সোমেন চন্দ: স্মরণীয় এক বিপ্লবী লেখক
লাবণী মন্ডল
‘…বিপ্লবের জন্য একজন লেখক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আমাদের সেভাবে প্রস্তুত হতে হবে। গোর্কির কথাই চিন্তা করো। শৌখিন সাহিত্য করার আর সময় নেই।’
১০২ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর যে ব্যক্তি মানুষের চিন্তার জগত দখল করে থাকতে পারেন, তাঁকে আর বিশেষ কোনো মহিমায় মহিমান্বিত করার দরকার নেই।তিনি তাঁর কর্মগুণেই আরও হাজার বছর মানবমননে স্থান দখল করে থাকবেন। যতদিন মানবসভ্যতা থাকবে, ঠিক ততদিন।
সোমেন চন্দ। মাত্র ২২ বছর দুনিয়াকে দেখেছেন। এর মধ্যে ১০ বছর ছিলেন শিশু। যখন শুধু ভাবনা তৈরি হয়, কিন্তু সে ভাবনাকে বাস্তবায়ন করা যায় না। তা হলে দাঁড়াল মাত্র ১২টি বছর, এর কমও বলা যায় জীবনকে উপভোগ করেছেন তিনি। আসলে উপভোগ না যন্ত্রণার ‘ভোগ’সেটি তাঁর জীবন-সংগ্রাম দেখলেই আঁচ করা যায়।
একজন ব্যক্তি জীবনের চরম দারিদ্রতার মধ্যে থেকেও লেখকসত্তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত যা ঘটেছে, তাই তিনি কলমের খোঁচায় লিখেছেন। যা একসময় গল্পের রূপ পেয়েছে। যে গল্পই এখন ইতিহাস। এ ইতিহাসকেই আমরা ধারণ করি। নিজেদের ভেতর যে সামান্য লেখকসত্তা রয়েছে, তা জিইয়ে রাখার প্রেরণা পাই—এই মানুষগুলোর জন্য।
২৪ মে, সোমেন চন্দের জন্মদিন। আজ আমরা শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। তবে এটুকু নিশ্চিত যে, তিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় কোথা দিয়ে জন্মদিন গিয়েছে, তা তার ভাবনায় থাকত না। যেখানে ভাবনায় থাকার সুযোগ নেই, সেখানে জন্মদিনের কেউ শুভেচ্ছা জানাবে—এটা ভাবাটাও বোকামি! কিন্তু তাঁর কর্ম পরিচয়ই, আমাদের মতো তরুণপ্রজন্মের মাঝে জাজ্বল্যমান করে রেখেছে জীবনগাথা গল্পগুলো। যে গল্প জীবনের গান গায়, মুক্তির মিছিলে দৌড়াতে প্রেরণা জোগায়। যে গল্প পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয়—আরেহ এ তো আমার গল্প, তিনি কীভাবে লিখলেন!
নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র পরিবারের নিত্যদিনের কথা যখন কারো লেখনিতে পাওয়া যায়, তখন সে লেখা পাঠক লুফে নেয়। কারণ পাঠকের জীবনই তো খুঁজে পায় ওসব লেখা। সেজন্য লেখা যখন জীবনমুখী হয়, তখন পাঠকপ্রিয়তা পায়। কারণ মানুষ সবসময় তার জীবনকে খুঁজে ফেরায়, জীবনের রঙ-বেরঙগুলো নিয়ে কেউ লিখুক, আঁকুক, সিনেমা, নাটক বানাক—এটাই প্রত্যাশা করে।
‘…লাইনের পাশে যাদের বাসা তাদের পালাবার আর অবসর কোথায়? তাদের মুখ চুন হয়ে গেল, কেউ হিন্দুত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে বীরের মতো অগ্রসর হলো। এক রিটায়ার্ড অফিসার ভদ্রলোক একটা ব্যাপার করলেন চমৎকার। বাক্স থেকে বহু পুরনো একটি পাৎলুন বের করে সেটা পরে এবং তার ওপর একটা পুরনো কোট চাপিয়ে এক সুদর্শন যুবকের মতো ওপর থেকে নিচে নেমে এলেন, তাঁর শরীরের ভিতর আগের সেই তেজ দেখা দিয়েছে, যখন ওপরওয়ালা অনেক সাহেব-সুবোকেও বকেঝকে নিজের কাজ তিনি করে যেতেন। সেই দিন আর এখন কই, হায়, সেই দিনগুলি এখন কোথায়। ভদ্রলোক নিচে নেমে এলেন। পাৎলুনের দুই পকেটে কায়দা করে দুই হাত ঢুকিয়ে দুই পা ফাঁক করে গেটের উপর দাঁড়ালেন। ঐ যে, রক্তবর্ণ সার্জেন্টটি এদিকেই আসছে। ভদ্রলোক তার সঙ্গে বড়বাবুসুলভ ইংরেজি আরম্ভ করে দিলেন।
শিক্ষয়িত্রী সুপ্রভা সেনের ব্যাপার আরো চমৎকার। সে তো মেয়েদের কোন ইস্কুলে চাকরি করে। শহর দাঙ্গা-বিধ্বস্ত বলে প্রচুর ছুটি উপভোগ করেছিলো, আজও এইমাত্র দুপুরের রেডিও খুলে বসেছে। ছুটির দিন বলে একটা পান চিবুচ্ছে। ভোরবেলা ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী ছোট ভাইকে গাধা বলে শাসিয়েছে, খানিকক্ষণ গভীরভাবে কিছু ভেবেছে আর এখন বসেছে রেডিওর গান শুনবে বলে। তার চোখে চশমা, একগাছি খড়ের মতো চুল সযত্নে বাঁধা। আঙ্গুলগুলি শুকনো হাড়ের মতো দেখতে, আর শরীরের গঠন এমন হয়ে এসেছে যত্নবতী না হলেও চলে। এমন সময় বাইরের রৌদ্রে গুর্খাদের বন্দুকের সঙ্গীন ঝলমল করে উঠলো, তাদের শ্বেত অধিনায়কের গর্বোন্নত শির আরও চোখে পড়ে এবং বুটের খটখটে আওয়াজ। সুপ্রভা সে আর তিলমাত্র দ্বিধা না করে নীচে চলে গেল, বসনে এবং ব্যবহারে বিশেষ যত্নবতী হয়ে সাহেবের সম্মুখীন হলো।
মুহূর্তে এই গল্প লাফিয়ে চললো এবং সুপ্রভা সেনের অনেক খ্যাতি ও অখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।
লাইনের পাশে কোন বাড়িই থানাতল্লাসীর হাত থেকে রেহাই পেলো না, রাজনৈতিক বন্দীদের বেলায় যেমন থানাতল্লাসী হয় তেমন অবশ্য নয়, তল্লাসী হয় শুধু মানুষের।
ভিতরের দিকে তেমনি ছুটোছুটি, একবার এদিকে একবার ওদিকে। কিন্তু সকলের মুখেই হাসি, বিরক্তি বা রাগের চিহ্নমাত্র নেই। আশোকের দেখে রাগ হলো, এই ব্যাপক ধরপাকড় আর ব্যাপকতর ঘেরাও মানুষের কাছে একটা Sports হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধঃপতন বা পচন একেই বলে।
আশোকের ইচ্ছে হয় চিৎকার করে বলে, ‘আপনারা কেন হাসবেন? কেন হাসছো তোমরা?’
একটা জায়গায় কিছু লোক জমা হয়ে গেলো বটে, কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভেঙ্গে গেল। লোকগুলির মুখে হাসি আর ধরে না। তারা আর কিছুতেই সিরিয়াস হতে পারছে না। আশোকের মনে হলো, এরা একেবারে জর্জরিত হয়ে গেছে।
রাস্তা দিয়ে এক ফেরিওয়ালা যাচ্ছিল পুরনো কাগজের বোঝা নিয়ে। তার পায়ে একটা ময়লা কাপড়ের প্রকাণ্ড ব্যান্ডেজ বাঁধা। সে হঠাৎ থেমে বললে, ‘বাবুরা হাসছেন। হাসুন, আপনাদেরই দিন পড়েছে, গবর্নমেন্টের যেমন পড়েছে। দিন পড়েনি মৃদু আমাদের, আমরা মরবো, মরবো!’
অশোক মন্থর পায়ে হেঁটে বাসায় গেল। এই মাত্র আর একটা ঘটনার সংবাদ পাওয়া গেছে। দোলাইগঞ্জ স্টেশনের ডিস্টেন্টসিগন্যাল পার হয়ে এক বৃদ্ধ যাচ্ছিলো—ঘটনার বিবরণ শুনতে আর ভালো লাগে না। কখনো নিজেকে এতো অসহায় মনে হয়।
আশোকের মা খালি মাটিতে পড়ে ভয়ানক ঘুমাচ্ছিলেন, ছেলের ডাকে ঘুম থেকে উঠে তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, ‘যা শীগগির, বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা বলছি। একশবার বলেছি যে, যা বাপু মামাবাড়িতে কিছুদিন ঘুরে আয়, মারামারিটা কিছু থামলে পরে আসিস, না তবু এখানে পড়ে থাকা চাই, একটা ছেলেও যদি কথা শোনে! মাটি কামড়ে পড়ে থাকা চাই, শহরের মাটি এমন মিষ্টি, না?’
অশোক হেসে বললে, ‘এত কাজ ফেলে কোথায় যাই বলো?’
‘হু’, কাজ না ছাই। কাজের আর অন্ত নেই কী না! তোদের কথা শুনবে কে রে? কেউ না। বুঝতে পেরেছি তোদের কতখানি জোর, কেবল মুখেই পটপটি, হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা।’
‘জানো কংগ্রেস মিনিস্ট্রির সময় কানপুরে কী হয়েছিল? আমরা দাঙ্গা থামিয়ে দিয়েছিলুম।’
মা দুই হাত তুলে বললেন, ‘হয়েছে। অমন ঢের বড় বড় কথা শুনেছি। তোদের রাশিয়ার কী হলো শুনি? পারবে জার্মানির সঙ্গে? পারবে?’
আশোক বাইরের দিকে চেয়ে বললে, ‘পারবে না কেন মা? বিপ্লবের কখনো মরণ হয়?’
মা হাঁ করে চেয়ে রইলেন, একটু পরেই চুপি চুপি বললেন,
‘হ্যাঁরে, একী সত্যি?’
‘কী মা?’
‘ঐ যে উনি বললেন, জার্মানি রাশিয়ার সব নিয়ে গেছে, একেবারে আমাদের দেশের কাছে এসে পড়েছে?’
এমন সময় অজু মানে অজয় এসে হাজির। অজু আশোকের ছোট ভাই। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ‘নবাব বাড়ি সার্চ হয়ে গেছে।’ অশোক চোখ পাকিয়ে বললে, এটি কোথেকে আমদানি, শুনি!’
‘বারে, আমি এইমাত্র শুনলুম যে!’
‘তোমার দাদারা বলেছে নিশ্চয়?’
অজু একজন ‘হিন্দু সোশালিস্ট’। সম্প্রতি দাঙ্গার সময় জিনিসটার পত্তন হয়েছে। এই বিষয়ে শিক্ষা নিতেই সে পাগলের মতো ঘোরাফেরা করে। উচ্চ-স্বরে মানুষের সঙ্গে তর্ক করে, হিটলারের জয়গান করে, হানহানিতেও প্রচুর আনন্দিত হয়।
‘বারে, আমি নিজের কানে শুনেছি। একটা সোলজার আমায় বললে,–’
‘তোমায় কচু বলেছে!’
অজু কর্কশ স্বরে বললে, ‘তোমরা তো বলবেই-’ তারপর মৃদুস্বরে- ‘তোমরা হিন্দুও নও, মুসলমানও নয়-’
‘আমরা ইহুদির বাচ্চা, নারে?’ অশোক হা হা করে হেসে উঠলো, বললে, ‘সার্চ হোক বা না হোক, তাতে Rejoice করবারই বা কী আছে, দুঃখিত হবারই বা কী আছে? আসল ব্যাপার হলো অন্যরকম। দেখতে হবে এতে কার কতোখানি স্বার্থ রয়েছে।’
অজয় চুপ করে ছিলো, সে খুক খুক করে হেসে উঠল।
দুপুর আস্তে বিকালের দিকে এগিয়ে গেল।
অশোক রাস্তায় বেরিয়ে দেখতে পেলো, এইমাত্র পুলিশ তুলে নেওয়া হয়েছে। লোকে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। এই অঞ্চলেরই আধিবাসী যারা বাইরে ছিল, অনাহারে তাদের মুখ শুকিয়ে গেছে, কিন্তু বেশিরভাগ লোকেরই মুখের হাসিটি শুকোয়নি। ভিতরে এবং বাইরে যারা ছিল তাদের সকলেরই অভিজ্ঞতার বর্ণনা চলতে লাগত। ওদিকে দুই গাড়ি বোঝাই ভদ্রলোকদের ধরে নিয়ে গেছে। একজন ভদ্রলোক গাড়িতে বসে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।
‘কার আবার স্বার্থ থাকবে? স্বার্থ রয়েছে হিন্দু আর মুসলমানের।’এই বলে অজয় অন্যদিকে চেয়ে একটা গান গাইতে লাগল।
মা বলে উঠলেন, ‘তোরা ভাইয়ে ভাইয়ে এমন ঝগড়া করিস কেন বলত? আমাদের সময় আমরা বড় ভাইয়ের দিকে মুখ তুলে কথা কইতাম না, মুখে মুখে তর্ক করা দূরের কথা। কিন্তু দাদা আমায় যা ভালবাসতেন। ছোটবেলায় অনেক শীতের রাত্তিরে আমরা এক লেপের তলায় শুয়ে ঘুমিয়েছি।’
অশোক গালে হাত দিয়ে বললে, ‘হয়েছে। এবার ভাইয়ের গল্প আরম্ভ হয়ে গেছে, আমাদের তাহলে উঠতে হয়।’
তারপর আস্তে আস্তে সন্ধ্যা এগিয়ে এল। এবার তবে বাসায় ফিরে হয়। কিছু পরেই সান্ধ্য আইন শুধু হয়ে যাবে। রাস্তাঘাট নির্জন হবার আগে একটা মস্ত ঠেলাঠেলি আরম্ভ হয়ে গেছে। পুলিশগুলি মানুষের শরীর সার্চ করে নিচ্ছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোকেরা একেবারে হাত তুলে দাঁড়িয়ে যায়। এক ভদ্রলোক একটা পেন্সিল কাটা ছুরি নিয়ে ধরা পড়লেন। সকলে তাঁর নির্বুদ্ধিতার নিন্দা করতে ছাড়লো না। ওদিকে সমস্ত দোকানপত্র আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটু আগেও রাস্তার পাশে একটা মেলা বসেছিল যেন, এখন সকলেই শেষ ডাক দিয়ে চলে যাচ্ছে। রিটায়ার্ড অফিসাররা নিজেদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পরম স্নেহের দৃষ্টিতে সেই অস্থায়ী হিন্দু দোকানদারদের দিকে বারবার তাকাচ্ছেন, ওদের এখন পুত্রবৎ মনে হচ্ছে, অথবা যেন বোমা বিধ্বস্ত লন্ডন নগরীর অসংখ্য রিফিউজি।
অশোক বাসার কাছে গিয়ে দেখে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে মা দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে যেতেই বললেন, ‘বাবা আশু, তোর বাবা তো এখনও এল না।’ তারপর ফিসফিস করে-‘তাছাড়া আজ আবার মাইনে পাবার দিন।’
কিছুমাত্র চিন্তার চিহ্ন না দেখিয়ে আশোক তৎক্ষণাৎ বললে, ‘আহা, অত ভাবনা কিসের? এখনও তো অনেক সময় আছে।’
‘অনেক নয় আশু, সাতটা বাজতে আর আধঘণ্টাও বাকি নেই।’
আশোক আবার রাস্তায় নেমে এল, পেছনে ছোট ভাই নীলু মা’র আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। বেলাও মা’র পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাস্তায় ক্রমেই লোক কমে আসছে। যারা কিছুদূরে আছে তাদের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়েছে। কয়েক মিনিট পরেই ছোট ছোট সৈন্যদল মার্চ করে গেল।
আকাশের রঙ ক্রমেই ধূসর হয়ে আসছে। রাস্তা আর দালানের গায়ে ছায়া নেমেছে। বাদুড় উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে।
এই সাতটা বাজলো। আশোক ফিরে এল।
মা এখনো বাইরের দরজায় চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে। চোখ দুটি ভোরের তারার মতো করুণ। ‘আশু, এখন উপায়?’ মা ভাঙ্গা গলায় বললেন। তাঁর চোখ জলে ভরে এসেছে।
অশোক কিছু বললে না। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে খালি তক্তপোষের ওপর শুয়ে পড়ল। তার মুখ কুঞ্চিত হয়ে এসেছে, চোখের ওপর একটা বিষম দুর্ভাবনার চিহ্ন স্পষ্ট। হয়তো একটা কঠিন কর্তব্যের সম্মুখীন হতে চলেছে সে। নীলু তার হাত ডাকলো ‘বড়দা, ও বড়দা? বড়দা, বড়দা গো? বারে, কথা বলে না। ও বড়দা? বারে! বারে!’
নিলু কেঁদে ফেলল, ‘বাবাগো’ বলে নাকিসুরে কাঁদতে লাগল।
ওদিকে মা-ও কাঁদতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। বেলাও তাঁর পাশে বসে দুই হাঁটুর ভিতর মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এছাড়া সমস্ত বাড়ির মধ্যে একটা ভয়াবহ গাম্ভীর্য বিরাজ করছে। অন্ধকার নেমেছে রাস্তায়। ঘরের অন্ধকার আরও সাংঘাতিক। আলো জ্বালাবে কে? ঘরের আবহাওয়া ভুতুরে হয়ে উঠেছে। বাইরে ঘন ঘন বাসের হর্ন শোনা যায়। সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। যেন কোন যুদ্ধের দেশ। অথবা কোন সাম্রাজ্যবাদের শেষ শঙ্খধ্বনি, বার্ধক্যের বিলাপ।
পাশের বাড়িতে ভয়ানক তাসের আড্ডা জমেছে। বেশ গোলমাল শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে আড্ডা ছেড়ে টর্চ হাতে বিমল এল। বিমল ছেলেটিকে ভালোই মনে হয়, কথাবার্তায় অনেক সময় ছেলেমানুষ। অনেক সময় পাকাও বটে। সে বললো, ‘অশোকবাবু, চলুন।’
অশোক প্রস্তুত হয়েই ছিল। খালি পায়েই সে বিমলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বিমল টর্চ জ্বালিয়ে এগুতে লাগল। মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল, কোন পুলিশ আসছে কি না। বাড়িটা বেশি দূরে নয়। অলিগলি দিয়ে নিরাপদেই যাওয়া যায়। বিমল যথাস্থানে গিয়ে ডাকল, ‘সূর্যবাবু? সূর্যবাবু। বাড়ি আছেন?’
ভিতর থেকে আওয়াজ এল, ‘কে?’
‘আমরা। দরজাটা খুলুন।’
সূর্যবাবু নিজেই এসে দরজা খুললেন, হেসে বললেন,-‘কি ব্যাপার?’
বিমল বললে, ‘আমরা আপনার ফোনে একটু কথা বলতে পারি?’
‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।’সূর্যবাবু সাদরে ফোন দেখিয়ে দিলেন। বিমল স্টিমার অফিসে ফোন করল, অনেকক্ষণ পরে কে একজন লোক এসে বলল, ‘সুরেশবাবু কে? সুরেশবাবু টুরেশবাবু বলে এখানে কেউ নেই। ও, দাঁড়ান-দাঁড়ান। ভুল হয়ে গেছে। আচ্ছা ঘণ্টাখানেক পরে আবার আসুন। আমি খুঁজে আসছি।’ বিমল অনেকবার ডেকেও আর কোন উত্তর পেল না। ফোন রেখে অশোকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলুন, আবার আসবোখন।’
অশোক ফিরে এল। দরজার কাছে মার জল-ভরা চোখ ছলছল করছে। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন। অশোক বললে, ‘পরে যেতে বলেছে।’ এই শুনে মা আবার ভেঙে পড়লেন, ভগ্নস্বরে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। মাটির দিকে চেয়ে অশোক মনে মনে বললে, ‘আগামী নতুন সভ্যতার যারা বাজি, তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে আমি যোগ দিয়েছি, তাদের সুখ-দুঃখ আমারও সুখ-দুঃখ। আমি যেমন বর্তমানের সৈনিক, আগামী দিনেরও সৈনিক বটে। সেজন্য আমার গর্বের সীমা নেই। আমি জানি, আজকের চক্রান্ত সেদিন ব্যর্থ হবে, প্রতিক্রিয়ার ধোঁয়া শূন্যে মেলাবে। আমি আজ থেকে দিগুন কর্তব্যপরায়ণ হলাম, আমার কোন ভয় নেই।’
এমন সময় পাশের ঘরে আলো দেখা গেল-আলো নয় তো আগুন। কাগজ পোড়ার গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। অশোক গিয়ে দেখল হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের আবেদনের ইস্তাহারগুলি স্তুপীকৃত করে অজয় তাতে আগুন দিয়েছে। অশোক তৎক্ষণাৎ আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে করতে বললে, ‘এসব কি করছিস?’
‘কী আর করব আবার? মড়া পোড়াচ্ছি।’
‘অজু, তুই ভুল বুঝেছিস। চোখ যখন অন্ধ হয়ে যায়নি, তখন একটু পড়াশোনা কর। তারপর পলিটিক্স করিস।’
‘দাদা, তোমার কম্যুনিজম রাখো। আমরা ওসব জানি।’
‘কী জানিস, বল?’ অশোকের স্বরের উত্তাপ বাড়ল।
‘সব জানি। আর এও জানি তোমরা দেশের শত্রু-’
‘অজু, চুপ করলি?’
অজয় নিজের মনে গুম গুম করলে লাগল।
অশোক উত্তপ্ত স্বরে বললে, ‘ফ্যাসিস্ট এজেন্ট। বড়লোকের দালাল। আজ বাদে কালের কথা মনে পড়ে যখন ‘হিন্দু-মুসলমান ভাই-বোনেরা’ বলে গাধার মতো ডাক ছাড়বি? তখন তোর গাধার ডাক শুনবে কে? পেট মোটা হবে কার? স্টুপিড, জানিস দাঙ্গা কেন হয়? জানিস প্যালেস্টাইনের কথা? জানিস আয়ারল্যান্ডের কথা, মূর্খ!- কিন্তু একটা তীব্র আর্তনাদ শুনে হঠাৎ অশোক থেকে গেল, পাশের ঘরে গিয়ে দেখল, মা আরও অস্থির হয়ে পড়েছেন।’
কয়েকদিন পরে। অশোকে বাইকে চড়ে একটা সাম্প্রদায়িক-বিরোধী মিটিং-এ যোগদান করতে যাচ্ছিল। এক জায়গায় নির্জন পথের মাঝখানে খানিকটা রক্ত দেখে সে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। সারাদিন আকাশ মেঘাবৃত ছিল বলে রক্তটা অত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়নি, এখনো খানিকটা লেগে রয়েছে। কার দেহ থেকে এই রক্তপাত হয়েছে কে জানে? অশোকের চোখে জল এল, সবকিছু মনে পড়ে গেল। সে চারদিক ঝাপসা দেখতে লাগল, ভাবল এই চক্রান্ত ব্যর্থ হবে কবে?’
সোমেন চন্দের ‘দাঙ্গা’গল্পটি থেকে তুলে ধরা হলো। পাঠ করুন, জীবনচরিতকে। শুধুমাত্র শুভেচ্ছাবার্তা নয়, সোমেন চন্দকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ অনুভব করুন। জীবনসংগ্রামে এমন ব্যক্তিত্বকে পাথেয় করেই আগাতে হয়, তা না হলে বারবার হোঁচট খেয়ে, থেমে যাওয়ার ভয় থাকে। যেটি খুব ভয়ংকর। কেননা, মানুষ একবার থেমে গেলে, তাকে আর প্রাণোচ্ছল করে তোলা যায় না। আমাদের সমাজব্যবস্থা মানুষকে থামিয়ে দেয়, অচল করে দেয়। আর এই শিল্পী-সাহিত্যিকরা জেগে উঠার গান শেখায়।
শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণিটাকে নিয়ে যারা শুধু মাতামাতি করেন, লেখালেখি করে বড় গল্পকার হয়ে উঠেছেন; তারা সোমেন চন্দের গল্পগুলোতে হাত লাগাতে পারেন, পড়তে হবে এমন নয়—শুধু উপলব্ধি করুন, জীবনের মানে কী, বিস্তর পাঠকগোষ্ঠী আসলে কী পড়তে চায়? তাদের চাহিদাই-বা কী?
গল্পকার, বিপ্লবী সোমেন চন্দের গল্প আমাকে ভাবিয়েছিল ২০১৫ সালে। যে ভাবনাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে নিতে চাই। বলতে চাই, শোনাতে চাই মুক্তির গান, জনমানুষের কথা।
শুভ জন্মদিন সোমেন চন্দ। আপনি বেঁচে থাকবেন, লড়াকুদের মননে।
লাবণী মন্ডল: লেখক ও প্রাবন্ধিক