চিন্ময় গুহ’র কলমে চিত্রী রবীন্দ্রনাথ
পারমিতা ভৌমিক
রবীন্দ্রনাথের ওপর প্রচুর অনন্য আলোচনা পড়েছি। আজ দেখব আমাদের সমকালে বসে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখকব্যক্তিত্ব চিন্ময় গুহ’র দৃষ্টিতে রবিকবি কিভাবে প্রতিফলিত হয়েছেন। বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথের চিত্রধর্মীতাটি।
চিন্ময় গুহ তাঁর লেখায় (ঘুমের দরজা ঠেলে) সরাসরি টান দিয়েছেন আমাদের ঐতিহ্যের শেকড়ে।
সেই শিকড় আছে উপনিষদে, আছে ঋষি জীবনে ,আছে আর্ষবাণীতে, আর আছে রবীন্দ্রদর্শনে।
আসুন পড়ি এ বিষয়ে চিন্ময় কি বলছেন তাঁর “ঘুমের দরজা ঠেলে” বইখানিতে।――
“-‘শিশুতীর্থ’ কবিতার অগ্নিদগ্ধ পৃষ্ঠা উড়ছে। বিংশ শতাব্দীর সেই উল্কার মতো মহাকবিতা। ‘পাহাড়তলিতে অন্ধকার মৃত রাক্ষসের চক্ষুকোটরের মতো,/স্তূপে স্তূপে
মেঘ আকাশের বুক চেপে ধরেছে….”
――ঠিক তখনই অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত হচ্ছে আলো। সে আলো ভোগবতী পৃথিবীর অন্ধকার চিরে কোনো আলেয়ার আলো নয়। সে আলো মানসোত্তর আলো। সে আলো তূ্র্যাতীতের। মানসনয়ন তখন অতিমানসের সামনাসামনি হয়েছে।
সামনেই চিন্ময় দেখছেন ঔপনিষদিক ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথকে। অদ্ভুত বিস্ময়ে চিন্ময় দেখছেন ――
“এর মধ্যে এত আলো আসছে কোথা থেকে? এত স্বর্ণস্রোত?
প্রত্যুষের প্রথম আভা তাঁর কপোলে। অলৌকিক উষ্ণীষের মতো তাঁর সাদা চুল, দাড়িতে মৃদু শিহর। এমন আশ্চর্য দীপস্তম্ভ দেখেছে কি কেউ, কোথাও? মানুষের ইতিহাসে?”—–
এই দেখার মধ্যে চিন্ময় ঢেলে দিলেন আশ্চর্যরস। একসঙ্গেই মনে পড়ল আমার এরিয়েলের রূপ আর ক্যালিবানের রসের কথা। চিন্ময়ের সুসমঞ্জস এই সিন্থেসিস পাঠককে উপর্যুপরি পরিবেশন করতে লাগল অন্য আর এক সংবেদী ভাব ও ভাবনা। অনন্য এক সাহিত্যসৃষ্টি হয়েই সেসব প্রতিভাত হল।
চিন্ময়ের অন্তরপুরুষ একজন দক্ষ চিত্রী। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তিনি গড়ে নিচ্ছেন তাঁর আলোর পুরুষটিকে—রবীন্দ্রনাথকে। সেই বিরাট পুরুষ,রবীন্দ্রনাথের অন্তর-তরঙ্গেই বেজে উঠলো――
“আবার জাগিনু আমি।
রাত্রি হ’ল ক্ষয়।
পাপড়ি মেলিল বিশ্ব।
এই তো বিস্ময়
অন্তহীন।”
(‘বিস্ময়’, ‘পরিশেষে’)
এ এক অধিস্তরীয় জাগরণ। পাপড়ি-মোচনের অপ্রকট স্নিগ্ধ রূপকল্পে আঁকা হয়েছে ক্ষয়হীন অন্য ছবির ইতিকথা।
চিন্ময় তখন “ঘুমের দরজা ঠেলে”তে দেখছেন――
“ওই তো বেতের চেয়ারে তিনি বসে আছেন, যেমন রানী চন্দ লিখেছেন, সামনে ছোট টেবিলে দু’খানি লিখবার খাতা, ছোট্ট ডায়েরিটি – তাতে কবিতা লেখেন, আর রয়েছে কলম রাখার ছোট্ট লম্বা রুপোর তারের কাজ করা তামার বাক্সটি। ধবধব করছে সাদা রেশমের মতো চুল ও দাড়ি।”—–
কি minute detailing…..(অবশ্য রাণী চন্দের দেখার উল্লেখ করেছেন চিন্ময়) কিন্তু তাকে অপরূপ মুন্সিয়ানায় সাজিয়ে চিন্ময় আর একটি স্বতন্ত্র রূপচিত্র অঙ্কনের কৃতিত্ব অবশ্যই দাবী করতে পারেন।
শুধু এইই নয়, চিন্ময় প্রত্যেক পাঠককে স্পেস দিলেন যাতে যার যার মত তাঁরা চিত্রময়তায় অন্যভুবন পরিসৃজন করতে পারেন।
এ যেন অদ্ভুত এক স্টেজ ডিরেকশন—কোনো একাঙ্ক নাটকের প্রাকভাষ—–
আমি আমার মতো সাজিয়ে নিতেই পারি――
ক) বেতের চেয়ারে তিনি বসে আছেন।
খ) সামনে ছোট টেবিল
গ) টেবিলের ওপর দুখানি লেখবার খাতা
ঘ) একটা ছোট্ট ডায়রি।তাতে কবিতা লেখেন।
ঙ)আর রয়েছে কলম রাখার ছোট্ট লম্বা রুপোর তারের কাজ করা তামার বাক্সটি।
এইভাবে অবশ্যই চিন্ময় উদ্দীপিত করতে চেয়েছেন পাঠকের ইমাজিনেটিভ শক্তিকে যাতে যে যার মতো করে ঐ ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক সত্যের সঙ্গে একরূপতা পায়।
এরপরে বস্তুদেহের সুন্দর রূপ–অভিব্যক্তি পেলাম।
“ধবধব করছে সাদা রেশমের মতো চুল ও দাড়ি।”—– যেন সাগর ছেঁচে চিন্ময় তুলে আনছেন অপরূপ মণিমুক্তো, এক আর্যঋষির অনুকৃতি।
চিন্ময় তাঁর কাব্যিক গদ্যের অনুকূল করে খুঁজে এনেছেন এসব। নইলে আমরা এইহব কবে অথবা কোথায় পেতাম তার হিসেব কে দেবে?
এরপরই মঞ্চসজ্জার সমাপ্তি।
কুশীলব সচল।
কি সুন্দর উপস্থাপনা করছেন চিন্ময় !!!
“সন্ধে নেমে আসছে।”― ইমপ্রেশনিষ্ট চিন্ময় গুহ , সাহিত্যে ছবি তৈরী করছেন আর এক ঋষির যিনি চিত্রী, যিনি চিন্ময়ের মতোই ইমপ্রেশনিজম এ আস্থাশীল।
“সন্ধে নেমে আসছে”– এও কি ইমপ্রেশন অফ টাইম ব্যবহার নয়? এসব আমরা দেখেছি জীবনানন্দে। সন্ধ্যায় সুদর্শন ওড়ার চিত্র বর্ণনা তে।
সময়ের সুস্পষ্ট উল্লেখ চিত্রে বা চিত্রকল্পের চিত্রধর্মে।
তারপর―――
“আস্তে আস্তে হেঁটে কোনার্কের পশ্চিম দিকে ছোট্ট বাগানটিতে চলেছেন। একা। ‘বিজয়া’-র চিঠি এসেছে। ছোট্ট একটি কার্ড: ‘যদি তুমি আমায় কিছু লেখো।”
তারপর আবার টুকরো টুকরো ছবি জোড়া দিয়ে সমগ্রের ইমপ্রেশন তৈরি হচ্ছে――
ক) ইজিচেয়ারে বসে আছেন আধ-শোওয়া অবস্থায়।
খ) হাতে বই। রানীকে পড়ে শোনাচ্ছেন গোর্কির আত্মকথা।
গ) ‘উদীচী’র পাশে বাগানে বহু দিন আগে বকুল গাছ লাগিয়েছিলেন। এত দিনে সে গাছে ফুল ফুটেছে। সেই ফুল কেউ কুড়িয়ে এনে দিল তাঁর সামনে।”
―― যেন চলচ্চিত্র তৈরী হচ্ছে একখানি। একখানি ডকুমেন্টারি।
ঘ) মাথা নীচু করে, ছবি আঁকছেন।
ঙ)পাশে কালি, কলম, রং আর হরেকরকম
তুলি।
চ) পাশে পড়ে আছে প্রুফ।
ছ)একটি প্রজাপতি উড়ে এসে বসেছে তাঁর
চুলে।
জ) আজ ভোরে তাঁর মুখ একেবারে রামকিঙ্করের ভাস্কর্য। না কি জেকব এপ্স্টাইনের ব্রোঞ্জ প্রতিমূর্তি?
ঝ) এমনও হয়? মানব-মৃত্তিকা দিয়ে তৈরি এমন আশ্চর্য রূপ কেউ দ্যাখেনি কোনও দিন, লিখেছেন স্যাঁ-জন পের্স।
কী সুন্দর করে একটা চলচ্ছবির চালচিত্র সাজিয়ে দিয়েছেন চিন্ময় গুহ। কখনও জ্ঞাততথ্য ও সত্য থেকে এসেছে বিষয়বস্তু কখনো নিজের অপূর্ববস্তু নির্মাণক্ষম প্রতিভা ও উত্তুঙ্গ বোধের সিঁড়ি বেয়ে নেমেছে একটা অনন্ত আকাশের পূর্ণায়তন ছবি।
কী অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার একাত্মতায় চিন্ময়ের ছবিকল্পগুলো মূর্তি ধরে ভেসে এসেছে তাঁর “ঘুমের দরজা ঠেলে”――গ্রন্থে।।
―――”ভাষার গর্ভযন্ত্রণা যাঁর শরীরে, যিনি প্রায় এককভাবে ইড়া-পিঙ্গলায় ধারণ করেছেন কবিতার অন্দরের ইতিহাস, তিনি এখন চিত্ররেখার গহনে ডুবে আছেন।”――
কী আশ্চর্য !!!।এতক্ষণ যে ইমপ্রেশনিজম্ চিত্রধর্মের কথা বলছিলাম, এখন সেই কথাই চিত্রী রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কেই তো বলছেন চিন্ময় !!!
“কখনও রঙিন পেনসিল দিয়ে ছবি আঁকছেন, রানী চন্দ ছুরি দিয়ে কেটে-কেটে তাঁর হাতের কাছে রাখছেন।”
আর তারপরেই এ কী বলছেন !!!??
“জানিস, আমি আর্টিস্ট নই। আমি যা আঁকি, তা মনের আগোচরে।”—–
এ কোন শিল্পচর্চা!?
এইই তো ইম্প্রেশনিজম্ এর মূলকথা! এতবড় সত্যটার সূত্র ধরিয়ে দিলেন চিন্ময় গুহ। তাঁর কাছে আমাদের আদিগন্ত ঋণ রইল।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন――
“ইচ্ছে করে আঁকা বা আঁকতে চাওয়া, তার একটা রূপ দেওয়া—তা আমার দ্বারা হয় না।”—–
অঙ্কনের প্রকরণকৌশল ও প্রাকরণিক উপকরণ, এবং শিক্ষণ রবীন্দ্রনাথের সে অর্থে ছিল না অথচ যা ছিল তা হল তাঁর অন্তরশায়ী শিল্প দৃষ্টি ও তার স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ ব্যাকুলতা――
“হিজিবিজি কাটতে কাটতে, একটা কিছু রূপ নিয়ে যায় আমার আঁকা।…”
――আমার মনে হয়, আশ্চর্য রকম স্বাতন্ত্র্যে সেসব প্রভাস্বর হয়েছে। একেবারে পশ্চিমী ধাঁচ।
এটি কিন্তু মনে মনে জেনেছিলেন তিনি আর তাই ভেবেও ছিলেন ――
“এবারে আমার একট আস্তানা করব। দোতলায় একটি ঘর শুধু, চার দিক থাকবে খোলা সেখানে বসে বসে কেবল ছবি আঁকব আর কিছু করব না; কোনও কাজের ভাবনা থাকবে না। ছবি আঁকতে আমি আনন্দ পাই; সেটা আমার খেলার মতন।
(২৪ জুলাই ১৯৩৯)
দেখ তো অন্ধের মতো বসে বসে এই ছবিখানি করলুম। শুধু লাইনেই রেখে দিলুম। এইতেই যখন ছবি একটা কথা বলছে তখন আর তাতে কিছু করা উচিত নয়।… “
―――কত অনায়াস সত্য এই আত্মকথনে রয়েছে। সৎশিল্পের পথ নির্দেশ। কোনো মিমেসিস নয়। অন্তরদৃষ্টির নিজস্ব অবলোকন।
চিন্ময় এ কোন্ রবীন্দ্রনাথকে চিনিয়ে দিচ্ছেন??? অঙ্কন-শিল্পীকে???
“আমার সব ছবিরই ভাব কেমন যেন বিষাদমাখা। হয়তো ভিতরে আছে আমার ওটা।
(৩১ জুলাই ১৯৩৯)”
――― ভিতর থেকে অপ্রতিরোধ্য ধারায় নেমে আসা কোনো মানসছবি ও সম্যগ আবেগ হবহু আঁকা হয়ে যাচ্ছে― অটোমেটিক ― তবে ডাডাদের মত নয়।
“মানুষের কতকগুলো অহংকারের বিষয় আছে। যেমন আমার গান। আমি জানি সেখানে আমার একটা বিশেষত্ব আছে। “
― সে অন্য প্রসঙ্গ।এটি পরে অন্যত্র বলা যাবে।
“আমি আপনার অবজেকটিভ মনস্তত্ত্বের একটা দৃশ্য পাই।”—–
এই অবজেক্টিভ মনস্তত্ত্বই আরো একটু এগিয়ে গিয়েই কি এক্সপ্রেশনিজম নয়????
“কীরকম করে হৃদয়ে ভেসে উঠছে— কতখানি সত্য, সুখ, দুঃখ আইডিয়ালাইজ করছে। যেখানে সকল বিশ্বের হার্মনির মূল— আমার গানে সেখানে পৌঁছই।”—–
অসাধারণ সঙ্গীত শিল্পকথা। পশ্চিমের সঙ্গে তফাৎ এই যে এখানে তাঁর রঞ্জনবৃত্তি বা আইডিয়ালাইজেশন ক্রিয়াশীল।
আবার বলি আমরা কৃতজ্ঞ চিন্ময় গুহর কাছে। এভাবে রবীন্দ্রনাথকে কখনও দেখিনি। একটা গভীর আলো, সার্চলাইট এনে দিলেন চিন্ময় পাঠকের হাতে।
“আমার নাটকে অন্তত একটা কল্পলোকের ছায়া আছে, একটা কোণ অধিকার করেছি মাত্র।”
―― রবীন্দ্রনাথ এর অধিকৃত শিল্পভূমির এই যে তর তম টুকু জানছি এ বড় সম্পদ। এভাবে ভাবিনি। আর আশ্চর্য এই যে চিন্ময় এখানে তাঁর নিজস্ব আর্টকে কনশিল করেছেন।
“ঘুমের দরজা ঠেলে”―তাই হয়ে উঠেছে আর্টলেস আর্ট।
“কিন্তু আমার ছোটগল্পগুলো স্রোতের মতো বয়ে গেছে—বসন্তের ফুলের মতো ফুটে উঠেছে।”
――― এই জানাটা সত্য ও স্বীকৃত। রবীন্দ্রনাথ নিজেও জানতেন নিঃসংশয় ভাবে। চিন্ময়ও একমত।
চিন্ময় দক্ষ শিক্ষক ও অভিভাবকের মতো আলো দেখাচ্ছেন। বলে দিচ্ছেন কী ভাবে শিল্পকে, সাহিত্য কে এমনকি জীবনকেও দেখতে হবে।
রবীন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তি অনুধাবন যোগ্য ―――
“আমার ছবির বিষয়ে আমার নিজের বলবার কিছুই নেই।… ছবির জন্য এখনও অনেক সবুর করতে হবে আমাদের।
(২৬ মে ১৯৪১, দুপুর)
হাতড়ে হাতড়ে বেড়াই।।
যখন ছবি আঁকতে শুরু করি, আমার একটা পরিবর্তন দেখলুম। দেখলুম গাছের ডালে পাতায় নানা রকম অদ্ভুত জীবজন্তুর মূর্তি। আগে তা দেখিনি। আগে দেখেছি, বসন্ত এল, ডালে ডালে ফুল ফুটল—এইসব। এ একেবারে নতুন ধরনের দেখা। কিন্তু এই রিয়ালিস্টিক মূর্তি কে দেখালে। আর্ট দেখালে।
(২৭ মে ১৯৪১)
――― সারা দুনিয়ার আর্টের সঙ্গে পরিচয় না থাকলে এই রিয়ালিস্টিক আর্টের সেন্স (মূলতঃ পশ্চিমের বৈশিষ্ট্য) তৈরি হয় না। প্রাচ্যের সঙ্গে এইখানে তিনি ডিফার করেছেন। তিনি নিজে আঁকা না শিখলেও একটা এমন শিল্পসমৃদ্ধির মধ্যে দিনযাপন করেছেন যেখানে আমরা পেয়েছি গগনঠাকুর কে।
এরপর এলো ভাষাশিল্পের কথা। সে এক চলমান ঐশ্বর্য মানুষের ইতিহাসের।
“ভাষা যে নদীর কলস্রোতের মতোই, কেবলি যাচ্ছে আর নূতন হয়ে আসছে। আজকের ভাষা কাল থাকছে না। তাই আমিও মেনে নিয়েছি; দুঃখ নেই মনে। যতদিন আমি আছি, তারপরে দোরে তোমরা তালা বন্ধ করে দিও— বাতি নিভিয়ে দিও— আমার কিছু বলবার থাকবে না।
(২৩ এপ্রিল ১৯৪১। উদয়ন)”—-
―――এভাবে বলা যায়!!?
এরপর আসবো সাহিত্যের কথায়――― এখানে
কী কল্পনা শক্তি ! অথবা জল্পনা। তা সে কল্পচিত্রই হোক আর জল্পচিত্রই হোক, সে তো পরিণামে আমাদেরই সম্পদ।
――”মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে কল্পনা করছেন সাপে কামড়েছে। দেখতে দেখতে আমার সমস্ত শরীর ঝিমিয়ে এল, তারপরে মৃত্যুটা পর্যন্ত অনুভব করতে পারি।। কখনও তন্দ্রার ঘোরে বলে উঠছেন:’আকাশে তারা উঠেছে—
আকাশে তারা উঠেছে—-‘
তাঁর কপালে মৃদু স্বেদ মুক্তোর মতো ফুটে আছে।এত যুদ্ধ কেউ কি লড়েছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে? বাণীমুখর ঋতুর ফসলে ভরে আছে এই স্বেদাক্ত শিল্পীর গোলা।
ওই তো’পুনশ্চ’ বাড়ির জানলার ধারে তিনি বসে।হাতে তাঁর আকাশপ্রদীপ।আমি আরেক রাণী,রাণী মহলানবিশকে লেখা,’পথে ও পথের প্রান্তে’—র চিঠিগুলি খুলে বসি।
ভূমিকায় লিখেছেন (জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৫):
পৃথিবী আপনাকে প্রকাশ করে দু’–রকমের চলন দিয়ে।একটা চলন তার নিজেকে ঘিরে-ঘিরে,আর একটা চলন বড়ো যাত্রাপথে—–সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর বর্ষচক্রমন্ডলে দেখা দেয় তার ঋতুপর্যায়,নানা জাতের ফল—ফসলের ডালি ভ’রে ওঠে,সর্বজনের পণ্যশালায়।আর তার দিন যাত্রায় দেখা যায় জলে স্থলে আলো–ছায়ার ইশারা,আকাশে আকাশে প্রকৃতির মেজাজ–বদল,সকাল-সন্ধ্যার দিক–সীমানায় রঙের খেয়াল, ঘুম-জাগরণের আনাগোনার পথে নানা কন্ঠের কলকাকলি।
এখন বছলা দু’টো।কেয়াফুলের গন্ধ আসছে—-টেবিলের একপাশে কে রেখে দিয়েছে।এই বর্ষাদিনের দুপুরবেলাকার রোদ্দুর ঈষৎ আর্দ্র,তার উপরে যেন তন্দ্রার আবেশ——-
(৮ই জুলাই ১৯২৮)
আজ চল্লিশ বছর হয়ে গেল আমার মনের মধ্যে একটা সংকল্পের সম্পূর্ণ ধ্যানমূর্তি জেগে উঠেছিল, ইংরেজিতে যাকে বলে vision।তখন বয়স ছিল অল্প,মনে দৃষ্টিশক্তিতে একটুও চালশে পড়েনি।জীবনের লক্ষ্যকে বড়ো করে সমগ্ৰ করে স্পষ্ট করে দেখতে পাবার আনন্দ যে কতখানি তা ঠিকমত তোমরা বুঝতে পারবে কি না জানিনে।সে আনন্দের পরিমাণ পাবে আমার ত্যাগের পরিমাপে।আমার শিলাইদা,আমার সাহিত্য–সাধনা, আমার সংসার–সমস্তকেই।