কুমার চক্রবর্তীর একগুচ্ছ কবিতা
নিয়তিগ্রস্ততা
নিয়তিগ্রস্ত আমি, দাঁড়িয়েছি এসে
এই মর্মী নদীটির পাশে⎯
যে নদীর ভেতরে মিশেছে নদী, সমুদ্রসম্ভব দূরচিহ্ন,
হাজার বছর ধরে পাখিদের উষ্ণ মনো¯্রােত।
বাতাস বইছে, দেখি দূরে⎯অন্তর্বস্তুরূপ,
বর্ণরূপ, একটি রমণীপ্রিয়
মাছরাঙা মুখে পুরে নিয়ে যায় জলের মরুৎ।
ভাবি, এ জীবন মৃত্যুকে সাজায়:
নদী জানে এইরূপ কথা, — বলে⎯
পাখিরা এখানে এসে ঠোঁটে করে মৃত্যুকেও তুলে নিয়ে যায়!
জেতবনে
জেতবনে এসে আজ দেখি⎯
মনের ভেতরে মন ঢুকে বসে আছে,
বিগ্রহ কোথাও নেই, বিনাশ আর বৈভব যেন
ধূসর ছায়া বিস্তার করে রেখেছে।
মনে পড়ল তোমার চম্পক বন⎯
একদা একা একা হেঁটে চলা,
চারপাশের হাওয়া ছিল কায়মাতাল।
হঠাৎ শুনি গুম্ফার ঘণ্টাধ্বনি,
বুঝতে পারি⎯নিকটেই তুমি,
তোমার হোমমন্দির।
তোমার গন্ধ,বর্ণ, ধ্বনি, রস, মন, মাধুর্য আর স্পর্শের বর্তমানে
যাই⎯দেখি, অদ্ভুত এক দেবীপক্ষ,
যেখানে জোছনার রস নিরন্তর শুষে খায়
তোমার আমার ক্ষয়িত ব্যথারাশি।
তোমার ধ্বনিময়তায়
তন্ত্রমুদ্রার মতো দু-দুটি তিল পাহারা দেয় তোমার শরীর
যেন শুক আর সন্ধ্যাতারা
⎯অদৃশ্যভাবে পাহারা দেয় তোমার অসম্ভব-আকাশ।
তোমার অস্তিত্বরাশি যেন ভাটিতে নেমে আসা
সালসাবিল, মধুবনে
ঘুমিয়ে পড়া মধুপবন, কার পরশে যে সংবেশিত আজ!
এখনই নদীর জল ফিরে যাবে উলটোপথে, নিয়ে আসবে
মালভূমির পূর্বরাগ আর চন্দনবনের ঘুমধ্বনি।
টের পাই সময় কীভাবে স্মৃতি হয়, আর স্মৃতি আবারও
জন্ম দিতে থাকে অজ¯্র আয়নামুহূর্তের, যা কি না
তোমাকে উদ্ভাসিত করতে চায় গুলশানমুখরিত হর্ষময়তায়
⎯যা আজ সুর হয়ে, রাগ হয়ে, তান হয়ে,
আমাকে বিবশ করে যায়!
কাল ও তুমি
সন্ধ্যার নদীকূল ভালো, অবলোপী
দেখা যায় জলের বিষাদ
একটি খঞ্জনা পাখি এইমাত্র উড়ে গেল
মনে তার বিস্ময় অপার
বধিরেরা এইপথে আনমনে বয়ে চলে বেদনার ভার।
তোমার বসন্তকুঞ্জ হয়েছে যে ঋদ্ধ, এইবার
ফুলে-ফলে কোরকের ছলে
কিন্তু জেনো হিমবতী ঋতু অনুবর্তী
একটি ছায়ার মতো বিস্তারিত, মৃত্যুর কৌশলে।
যে-সব পুষ্পকলি ফোটালে, কী আশায় আশায়
কালের বন্দনাগীত স্তব্ধ হলে
সে-কোন অজানা থেকে ভেসে আসা নিশ্চিহ্নের দান
গ্রহণ করতে হলো নিয়তির বরে
জন্মনক্ষত্রের দিকে ছুটে গেল একটি প্রলয়
প্রবল প্রচÐ খেলাচ্ছলে!
তবু থাকো প্রীতি নিয়ে, প্রেমনদী বেয়ে দিন যাক
আশ্চর্য দিনের পরমায়ু তোমাকে অস্থির করে করে
ভিড়বে আমার কাছে আজ
পেছনেই পড়ে থাক মরণের রক্তচক্ষু, শূন্যগর্ভ মাঠ!
নির্বাণ
এ ভুবন কারণসম্মত নয়, আজ
তাকে দাও নিখিলের ভার
আমার সমস্ত বোধ, অহো উদ্বোধিত
সেই নিক মোরে, আজ আমি হই তার।
তবে কি আকাশে হাসে তারা
পৃথিবী বাজায় আত্মসুর
সবকিছু ঠিকঠাক হলে হবে-না কিছুই
যদি না সে গড়ে অন্তঃপুর!
সম্পর্ক তো নয় বিবাহসম্মত
অনৈতিক সৌন্দর্যই প্রাণ
যদি হয় সুর পরিণত, এই রাতে
তবে দুজনের পরিনির্বাণ!
মৃত্যু
মৃত্যুর পর কেউ আর
হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান
বা অন্যকিছু থাকে না,
থাকে না ধর্মীয় বা অধর্মীয়,
⎯কিন্তু হয়ে যায় আধ্যাত্মিক।
কেননা মৃত্যুতে ব্যক্তি
বস্তু থেকে ভাবে রূপান্তরিত হয়
কায়া তখন ছায়া হয়ে যায়,
হয় কালরূপ,
সে তার আগের সব পরিচিতিকে বাতিল করে
অনন্ত হয়, আর অপার্থিব থেকে পার্থিবকে
শাসাতে থাকে।
রহস্য অতল
দৃষ্ট জলরেখা ধরে এসে যাই পলল ভূমিতে
চারদিকে জলভাঁজ, জলস্তর, জলরূপলীলা
আমার নশ্বর মান্দাস ভাসে, ভেসে চলে
ডুবে যাবে বলে,
গন্ধ পাই হারানো নদীর, দেখি লুপ্ত জলজাদুঘর,
হাত রাখি সোঁদা বুকে অতঃপর
কে যেন অদূর থেকে হাঁক দেয়⎯
রাখো আরও নীচে হাত, তবে
পেয়ে যাবে স্পর্শ-⎯রহস্য অতল!