নতুন করে হারাই বলে
বদরুজ্জামান আলমগীর
ব্যক্তির পূর্ব-পশ্চিম
তার আগে প্রথমেই বাতিল করে নিই সেই পুরাতন কূটচাল : জলের উপর পানি না-কী পানির উপর জল; তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালি জাতিসত্ত্বার ভিতরমহলে আলো ফেলে আমাদের জন্য তুলে আনেন সহজ প্রণম্য সারবস্তু যে অর্থ করে এক ও অদ্বিতীয় – সত্য ঘোরনিষ্ঠা- প্রিয়তম জীবনসুষমার জয়ধ্বনি আর কলকাকলি; হীনমন্যতার সাধ্য কী মুহূর্তলাগি কালি ফেলে জীবনমাধুরী পটে।
মিথ্যা আর পুরাতন গ্লানির ক্ষমতা-ই নেই পথ আটকে দাঁড়ায় আনন্দকল্যাণ অভিযাত্রার মুখে- তিনি রবীন্দ্রনাথ জাদুকরি হাতের স্পর্শে আমাদের ভাষায় প্রতিষ্ঠা করেন নোতুন প্রাণের উৎসার, হৃদয়ের যতকথা মেঘ ও রৌদ্রের কলহাস্যে গুঞ্জরণ করে, দুঃখ ফোটে বসন্তদিনের নিদারুণ কল্লোলে; যে-ভাষা চমকায় প্রকৃতির সহজিয়া বিস্তারে, তিনি সেই ভাষায় মন্ত্র শোনান পাশ্চাত্য অন্ধগতির কানে কানে।
জাতীয়তাবাদী গণ্ডারী ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসা ব্যক্তিকে তিনি দেখতে চান সহমর্মিতা আর সংবেদের মনকড়ায় বন্দীবিলাসে মুক্ত; রবীন্দ্রনাথ চান প্রাণহীন পশ্চিমা ক্ষিপ্রতার গোঙানির জায়গায় ফুটে উঠুক মননের গৌরব, প্রাচ্যের স্থবির সংস্কারে চনমনিয়ে উঠুক গতির টঙ্কার, মর্যাদাবান ব্যক্তির বলিষ্ঠ জাগরণ তাঁর সর্বৈব সাধনা- তাই আজো কে থাকে ঘুমের ভিতরে নিষ্প্রাণ জড়, তাঁর আমূল সুরে ও প্রাণে চিত্তের মিলনযাত্রায় অর্ধব্যক্তিরা আড়মোড়া ভাঙে, নিসর্গও কাতরায় বুঝি প্রত্যুষের দিকে-
একাএকা মর্মরধ্বনি জাগে মনে ও মেঘে, ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় তাহারই চিহ্ন পড়ে!
নতুন করে হারাই বলে
অনেককেই জানি, যারা রবীন্দ্রনাথের আলোকধারায় জীবনে পথ চলেন, তারা রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্রে রেখে সম্পূর্ণ জীবন বিন্যস্ত করে তোলেন। এই কথাটির বাস্তবিক অর্থ কী- তা অবশ্য খুঁজে পাওয়া খুবই মুশকিল।
উদাহরণ হিসাবে দাখিল করি : আমি এমন একজন শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মানুষকে জানি- যিনি জীবনের ভরা যৌবনকালে প্রেমে পড়েছিলেন। এবং তাঁর প্রেয়সী তাঁকে শ’ খানেক প্রেমপত্রও লেখেন- যার প্রতিটিই ছিল চিঠির বদলে রবীন্দ্রনাথের একেকটি গান। শেষাবধি ভদ্রলোক ওই সম্পর্ক থেকে পালিয়ে আসেন।
পরে অনেকটা আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার আদলে প্রেমিকপ্রবর কহেন- ওখানে লম্বা লম্বা গানের বাণী ছিল, অতি দূরবর্তী উতল হাওয়া ছিল- কিন্তু কোনভাবেই আমি ছিলাম না, না ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কী ওই দয়িতা নিজে। যা ছিল- তার নাম মহীয়ান নামতা।
পলাতক শ্যামপ্রেমিকরাজ আরও বলেন- রবীন্দ্রনাথ অনেক বড়, কিন্তু আমার সামান্য জীবন থেকে বড় নন, আমার গোটা জনপদ যতোই পশ্চাৎপদ হোক- সেই জনপদ থেকে বড় নন। কেউই এভাবে বড় নন- না কার্ল মার্কস, না মাও সেতুং, আব্রাহাম লিঙ্কন, না রবীন্দ্রনাথ, না গৌতম বুদ্ধ- কেউ না।
আমরা রবীন্দ্রনাথকে বাজারে তুলি, তা-কে ভাঙিয়ে বড়াই করি, কিন্তু উদযাপন করি না- সে জীবন যাপন করি না- যাতে তিনি মর্মের গোপনে থাকেন, তাঁকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফুলের বহু মনকাড়া বর্ণে উপস্থিত করি, কিন্তু আসলে তিনি ফুলের গন্ধে হাজির।
আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়। বাস্তব জীবনে যদি ঘনঘোর, স্পর্শকাতর বিহ্বলতা না থাকে- তাহলে ওই রোমান্টিক গান- সকল সুসমাচার, উঁচু উঁচু কোটেশন সবই কুঠারাঘাত, শিলাবৃষ্টি- তা সে যে নামেই বর্ষিত হোক।
ধূলার প্রতিভা
গোড়ায় হাত দিলে যা উন্মোচিত হয় তার নাম পরিচয়ের সংকট।
বাঙালি হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের পরিস্থিতি শহুরে মানুষের ভূতে অবিশ্বাসের মত বিশ্বাস। আধুনিক নগরবাসী মানুষেরা থিউরিটিক্যালি ভূতে অবিশ্বাস করে, কিন্তু তাকদের ভিতর ভূতের ডরে গোপনে শিউরে ওঠে; অন্যদিকে গ্রামের মানুষ ভূতে অহোরাত্রি বিশ্বাস করে, কিন্তু নির্ভয়ে পাড়াপ্রতিবেশীর মত মিলেমিশে থাকে। বাঙালি হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমানের ঐক্য ও দূরত্ব এমনই এক সহজ ও কঠিন সমীকরণে বাঁধা।
দুর্ভাগ্যক্রমে শহরাভিমুখী এবং নাগরিক মানুষ ও তাদের সাংস্কৃতিক সিদ্ধান্তই হাল জমানার নিয়ামক নির্ধারণী। তাঁদের বোধবুদ্ধি উচ্চ মার্গীয় আর একোরিয়ামের লালনীল মাছেদের কিংখাবে ঝলমলে। কিন্তু জীবনের প্রকৃত গতিমানতার সঙ্গে তার কোন যোগ নেই।
দুই পক্ষই নিজেদের কেটে খণ্ডিত করে, আর পূর্ণতার জৌলুসে ডিগবাজি খায়। হিন্দু সম্প্রদায় রামায়ণ – মহাভারতকে আমাদের পূর্বপুরুষদের মহাকাব্যের বদলে ধর্মগ্রন্থ হিসাবে কুক্ষিগত করে নিজেদের খণ্ডিত করে; অন্যদিকে মুসলমানকূল রামায়ণ- মহাভারতকে হিন্দুদের সম্পত্তি ধরে প্রত্যাখ্যান করে পূর্বপুরুষের কল্পনাপ্রতিভার মহাযজ্ঞ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকেও তাঁদের নিজস্ব চরিতে উৎসারিত হতে দেওয়া হয়নি। হিন্দু সম্প্রদায়, বিশেষ করে ভারতীয় সনাতনী সমাজ রবীন্দ্রনাথকে রক্তমাংসের কবির সংবেদ থেকে তুলে নিয়ে নীরক্ত দেবতার আসনে ঝুলিয়ে রাখে; নজরুলকে দ্বিতীয় শ্রেণির কবি হিসাবে কোঠাবদ্ধ করে। তাঁদের মহীয়ান সীমাবদ্ধতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ও একচ্ছত্র কলকাতা নগর।
অন্যদিকে বাঙলাদেশে রবীন্দ্রনাথকে প্রকৃত প্রস্তাবে হিন্দু মনীষার উচ্চাসন চিলেকোঠার ঘেরাটোপে আবদ্ধ করে রাখে, নজরুলকে ডাহা অজ্ঞতায় কবি খলিফা হিসাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে গ্রহণ করে- কিন্তু প্রকৃত ও সম্পূর্ণ নজরুলকে বরণের সাহস ও ঝুঁকি নেবার ব্যক্তিত্ব অর্জন করে ওঠেনি। তাঁদের সরব অক্ষমতা- নীরবতার অভাব, ও মুখস্থ ধর্মের বড়াই।
আধুনিক পশ্চিমা কৃৎকৌশল এই ব্যাধির দাওয়াই দিতে অপারগ, তাদের বড়বড় গোঁফ মোচড়ানি আর ডৌল নকশায় রোগীর অবনতি বৈ একতিল অগ্রগতি হয়নি। তার জন্য দরকার বাঙলার সহজিয়া লোকজ ধন্বন্তরি!
বাসুদেব বাউলের কন্ঠে শুনি এমনই এক বিজ্ঞানের অধিক লৌকিক পানিপড়া, নিগূঢ় ঐক্যের লেনদেন এবং নৃতাত্ত্বিক পরম্পরা :
মরুতে এলেন মুহাম্মদ, মথুরাতে এলেন শ্যাম; ইমান খেলা খেলে রসুল, লীলা খেলে ঘনশ্যাম!
রবীন্দ্রনাথের ইমাম মেহেদি
সভ্যতার সঙ্কট লেখাটায় রবীন্দ্রনাথকে বেশ বিচলিত লাগে। মাঝেমাঝে নিজের প্রতি তাঁর ক্ষুব্ধতাও আমাদের চোখ এড়ায় না। তিনি যে ইংরেজকে আশীর্বাদ মনে করেছিলেন তার ভিত্তি ছিল ইংরেজি সাহিত্যপাঠ। সাহিত্যপাঠের ভিতর দিয়ে তাঁকে সামাজিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছিল- পঠন পাঠনে তাঁর কাছে ইংরেজদের মনে হয়েছিল আশার বাণী, মুক্তির দূত।
আমরা দেখি তিনি এখানে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই মুসলমানদের প্রসঙ্গ টেনে কথা বলেছেন,বারবার বলছেন। সোভিয়েত দেশে মুসলমান, পারস্যের মুসলমান প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে সভ্যতার সঙ্কটে বারবার মুসলমান প্রশ্নটি এমনভাবে এনেছেন- যারমধ্যে একটা তাড়াহুড়ার প্রশ্রয় আছে।
এখানেই দেখা যাচ্ছে, ইংরেজকে তিনি খ্রিস্টান বলছেন।পুরো ব্যাপারটি দেখে অনুমান করা যায়, মুসলমান প্রশ্নে তাঁর মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল।
একইরকম অস্থিরতা রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ গল্প- মুসলমানীর গল্প- যা মৃত্যুর ৬সপ্তাহ আগে লেখা হয়েছিল; ঠিক লেখা হয়নি- তিনি বলেছিলেন, যার শ্রুতিলিখন করা হয়েছিল।
ওখানেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বভাবের তুলনায় ডেসপারেট। বিয়ের পর স্বামীবাড়ি যাবার পথে মধুমোল্লা ডাকাতের হাতে পড়ে হিন্দু ব্রাহ্মন ঘরের মেয়ে কমলা সবকূল হারায়। ডাকাতির পর কমলা কাকার ঘরে ফেরত যায়, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই তার ওখানে ঠাঁই হয়নি। ঠাঁই যে হবে না হবির খাঁ আগে থেকেই জানতেন।
হবির খাঁ কমলাকে বিনা দ্বিধায় নিজগৃহে নিয়ে আসেন। কমলা হবির খাঁ’র বাড়ি এসে দেখে মুসলমানের বাড়ি হলেও এখানে নামাজের ঘর পাঞ্জাখানার চেয়ে অধিক সৌম্য মর্যাদায় শিব ঠাকুরের পূজার ঘর বিন্যস্ত।
রবীন্দ্রনাথ যেমন হিন্দু হয়েও ঠিক হিন্দু নন- হবির খাঁ-ও তেমনি মুসলমান হয়েও ঠিক মুসলমান নন; তাঁর জন্মকূলের দিক থেকেও অর্ধেক মুসলমান, অর্ধেক হিন্দু। হবির খাঁ মায়ের দিক থেকে রাজপুতানির ছেলে, যদিও তিনি লালনে পালনে মুসলমানের ধর্ম গ্রহণ করেন।
এই গল্পটি থেকে রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ লগ্নে এসে যে এক অকূলান অস্থিরতার মধ্যে পড়েছিলেন তার একটা চালচিত্র পাওয়া যায়। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন- প্রতিবেশী এতোবড় একটা সম্প্রদায় সম্পর্কে তাঁর যে পরিমান মনোযোগ দেবার দরকার ছিল- তা তিনি দিতে পারেননি।
ফলে তিনি বোধকরি, সেই ঘাটতিটুকু পূরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবানুগ অন্তর্গতভাবে একটি সম্প্রদায় সম্পর্কে লিখতে চাইলে যে ধরনের যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতা থাকা দরকার তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিল না। আসলে সমাজ রাষ্ট্রের যে ব্যাপক কর্মজীবী শ্রেণী- তাদের ভূমিকাটা দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর বোঝা হয়ে ওঠেনি।
তিনি মাটির উপরে দৃশ্যমান দালানঘরটিই দেখেছেন। কিন্তু যে অগণিত ইটের সারি মাটির নিচে প্রাসাদের ভরকেন্দ্র হিসাবে থাকে- তাদের দেখতে পাননি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অলোকসামান্য বোধির কারণে সম্ভবত নিজের ঘাটতিটুকু অনুধাবন করেছিলেন, আর উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা পূরণ করার। ফলে
তাঁর অস্বস্তি ও বেদনার পরও যে সমাধানের পথ খুঁজে বের করেন সেটি চিরায়ত রবীন্দ্রনাথ থেকে আলাদা কেউ নন। রাজা নাটকে যেমন, রক্তকরবীর যে সমাধানকারী তার থেকে ভিন্ন কোন নায়কের আবির্ভাব ঘটেনি। শেষপর্যন্ত একজন ক্যারিসমেটিক, সকল সঙ্কট উতরানো রাজা- এ কাইন্ড হার্টেড হিরো- যিনি তাঁর ভাষায় ওই মহামানব আসে। রবীন্দ্রনাথের ইমাম মেহেদি বুঝি আসবেন, মৃত্যুর মুখে তিনি তারই পায়ের আওয়াজ শুনতে চেয়েছিলেন; আমরাও তার পদধ্বনি শুনতে বুঝি কান পেতে রই।
আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ
বোধকরি বৈজ্ঞানিক সত্যের নৈর্ব্যক্তিকতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একটু ভয় ছিল। তিনি সত্যকে বস্তুনিরপেক্ষভাবে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না।
১৪ জুলাই ১৯৩০ সনে আলবার্ট আইনস্টাইন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে যে আলাপ হয় তাতে বুঝি- রবীন্দ্রনাথ ধর্মীয় জ্ঞানতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে সবকিছু বিচার করার যে রেওয়াজ তার বাইরে যাননি।
আইনস্টাইন বলেন- জগৎ-সংসারে কেউ না থাকলেও অ্যাপোলো বেলভেডিয়ার একইরকম সুন্দর থাকবে।
রবীন্দ্রনাথ বলেন- না, তা থাকবে না। মানুষের চোখের সমর্থন ছাড়া অ্যাপোলো বেলভেডিয়ার সুন্দর নয়।
আইনস্টাইনের উত্তর- তা হয়তো সৌন্দর্যের ব্যাপারে সত্য হতে পারে, কিন্তু সত্যের বেলায় নয়। কেউ দেখুক, কী না দেখুক- সত্য একা একাও সত্যই।
মানুষের অংশগ্রহণ বা আত্মিকতার বাইরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিন্তাকে টেনে নিয়ে যাননি। আইনস্টাইন সংশয়ী হয়েছিলেন বটে, তাঁর কথায় একটু দীর্ঘশ্বাসের প্রলেপ ছিল; বলেছিলেন- বৈজ্ঞানিক সত্যের দিকে যাওয়াই তাঁর ধর্ম, তাই পিছন ফিরে তাকাননি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহত্ত্ব এখানেই যে, তিনি নিঃসঙ্গ হতে চাননি- তাই বারবার মানুষের দিকে ঘুরে দেখেন; আলবার্ট আইনস্টাইনের গরিমা ওখানে যে, তিনি পিছনে ফিরে তাকাননি।
মোহন সর্বনাশ
তিরিশি কবিদের দাপটের কাছে একসময় আধুনিক কবিতা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশ খানিকটা পিছিয়ে আসেন।
তিনি যে কবিতা থেকে সরে এসে গানে নোঙর করেন- তার মধ্যে একটা ঐতিহাসিক দার্শনিক ঘটনার রূপায়ণ ঘটে।
রবীন্দ্রনাথের অন্তর্লোকে একটি গভীর নিজস্ব ঐতিহ্যকাতর দীক্ষা ছিল- যাকে তিনি কখনও দূরে সরিয়ে দেননি। আধুনিক কবিতার জন্য নিজের ছায়া কেটে ইউরোপীয় মাজহাব কায়েমে তিনি ঠিক ওইভাবে জঙ্গম হয়ে উঠতে রাজি হননি।
ভাবগীতল গানের মাঝে বাঙলা লোককবির সারল্যের সঙ্গে পশ্চিমা ব্যক্তি মানস উন্মোচনের একটি দ্বিধা থরোথরো কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অদম্য আত্মগোপনকারী সুরের শিখায় ছুঁইয়ে দেন।
প্রটেস্ট্যান্ট ক্রিসটিয়ানিটি যেমন নবীকে কবির সঙ্গে মিলাতে রাজি থাকে, রবীন্দ্রনাথও উঠতি ব্যক্তি মানুষের বিশদ চৈতন্যকে তাঁর গানে বেদমন্ত্রের উপরে সমাসীন করেন।
রবীন্দ্রনাথের এই সুরের ঝুঁকি আমাদের ভীষণ কাজে আসে। মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসের কেন্দ্রীয় বিহ্বলতা অতঃপর দু’টি আকুতি নিয়ে গড়ে ওঠে : বাতাসে দোলা বাবুই পাখির বাসা, আর রবীন্দ্রনাথের গানে মহীয়ান সর্বনাশের উদযাপন।
বৃক্ষের নাম
আমার বন্ধু ছদ্মনামে লেখে- লেখক নাম রথীন ঘোষাল, কিন্তু আদতে তার নাম সামিউল ইসলাম, এতোদিন বাদে সে যে সামিউল ইসলাম তা সে নিজেও হয়তো ভুলে গ্যাছে।
এমন হয় না অনেকসময় যে, মাথায় কতো প্রশ্ন আসে দিচ্ছে না কেউ জবাব তার!
ধরা যাক, এই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- তিনিই, এই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই ছদ্মনামে লিখেছেন- তার নাম কুদ্দুস আলী হাক্কানি, তার সব লেখা, সব কাজ এক্সাক্টলি তা-ই আছে- তাহলে এর কনসিকোয়েন্সটা কী হতো?
অন্যদিকে কাজী নজরুল ইসলামও একটি লেখক নাম বেছে নিয়েছেন, নামটি ধরা যাক পরিমল রায়। তার লেখা, গান, কাজকর্ম যা আছে তাই রইলো- তাহলে তার গুণগ্রাহীদের চালচিত্রটা কেমন হতো?
একদম দিব্যি দিয়ে বলা যায়, তাদের দুজনেরই ভক্ত ও প্রচারকারীর প্রবাহ একইরকম হতো না। আজ যাদের দেখি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্ত্রে, তন্ত্রে, বিস্ময় আর গৌরবে মুহ্যমান এবং তৎপরতায় অনিরুদ্ধ- তারা কুদ্দুস আলী হাক্কানির জন্য একই ভক্তিরসে জমায়েত হতেন না।
কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও একই সিনারিও হতো বলেই কিড়া কেটে বলা যায়। যারা কবি নজরুলের বাঁশির সুর, তন্দ্রাহীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতার রবে, বিদ্রোহ, ঝড়, প্রেমের ফল্গুধারায় স্নাত ও সামনে আগুয়ান- পরিমল রায়ের পিছনে একই জোস ও অঙ্গীকারে তারা জড়ো হতেন না।
জন্মের পর থেকে শুনে এসেছি : বৃক্ষ তোর নাম কী- ফলে পরিচয়; হাল জমানার দুনিয়ায় তা তো ধোপে টেকে না। প্রশ্ন ও তার উত্তরটি কিন্তু ঘুরিয়ে এভাবে বলতে হবে : বৃক্ষ তোর ফল কী- নামে পরিচয়।
অমীমাংসা
সবচেয়ে উচ্চশিখর বাঙালির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।তিনি প্রথম এশীয় যিনি ইউরোপীয়দের কাছ থেকে নোবেল পুরস্কার ঘরে তুলে আনেন, তিনি বাংলা ভাষার সাংগঠনিক সংহতি আনার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন, তাঁর আগে আমরা জানতাম না- আমাদের প্রাণের অন্দরমহল যে কত সহস্র শিহরণের নগর!
তিনি প্রথম বাঙালি পশ্চিমা লেখক যিনি হিন্দু ও মুসলমানকে রাখীবন্ধনে বাঁধেন, সেই সঙ্গে বিজ্ঞান ও সাহিত্যে শানজরের উদ্যোগ নেন, তিনি মানুষকে আগুনের কাছে বিনত করেন- আগুনকে উদ্বুদ্ধ করেন নতশির হতে, রবীন্দ্রনাথ ধর্মকে দৃশ্যমানতার অয়োময় থেকে অদেখার অনুরণনের বোধির সঙ্গে মেলান, তিনি জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে কাঁটাতারের বিভেদ দিগন্তের সঙ্গে মিলিয়ে দেন।
এতোগুলো অর্জনের কারণেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সর্বোচ্চশিখর বাঙালি নন; তাঁকে নিঃসঙ্গ মৃত্তিকামুকুট রাজার অধিষ্ঠানে গ্রহণ করি- কেননা তিনি পথভোলা এক পথিক- নিশ্চিত করে জানেন না তাঁর আসলে গন্তব্য কী- অন্বেষা-ই তাঁর বাড়ি; সবার সর্বাংশে জানার মচ্ছবে তিনি-ই একমাত্র না-জানার সংশয়ে মহীয়ান।
বাঙলার মূল
ব্যাপারটা কিন্তু আশ্চর্য লাগে। দুই বাঙলা ভাষাভাষী অঞ্চল দুইরকমভাবে বিকাশ লাভ করে, পিছনে পড়ে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ধরে নিতে হর্ষ হয় এমন ভেবে যে, কোথাও ঘন্টাধ্বনি বেজে চলে।
প্রথমত পশ্চিম বাঙলা কোলকাতার উন্মেষে, বিকাশে সমানতালে পা ফেলে, কখনও উড়ে এগিয়েছে। দুর্গাপূজার সময় কোলকাতা নিদারুনভাবে জমে ওঠে। নাচে, গানে, পোশাকের জেল্লায়, পূজামণ্ডপের ছড়াছড়িতে কোলকাতা সয়লাব- জনজীবন অচল, গাড়িঘোড়া নিয়ে স্বাভাবিক নাগরিক চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে ঈদের সময় ঢাকা ভীষণ লুপ্ত হয়ে যায়- ঢাকা ফাঁকা হয়ে পড়ে- সবাই গ্রামে, দেশের বাড়ি চলে যায়। এভাবেই কোলকাতা অধিক নাগরিক মেট্রো নগরে দিশাহারা তড়পায়; অন্যদিকে ঢাকার নগর হয়ে ওঠা তো বহুত পরের কথা- না শহর না গ্রামের নো ম্যান’স ল্যান্ডের দোটানায় লোকগীতির গানে মজে, রবীন্দ্রনাথের চান্নি-পসরে জাগে।
পশ্চিমা, সংস্কারমুক্ত আধুনিক শিক্ষার কায়দামুখী যে কোলকাতার জাগরণ তার অন্তরাত্মায় তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে পথপ্রদর্শক করে যদ্দূরসম্ভব এগিয়ে গ্যাছেন। তাঁদের নাটকে, থিয়েটারে, বিয়ের আমন্ত্রণপত্রে, মেট্রোরেলে, পূজোর ঘরে হরহামেশাই রবীন্দ্রনাথ আসন করেন। তা-সত্ত্বেও আজ তাদের সৃজনশীলতা অনেকটাই রাস্তার ডেড এন্ডে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গ্যাছে।
এমত লক্ষ্মণে অনেকের চিকিৎসাপত্র এরকম- রবীন্দ্রনাথের অন্তর্বস্তু সমাজে, জীবনে আরো গভীরভাবে অঙ্গীভূত করে নিলে এই নিস্ফলা খরাকাল থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতো।
অন্যদিকে পূর্ব বাঙলা এগিয়ে যাবার সঙ্কল্পে, পথে পরিক্রমায় নিজেদের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাগরণের রেনেসাঁয় উজ্জীবিত করে তোলে; তার এই অভিযাত্রায়ও কেন্দ্রীয় প্রণোদনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০বছর পর এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাঙলাদেশও এক ডেড এন্ডের মুখে এসে দাঁড়ায়- যার বামদিকে বাঙালি মুসলমানের জনরব; যে পথ ডানদিকে যায় তার মুখে মুসলমানের, কী খানিকটা মুসলমান বাঙালির শোরগোল।
বাঙলাদেশেও অনেকের ছাড়পত্র এমন- রবীন্দ্রনাথকে দর্শন ও প্রকল্পে আরো নিবিড়ভাবে আত্মস্থ করলেই আমাদের ব্যক্তি ও সামাজিক দুর্দশাকাল ডিঙিয়ে আলোর উৎসারণ দেখা যেতো।
এ-বেলায় দুই সম্মুখবাদী বাঙালির সামনেই একটি প্রশ্নের পেন্ডুলাম- রবীন্দ্রনাথকে সর্বনিশানায় বসিয়ে কী ইতিহাসের কোন ব্লাইন্ড স্পটকে আমরা বেমালুম ভুলে এক দূরত্বের ঢালুতে এসে দাঁড়িয়েছি- নাকি নানা সংখ্যালঘু জাতিসত্তা, বর্ণ, শ্রেণী, নৃগোষ্ঠী ও প্রান্তিক আত্মীয়ের ব্যথা, বাসনার প্রতিধ্বনি আমলে না তুলে এক সম্মিলিত নাগরিক উচ্চবিত্তীয় একাকিত্ব গড়ে তোলার ফল এটি?
শিক্ষিত উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর খায়েশের ঘেরাটোপে- কোথাও বর্ণপ্রথার পেষণে, কোথাও শ্রেণীর শোষণে দু’চোখে আমূল রক্ত এসে জমে; আমরা কেবল ভাবি- প্রেশার বেড়েছে- একটু শিথিলে বসে একচুমুক রবীন্দ্রসঙ্গীত শোন হে বাপু, সব ঠিক হয়ে যাবে।
ইতিহাসের পিছনে ও সামনে পাতাদের শনশন ধ্বনি ও সহস্র পায়ের পত্তনির আওয়াজ ভেসে আসে; আর জেব্রা ক্রসিঙে আকুল তাকিয়ে থাকে বাঙালি এক, বাঙালি দুই।
বাঙলার উপরে দাঁড়িয়ে ভাবি- বাঙলা আসলে কোথায়!
কেইটলিন ডেভিসের কাছে আমার রবীন্দ্রনাথ
আজ থেকে ১০বছর আগে কেইটলিন ডেভিসের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কেটলিন একজন সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানী- দুনিয়ার তাবৎ সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির খোঁজ রাখা তাঁর নেশা, খানিকটা পেশাও- তিনি একটি কলেজে নৃবিজ্ঞান পড়ান। আমার সঙ্গে আদিবাসী আমেরিকানদের ইতিহাস কৃষ্টি বিষয়ে কথা কলার সূত্রে তার সাথে পরিচয় হয়।
একথা সেকথার পর কেইটলিন আমাকে ধাঁধার ধাঁচে একটি প্রশ্ন করেন- আচ্ছা ধরো, আমি তো বাঙালি নই, দুনিয়ার অন্য জায়গায় অন্য কায়দায় বড় হয়ে উঠেছি; আমি বাঙালি না হওয়ায় এমন একটা জিনিসের নাম বলো যা আমি মিস করেছি, যা আমার দুর্ভাগ্যের সামিল- সরিষা ইলিশের কথা নয়, অন্যকিছু বলো।
আমি উত্তরে বলি- আমাদের ভাষায় একজন কবি আছেন তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; তুমি ওঁর গান শোনোনি, বা শুনলেও বুঝতে পারো না- এটিকে আমি তোমার দুর্ভাগ্যই বলবো, তামাম দুনিয়ায় এমন অমৃত খনি ও বাণী আর কোথাও নাই।
১০বছর পর কেইটলিন ডেভিসের সঙ্গে দেখা হলে সে আবার আগের কথাটি পাড়ে। বলে, আমি এখনও তোমার বলা নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাথায় নিয়ে ঘুরি। কিন্তু এবার তাকে বলি- আজ যদি তুমি আমাকে একই প্রশ্ন করো, আমি কিছুটা অন্যভাবে এর জবাব দিবো। কেটলিন বলে- তাই নাকি, ধরো আজও আমি একই প্রশ্ন করেছি, তুমি কী বলবে?
তুমি বাঙালি নও, বাঙলা অঞ্চলে তোমার জন্ম হয়নি বলে লালন সাঁই নামে আমাদের এক ফকির কবি আছেন- তাঁর গান শুনতে পাওনি- এবেলায় এটিকে তোমার দুর্ভাগ্য বলবো। লালন আমাদের জনপদের সমন্বিত পিছুটান ও এজমালি আর্তির হৃদপসারি রূপকার, দার্শনিক সুরের মোহরদানা।
কিন্তু মজার কথা কী জানো- যে অভিজ্ঞান, রুচি আর বীক্ষার উপর দাঁড়িয়ে আজ রবীন্দ্রনাথের বদলে লালন সাঁইয়ের কথা বলি- সেই পাটাতনের উপর দাঁড়াতে যে মনীষী আমাকে তৈরি করেছেন- তিনি প্রধানত, মুখ্যত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।।