‘মন্ত্র পড়া ধর্ম নয়, কর্মকেই ধর্ম মনে করি’-শাহ আবদুল করিম
সৈয়দা আঁখি হক
বাউল চেতনার কবি শাহ আবদুল করিম আজীবন ছিলেন ত্যাগÑতিতিক্ষায় অনড়, সত্য ও ন্যায়ের পথে প্রতিজ্ঞাপূর্ণ। ভাববাদের বৃত্ত ভেঙে সমাজের বাস্তবতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বস্তুবাদী এই সাধক সাহসী উচ্চারণে বলেছিলেন, ‘মন্ত্র পড়া ধর্ম নয়, কর্মকেই ধর্ম মনে করি।’ অন্তরদ্রোহের ক্ষোভগুলো তাঁর বেদনারই স্মারক, তাঁর দীর্ঘ জীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞাতাগুলো যেন একেকটি ইতিহাস। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন করিমের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, চিন্তার ব্যাপ্তি ছিল সমষ্টিগত। সমাজ ও মানুষকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করার সামষ্টিক ভাবনায় স্বাতন্ত্র্য এই কবি বলেন-
এইসব নিয়ে দ্ব›দ্ব কেন
কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান,
তুমি মানুষ আমিও মানুষ
সবাই এক মায়ের সন্তান।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সর্ব শ্রেণির মানুষকে উজ্জীবিত করার প্রয়াসে মানুষের কল্যাণে গণসংগীতে গেয়েছেন মানুষেরই জয়গান। সমাজের সংকীর্ণতা, অত্যাচার, অন্যায়-অবিচার ও হীন মানসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে জাগিয়ে তুলেছেন মানুষের চেতনার জগতকে। সমাজ, রাষ্ট্র ও হাওরা লের বি ত, অবহেলিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র অতি কৌশলে গানের বাণীতে তুলে ধরে বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন, দিয়েছেন শোষকের বিরুদ্ধে হুংকার-
মাথা নত করে আর বসব না ঘরে
বলব উচ্চস্বরে পূর্ণ স্বাধীন চাই
সহিব না আর কোনো অবিচার
করিব এবার সত্যের লড়াই।
জাতির উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতেন করিম। এখানেই তিনি অনন্য এবং স্বাতন্ত্র্য। রাজনৈতিক জীবন, মানব কল্যাণমূলক কাজ, সামাজিক পটভূমি এবং শিক্ষা বিস্তারে তাঁর আত্মনিবেদন জাতিকে অনুপ্রাণিত করে। অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী উদ্যোক্তা ও সমাজ সংগঠক করিম মাঝে মাঝে পরকালের চিন্তায় ডুবে যেতেন। যথার্থ জীবনীশক্তিতে পরম পুরুষের ভজনা করেছেন হাসি-খুশি-নম্র-বিনয়ী এ সাধক। ভাবতেন দেশ ও জাতি নিয়ে, কাঁদতেন অসহায় মানুষের দুঃখে। কিন্তু খাদ্যের অভাবে কেবল পানি খেয়েও দিন কাটিয়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। পুরস্কার পেয়ে বাড়ি ফেরার মত গাড়ি ভাড়া ছিল না তাঁর, বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন প্রিয়তমা স্ত্রী সরলা। তাঁর চিন্তা-চেতনা ও গান আমাদের হৃদয় সিংহাসন জয় করলেও জীবদ্দশায় সুখের ছোঁয়া পাননি তিনি। অভাব যাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল তাঁকে কি ‘সম্রাট’ বলা যায়? এত দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেও বিলাসিতার লোভ ছিল না। কোনও প্রত্যাশা নয়; কেবল দু’মুঠো খেয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। জীবনের পরন্তবেলায় এসেও মানবসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে ভেবেছেন মানুষের কল্যাণের কথা। সয্যাশায়ী অবস্থায় একমাত্র সন্তানকে বলেছিলেন- ‘১০টি স্বপ্ন পূরণের মাধ্যমেই গানে-গীতে-জনকল্যাণে আমার জীবন ধন্য করতে চাই। আশা করি তুমি আমার ইচ্ছের মূল্যায়ন করবে।’ এই প্রত্যাশাগুলো ব্যক্ত করেছিলেন গানের বাণীতে-
আমি বাউল আবদুল করিম, কুঁড়ে ঘরের সন্তান
আমার প্রতি এলাকাকাসীর, আছে অনেক অবদান
প্রতিদান দেবার মতো, আমার কিছু নাই
চিরঋণি হয়ে আমি, নিবেদন জানাই
আমার নামে কেউ যদি, কোন কিছু করতে চায়
উজানধলে করতে হবে, থাকব শুয়ে সেই জায়গায়
আমার হাড্ডি নিয়ে ব্যবসা হবে, আমরা আজ উপাস
একদিন চিনবে আমায় আসবে টাকা, আমার আত্মবিশ্বাস
সেদিন হয় তো বা আমি, নাও থাকতে পারি
টাকা আসলে বাড়িটা মোর, কইরো বাউন্ডারি
কালনীর তীরে উচ্চ গেইটে, নাম ঠিকানা লিখবে
উজান ভাটি করতে মানুষ, আমি কোথায় দেখবে
দুই প্রান্তে লম্বা ঘর করে, নদীর পাড়ে নিবে
অতিথি মোছাফির থাকা খাওয়ার, সুব্যবস্থা দিবে
ভিক্ষুক অনাহারীর জন্য, খুলবে লঙ্গরখানা
সংগীত বিদ্যালয় চালু করে, শিখাইবে গান বাজনা
দেশ বিদেশের গবেষক আসবে, গবেষণা করিতে
তাদের সুবিধার্থে একটা, ডাকবাংলো হবে গড়িতে
পাশে থাকবে স্মৃতি সংসদ, একটা পাঠাগার
একটা পার্কের মতো, গড়ে তুলবে বাড়িটা আমার
টাকার অভাব হবে না, দয়াল মৌলায় দিবে
টাকা আসলে এই কাজগুলো, বাকি না রাখিবে
গান গীত মানব সেবায়, থাকব আমি চিরকাল
জনস্বার্থে আমার বাড়ি, গড়বে এটি হাসপাতাল
লোকায়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র করিমের কাছে গান ছিল প্রেমাস্ত্র। মরমি ভাবনায়, প্রগতিশীল চেতনায়, লোকজ সুরের আশ্রয়ে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন গীত বাণীকে। আধুনিককালের মধ্যবর্তী সময়ে বাঙালি জাতির চিন্তা-চেতনায় প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল দেশপ্রেম। সেই ধারাবাহিকতায় পূর্বসূরিদের মত করিমেরও দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সংগ্রামি চেতনা স্মারক হয়ে থাকবে বাঙালির ইতিহাসে। নিরন্ন-অসহায় মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তাঁর কালজয়ী গানগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। সহানুভূতি এবং মানুষের দুঃখ-বেদনাগুলোই তাঁর দৃষ্টিকে অন্তর্ভেদী করে তুলেছিল বলেই অত্যন্ত সহজ কথায় লিখেছেন বাঙালির মাতৃভাষা, স্বাধীনতা, বাঙালিদের শোষণ ও শোষিতদের ইতিহাস। তাঁর গণসংগীতে মার্কসীয় প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট, ফলে তাঁকে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিক কবি বললে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না। আজীবন মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছেন, জাতিকেও বাঁচার মতো বাঁচতে বলেছেন-
শপথ নেও বাঙালি যত
বাঁচলে বাঁচব বাঁচার মতো
আমরা হব না নত
যদি হয় প্রলয়।
ভাটিপুত্র শাহ আবদুল করিম জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভাটির জনপদের জীবনসংগ্রাম ও ইতিহাসের চিত্রকল্প এঁকেছেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে। ভাটি বাংলার ইতিহাস নির্মাতা করিমকে আমৃত্যুই যুদ্ধ করতে হয়েছিল অভাবের সঙ্গে। নিজের সুখ-সমৃদ্ধির কথা ভাবেননি কখনো, বরং জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন মোহ-লালসাকে। দিনমজুর পিতার শেষ সম্বল জমিটুকুও হারিয়েছেন দেনার দায়ে। অভাব-অনটনসহ নানা প্রতিক‚লতা ডিঙিয়ে গণসংগীত গেয়ে বাঙালি চিত্তকে জাগ্রত করেছিলেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, হিংসাখোরদের বাধা-বিপত্তি, অভাব-অনটন তাঁর জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল। অত্যন্ত সাহসের সঙ্গেই তখন বললেন-
হাত বান্দিব পাও বান্ধিব আমার, মন বান্ধিব কেমনে
তোমরা যে বুঝাও গো আমার, মনে কি মানে?
সকল প্রতিক‚লতা ডিঙিয়ে বাউল চেতনা থেকে গণমানুষের জীবনসংগ্রামের চেতনায় উন্নীত হয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও নিজের কথা বলেননি; অন্যের জন্য ভেবেছেন আজীবন। তিনি যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন সমাজ, রাষ্ট্র, মানবতার কাছে। ভাবনায় বিভোর হয়ে একদিকে লিখেছেন প্রেমের গান, আবার মে উঠে গীতবাণীতে উদাত্তকণ্ঠে পৌঁছে দিয়েছেন জাগরণের বার্তা। গানে গানে বলেছেন নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায়ের কথা। মরণ ভয়কে তুচ্ছ করে মুক্তিযুদ্ধে গান গেয়ে অনুপ্রাণিত করেছিলেন বাঙালির বীর সন্তানদের-
বলো স্বাধীন বাংলা
মোদের মাতৃভূমির জয়,
প্রাণপণে প্রতিজ্ঞা করো
ছেড়ে দাও মরণের ভয়।
চল্লিশ থেকে সত্বরের দশক পর্যন্ত শাহ আবদুল করিম দোতারা, বেহালা হাতে ঘুরে বেড়িয়েছেন মাজারে, মন্দিরে, আখড়ায়। তিনি মে উঠলে দর্শক নিস্তব্ধ হয়ে যেত। সারাদিনের পথ পায়ে হেঁটেও তাঁর ভক্তরা আসতেন গান শুনতে। এভাবেই রাতের পর দিন কেটে যায় বিভিন্ন গানের আসরে। গান শেষে গৃহে ফেরার পর শত অভাবের মাঝেও তাঁর বাড়িটি ছিল যেন স্বর্গলোক। লোকে লোকারণ্য থাকতো সর্বদা। বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, লেখক, গবেষক, পির-ফকিরের পদচারণায় আনন্দে-উৎসবে মুখরিত ছিল তাঁর বাড়ির আঙিনা আর প্রিয় কালনীর তীর। নদীর কলতান, পাখির কলকাকলী, হাওয়েরর রূপসুষমায় বেড়ে উঠা এই ভাবের মানুষ ভাবোন্মাদনায় ভক্তের আবেষ্টনে গলা ছেড়ে গাইতেন-
মানুষ হওয়ার ইচ্ছা থাকলে, মানুষের সেবা করিলে
বাউল আবদুল করিম বলে, মানুষ হইতে পারো
হিংসা নিন্দা দিলের গুমান, লোভ লালসা ছাড়ো
জীবনের প্রথম দিকেই বাংলা ভাবসংগীতের দীক্ষা পেয়েছিলেন দাদার কাছে, জীবনের শেষের দিকে এসে গণসংগীতে মনোনিবেশ করেন। একদিকে তিনি যেমন গণচেতনার কবি, অন্যদিকে এই সহজ মানুষকে খুঁজে পাই বাউল আঙ্গিকের গানের রচয়িতা ও এবং বাউল গায়ক হিসেবে। সমাজ পরিবর্তন, সংকটে, নিদানে, বিপদে গণমানুষের মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা করিমের গানই ছিল একমাত্র শক্তির প্রতীক। অসাম্প্রদায়িক মানসগঠনে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে প্রজ্ঞা ও মননশীলতায় বিবেককে জাগ্রত করার অভিপ্রায়ে গান গেয়েছেন। নারী শিক্ষা, নারীর অধিকার ও সমমর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলেছিলেন-
স্বাধীন দেশের মানুষের
অধিকার চাই
সমানভাবে দেখতে হবে
নারী-পুরুষ প্রভেদ নন
সেবক হয় নারী জাতি
সবসময় সেবাতে ব্রতী
বিদ্বেষ কেন তাদের প্রতি
বলো এবার জানতে চাই
পঞ্চাশের দশকে ভাটি বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টি করা এই গীতিকবি নব্বইয়ের দশকে মিডিয়ার বদৌলতে পৌঁছে গেলেন সারাবিশ্বে। ফলে অনুসন্ধিৎসু করিমের গান নিয়ে হচ্ছে বিস্তর গবেষণা এবং অনুবাদ, অনুরণিত হচ্ছে ভক্তের কণ্ঠে। প্রায় ছয় দশক সাধনা করে তিনি হলেন লোকপাঠের বিষয়বস্তু। কৈশোরে তত্ত্বকথা বুঝার বোধজ্ঞান না হলেও ডুবে যেতেন গানের ভাবগহীনে। সংসারে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে কিশোর রাখাল মুদি দোকানে কাজ করলেও থেমে যায়নি গান গাওয়া। সর্বশেষে নিজের নয় বিঘা জমি বিক্রি করে গানের বই প্রকাশ করেছিলেন। কোমল, ভাবুকপ্রাণ এবং সৃজনপিয়াসী করিমের গীতিগ্রন্থে রয়েছে- মানবিকতা, প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজব্যবস্থা, দেশপ্রেম, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং অসহায়-দরিদ্র মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, সম্প্রীতি ও সাম্যের কথা। পরম মমতায় এঁকেছেন শোষণ, নির্যাতনের করুণচিত্র। ভাটির আদি ইতিহাস তুলে ধরেছেন ইতিহাসবেত্তার মতো। তাঁর উজ্জ্বল মানসলোকের স্বকীয়তা থেকে আলোর রশ্মি বের হয়েছে বলেই প্রাণ খুলে তাঁরই উত্তর প্রজন্ম এখন গাইছেন-
আমি কুলহারা কলঙ্কিনী
আমারে কেউ ছঁইয়ো না গো সজনি
প্রেম করে প্রাণ বন্ধুর সনে
যে দুঃখ পেয়েছি মনে
আমার কেঁদে যায় দিন রজনি
প্রেম করা যে স্বর্গের খেলা
বিচ্ছেদে হয় নরক জ্বালা
আমার মন জানে আমি জানি
সখী আমার উপায় বলো না
এ জীবনে দূর হলো না
বাউল করিমের পেরেশানি
গানের মাঝে নিমজ্জিত থেকেই অন্তরে লালন করতেন বাউল সত্তা। ফলে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন গানের মাঝেই, গান ছিল তাঁর প্রেম, আরাধনা, প্রার্থনা। গানই তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম অংশ। প্রেমাকাঙ্খায় গানের মাঝেই সন্ধান করেছেন নিরঞ্জনের। কিন্তু তাঁর দেহের মাঝেই তো রয়েছে সাঁই নিরঞ্জন, তাঁকে পাওয়ার জন্য মক্কা-মদিনায় যাওয়ার প্রয়োজন আছে?
মসজিদ মন্দির গির্জা ঘরে
কেউ খোঁজে জঙ্গল পাহাড়ে
আবদুল করিম বিশ্বাস করে
আমাতে তুমি রয়েছো।
করিমের অর্ন্তভেদী চেতনা সুস্পষ্ট হয়েছে গানের বাণীতে। আটদিন মাত্র স্কুলে যাওয়া ভাটি অ লের রাখাল বালক অবলীলায় স্থান করে নিলেন পাঠ্যপুস্তকে। তাঁর জীবনদর্শন ও গান হয়ে গেল গবেষণার বিষয়। বিখ্যাতজনদের তালিকায় অর্ন্তভুক্ত সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই থানার উজানধল গ্রামের সেই করিমের নাম। গান গাওয়ার অপরাধে যাঁকে ঈদের নামাজ পড়তে দেওয়া হয়নি, বরং গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। গান ছাড়তে পারবেন না বলে গান গাইতে গাইতেই দোতারা হাতে বেড়িয়ে পড়েছিলেন করিম-
গান গাই আমার মন রে বুঝাই, মন থাকে পাগল পারা
আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া
গানে বন্ধুরে ডাকি, গানে প্রেমের ছবি আঁকি
পাব বলে আশা রাখি, না পাইলে যাব মারা
গান আমার জপমালা, গানে খোলে প্রেমের তালা
প্রাণবন্ধু চিকন কালা অন্তরে দেয় ইশারা
ভাবে করিম দীনহীন, আসবে কি আর সেই শুভ দিন
জল ছাড়া কি বাঁচিবে মীন, ডুবলে কি ভাসে ভরা
বাউলগান ও গণসংগীত গেয়ে ভাটিবাংলায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী করিম ২০০৭ সালে প্রবাসীদের আমন্ত্রণে তৃতীয়বারের মতো লন্ডন সফর করেন। এ বয়সে দীর্ঘ ভ্রমণ সহ্য করতে না পেরে একসময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। লন্ডনের রয়্যাল হসপিটালে এক মাস চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরলেও দিনে দিনে শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ভর্তি করা হয় সিলেটের নূরজাহান হাসপাতালে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও বলেছিলেন ‘বিশ্ববাসী সুখী হোক এই দোয়া করে যাই।’ সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে উপস্থিত শিষ্যদেরকে বলেন নিজের রচিত ‘গাড়ি চলে না’ গানটি গাইতে। গুরুর আদেশে শিষ্যরা গাইতে থাকেন-
গাড়ি চলে না, চলে না
চলে না রে, গাড়ি চলে না
চড়িয়া মানব গাড়ি
যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি
মধ্য পথে ঠেকল গাড়ি
উপায়-বুদ্ধি মেলে না
গানটি শুনতে শুনতেই অসুস্থতাবোধ করলেন, শুরু হয় চিকিৎসা। না! আর সুস্থ হলেন না এই ভাটিপুরুষ। ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯, ঘড়ির কাঁটা সকাল ৭টা ৫৮ মিনিটে। জীবনের অবসান ঘটিয়ে ৯৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গণমানুষের কবি শাহ আবদুল করিম। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তাঁর গান স্থান করে নিয়েছে দেশ-বিদেশের ভক্তের হৃদয়ে। জনপ্রিয়তার জোয়ারে কিংবা অতি ভক্তির কারণে ভক্তজনেরা তাঁকে ‘বাউল সম্রাট’সহ নানা অভিধায় অভিহিত করছেন। কিন্তু, ‘সম্রাট’ কিংবা বাউলের যাপিত জীবন অথবা ‘বাউল দর্শন’ কি আমাদের করিমকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দিতে পারে? শুধুমাত্র ‘বাউল সম্রাট’র চাদরে কি তাঁকে ঢেকে রাখা যায়? মুক্ত আকাশ, নির্মল বাতাস, মনোরম প্রকৃতি এবং জীবনের বাস্তবতা থেকে যিনি শিক্ষালাভ করেছেন তাঁকে নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তকে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চার দেয়ালে আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। তাঁর রসময় সুরে মাধুর্যমন্ডিত সৃষ্টিগুলো ছড়িয়ে পড়ুক বাউলা বাতাসে।
কল্যাণপুর, ঢাকা।