আহমদ ছফাঃ সার্বক্ষনিক সত্ত্বা ও তাঁর অভিঘাতের উদ্দাম চৈতন্য
আলমগীর ফরিদুল হক
……….এর পর মাস যেতেই আমাদের রক্তাক্ত দেশ স্বাধীন হলো, সদ্য জন্মপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশে আন্দরকিল্লার তাজ লাইব্রেরী’ হাক্কানী লাইব্রেরী, পাঠক বন্ধু লাইব্রেরী থেকে বই কেনা শুরু, বাঙলা যুক্তাক্ষর উচ্চারণ করতে না পারলেও বাঙলা পড়ে যেতে পারি! আশ্চর্য লাগে বৈকি ৬৮, ৬৯, ৭০ সালে প্রকাশিত আমাদের বাঙলা সাহিত্য, অনূদিত সাহিত্য, এমন কি কিশোর সাহিত্য কি শক্তিশালী উন্মেষ আর উদ্ভাসন ছিল তা ভাবাই যায় না! একদিন তাজ লাইব্রেরী থেকে পেয়ে গেলাম ‘নিহত নক্ষত্র’, লেখক আহমদ ছফা, তাঁর ভাষা ভঙ্গী’তে আছে একটা টকবগে সতেজ বর্নাণাক্রম! বাড়ি’তে এসে বললাম এই লেখকের নামের বানান ভুল আছে, আমার মনে হলো সেই যুগে ভুল ছাপা হয়েছে! হবে ‘সফা’ অনেক’টা আমাদের চট্টগ্রামের ক্যাপ্টেন সফা’র মতই হবে হয়তো! তবে এই নামের বানান নিয়ে কোন কিছুর সুরাহা হয়নি, তবে কে যেন বলল চাটগাঁয় আঞ্চলিক টান রাখা হয়েছে হয়ত তা ইচ্ছাকৃত! এরপর থেকে একে একে, ‘জাগ্রত বাঙলাদেশ’, ‘ওঁম’, ‘বুদ্ধিবৃত্তির নূতন বিন্ন্যাস’ কিনে ফেলি কিন্তু এর পরবর্তি কালে আর কিছু কেনা হয়নি! উনি আমার কাছে বিস্মৃত না হলেও একটু দূরের হয়ে গেলেন। তখন রুশ ও ফরাসী দেশের সাহিত্য ও চলচ্চিত্র নিয়ে মেতে আছি! ছফা ভাইয়ের সাথে পরবর্তিতে আমার পরিচয় ঘটবে তা আমি কি ভেবেছিলাম! এমনি কতো স্বপ্ন ছিল দেখা করবো লোকশিল্প ও সাহিত্যের গবেষক মনসুরুদ্দিন, শিল্প গুরু এস এম সুলতান, দেবেশ রায়, সুবিমল মিশ্র, অসীম রায়, আহমদ ছফা, খন্দোকার মুহম্মদ ইলিরাশ, হাসান আজিজুল হক, জ্যেতিপ্রকাশ দত্ত, হায়াত মাহমুদ প্রমুখ আমার প্রিয় মানুষ গুলোকে কাছে থেকে দেখবো, পরিচিত হবো। তাই কি হয়! কিন্তু আমাদের দেশজ চিন্তক আহমদ ছফা’র সাথে ঢাকায় এক ঘটনা চক্রে অনির্বায ভাবে দেখা হয়ে গেয়েছিল। জেনেছিলাম তিনি চাটগাঁর মানুষ, তা তাঁকে কখনো চাটগাঁয় দেখিনি! তবে চট্টগ্রামে মেডিক্যালের হবু ডাক্তার বন্ধু’দের আড্ডায় পরিচয় ঘটলো ইরানী ছাত্র আসাদ রাজাগভির সাথে। তার কন্ঠ থেকে দীর্ঘ যুগ পরে হঠাৎ করে শুনলাম ছফা ভাইয়ের কথা ! সেই ‘নিহিত নক্ষত্র’এর কথা আমার মনে আবার জেগে উঠলো! সে নাকি চট্টগ্রাম মেডিক্যালে ভর্তির আগে ছফা ভাইয়ের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে একই হলে ছিল অনেক বছর! আসাদ যা চেহারা চারিত্র্য বর্ণনা দিল ছফা ভাইয়ের, তাঁর কথায় খুবই সাধারণ শ্রমিকের মত দেখতে হাইলি চার্জড একজন মানুষ! না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না ইত্যাদি! তাকে দেখতে খুবই মন চাইতো! তাঁর কাঁধে থাকতো একটা টিয়ে পাখি! দিন দুপুরে বাসের কন্ট্রাটরগীরি করতেন, ঘরে বাইরে কিনবা খোলা জায়গায় বাঁশি বাজাতেন, বাঙলা একাডেমী থেকে গবেষণা করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গাভী পালাতেন, যে গাভীটির দুধ পান করতেন, গাভীটি বাগানের লতা পাতা ফুল সবজী খেয়ে ফেলতো সে ব্যাপারে ছফা ভাইয়ের কোন ভ্রূক্ষেপ ছিল না! ইত্যাদি ইত্যাদি ! সব শুনে টুনে এই মানুষটি’কে সনাক্ত করার চেষ্টা করি। কে উনি? উনি’কে? মানুষ পাখি সব কিছুতে তিনি সার্বক্ষনিক অভিঘাত করে চলেছেন! তিনি যেন কারলস কস্তানেডাস সেই রেড ইন্ডিয়ান সন্ত এর মতন ! যার জ্ঞান আছে ফলে তাঁর কোথাও থেকে ভয় নেই। তাঁর আছে মানব জীবনের গভীর চেতনা, যার কোথা থেকে কোন ভয় নাই!
ক্লু বিয়ারিং ল্যাঙ্গুয়েজে প্রথম শনাক্তিঃ
জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের লাইব্রেরীয়ান মতিউর রাহমান একদিন খবর দিলেন, বললেন, ছফা ভাইকে চেনেন? উনি আপনাকে দেখতে চেয়েছেন, যেভিৎটস সাহেবও আপনার তল্লব করেছেন উনার রুমে! কে উনি? ও বুঝেছি, না ওনাকে চিনি লেখার মাধ্যমে, তবে কখন দেখিনি! তা উনি এখানে কি করছেন, মতি ভাই বললেন, আরে জানেন না! ছফা ভাই যেভিৎটস’কে হাত করে ফেলেছে, সে ছফা বলতেই পাগল! দেখি পিটার যেভিৎটসের সাথে একজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষ বড় বড় চোখে তাকাচ্ছেন, আর চোখের বলয়ে মনি’টার মুভমেন্ট যেন সেন্ট্রিফিউগাল, চারদিকে ঘুড়পাক খাচ্ছে, যেন মনে হল ভদ্রলোক খুব টেনশনে থাকেন, একটা হাইপার ইম্পালসেও ভোগেন। এটা যেন তাঁর সৃষ্টিশীলতার ইম্পালস্! প্রতিনিয়ত কিছু গড়ছেন, ভাঙছেন, আমার মতন হাতের আঙ্গুলির মুদ্রা গালের কাছে এবং মাথাটা খুবই সোজা এবং অনড় শিরদাড়া! যেভিৎটস সাহেব পরিচয় করে দিলেন! ‘দিস ইজ আর সাফা’। উনাদের সাথে বিশাল পৃথুলা এক রমণী কালচারাল আটাচে বসে, খুবই ভালো মানুষ, আজ আর তাঁর নাম মনে নেই! যেভিৎটস সাহেব বললেন তোমাকে ডেকেছি সালমান রুশদি’র স্যাটানিক ভার্সেস সম্পর্কে তোমার মতামত জানতে! পশ্চিমের ধর্মীয় প্রেমিজে ইসলামের অবস্থান সনাক্ত করে বললাম, সংক্ষেপে বললাম এগুলো কিছু সিম্পটম পশ্চিমের টু মেইক রিলিজিয়ন আ ডিবেটেবল প্রেমিজ! এই ভাবে ছফা ভাইয়ের সাথে প্রথম পরিচয়। পরিচয়ের পর্ব এখানে থেমে থাকেনি! পরবর্তিতে আমাকে নিয়ে যান মিরপুরের বাড়িতে, তারপর খুব কাছেই বাঙলা মটরের বাড়ীতে। অনেক পড়ে ছফা ভাই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ডক্টর মফিজ চৌধুরীর সাথে, নিয়ে গেলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের বাড়ী, এই আবার অন্য ঘটনা! পেইন্টিং পাগল আমি কি করে ছুটে চলে গেছি আবুল খায়ের লিটুর সংগ্রহ দেখতে ঘরের ভেতর অন্য ঘরে! ঘরে ঘরে যশস্বী শিল্পীদের সকল ছবির কি সম্মিলন!
ঢাকায় ছফা ভাই আর পিটার যেভিৎটসের অনুরোধে সুলতানের রেট্রিস্পেক্টিভ এর জন্যে আমাকে বলা হলো। আমি বন্ধু পাবলো’র (জিয়াউদ্দিন খান) মাধ্যমে বড় বড় মাপের সেই বিশাল আকারের ক্যানভাসগুলো যেন এ,কে, খান ফ্যামেলী এবং এম আর সিদ্দিকীর ফামিলী থেকে যেন সংগ্রহ করে আনি। তাঁদের ছবিগুলো নিয়ে যে ভাবে প্রদর্শন করা হয়েছিল এই বিষয়ে অনেক কিছু বলার আছে, যা হোক এই বিষয়ে আজ কিছু বলার অবকাশ নেই এখানে, তবে এই রেট্রস্পেক্টিভে আমারো ভূমিকা ছিল যা আমাদের কিছু কাছের মানুষজন মুছে দেয় সহজে! এই বিষয়ে শিল্পীগুরু সুলতান ভাই ভাল বলতে পারতেন! কিন্তু মোদ্দা কথা এই চিত্র উৎসব সম্ভব হয়েছিল কিন্তু ছফা ভাইয়ের উদ্যোগে এবং তাঁর সংকল্পে!
I refuse to live in history’s pages,
I must live in days still to come,
I must overtake history, become something more.
So father, I will not go to school,
There they teach the history of days long dead.
I prefer ideals I can feel
To ideals which are locked in a frame,
I prefer building my road as I travel
-Haribhakta Katuval
আহমদ ছফা’র বই পড়ে তাঁর মনঃস্তত্ত্ব ও চেতনার সাথে সম্পৃক্ত হলেও ব্যাক্তির সাথে সংস্পর্শে এসে আমার মনে হল যেন একজন শিক্ষকের দ্বারে এসে পৌঁছে গেলাম! দেশের অনেক লেখক’কের সাথে পরিচিত না হলেও তাদের লেখলেখির সাথে কম বেশী পরিচিত! কিন্তু ধীমান লিখিয়েদের আর চিন্তকদের মধ্যে পরিচিত হয়েছিলাম তাঁদের যাদের সাথে, তাঁদের মধ্যে লেখক আহমদ ছফা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াশ, অন্যতম। শুধু তাঁদের কাছের মানুষ বলে জেনেছি। তাঁদের কথা আদব কায়দায় কারো প্রতি কোন হেজিমনি আরোপ করে না! কিন্তু ছফা ভাইয়ের সংস্পর্শে আসা আমার কাছে তা মনে হল ‘ইটস ফর দ্যা লাইফ টাইম ইভেন্ট, এভেন দ্যো ইউ হাভ আ ভোইজ অফ ডিসসেন্ট’! তিনি সবাই’কে গ্রহন করতেন, স্থান দিতেন তাঁর মানসিক সেই বিস্তৃত প্লাস্টিক ফর্মে! যে মনটাকে যত টানা যায় তত বিস্তৃত হয়। তাঁকে পেয়েছি আমার শিক্ষকদের মতন অন্য এক শিক্ষক হিসেবে তাঁর প্রতিটি শব্দ স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল! তাঁর কথার ভঙ্গীতে যেমন একটা শক্তিশালী যুক্তি ও শব্দ ঘাতুনি, তেমনি তাঁর আছে লিখিত ব্যাখ্যায় সাতন্ত্র প্রাতিস্বিক একটা বৈশিষ্ট্য। তিনি বড় ভুমিস্থিত, বড় ইন্টারএক্টিভ, বড় এঙ্গেইজিং এবং নিজ সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন একটি সত্ত্বা! তাঁর আলাপচারিতায় একটা নূতন অভিঘাত তৈরি হয়, একটা অনুধ্যায়ী চিন্তায় মনে হবে তাঁর বিশ্লেষণ একটা মেরুকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। এই মেরুকরণ করা হয়, তাঁর কথায় ‘ঝালিয়ে তোলা’ মত, কিন্তু মেরুকরণের পদ্ধতি কিন্তু পশ্চিমের কোন কন্টিনেন্টাল বোধি বা তত্ত্বের প্রেক্ষিত ছাড়াই তিনি করে যাচ্ছেন তাঁর অজস্র অলিখিত ঐতিহাসিক তথ্যে, যুক্তির শৃঙ্খলায় ও যুক্তির তোড়ে! তাঁর আলোচনার ভিতটি কেবলি স্বদেশের ফ্যাক্ট অ্যান্ড ফিচারস, এবং কেবলি ঘুরছেন শেকড় বাকড়ের নিয়ে একটা নূতন ইতিহাসের সন্ধানে, এই আমার কাছে পরম পাওয়া! কারণ আমরা সবাই একটি পূর্বলিখিত ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা’কে যেন সুরক্ষা করার জন্যে জন্মেছি! ছফা ভাই কিন্তু তা ভেঙ্গে দিতে চান তাঁর নয়া মেরুকরণে। আমার স্মৃতিতে এখন জাগরূক কিন্তু এর কোন রেফারেন্সে তার চৌহদ্দি’র রূপরেখা টানা যাবে না! কিন্তু তাঁর অকাট্য মেনিফেস্টো ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ এখানে উল্লেখ করতে হবেই। তিনি বাঙালীর মুসলমানের পিছিয়ে থাকা মনের বিশ্লেষণ করেছেন, সাহিত্য, ভাষা, সমাজ, রাজনীতি, মানসিক পূর্বাপর সকল পরিপ্রেক্ষিতে, যা ইতিহাসে আত্মহননের নামান্তর। সেই প্রান্তিক ব্রাত্যজনের ইতিহাস তিনি গভীর গাত্রে প্রোথিত করেছেন! সে হল আত্ম-সমালোচনার সাবালকত্ব! এবং বড় নির্মোহ ভাবে যেন উপলদ্ধি করতে তিনি উৎসাহী। যা তিনি একটা আত্ম-উন্নয়নের আত্ম-সম্প্রীতির লক্ষ্যে যেন এগিয়ে যেতে পারে তারই সুপ্রার্থী। তিনি খুব সূক্ষ্মভাবে সাব-অল্টার্ন, পোস্ট কলোনিয়াল, কিংবা হিস্টিরিওগ্রাফির রেফারেন্স এড়িয়ে যান, কিন্তু সে প্রেমিজগুলো তাঁর বিশ্লেষণে সংশ্লেষে যেন নড়ে চড়ে উঠে, জেগে থাকে।
আমাদের সে সাম্যবাদী আন্দোলনের জন্ম দেয়ার সময় রাজনীতিকে দেশ ও সংস্কৃতি সম্পৃক্ত করেছিলেন যারা, তাঁর কণ্ঠে আমি শুনছি তাঁদের সেই কণ্ঠ যেন কিন্তু আরো সোচ্চার ভাবে বেজেছে, প্রথাগত ক্ষেত্র’কে বিসর্জন দিয়ে ! আত্মসমালচনার দিকটি তাঁর মধ্যে বার বার পারদের ব্যারোমিটারের মত উঠা নামা করে! আলোচনার উপস্থাপন এবং বিস্তৃতি যেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মত এখানে এবং শেষে যেন ঝালার কাজ করে শেষ করছেন, ‘বাঙালী মুসলমানদের মন যে এখনো আদিম অবস্থায়, তা বাঙালী হওয়ার জন্যেও নয়, মুসলমান হওয়ার জন্যেও নয়। সুদীর্ঘকালব্যাপী একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুন তার মনের উপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত রয়েছে, সজ্ঞানে সে বাইরে আসতে পারে না। তাই এক পা যদি এগিয়ে আসে, তিন পা পিছিয়ে যেতে হয়। মানসিক ভীতিই এই সমাজকে চালিয়ে থাকে। দু’বছরে কিংবা চার বছরে হয়ত এ অবস্থার অবসান ঘটানো যাবে না, কিন্তু বাঙালী মুসলমানের মনের ধরণ-ধারণ এবং প্রবণতাগুলোও নির্মোহ ভাবে জানার চেষ্টা করলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ হয়ত পাওয়াও যেতে পারে।’ দার্শনিক আহমদ ছফা এখানে এক অনন্য সামাজিক হিস্টিরিওগ্রাফির জন্ম দিয়েছেন তাঁর সমকালীন ও ভবিষ্যতের কাছে।
for you
there might be another song
but all my heart can hear is your melody
– Stevie Wonder
ছফা ভাই তাঁর অলাতচক্রে যে ডাইলেক্টিক্স উপস্থাপন করেছেন তা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কলকাতায় অবস্থানকারী শরণার্থী, মুক্তিযোদ্ধা, চোরছেঁচর, নেতা, পার্টিকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, ভুঁইফোঁড়’দের নিয়ে চাঁছাছোলা এক পরাক্রম দলিল চিত্র! একদিকে বলা যায় তিনি চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ভূমিকা উনি একাই পুরণ করেছেন ৮০’র দশকে অলাতচক্রের মত দলিলটি লিখে! জহির রায়হান এই কর্মটি সম্পাদন করতে পারতেন প্রামাণ্য চিত্রে, একটি ভিন্ন মাধ্যমে, কিন্তু এক অবিশ্বাস্য জনক ভাবে উনি অন্তর্ধান হলেন দেশ স্বাধীন হওয়ার অনতিবিলম্বে। এই যেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মতন রহস্যজনক ভাবে হারিয়ে গেলেন! এবং আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে আজো এই দুই বাঙালীর অন্তর্ধানের রহস্য উন্মোচনের জন্যে উভয় দেশের সরকারই কোন সঠিক ও প্রকৃত উদ্যোগ নেয়নি! জনশ্রুতি আছে যে শিল্পী জহির রায়হান ছফা ভাইয়ের মতন উনি সেলুলডের ফিতেয় ধারন করেছিলেন কলকাতার শরণার্থী, বুদ্ধিজীবী ও নেতাদের কর্মকান্ড নিয়ে দৃশ্যজ ডাইরী! যাতে ছফা ভাইয়ের মতন না দেখা বিচিত্র ঘটনার ডায়ালেক্টিক্সে ভরা! এবং আমরা জহির রায়হান যে ডাইরী লিখতেন এবং কলকাতার দৃশ্যজ দিনলিপির কথা জানতে পারি খুব সম্ভবত সাংবাদিক ও লেখক শাহরিয়ার কবিরকৃত সম্পাদিত জহির রায়হান রচনাবলীতে লিখিত ভুমিকাতে। তবে এই খেরো খাতার অস্তিত্ব সম্পর্কে হয়তো শাহরিয়ার কবির জানতে পারেন! যাই হোক, আমি অনুমান করি যা ছফা ভাইয়ের মতন একই মাত্রাগত অভিপ্রায় ছিল, যাতে পার্টিগত আত্ম-সমালচনার সুযোগ ছিল যা পরবর্তিতে একটা নূতন স্যন্থেসিস দিতে পারতো ! এই আত্ম-সমালোচনা দিকটি, আজকের রাজনৈতিক অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই সুপ্রযুক্ত!
অলাতচক্রের শীজোফ্রেনিক সত্ত্বা, একটা দুর্মর প্রকাশেঃ
Politicians laugh and drink –drunk to all demands
–Stevie Wonder
ছফা ভাইয়ের অলাতচক্রের মত উপন্যাসের ভেতকার ডায়ালেক্টিসে যাব না, এবং ওই তুখোড় তীরন্দাজের লেখক সত্তা’কে নির্ণয় করতেও যাবো না ! কেবলী ছফা চরিত্র’কে আমার মত করে দেখার চেষ্টা করব। স্কটল্যান্ডের স্টাভিস্টক মানসিক হাসপাতালের মনোবিজ্ঞানী রোনাল্ড ডি লাইং’কৃত শীজোফ্রেনিয়ার সংজ্ঞাটি আমার কাছে কেন যে মনে হয়েছে বারংবার আহমদ ছফার সত্ত্বা অন্বেষণে! লাইং ষাটের ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের বিদ্রোহী ছাত্রদের বাম দৃষ্টিতে শিজফ্রেনিয়া’কে কেবল মানসিক ব্যাধি হিসেবে দেখতে অপরাগ। ষাটের যুদ্ধবিরোধী সন্তানেরা আজকের ইরাক আফগানিস্তানের যুদ্ধবিরোধী সত্ত্বার মতন, কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধবিগ্রহের বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় ন্যায় ও বিবেক’কে সমুন্নত রাখতে প্রয়োজনে রক্তপাত ঘটায়, এবং ঘটাতে পারে। লাইং এই সংগ্রামী সত্তা’কে বলেছেন শীজোফ্রেনিক সত্ত্বা, যাদের জন্ম হয়েছে সমাজের অপর্যাপ্তি থেকে, যাদের জন্ম হয়েছে সমাজের বৃহত্তর সামাজিক শরীরের শূন্যতা থেকে । অন্যদিকে তাঁর শীজোফ্রেনিয়ার সনাক্তিকরণ অনেকটা মিশেল ফুকোর সমার্থক। তিনি পাগল’ এর ব্যাখ্যায় সমাজ’কে এক্সটার্নাল শক্তি হিসেবে দায়ী করেছেন। এঁরা এন্টি এস্টাবলিস্ট শ্রেণীর, তাদের বাঙময় সত্ত্বা সমাজের মুক্তি ও জাগৃতির দিকে তাঁদের লক্ষ্য। তারা সমাজের ডায়ালেক্টিক্স বোঝে, নৈতিক ও সামাজিক পটপরিবর্তন প্রশ্নে প্রয়োজনে আত্মহুতি দিতে যারা পিচ পা হয় না! ছফা ঠিক তেমনি! এই শীজোফ্রেনিক সত্ত্বা নিজের কোন অবলম্বন না থাকলেও এই সত্ত্বা কারো উপকারের জন্যে, স্পষ্ট চেতনার লক্ষ্যে যেন নিজের শেষ অবলম্বনটুকু ছেড়ে চলে যাবেন! প্রয়োজনে তিনি দিগম্বর হয়ে, মানে ইংরেজীতে যাকে বলে Buck naked!, নিরালম্ব হয়ে ছুটে যাবেন সেই মানুষের অণুতে মানবিক ভোর’কে প্রোথিত করতে! আহমদ ছফা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর সর্বাক্ষনিক ডায়ালেক্টিক্সের জানালা খোলা খাপে রেখেছিলেন, ফলে তাঁকে দেখি মুক্তিযুদ্ধে প্রতিনিয়ত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের মত বা ঋত্বিক সৃষ্ট নিশিকান্তের মত কিংবা আমাদের হালের দার্শনিক শ্লাভোয যিযেকের কিংবা সিডনী লুমেটকৃত ‘টুয়েলভ এংরি ম্যান’র ডেভিসের মত একটা ‘এভার এঙগেজিং’ এর একটা প্রেমিজ তৈরি করে যাচ্ছেন অনবরত। তিনি এসটাব্লিশমেন্ট গোত্রের কেউ ছিলেন না ফলে তিনি সেই ষাটের ছাত্রদের মতন ঢাল খোলা মুক্ত চিত্ত যেন। এখানে তাঁর গদ্য নির্মাণকৃতিও শীজোফ্রেনিক বর্ণাক্রম যা স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল সময়ের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়েছে! তিনি উপন্যাসের যে ক্যানভাস হাতে ধরেছেন সে অস্থির, অনিশ্চিত, উত্তাল (আনন্দের উত্তাল, উদ্দামতা অর্থে নয়) যুদ্ধে আশ্রয় প্রাপ্ত কলকাতায় মুক্তিকামী মানুষের পরিসর! এখানে আহমদ ছফা তাঁর গদ্যরীতি এই অস্থির সময়ের ব্যাখ্যায় শীজোফ্রেনিক। তাঁর এই পরাক্রম বর্ণপ্রভা ওই প্রতিনিয়ত সংযোগ (‘এভার এঙগেজিং’) আর প্রতিক্রিয়ার অভিঘাত করে চলেছে ! ছফা’র শীজোফ্রেনিয়া এখানে সংগঠিত প্রতিটা অণু পরমাণুর সাথে সেই পূর্বের উল্লেখিত এঙগেজিং সত্ত্বা, কি মানুষের উপকারে, কারো চিকিৎসা নিমিত্তে, কারো রেশন কার্ড তৈরিতে, কারো দেহজ বিকারে, বিবেকের দংশনে, রাজনৈতিক অসততায়, রাগে দুঃখে এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তাঁর প্রতিটা রক্তহরণ ও ক্ষরণ হয় নিজের ভেতর। লাইংকৃত সংজ্ঞায়িত শীজোফ্রেনিয়ার প্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা ছফার রক্তক্ষরণের প্রতিবাদী কণ্ঠ প্রায়ই রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে দেখি! অর্থাৎ অন্তরভেদী রক্তপাত হয়! এই শীজোফ্রেনিক সত্ত্বাকে দেখতে পাই আমরা অলাতচক্রের যতীন দা’র মুখে যখন তনু’কে আমাদের লেখক দানিয়েলের সাথে পরিচয় করে দেয়া হয় এই বলে যে, ‘আর ও হচ্ছে দানিয়েল, অনেকগুণ, কালে কালে পরিচয় পাবে। তাঁর সর্বপ্রধান গুণ হলো সে ভয়ানক রাগী। নাকের ডগার কাছ দিয়ে মাছি উড়ে যাওয়ার সময় দু-টুকরো হয়ে যায়!’ এখানে আমার যা মনে হয়েছে, যদিও কষ্টকল্পিত শোনাবে না হয়তো, মাছির দু’টুকরো হয়ে যাওয়া যেন ডায়ালেক্টিক্সের কথা। মাছির একটুকরো থিসিস, অন্যটা এন্টি থিসিস ! দুই টুকরো হাওয়ায় ছুড়ে ফেলে ঝেড়ে বের হয় তৃতীয় মাত্রা! ছফা ভাইয়ের দুর্মর ডায়ালেক্টিক্ বিশ্লেষণ প্রসূত স্যন্থেসিস! শীজোফ্রেনিক গদ্যভঙ্গি যে যাই বলুক, তাতে সংকটের বহুমাত্রিকতার ভিতর থেকে তিনি দিতে চান বিপরীত স্রোতের অভিযাত্রার সংকেত! কলকাতায় তাঁর উপস্থিতি না হলে মনে হতো বাঙ্গালীরা আমরা ইতিহাসের একটা আরামদায়ক কমফোর্ড জোনে ব্যাপৃত থাকতাম! তাঁর শীজোফ্রেনিক চোখের প্রিজম খানা যেন সর্বত্রগামী, যেন কোন অবগুন্ঠন আভরণে ঢাকা যাবে না! ছফা ভাই যেন প্রতি তল্লায় সার্ভিলেন্স ক্যামেরা বসিয়ে দিয়েছেন, যা চোখে দেখছেন, আর তাঁর প্রতিক্রিয়া আমাদের ব্যক্ত করছেন ক্ষণে ক্ষণে! এই যেন নীৎশীয় ইভেন্ট! তৈরি করে চলেছেন, প্রতিটি সময়ে প্রতিটি ক্ষণে তিনি নিজের ভেতরকার এনার্জীর সাথে বাইরের এনার্জীর সঙ্গমে একেকটা ইভেন্ট তৈরি করছেন প্রতিনিয়ত! তাঁর এই পর্যবেক্ষণে একটি স্বদেশের বিশাল সংকটের কথা বলে, কিন্তু সকল ডায়ালেকটিক্সে আছে নঞ্চ বোধের স্রোত। মনে হবে স্বাধীনতাকামী মানুষটি এই সকল ব্যাপক অরাজক পরিস্থিতি কেনো প্রত্যক্ষ করছেন? তাঁর সৃষ্ট চরিত্র জাহিদুল হকের মত স্বেচ্ছাচারীর মত বলবেন হয়ত, ‘তাঁর কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, অন্যান্যের মত মদ আর মেয়ে মানুষ নিয়ে সিটি ড্রেনে গড়াগড়ি তো খেতে পারতেন, নিজের নীতি আর বিবেক বিসর্জন দিয়ে কেউ কি আর নেই?’ কিন্তু সেই তর লিঙ্গানন্দে গা ভাসিয়ে না দিয়ে ব্যাতিক্রম হতে পারেন কেউ কেউ, যেমন আহমদ ছফা, জহির রায়হান প্রমুখ চেতনা প্রবাহী মানুষ সকল! ফরাসী দার্শনিক অ্যাঁলা বাদিয়্যূ যা বলেছেন খুব সহজ ভাষায় বললে যা দাঁড়ায় তা হল কোন শ্রমিক’কে যদি কোন প্রতিষ্ঠান ডিস্ক্রিমিনেট করে তাহলে সে অপরাধের শিকার যে ব্যক্তিটির উচিৎ এই অসম সংকট’কে বিচারের দাবীতে ট্রেড ইউনিয়নের চোখে আনা, যাতে তার সততা বা ট্রান্সপারেন্সী সবার দৃষ্টিগোচরিত হয়! ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি সংকটের ভেতর থেকে একটা স্পষ্ট সততার স্বর ধ্বনিত করতে, সবার দৃষ্টি কাড়তে ট্রেড ইউনিয়নে যাওয়ার মতন কেউ উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, চলচ্চিত্র, সংবাদে তুলে আনতে পারেন ওই বিগ্রহকালের চিত্র। ছফা ভাই এনেছেন কলকাতা অবস্থানকারী একাধিক চরিত্রের কেইস স্টাডি সবার চোখে দৃষ্টিগোচরিত করার ব্জন্যে শুধু নয়, কিন্তু এই বিগ্রহের চিত্রের একটা সমগ্রতা পাওয়ার জন্যে। ছফা ভাই যেন নিজ দায়িত্বে ইতিহাসে দায়মুক্তি ঘটাতে আমাদের সংকট’কে ব্যাখ্যা করতে ফুরসৎ দিয়েছেন! আমেরিকান মার্ক্সিস্ট সাহিত্য দার্শনিক ফ্রেড্রিক জ্যামিসন বলেছেন যে কোন বর্ণনাক্রমে সত্যটা অনুচ্চারিত থাকে, অর্থাৎ ঢাকা থাকে, তা কেবলী ব্যাখ্যায় সেই ঐতিহাসিক সত্য প্রকাশ পায়। অলাতচক্রের কলকাতার রাস্তায় তপ্ত রোদে ঘর্মাক্ত, কোমড় পর্যন্ত বিস্টির পানির সরিয়ে যে শীজোফ্রেনিক অথচ অতিদ্রুত কথন ভঙ্গীতে সে সত্যের বয়ান তার স্রোত বেয়ে আমরা বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যায় অগ্রসর হতে পারি একটা অমোঘ ঐতিহাসিক সত্য নিরূপণে! ছফা’র শীজোফ্রেনিক সত্ত্বা আমাদের কি বলে? নেতৃত্বের প্রশ্নে আমরা কি নিরব ভূমিকা নেবো? কলকাতা’র থিয়েটার রোডের সে যুগের নেতৃবৃন্দের নৈরাজ্য আর অজবাব্দিহিতার রাজনীতি কি এখন বিদ্যমান নয়? আমাদের আত্ম-সমালোচনা করার সাবালকত্ব কতো যুগে গেলে পরে দেশের মুক্তি ঘটবে? এর মুক্তি না ঘটলে তো যে কোন পার্টিগত রাজনীতি সহসা হয়ে পড়ে ওলিগার্কির, হয়ে পড়ে ফ্যাসিস্ট! কেন গণতন্ত্র? গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতায়ণের অন্যপিঠ কি দূর্বৃত্তায়ন?