গুচ্ছ কবিতা/ শিলু সুহাসিনী
~ বৃষ্টি নিমজ্জন ~
এবার বরষায় বৃষ্টি দিয়া, তোমারে
একখানা ছাতলা বুনায় দেবো।
তুমি দিগভ্রান্ত হয়া
দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াবা।
তুমি বৃষ্টির বেড় পাবা না!
বৃষ্টিতে ভেসে যাবে তামাম দুনিয়া
তলায়া যাবে আসমান, চান, তারা
আন্ধারও হবে দিশাহারা!
অবিরল বরিষিবে জলধারা
বরষা, তোমায় শুধু পাবে না।
তুমি চাতক হয়া জন্ম নেবা।
জন্ম থিকা জন্মান্তর
তুমি বৃষ্টির জন্যে ব্যাকুল হবা
তবু, বৃষ্টি তোমায় ছোঁবে না!
~ গাণিতিক ~
এতোদিনে জেনে গেছি-
কিছু অঙ্কের যোগফল মিলাতে হয় না।
পাটিগণিতের তেল মাখানো বাঁশটা
না থাকলে, আদৌ কি জানা হয়ে উঠতো
কখনো কখনো এক পা আগানোর চাইতে
দুই পা পিছিয়ে আসা কতোটা সুন্দর!
অঙ্কের খাতায় এক দুইটা লাল কালির
দাগ-ও কতোটা অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে
অথচ পৃথিবীর সব সৌন্দর্যের রহস্যে অঙ্ক!
অংক ছাড়া সৌন্দর্য মেলে না, তত্ত্ব মেলে না,
নন্দনতত্ত্ব মেলে না।
তবুও অতদিনে জানা হয়ে গেছে,
অনন্তকাল ধরে অপেক্ষমান যে পথিক
সে-ও জেনে গেছে হয়তো।
কিছু অঙ্ক অমীমাংসিত রাখতে হয়
কিছু গল্প শেষ করতে হয় না কখনো
আরব্য রজনী শাহেরজাদির একেকটা অনিঃশেষ রাত।
~ উপেক্ষানামা ~
তারপর নীল জলে ধুয়ে যায় বারবার
ঋতুবতী উপেক্ষার লাল রঙ।
বাবার শেষ চাহনি ভেসে ওঠে
এক ঝলক কিংবা বারবার
কৈশোরের বালখিল্য
লেপ্টে থাকে শরীরের আনাচকানাচ।
রঙের ছড়াছড়ি ফের
ব্লুটুথ উপছে ভেসে যায় ঘর,
গানে, পুরাতন ঘ্রাণে-
অতঃপর শেষ নাকি শুরু
কখনো শচীন, কখনো সন্ধ্যা
অথবা লারা ফাবিয়ান
কী সিসারিয়া ইভোরা
হঠাৎ বদরুজ্জামান আলমগীর
কখনো জীবনানন্দ দাস
শুধুই অস্থিরতা।
মার্চের শেষ ক’টা দিন
আসে আর ফিরে চলে যায়,
কেটে যায় উন্মূল অব্যাখ্যায়-
উপেক্ষার লাল রঙ
বারবার হাতছানি দেয়
উপেক্ষাই হোক বেঁচে থাকার নাম
এই যে কুহক, মাধুরি প্রণাম।
~ ভিট্রুভিয়ান ম্যান ~
একবার দেখেছিলাম তারে
রেলিঙের ফাঁক গলে চেয়েছিল
হলুদ পাতার ‘পরে
সন্ধ্যার কিছু পর।
সোনালী দুপুর-
পুরোটা দখলে ছিল আর্ট আর
ড্যানিশের শীতল আঙুর।
দ্য বার্থ অফ ভেনাস
অথবা স্কুল অফ এথেন্সের
সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে
পিয়েতা, ভিট্রুভিয়ান ম্যান
কবরের দেয়াল খুঁড়ে
ইজিপশিয়ান কারুকায
কিংবা আফ্রিকার মাস্ক
অথবা বাঙালির আধুনিক শিল্পের জনক
চিনেছিল কি?
সে যে তাহাদেরই লোক!
কালো আলখাল্লা কিংবা
কখনো শাড়ি বেনি রাঁধা বেশে-
বেনু হাতে একেঁছিল- প্রথম বৃক্ষরোপন
নিজেকে সঁপে দিয়েছিল
পশুপাখি বিষধর সাপের কুটিরে-
একবার দেখেছিলাম তারে
চিনেছি কি এতো মানুষের ভিড়ে!
অথবা চিনতে চাইনি আর
ফিরে এলাম,
ফিরে না-দেখার অভ্যাসটুকু সাথে করে।
~ অবশেষে আমি ~
একদিন গোলাপ ছিঁড়বো বলে, সারা শরীরে
কাঁটা বিঁধিয়েছিলাম।
একদিন সূর্য ছোঁবো বলে, সারা গাত্রে
আগুন ধরিয়েছিলাম।
বটবৃক্ষের নাগাল পাওয়ার আশায়, ঘাসের উচ্চতা মেপে গেছি পায়ে পায়ে।
কৃষ্ণচূড়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে, সারা দেহ
সিঁদুরে রাঙিয়েছি অবলীলায়।
সিঁদুরের কৌটো উল্টে ফেলে,
দু’পায়ে অগুনিত ঘাস দলিয়ে,
যখন আমি অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হলাম।
তখন দেখি, আমার শরীরে একটিও কাঁটা নেই।
আমার দু’চোখে গেঁথে দেওয়া হয়েছে, আস্ত গোলাপ।
সেই থেকে আমি জন্মান্ধ হলাম।
জীবনবাবুর দিব্যি দিয়ে বলছি,
এখন আমি, সবচেয়ে বেশি চোখে দেখি।
এখন আমি গল্পে বটবৃক্ষের মতো ডালপালা ছড়াই।
এখন আমি ভালবাসা দিয়ে গোলাপ ফোটাতে
উৎসাহী নই আর।
বরং পৃথিবীর পথে পথে গোলাপের কাঁটা
ছড়িয়ে দিতে উদ্যত।
এখন আমি কৃষ্ণচূড়ার ভাষা পড়ে ফেলতে পারি,
পত্র লেখক প্রেমিকের মতো।
এখন আমি সূর্যকে ধারণ করি বক্ষে।
এখন আমি বোহেমিয়ান এক।
এখন আমি কাঙাল মানুষের ঘৃণার জন্য।
ভালবাসা মানুষকে স্থবির করে দেয়।
ঘৃণা মানুষকে করে তোলে তেজস্ক্রিয়।
তাই, এখন আমি ঘৃনীত মানুষের দলে
যুক্ত হলাম।
এখন আমি, দলিত মানুষের দলে যুক্ত হলাম।
এখন আমি উদ্ধত হলাম, ধৃষ্ট হলাম।
এখন আমি, আমি হলাম।
শিলু সুহাসিনী : শিল্পী। শিল্পবিষয়ক লেখক। একাডেমিক পড়াশোনা- ড্রয়িং এন্ড পেইন্টিং। কেন্দ্রীয় মনোযোগের জায়গা শিল্পে যাপিত জীবন ও সমাজের নানা সংঘাত নিয়ে সমসাময়িকতার চর্চা।
ছাপচিত্র, মনোপ্রিন্ট, পারফরম্যান্স আর্ট, ইন্সটলেশন আর্ট, ভিডিও আর্টসহ নানা মাধ্যমে কাজের অভিজ্ঞতাও আছে। থিয়েটার আর অভিনয় একটি অন্যতম পছন্দের এলাকা। কবিতা পড়া, কবিতা লেখা নিজের মগ্নতা ও নিঃসঙ্গতার সাথে অঙ্গাঙ্গী জড়ানো। দিনকে দিন নারীবাদিতা জীবনের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ এবং ভাবনার বুনিয়াদ হয়ে উঠছে।