You are currently viewing আড্ডার ভিতর থেকে উঠে আসা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বাসনা/ বদরুজ্জামান আলমগীর

আড্ডার ভিতর থেকে উঠে আসা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বাসনা/ বদরুজ্জামান আলমগীর

     ২টি ছিন্নগদ্য

 আড্ডার ভিতর থেকে উঠে আসা
     রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বাসনা
          বদরুজ্জামান আলমগীর

 

দুই পাহাড়ের মাঝে মাওলা 

তাহারা নিদারুণভাবে মানুষের সেবা করিতে সক্ষম হইয়াছেন, ইহাতে তাহাদের জীবন ফুলে ফলে কালে নাকালে অগ্নিজলে কুসুমিত হইয়াছে। তাহারা যে কেবল নিশিপাওয়া, উন্নয়নবিধ্বস্ত বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ঘরে আজীবন মেহমান হইয়া থাকিবেন- ইহা তাহাদের জীবদ্দশায় তিলেকমাত্রও ঠাহর করিতে পারেন নাই; আমি এইবেলায় আমাদের দুই মহীরুহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের বর্তমান ও ভবিষ্য মৃত্যুর কথা কহিতেছি।

তাহারা যে আয়ুর্বেদিক, হেকিমি, এলোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক, তুকতাক, ঝাড়ফুঁক, দারুটোনা- সকল চিকিৎসা পদ্ধতিতেই কুইনাইন বড়ির অকাট্য ক্ষমতায় কার্যকরী হইয়া উঠিতে পারেন- তাহা ভাবিতেই শরীর মন পুলকিত হইয়া ওঠে।

এইক্ষেত্রে অবশ্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাওয়াই অব্যর্থভাবে অধিকতর ফলবান হইয়াছে- বিফলে মূল্য ফেরত দিতে হয় নাই। তিনি জীবনদেবতা কনসেপ্টের মাধ্যমে এমন একটি আয়াশ পরিসর সৃষ্টি করিতে পারিয়াছেন- যাহাতে বাঙালি শিক্ষিত রুচিশীল, সুশীল সমাজের এমন সমূহ আরাম হইয়াছে যে, তাহাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য যে যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন তাহাদের সবই তাহারা নির্বিঘ্নে করিয়া উঠিতে পারেন, সেইসঙ্গে সুরুচিসম্পন্ন নম্র এলিট হইবার ফেসিলিটিও ভোগ করিতে পারেন।

অন্যদিকে কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগতভাবে অমিত প্রতিভাধর হইবার কারণে বাঙালি মধ্যবিত্ত  শিক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায় হিন্দুদের মোকাবেলা করিবার চাক্ষুষ হাতিয়ার হস্তগত করিবার সুযোগ পাইয়াছেন। কিন্তু নজরুলের নিম্নবর্গীয় মানসিকতার কারণে তাহাদের কিছুটা ভোগান্তি সহিতে হইতেছে। নজরুল সৈনিকদের মুখে মুখে সম্পূর্ণ ইচ্ছার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতার জিকির তুলিতে হয়- যদিও তাহাদের সিংহভাগই সাম্প্রদায়িক, ধর্মাচারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য- তাহারা পেটে পোষেন এক প্রকল্প, মুখে উড়াইয়া দেন অন্য কথা।

এই দুই পাহাড়ের মাঝখানে একটি ছোট সম্প্রদায় রহিয়াছে যাহাদের চোখের ঘুম কে জানি হরণ করিয়া নিয়াছে; যাহারা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের আদি পরশ পাথরের পরশ পাইয়াছেন- তাহারা দেখিতেছেন- এই দুইটি মানুষ যতোই বিপুলাকারে চর্চিত ও অনুষ্ঠানায়িত হইতেছেন- তাহারা ততোই দূরে সরিয়া যাইতেছেন, কতিপয় পাহারাদারের হাতে বন্দী হইয়া পড়িতেছেন; তাহারা একোরিয়ামের মাছসদৃশ আয়না প্রাচীরে বেজান গোত্তা খাইতেছেন; তাহাদের কানকো ও গাত্রবর্ণ  ঝকমক করিতেছে বটে কিন্তু ভিতরে পরাণ ফুটিতেছে না।

 

 

বৃক্ষের নাম 

আমার বন্ধু ছদ্মনামে লেখে- লেখক নাম রথীন ঘোষাল, কিন্তু আদতে তার নাম সামিউল ইসলাম, এতোদিন বাদে সে যে সামিউল ইসলাম তা সে নিজেও ভুলে গ্যাছে।

এমন হয় না অনেকসময় যে, মাথায় কতো প্রশ্ন আসে দিচ্ছে না কেউ জবাব তার!

ধরা যাক, এই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- তিনিই, এই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই ছদ্মনামে লিখেছেন- তার নাম কুদ্দুস আলী হাক্কানি, তার সব লেখা, সব কাজ এক্সাক্টলি তা-ই আছে- তাহলে এর কনসিকোয়েন্সটা কী হতো?

অন্যদিকে কাজী নজরুল ইসলামও একটি লেখক নাম বেছে নিয়েছেন, নামটি ধরা যাক পরিমল রায়। তার লেখা, গান, কাজকর্ম যা আছে তাই রইলো- তাহলে তার গুণগ্রাহীদের চালচিত্রটা কেমন হতো?

একদম দিব্যি দিয়ে বলা যায়, তাদের দুজনেরই ভক্ত ও প্রচারকারীর প্রবাহ একইরকম হতো না। আজ যাদের দেখি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্ত্রে, তন্ত্রে, বিস্ময় আর গৌরবে মুহ্যমান এবং  তৎপরতায় অনিরুদ্ধ- তারা কুদ্দুস আলী হাক্কানির জন্য একই ভক্তিরসে জমায়েত হতেন না।

কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও একই সিনারিও হতো বলেই কিড়া কেটে বলা যায়। যারা কবি নজরুলের বাঁশির সুর, তন্দ্রাহীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতার রবে, বিদ্রোহ, ঝড়, প্রেমের ফল্গুধারায় স্নাত ও সামনে আগুয়ান- পরিমল রায়ের পিছনে একই জোস ও অঙ্গীকারে তারা জড়ো হতেন না।

জন্মের পর থেকে শুনে এসেছি : বৃক্ষ তোর নাম কী- ফলে পরিচয়; হাল জমানার দুনিয়ায় তা তো ধোপে টেকে না। আজ প্রশ্ন ও তার উত্তরটি কিন্তু ঘুরিয়ে এভাবে বলতে হবে : বৃক্ষ তোর ফল কী- নামে পরিচয়।।

 

 

বদরুজ্জামান আলমগীরঃ

কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক