বাংলা নবর্বষ: ঋতুযোগ ও বিবিধ
আজিজ কাজল
বাঙালির আচরণের মেজাজ ও ধরন এবং ঋতু-প্রকৃতির মেজাজ ও ধরন যেন একে অপরের অন্যতম পরিপূরক। ঋতুর আচরণে অনেক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্যযোগ্য হলেও মানসিক আচরণ ও পেশাগত আচরণে বাঙালির ঋতু নির্ভরতা ফেলনা নয়। কেননা কোন মাসে নতুন ধান হয়, কোন মাসে কোন ফসল বা তরিতরকারী সুবিধাজনক। কোন সিজনে সমুদ্রে মাছের চাহিদা বেশি। এবং বেচাকেনার মুনাফা অধিক হয়। বাগানে কোন সময় কোন ফল-ফলাদি ভাল হয়। কোন প্রজেক্টে কোন মাছের চাষ দুর্যোগহীন সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যায় ইত্যাদি। মোটামুটি নগর জীবনের মানুষের চাকরি বাকরি ব্যবসা বাণিজ্যে মূল পেশা ছাড়াও সহায়ক পেশা হিসেবে বাঙালির ঋতু-নির্ভরতা কোন মতেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
মানুষের শারীরিক গঠন, কথা বার্তা আচরণে প্রকৃতি অনেক বড়ো অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। বারের হিসেবে অথবা অনিবার্য জীবনাচরণের হিসেবে ইংরেজি বার বা তারিখগুলো আমরা প্রতিদিন মনে রাখি। তেমনি ইংরেজি হিসেবের পাশাপাশি নানা কারণে, বাংলা ঋতুর বাংলা সন বা তারিখের হিসেবও অনেকের মনে রাখতে হয়—সনাতন ধর্মাবলম্বীর দুর্গাপূজা, লক্ষীপূজা, সরস্বতী পূজা, কালি পূজা, মনসা পূজা, আশ্বিনে রেঁধে কার্তিকে খাওয়ার হিসাবসহ বিভিন্ন উৎসব, পালা-পার্বণ, কোষ্ঠী গণনা ও বিয়ে সাদীতে তারা (অমাবশ্যা, পূর্ণিমা, শুক্লপক্ষ এবং কৃষ্ণপক্ষের হিসাবসহ) বাংলা তারিখ বা সনগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তেমনি মুসলমান সম্প্রদায়ের রোজা, ঈদ, রবিউল আউয়াল, মিলাদুন্নবী, শবে মেরাজ, শবে বরাত, শবে কদর, ইদুল ফিতর, ইদুল আজহা এসব দিনগুলো গণনার হিসাবেও অনেককে আরবি সনের পাশাপাশি বাংলা সনকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে নিতে দেখা যায়। ইংরেজি ক্যালেন্ডার, দিনপঞ্জিতেও বাংলা সন বিশেষ গুরুত্বের সাথে স্থান পায়। এছাড়াও আছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব বুদ্ধপূর্ণিমা বা বৈশাখি পূর্ণিমা(বুদ্ধের ত্রিস্মৃতি বিজড়িত বলে, এবং এটি বৈশাখ মাসে উদযাপন হয় বলে বৈশাখী পূর্ণিমাও বলে) মাঘী পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমা, প্রবারণাসহ বিবিধ আচার অনুষ্ঠান। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ক্রিসমাস বা বড়দিন, ইস্টার সানডে সহ সব ধরনের অনুষ্ঠান, মোটামুটি ঋতু-ভিত্তিক বা ঋতু-নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
পহেলা বৈশাখ। বাঙালির সম্পূর্ণ নিজস্ব-সংস্কৃতির বিশাল একটি পরিচয়ের বাহক বাংলা নববর্ষের কথা বললে, হাজার বছরের বাংলা, বাঙালি এবং পরম্পরাভেদে (যদিও স্থান-কালভেদে দুই বাংলার সম্মিলিত নানা বৈশিষ্ট্যকে নিজের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জন্য স্বীকার করতে হবে) বাংলাদেশের কথা চলে আসে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মনে করেন, বাংলার নদীমাতৃক পূর্ব বঙ্গে হয়েছে ভাটিয়ালি গানের বিস্তার। আর শুষ্ক বঙ্গে হয়েছে ভাওয়াইয়া গানের বিস্তার। আর বাংলা ও পশ্চিমাঞ্চলে হয়েছে কীর্তন ও বাউলের। এভাবে বাংলার মানসসংস্কৃতি, সাহিত্য ও সংগীত, অধ্যাত্মচিন্তা ও দর্শনকে কেন্দ্র করেই মূলত গড়ে ওঠেছে। এবং এইসব বিষয় যে অনেকবেশি প্রকৃতিলগ্ন তা তিনি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন। সুতরাং এভাবে আসে চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কথা। আসে মাটিজাত মরমী শিল্পী লালনের কথা। হাসন রাজা, রাধারমণ, আসকর আলী পণ্ডিত, শাহ আব্দুল করিম, উকিল মুন্সি, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, শেফালি ঘোষ, আব্বাস উদ্দীন, আব্দুল আলীম, পল্লীকবি জসীম উদদীন, আসকর আলী পণ্ডিত; আসে মাইজভাণ্ডার, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি সারি, লোকগান, লোকসাহিত্য, লোককথা, কিংবদন্তি, মিথ, এক তারা, ঢোলসহ মৃত্তিকালগ্ন পলিময় নানা সাংস্কৃতিক ব্যঞ্জনার কথা।
এখানে কেউ করেছেন মরমীবাদের মধ্য দিয়ে আধ্যাত্ম এবং অধ্যাত্মের যোগসাধনার চর্চা। কেউ করেছেন সহজ সরল পল্লীর জয়গাঁথা।কেউ করেছেন এই বাংলার ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের মাটি ও মানুষের জয়গান। প্রাণসঞ্চারী তথা হৃদয়ভেদী আঞ্চলিক গানের সরাসরি অমৃতবচনের গান ও শিল্পের চর্চা। রয়েছে বাঙালির নিজস্ব রসনা ইলিশ, শুটকি, লইট্যা, ভেটকী, টেংরা, পুঁটি, মলা, ঢেলা মাছ ইত্যাদি। আসেএখানকার নিজস্ব জলাধারসহ পুকুর, দীঘি, নদ-নদীর কথা। আসে মাটির শানকি, কলস, শাড়ি, শীতল পাটিসহ কামার, কুমারপালমশাই এবংপটুয়াদের কথা—এককথায় এই নববর্ষ হচ্ছে আমাদের বাঙালি জাতির নিজস্ব অশত্থ বা বটবৃক্ষ। আর উল্লেখিতঅনুষঙ্গগুলো হচ্ছে তার শক্তিশালী সতেজ-শাখা, ডাল পালা, অমৃত ফলের নিকুঞ্জ।
নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়ে বিবর্তনের ধারায় বাঙালির নিজস্ব মহোৎসব এই নববর্ষ, তার বড় একটা জায়গা অধিকার করে আছে। এই উৎসবের ভেতর থেকেও সে নিতে চায় আমাদের নৃ-গোষ্ঠীর যাপনবৈচিত্র্য-ঐতিহ্যসহ কৃষ্টি-সংস্কৃতির নানা আধার পাহাড়ী জনবসতিলগ্ন এলাকাগুলোতে অনেক নৃ-গোষ্ঠীসহ বাঙালিদের বাস। তাদের উর্বরা মাটিতে ফলানো ফল-ফলাদি, শাক-সবজির কদর এখন অনেক বেশি। গ্রাম ছাড়িয়ে এসবএখন নগরের স্বাস্থ্য সচেতন মানুষেরাও উচ্চমূল্যে ক্রয় করছে। আছে কামরাঙা। ধনে পাতা। ধনে মরিচ। বাতাসা মরিচসহ বিবিধ মরিচ। বেলুম্বু ফল। বেল বা শ্রীফল (সংস্কৃত নাম বিল্ব ফল) তাল। আম। দেশি কমলা। লিচু। জলপাই। জাম। কাঁঠাল। পেয়ারা। বাতাবি লেবু বা এলাচি লেবু (অঞ্চলভেদে আবার একেক ফল ফলাদি, সবজির সাইজ আর স্বাদ একই বা কাছাকাছি বলে অনেক সময় নামেও কিছুটা ভিন্নতা বা তারতম্য আছে) এ জাতীয় ফলগুলো আমাদের পলিময় দেশের মাটিতেই নিজ স্বাস্থ্যগুণে সমৃদ্ধ। উল্লেখিত সবজি বা ফল-ফলাদিগুলো একেক সিজনে, পুরো বারোমাসে অথবা ঋতু-নির্ধারিত সময়ে হয়েথাকে।
এসব খাবার-দাবার বাঙালির রুচি-অভ্যাস জীবনাচরণে, নিজেদের আবহাওয়া এবং মাটি গুণের প্রতি আলাদা কদর ও ভালবাসা বাড়ায়। যদিও ওষধি গুণসম্পন্ন এসব আইটেম এখন গবেষণার মাধ্যমে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির আওতাভুক্ত হয়েছে। এবং একে পুঁজি করে দেশে বিভিন্ন ধরণের ঔষধালয়ও জেগে ওঠেছে। কেননা আমাদের গ্রাম্য চিকিৎসা পদ্ধতি সেই পাঁচ হাজার বছর আগের (পাক-ভারতের) আয়ুর্বেদ চিকিৎসা-শাস্ত্রের উত্তরাধিকারকে নানা প্রকরণে বহন করে চলেছে। পুরনো কবিরাজী, আয়ুর্বেদ হারবাল চিকিৎসার পাশাপাশি এই চিকিৎসা পদ্ধতিও নিরাময়ের অমোঘ শক্তি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এসব আইটেম এখন সর্বত্র সুলভ।
বাংলার প্রান্তিক মানুষ এমনকি অনেক শহুরে মানুষেরাও এখনো গ্রাম্য বিষয়গুলোর সাথে নানাভাবে সম্পৃক্ত; তার যথা-উদাহরণ— বৈশাখ আসলে শুরু হয় অন্যরকম তোড়জোড়। এবং স্বাভাবিকভাবেই কিছু বিষয়ের প্রতি থাকে আলাদা দুর্বলতা। হাট বাজার থেকে শুরু করে সর্বত্র মিলে শুরু হয় তরমুজ, বাঙ্গি, গজা-মজা-মিঠাই-খৈ কড়ই কটকটি কেনার ভীড়; এমন বিবিধ মজাদার শুকনো খাবারে ভরপুর থাকে পুরো গ্রাম-বাংলা এমনকি শহর বন্দর।
বাংলা নববর্ষ হচ্ছে বাংলার নিজস্ব বটবৃক্ষ। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বাংলা নববর্ষের গুরুত্বপূর্ণ শাখা প্রশাখা। এখন সময় হয়েছে নিজেদের ঋতুজ শস্য ও ফল-ফলাদির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার—বাংলার সিজনাল বা ঋতুজ জিনিসের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে হবে; এর মাঝেই লুকিয়ে আছে আমাদের নিরাময়েরও অমোঘ শক্তি।