একগুচ্ছ কবিতা
অমিতা মজুমদার
হঠাৎ বৃষ্টি
সেদিন ছিল গ্রীষ্মের দুপুর,
হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বেজে উঠল বৃষ্টির নূপুর।
ছিল মিঠে কড়া রোদ্দুর,
বৃষ্টি ধরে আসতেই পুব আকাশে দেখা দিয়েছিল রংধনু।
শিশির দাঁড়িয়েছিল ঠায়,
ছোট্ট বাসা বাড়ির এক চিলতে বারান্দায়।
বছর ত্রিশেক ধরে,
এমন অসময়ে বৃষ্টি এলে শিশির বারান্দায় দাঁড়ায়।
যেন কার প্রতীক্ষায়,
দূর আকাশ পানে চেয়ে থাকে নির্নিমেষ—
মনে মনে আওড়ায়,
এমন হঠাৎ বৃষ্টিতেই তুমি প্রথম এসেছিলে।
কিছু কথা কি হয়েছিল?
নাকি কোনো কথাই হয়নি আজ আর মনে নেই।
শুধু মনে আছে এমন হঠাৎ বৃষ্টিতে তুমি প্রথম এসেছিলে,
বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে আমাদের ঘরে।
সেই প্রথম দেখায়
কী জানি কী হয়েছিল তোমাতে আমাতে,
কথাহীন সে দেখাতে।
তারপর অনেকটা সময়,
আমরা বন্ধু হয়ে ছিলাম।
আমি ভুলে গিয়েছিলাম তুমি মেঘ,
আমি শিশির।
তুমি থাকবে আকাশ জুড়ে আপন গৌরবে,
আর আমি শিশির ঝরে পড়ব মাটির বুকে।
সবাই জানে মেঘ শিশিরের আলাপন এক রাত্তিরের তরে,
ভোরের আলো ফোটার আগেই শিশির পড়বে ঝরে।
তোমার নামের মতোই রইলে তুমি,
দূরে অনেক দূরে যার নাগাল পাই না আমি।
তবুও এমন বর্ষা এলেই মন কেমন করে,
হয়তো তুমি আবার আসবে ফিরে।
বলবে হেসে এই দেখো ঠিক ফিরে এলাম,
না ফিরে কি পারি!
তোমায় যে কথা দিয়েছিলাম।
ক্ষতি
কোনো এক নিশুতি রাতে,
অঝোর ধারায় যখন বর্ষা নামে।
তখন যদি তোমার কথা মনে পড়ে,
খুব কি ক্ষতি হবে ?
বিশ্বসংসার যখন ঘুমে অচেতন,
আধখোলা চোখে জানালা গলিয়ে আকাশ পানে চাইলে কি এমন ক্ষতি!
জোছনায় ভেসে যাওয়া আকাশের দিকে চেয়ে,
তোমার কথা যদি মনে পড়ে যায়—
কিইবা ক্ষতি হবে জগৎ সংসারের?
নাগরিক জীবনে অমাবস্যার বিদ্যুৎ হীন রাতে,
তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে মন যদি বলে ওঠে সব চেয়ে উজ্জ্বল তারাটিই তুমি—
আকাশের কি এমন ক্ষতি হবে?
চৈত্রের বিকেলে আনমনে পথ চলতে চলতে,
হঠাৎ আসা ধুলিঝড়ে চোখে পড়া ধুলিকনায়
চোখ ভরে যায় জলে।
সেই জলভরা চোখ যদি খুঁজে ফেরে তোমাকে,
তাতে কি এমন ক্ষতি?
শ্রাবনের জলকাদা ভরা পিচ্ছিল পথে,
পা পিছলে পড়ে যেতে যেতে–
যদি আঁকড়ে ধরতে চায় তোমার হাত,
তাতেই বা ক্ষতি কিসের ?
শরতের ঘুঘু ডাকা বিষণ্ণ দুপুরে,
লাল হলুদ ফড়িং আর রঙীন প্রজাপতির
পিছুপিছু ছুটতে গিয়ে—-
হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে তোমায় যদি ডেকে উঠি,
তাতেও কি হবে ক্ষতি ?
ভালোবাসার পাত্র
ভালোবাসো নদীকে,
সে বুক দিয়ে আগলে রাখবে তোমায়।
ভালোবাসো পাহাড়কে,
সে স্থির হয়ে থাকবে তোমার সাথে।
ভালোবাসো নীল আকাশকে,
মাথার উপর সে রবে অবিচল।
ভালোবাসো সবুজ প্রান্তরকে,
পায়ের নিচে থাকবে অনন্তকাল।
ভালোবাসো দখিনা হাওয়াকে,
সে করবে না পক্ষপাত।
ভালোবাসো গাছপালা ফুল পশুপাখি,
অসময়ে ছেড়ে যাবে না।
এরা কেউ তোমাকে একলা করে দেবে না,
যদি না তুমি তাদের ছাড়ো।
শুধু ভুল করেও মানুষকে ভালবেসো না,
সুযোগ পেলেই সে ভুলে যাবে ভালোবাসা কারে কয়।
অনাসৃষ্টি
বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়ো,
কায়ার চেয়ে ছায়া বড়ো।
সাধ্যের চেয়ে সাধ বড়ো,
ক্ষমতার চেয়ে হুংকার বড়ো।
বর্ষণের চেয়ে গর্জন বেশি,
কাজের চেয়ে কথার জোর বেশি।
মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি,
নিজের চেয়ে পড়শীর গরজ বেশি।
খাঁটির চেয়ে ভেজালের কদর বেশি,
কখনো কখনো সত্যের চেয়ে মিথ্যের জোর বেশি।
এইযে এতসব অনাসৃষ্টি,
তার মাঝে মানবতাই ঝরায় পৃথিবীতে পুষ্পবৃষ্টি।