠককে! যে কবি চলমান সময়ের দাবী মিটিয়ে অযাচিত শব্দ ব্যতিরেকে, দুর্দান্ত বলিষ্ঠ শব্দ প্রয়োগে আঘাত করে ঘূণে ধরা সমাজের লুকায়িত ক্ষতে, আমার কাছে তিনিই সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী একজন সাচ্চা কবি, ঠিক যেমনটি কবি বিষ্ণু বিশ্বাস! তাঁর কাছে মরার খোলস গায়ে জীবিত মানুষগুলো যেন সব অন্ধ – বধির বাদামি লাল নীল লাশ!
“ সূর্য উঠে আসে ঐ যে মতো প্রথম সূর্য পুবের আকাশে অগ্রহায়ণের মতো হলুদ মুদ্রার মতো ঝরে গিয়ে শীতে কুয়াশা হলুদ হয়। বনৌষধি বনেবনে ফুল যত রাতে মরে যায়, স্তব্ধ ঘাসে। শিশিরের হলুদাভ সুগন্ধ বাতাসে।
তখনই প্রতিটি ঘর থেকে মৃত লাশগুলি বের হয়ে যায় পায়ে হেঁটে মৃতেরা বেরিয়ে আসে ঘর গুলি ছেড়ে, তারা হাসে নৈঃশব্দ্যের ভিতরে এবং যত ধূলিবালি ওড়ে, ধূলি, যেন মনে হয়, রাঙা হয় আবিরের মতো সলজ্জায়।
মড়ার খোলস গায়ে জীবিতের বসন্ত উৎসব ও কি! তাই। কিন্তু পাদুকার শব্দ শুধু গমনের-আর নারীর অঞ্জলি জলে ফলে ও পাতায় এক শব্দ এক সুর যায় দূরযায়ী, আর, ওরা, অন্ধ আর বধির বাদামি লাল নীল লাশগুলি।”
( সময়)