হৃদবিজ্ঞানের মোড়
৮টি ছিন্নগদ্য
বদরুজ্জামান আলমগীর
~ মাথার উপর কুপিবাতি ~
আসলে সত্যি কী-না জানি না; আদৌ সম্ভব কী-না তা কোনদিন যাচাই করে দেখিনি।
ঝড় এলে, বিশেষকরে তিনসন্ধ্যায় ঝড় হলে বেশি বিধ্বংসী লাগে: ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহাহুঙ্কারে দুনিয়া লণ্ডভণ্ড হবে সন্ধ্যায়। আগাম মৃত্যুর ভয়ে হয়তো উত্তরপুরুষের জন্য আমাদের গা ছমছম করে।
সন্ধ্যায় গোয়াল ঘরে বাতি দিতে হয়, পড়ার ঘরে পিদিম জ্বালানোর রীতি; কিন্তু বাতি আসে গৃহস্থের বসতভিটা থেকে।
আমাদের শৈশবে সাঁঝের কালে বড়বড় দেমাগি হাওয়া হতো, বাড়ির কিষাণী বলতেন- মাথার উপর কুপি নিয়ে উঠান পার হও। আমরা সত্যিসত্যিই মাথার উপর বাতি রেখে হাওয়াসংকুল উঠান পার হয়ে যেতাম। স্মৃতি বলে ঝড় উঠেছিল, কিন্তু বাতি ছিল যেই-কী-সেই, নিভেনি।
এই প্রতিপক্ষ সময়ের ঝড়ের ভিতর, সংক্ষোভের আস্তরণ চিরে মাথার উপর কুপিবাতি কবি নজরুলকে নিয়ে আমরা উঠান পাড়ি দিই।
শৈশব বলে,স্মৃতির সন্তাপ ও সরলতা কহে- ঝড়ের সাধ্য নেই বাতিটি নিভায়!
~ পানপাতা ক্লাব ~
পানপাতা মাটি ও মানুষের সঙ্গে এক সম্পর্কের সুইসুতা: সাদাত হাসান মান্টোর মুখে পান না হলে বুঝি দেশভাগের ব্যথা-ই বুক চৌচির করে জমে ওঠে না, বারাণসীর মগাই পান ছাড়া কীভাবে গিরিজা দেবী গাইতেন রাগ মিশ্র পিলু- দেবব্রত বিশ্বাসের মুখের পান-ই তো রবীন্দ্রনাথের গানকে বিলের হাওয়া আর হিয়ার তোলপাড়কে এক সম্মোহনে বাঁধে, নজরুলের পানরাঙা ভ্রূক্ষেপহীন মন- বাঁশি আর রণতূর্য ব্যথায়, আগুনে তুড়িয়া বাজায়।
পানই সকল পরাগে বনমোরগের ঝুঁটি, সিঁথির মুখে সিঁদুরে জাগরণ- আর এভাবেই প্রতি প্রত্যূষে লাল মুরাশাপরা সূর্যের উদ্বোধন।
বাঙলায় পানখাওয়া যেদিন থেকে দোষের কাজ বলে সাব্যস্ত হয়েছে, বুঝি বা সেদিন থেকেই হারিয়ে গ্যাছে আমাদের রঙিলা বারই, উঠানে উঠানে উঠেছে অদৃশ্য দেয়াল, কাঁটাতারের বেড়া।
যিনি পানপাতার রঙিন রসে মন, বন উপবন, ব্যথার নিমজ্জন ও বাঙলামেঘের সিঁথিতে সবচেয়ে রাঙা মধুমক্ষিকা সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
যেদিন থেকে রহিত হলো নজরুলের হাসির গমক আর গানের গলা, সেদিন থেকে ঢুকলো এসে উন্নয়ন হরবোলা- কোকাকোলা, কোকাকোলা।
~ নজরুল মুদ্রাদোষ ~
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরেপরেই পূর্ববাঙলা জনপদের একটি আব্রু দরকার পড়ে। সেই আব্রু প্রায় তাৎক্ষণিকভাবেই পাওয়া যায়, এবং তা তাড়াহুড়ো করে টাটকা বাঙলাদেশের উপর চাপিয়ে দিতে তেমন দেরি হয়নি- তার নাম কাজী নজরুল ইসলাম।
মুদ্রাদোষ একটি চাপাপড়া পরিস্থিতির নাম। মনোবিজ্ঞানের অন্বেষায় দেখি- কোন মানুষের মনের মূলে থাকা একটি বাসনা উন্মিলিত হবার পথে যদি প্রাসঙ্গিক পরিবেশ পরিস্থিতির আনুকূল্য না পায় তাহলে তা আবার মনের বদ্ধ কুয়ায় জড়োসড়ো লুকিয়ে পড়ে থাকে। সেই অবদমিত আকাঙ্ক্ষাটুকুই মুদ্রাদোষের নামে বারবার জানান দেয়।
দেখবেন, কখনও কখনও হয়তো দিব্যি একজন কেতাদুরস্ত লোক কারুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রায়শই- কঞ্চি, কঞ্চি বলে উঠলো। বলেই লজ্জা পায়, কুন্ঠিত হয়ে বলে- দুঃখিত, আমি তা বলছি না- এটি আমার মুদ্রাদোষ।
অন্য আরেকজন হয়তো কথার ফাঁকেফাঁকে তার স্বাভাবিক কথার বাইরে বলে ওঠে- রে ভগান, রে ভগান! ভগবানের একটি ভাঙা রূপ।
যার কঞ্চি, কঞ্চি বলার মুদ্রাদোষ – তার মনের গহীন পানের কৌটায় হয়তো একটি আঘাতের কড়া জর্দা লেগে আছে যার সে প্রতিশোধ নিতে চায়।
অন্যদিকে যিনি কথার কিনারে কিনারে রে ভগান, রে ভগান বলছেন- মনের খাস কামরায় একটি আতঙ্ক হয়তো দানা বেঁধে আছে- তারই ফল মনের অজান্তে তাঁর রে ভগান, রে ভগান বলে ওঠা।
মানুষের যেমন মুদ্রাদোষ থাকে- একটি গোটা জনপদেরও থাকতে পারে মুদ্রাদোষ।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে পূর্ববাঙলা জনপদের প্রাণের নিভৃতে স্বাধীনতা, মানবিক মর্যাদা ও সাম্যের বাসনা দানা বেঁধে ওঠে- যা চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে বাস্তবে রূপ নিতে পারেনি।
ফলে, মনের ভিতরে ডাবের নরম আকুতি বাইরের সমাজ রাষ্ট্রের শক্ত আবরণের নির্দয়তার মুখে পড়ে যে ছলকে ছলকে ওঠে তা-ই সবার মুখে নজরুল নজরুল বলার মুদ্রাদোষের ভিতর দিয়ে অভিব্যক্ত হয়।
~ আমি লোকালয় ~
তাঁর সংক্ষিপ্ত দীর্ঘ জীবনে আরাম করে একখিলি পান চিবানোর সুযোগও পাননি।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন নিজের হাতে ছিলেন তখন দারিদ্র্য তাঁকে বেজান তাড়িয়ে নিয়ে গ্যাছে- পাড় সিনেমাতে নাসিরউদ্দিন শাহ যেভাবে শূকর দাবড়ে নিয়ে যান, সেই রকম; আবার নজরুল পরোক্ষে বেঁচে থাকার কালে তাঁর মধ্যস্থতাকারী অসাম্প্রদায়িক কবিরাজি গুণ তাঁকে সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত করে রাখে।
১৯৭১ সনে এক রক্তগঙ্গা পেরিয়ে পূর্ববাঙলা স্বাধীন হয়ে বাঙলাদেশ নাম পরিগ্রহ করার পরও সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পায়ের নিচে মাটি সরে যেতে থাকে- আস্তে আস্তে ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি বা পাজামা পরে বাজারে আসতে থাকেন সীতানাথ সাহা, প্রমথনাথ রাউত- কবিতা লেখে যে ছেলেটি- অধিকতর বাঙালি হয়ে কী তার নামটি বদলে পথিক রাত হয়ে যায়?
কলেজে পড়া মেয়েটির নাম প্রতিমা কর্মকার রুমালি- তাকে জিজ্ঞেস করা হলে কেবল নামের শেষ অংশটুকু বলে- রুমালি। ইশকুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সুরা ফাতেহা পাঠের পর শ্যামল গোস্বামীকে গীতার স্তোত্র পাঠ করতে বললে শ্যামল গোস্বামী বলে, এইমুহূর্তে শ্লোকটি মনে পড়ছে না, বাদ দেন।
ঢাকা শহরে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, হিন্দু, বা যে-কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্র ভীষণ তৎপরতার সঙ্গে সমাবেশে নিরাপত্তার জন্য সশস্ত্র পুলিশ, এমনকী আরো চৌকস বাহিনী মোতায়েন করে।
বাড়ি ফেরার পথে সরকারি দলের লোকটা বলে- ভয় পাইও না, তাড়াহুড়া করার কিছু নাই- আমরা তো আছি। বাড়িঘর, সয়সম্পত্তি ছাড়ার সময় অন্য কারো কথা ভাইবো না, হে হে, তোমাদের অর্চনা তো ঢেকুর দিয়া উঠসে দেখি!
পাকিস্তান খেদানোর লড়াইয়ে জুম চাষী, ক্রসচিহ্ন, নির্বানিয়া বোধিবৃক্ষ, ওঁম শান্তি, বাঁকা চাঁদ- সবার সমন্বিত দাবড়ানি দরকার ছিল। এখন এতো ঝামেলার দরকার কী- এবার একটু ডিসিপ্লিন আনা জরুরি।
সশস্ত্র বাহিনীর ট্রেনিঙে একজন ননকমিশণ্ড অফিসার কমিশণ্ড অফিসারদের ট্রেনিং দেন। ট্রেনিং শেষ হবার পর প্রশিক্ষক তাঁর বেজপ্রাপ্ত অফিসারকে স্যালুট দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করে আস্তে দূরে সরে যান।
আন্তোনিও গ্রামশি প্যাসিভ রেভ্যুলেশন বলতে যা বলেন- পরিস্থিতিটা সেভাবে মূল লড়াইকারীদের কাছ থেকে ক্ষমতা, দল ও রাষ্ট্রের কাছে পুঞ্জিভূত হবার অনিবার্যতা সদ্য স্বাধীন বাঙলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় একইভাবে সত্য হয়ে ওঠে।
ভাঙা সাঁকোর উপর একটি বাঁশের টুকরা কাজী নজরুল- যাকে দিয়ে ভাঙা পুল জোড়া লাগানোর সৌজন্য দেখানো হয় মাত্র- তা কার্যত কোন কাজে আসেনি। জনপদের প্রত্যাশা আর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বে যে অমোছনীয় ফারাক তা-ই আমাদের ললাটে এনে দেয় জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলার সৌখিনতা, আর একইসঙ্গে শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকার চরদখল।
বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের শুরুতেই তার গেরোয় গেরোয় যে অসঙ্গতির ব্যথা ছিল তার উপর ঘষে ঘষে লাগাতে থাকা মলমের নাম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
নজরুলের নিজের দরকার ছিল আমাদের স্বপ্নের মধ্যে বেঁচে থাকা, কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য অবিরাম প্রয়োজন পড়ে তাঁকে অক্সিজেন সিলিণ্ডার হিসাবে রোগীর শিয়রে রাখা।
তাই ৭২সনে নজরুলকে ভারত থেকে বাঙলাদেশে আনবার সময় ব্যাপক তাড়াহুড়ো ছিল, আবার ৭৬সনে তাঁকে বাঙলাদেশের মাটিতে চটজলদি সমাহিত করারও আশু প্রয়োজন পড়ে।
এ-বেলায় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথাটিই মনে পড়ে যায়– কে কোথায় ঘুমায় তা বড় কথা নয়, কে কোথায় জেগে থাকে সেটিই আসল কথা।
কাজী নজরুল ইসলাম বাঙলা জনপদে আকাঙ্ক্ষার অপূর্ণতায় জেগে আছেন!
~ ঝরোখার উপরে আয়না ~
হাসির গমকে, ব্যথার নিরলে তিনি ফুটে থাকেন মর্মের গোলাপ, গরুর চোখের মায়ায় বয়ে চলা এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি- আর হাতে রণতূর্য!
তিনি কথা ও সুরে ফুল ফুটানোর বীজধ্বনি, অমৃত টঙ্কার -এই এক কবি, এমন এক মানুষ সুরই যাঁর ইমান, তিনি সুরের কৃষিজীবী- নিয়ত বপন করে যান সুরের বীজ ধান – মনসাধু তার উজান ও ভাটির ব্যাপারী।
গালাগালিকে গলাগলিতে রূপান্তর ঘটানো তাঁর সর্বৈব সাধনা। মন তাঁর গণিত ও বিজ্ঞান, মনই তাঁর ধর্ম এবং ভাষাতত্ত্ব, এই মন পাতায় মোড়া। বুকে আছে ময়না পাখির বাসা, মুখে রসালু পানপাতা। তাঁর বিচারে ক্বলবেতে তুলে রাখি নাম সর্বোত্তম, নমঃ নমঃ নমঃ বাঙলাদেশ মম।
তিনি কেবল গালভরা বুলি আর জাতীয় কবির রঙিন ফানুসমাত্র নন, তাঁকে বানাতে হবে আমাদের ঝরোখার উপরে আয়না- যেখানে পুরো জাতিগোষ্ঠির মুখচ্ছবি প্রতিবিম্বিত হয়ে ওঠে। খেজুর ভেবে তাঁকে নিয়ে হৈহুল্লোড় ও মাতামাতি করা হয়, কিন্তু আসলে তিনি খেজুর নন- হরতকি, প্রথম গ্রহণে তেতো ও কষাকষা – যাকে সর্বতো বরণ করতে পারলে সবকিছুই স্বাদে উত্তুঙ্গ হতে পারে।
আমাদের জাতিসত্তার এমন একটি খাঁটি বিন্যাস জরুরি যাতে কৃষ্ণ মুহাম্মদের ইচ্ছামৃত্যু ঠেকানো যায়।
দুঃখের গহনে ডুবে, বীরত্ব বিনয়ে,ক্রোধ ও কৌতুকে, সাম্য আর সৌহার্দ্যে, কোমলে-কঠিনে, ধর্মে কর্মে, সংকল্প আর প্রেমে, দেশজতা এবং আন্তর্জাতিকতায়, অহম ও নিরহঙ্কারে, তেজে আর মরমিয়ায়, নুনেতে- ভাতেতে, কল্পনায় ও মাটিতে, সিঁদুরে ও নোলকে, পাহাড়ে আর ঢালুতে, সহজতম গভীরে মুক্তির সংগ্রাম এবং চেতনাকে সমুন্নত ও কার্যকর রাখার জন্য আমাদের একটি বস্তুনিষ্ঠ ও সংবেদনশীল সংবিধান দরকার।
সেই সংবিধানের নাম কাজী নজরুল ইসলাম!
~ মেঘে মেঘে অন্ধ ~
কবি নজরুল সারাজীবন বাইরে বাইরে ছিলেন। অথচ তাঁর ঘরে ফেরার ব্যাকুলতা ছিল বিপুল। ছাউনীর ঘর নয়, তিনি সাধারণ্যের বুকের ভিতর খুঁজেছিলেন ময়না পাখির বাসা।
এ-সামান্য চাওয়ার অসামান্য তৃষ্ণা তিনি বলে যান গানে, কবিতায়, নাটকে, উপন্যাস, গল্প ও টালমাটাল গদ্যে। সম্পর্ক, সামাজিক প্রতিকল্প ও তাঁর মুক্তির সংকল্প কখনো বাঙময় হয়ে ওঠে রাজনৈতিক দাবির নামে; প্রেমের বিহ্বলতা প্রত্যাখ্যানের লজ্জায় জমাট বাঁধে চারণ কবির বিষাদে, তিনি সবার দুঃখ আলগোছে তুলে নেন নিজের হৃৎকমলে!
আমরা অতঃপর আর তাঁর সমুখে ভাঙা, নৈর্ব্যক্তিক, নীরক্ত, অনাবেগ থাকতে পারি না- সমূলে দুলে উঠি নিবেদন, প্রতিক্রিয়া ও ঔপনিবেশিকতার বাইরে নির্ভরতার দর্শনে এসে জড়ো হই; তাঁর কাছে হারিয়ে যাওয়া সহমর্মিতার তালাশ করি,বিশ্বাস আর বৈচিত্র্যপূর্ণ নতুন সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রত্যয়ে প্রাণাতিপাত করি।
দিনশেষে নজরুল নাম রত্নখনি খনন করে আমরা একটি মর্মের বাণী শুনি: সারল্য ও বিশ্বাসের স্থাপত্য কীভাবে জীবনে প্রকৃত আনন্দ নিশ্চিত করে; মাথা উঁচু না করে পরাধীনতার কাছে নতি স্বীকার করে নিলে তার চেয়ে বড় পাপ আর কিছু নাই।
জীবনের সহজ অভিধানখানি আসলে অ্যা জার্নি বাই হার্ট; মনুষ্যশিল্পের সাফল্য তখনি শতভাগ খাঁটি যদি আমরা সামান্য আহারটুকু সবাই মিলে ভাগ করে খাই; তীর্থযাত্রা প্রাত্যহিক; ধুলার মাঝে সে-ই গড়ে ময়ূর সিংহাসন- মানুষগুরু নিষ্ঠা যার!
~ মৃত্তিকাবতী কাসাসুল আম্বিয়া ~
বাঙলার মির্জা গালিব কাজী নজরুল ইসলাম মরমিয়া, ও কামাল পাশা; ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহাহুঙ্কার, পিনাক পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড,আর অতিঅবশ্য কৃষ্ণের বাঁকা বাঁশরি; তাঁর ঠাট্টা, উচ্চ হাসির গমক, সৈনিকী সাহসের ভিতরেও এক জলমগ্ন ব্যথার ছটফটানি বালুকারাশি বুঝি- যা পোড়ে, কিন্তু নিরন্তর ঝিকমিক করে।
নজরুল কাণ্ডজ্ঞানের লেখক: কেউ সংকীর্ণ চাষাভুষা অর্থে তার এমন তাফসির করতে পারেন। কিন্তু আদতে তিনি একটি ঔদ্ধত্যের নাম; তিনি ঔপনিবেশিক কোঠারি জ্ঞান, কাব্যবোধ, শিল্পবুলি, নামতা, গণিতের ধার ধারেন না- সাচ্চা অর্থেই এক বাঙলা পাঠশালার ছাত্র।
নজরুলের ব্যক্তিত্বে স্বভাবকবির বীজানু স্পষ্ট, কিন্তু তিনি স্বভাবকবি নন- বলতে পারি, স্বতঃস্ফূর্ত কবি। যাঁকে আমরা আন্তোনিও গ্রামসিউত্তর কালে অর্গানিক বুদ্ধিজীবী বলি- কাজী নজরুল ইসলাম সেই অর্থে একজন অর্গানিক বুদ্ধিজীবী। তিনি কেবল ছন্দে সূত্রে মিলানো কবিমাত্র নন- নিরন্তর সমাজ ও রাজনৈতিক চিন্তক- নির্ভীক বুদ্ধিজীবী।
তিনি তাঁর শ্রেণীর সঙ্গে কথা দিয়ে কখনও কথা ফেলে দেননি: থামতিহীন নিম্নবর্গের মানুষের সাহিত্য করেছেন, কিন্তু এই লেখাকে সিলমোহরাঙ্কিত মার্কসবাদী সাহিত্য করে তোলেননি, আবার মার্কসবাদের প্রতিপক্ষও নয়। তাঁর কথা ও লেখায় অনেক ইসলামী শব্দ, প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ থাকলেও সেগুলোকে ইসলামি সাহিত্য বলা যাবে না; একইভাবে হিন্দুয়ানি শব্দ, পুরাণ এবং উপনিষদসূত্র থাকলেও তাঁর রচনাকীর্তি হিন্দুত্ববাদী সৃষ্টিসম্ভার নয়- বরং তাঁর লেখা এক সহজাত অন্তরমথিত দরদী ধারা; তা কারো আদেশ পালনকারী দস্তাবেজ হয়ে ওঠেনি- হয়েছে খোলা প্রান্তর; বইয়ের পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাঁজ থেকে এ-লেখা বেরিয়ে আসেনি, এসেছে তাঁর মনমনুরার রঙধনু থেকে: এভাবেই তিনি বাঙলাচরিতের শীর্ষতম বিন্দুটি স্পর্শ করেন।
পথ থেকে, পরিত্যক্ত লোকালয় আর রোদে-বৃষ্টিতে পোড়া মানুষের ক্ষত থেকে, তাদের না-বলা শত রূপকথা উপকথার প্রাণভোমরা যত্নে নিয়ে, মনের জাল ফেলে নজরুল তুলে আনেন হৃদকমলের আয়নামহল, ক্রোধ ও কৌতুক, সংকল্প আর গোঙানি; এভাবেই তাঁর হৃদয় পিছিয়ে পড়া মানুষের রক্তক্ষরণের আলতা- সবুজে ও পিঙ্গলে, বহুবর্ণিল সুরের বয়ান- মৃত্তিকাবতী কাসাসুল আম্বিয়া।
~ হৃদবিজ্ঞানের মোড় ~
একজন কাজী নজরুল ইসলামকে বাঙলা তো বাঙলা, গোটা দুনিয়ার অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কী-না তা শতভাগ নিশ্চিত করে বলতে পারা প্রায় দুঃসাধ্য।
ওয়াল্ট উইটম্যানের দরকার ছিল গণতন্ত্র, পাবলো নেরুদা আরাধ্য করেছিলেন সাম্যবাদ, দান্তের বাঞ্ছা ছিল ক্যাথোলিসিজম, রবীন্দ্রনাথের প্রকল্প ছিল ব্রাহ্ম সমাজ, লিঁও টলস্টয়ের রোখ ছিল খ্রিস্ট ধর্মীয় মূল্যবোধ, আনা আখমাতোভা চাইছিলেন ব্যক্তিস্বাধীনতার মুক্ত পরিসর, কিন্তু আমাদের কাজী নজরুল ইসলামের বাসনা ছিল একটি অর্গানিক প্রাণের বিশ্বপাড়ার অধিবাসী হওয়া।
১৯২৪ সনে প্রমীলা সেনগুপ্তকে বিয়ে করার সময় কাজী নজরুল পণ করে বসলেন যে তিনি প্রমীলাকে ধর্মান্তরিত করাবেন না, যা চাইলে তা অবলীলায় পারতেন; কেননা গিরিজা বালা দেবী নজরুলের দাবি বিনা তর্কে মেনে নিতেন। প্রমীলা সেনগুপ্তকে ধর্মান্তরের চেষ্টা না করে নজরুল বরং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বেদ-কে ঐশী কিতাব হিসাবে গ্রহণ করার পক্ষে যুক্তি উত্থাপন করেন, এবং তারই জয় হয়। তিনি বলেন- কেবল তওরাত, জাবুর, ইঞ্জিল, কোরানই নয়- বেদও পবিত্র গ্রন্থ; তাই বেদাধীন মেয়েকেও একজন মুসলিমের পক্ষে বিয়ে করা ন্যায্য অধিকারের মধ্যে পড়ে।
এমন যে অসামান্য নজরুল তিনিই আমাদের মাথার তাজ ও গলার কাঁটা। এ-কারণেই নজরুল মাজারের অনেক ব্যতিব্যস্ত খাদেমকে দেখি তলেতলে কবি’র মুসলমান নামটিকেই রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ বানান, আর প্রতিযোগিতার আনন্দে ঢেঁকুর তোলেন।
আমরা যে ব্ল্যাক লাইভস মেটারকে সমর্থন করি, আমরা- আমাদের সন্তানেরা বার্নি স্যান্ডার্সের জন্য রাস্তায় নামি, ইউক্রেনের উপর আক্রমনে প্রাণ কেঁদে ওঠে আমাদের, ফিলিস্তিনের গৃহহীন শিশুটির জন্য রাত্রি জাগি, কী আমরা শতকরা ৯৯ভাগ হয়ে ন্যায্য দুনিয়া চাই, দেশে দেশে পুঁজিবাদী আগ্রাসনের নিপাত দাবি করি- সেই পরাণের গহীন ভিতরে একটি নামের মন্ত্র বুঝি আছে- সেই নাম কবি নজরুল- কাজী নজরুল ইসলাম।।
বদরুজ্জামান আলমগীর: নাট্যজন, কবি ও অনুবাদক