একগুচ্ছ কবিতা
কামরুল নাজিম
ফেলে আসা নিস্তব্ধতা
শৈশবের পথে হঠাৎ বৃষ্টি নামে। সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার কালো রাতেও সুস্পষ্ট সেই কীর্তিনাশা গ্রাম। যেখানে ছায়া মানেই জীবন আর জীবনের গল্প কেবলই ছায়া।
অসংখ্য ঝরে যাওয়া পাতা। ডালের শিরা উপশিরা। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া সে বটবৃক্ষ!
মানুষের কথা
অধিকারের কথা
ফেলে আসা বিকেলের কথা
উড়ে উড়ে দিগন্তের পথে হারিয়ে যাওয়া কবুতরের কথা
কেরামত আলীর ছেলের কথা। রতনের মেয়ে। সমাজ অস্বীকার করার ছিঃ ছিঃ কান্ড!
ক্লান্ত রোদের কথা
তৃষ্ণার্ত কণ্ঠে ঝরে পড়া হাহাকারের প্রতিধ্বনি
ভূমির বেদনার কথা
ফসলের কথা
লোকালয়ের কথা
ধূসর রাত্রি। ছোঁপ ছোঁপ রক্তের কথা। ঝুলে থাকা শার্টে হারানো ছেলেকে খুঁজে ফেরা মায়ের প্লাবিত চোখের কথা। কনকনে শীতল বাতাস!
চারপাশ ঘিরে থাকা প্রতিবেশীর কথা
বেঁচে থাকা মানুষের কথা
শিকার আর শিকারীর কথা
প্রগাঢ় অন্ধকার জুড়ে থাকা বিদীর্ণ সবুজ প্রান্তর…
এইসব পুড়ে যাওয়া সম্পর্ক। বুকের অলিন্দে জমিয়ে রাখা ভুল বাক্য। তুমুল গর্জন তুলে কাঁচের টুকরোর মত মানুষ ভেঙে গেছে মানুষ থেকে। ফেলে আসা নিস্তব্ধতাকে পেছনে ফেলে মানুষ ছুটছে অন্তিম গতিতে। স্থির ধূসর চোখের তারায় জীবন এখন রেল লাইনের পাশ ধরে হেঁটে যাওয়া, বিলবোর্ডে রমণীর চোখে চোখ রেখে ভুলে যাওয়া ধূসর মানচিত্র।
আঘাতের বিপরীতে
বাতাসের সাথে আমাদের কোন শত্রুতা নেই, তবুও—
পাঠশালায় যে মোমগুলো খুব করে জ্বলছে
সেসব নিভিয়ে দিতে চায় তারা।
আমরা সূর্যের প্রতিশব্দ খুব করে জানি
আমরা জানি সমুদ্র এবং আকাশের প্রাগৌতিহাসিক সম্পর্ক
তাই—
সবুজ গাছে লিখে রাখি একা পাখির উড়তে থাকার গল্প!
(কেননা, ওরা জানে না কখন কোথায় কীভাবে আগুন নেভাতে হয়। ওদের শিখাবেই বা কে?)
ওরা বলে, চন্দ্রমল্লিকার সাথে দেখছি দারুণ প্রেম আজকাল!
আমাদের হাসি আসতে চায়। দৈবাৎ আসেও প্রাণমনে।
তবুও—
আমরা গেয়ে যাই শোকের গান
যেহেতু ওরা যে জানে না অমাবশ্যা এবং পূর্ণিমার বৈপরীত্ব।
(আমাদের দুঃখ জাগে ভীষণ!)
ওরা জানে দু’একটা মুখস্থ ছড়া, যা তাদের শেখানো হয়েছে
ওরা জানে দু’একটা মারদাঙ্গা স্লোগান, যা কেবলই কথার কথা।
ওরা জানে না—
কোন ব্যর্থ আঙুলের ইশারায় এত উদ্দাম নৃত্য চলছে
ওরা জানে না—
কোন শৌখিন চোর গল্প বলার চ্ছলে স্বপ্ন চুরি করছে
ওরা কখনো সব ফুল ঝরে যাওয়া গাছের নিরবতা পাঠ করতে পারেনি,
ওরা কখনো পারেনি অনুবাদ করতে সান্ধ্যনগরীতে ধুলো না উড়ার দীর্ঘশ্বাস!
তাই—
প্রতিটি আঘাতের বিপরীতে ওদের জন্য আমরা তুলে রেখেছি সুর;
স্বপ্ন ও সুন্দরের
জীবন এবঙ বোধের।
যদি কখনো ঘুম ভাঙে তাদের…!
কথোপকথন
রাতগুলো খুব ভারী, তাই না?
— একদম আপনার নিঃশ্বাসের মত, জেসমিন।
আমার নিঃশ্বাস কি সবসময় ভারী?
— নাহ, যখন আপনিসহ পাহাড়ে যাই।
পাহাড়ে যেতে খুব ভালোলাগে তোমার?
— পাহাড়ে গেলে সাগরের দোর খুলে যায়।
সাগরে যেতে ভয় হয় না তোমার?
— শিখেছি সাঁতার, তবুও- ভেলা রাখি সাথে।
সবসময় সতর্ক থাকতে পারো এমন?
— সাবধানের মার নেই, জেসমিন। বিপদ তো ঐ এক মুহূর্তেই আসে।
যদি ভেসে যায় ভেলা?
— তার দায় ঈশ্বরের। সত্য বলতে ভয় পাবেন না, জেসমিন।
কিন্তু সমাজ?
— বমি করে দিন। আপনার এই সো-কল্ড সমাজ পেরেছিল সক্রেটিসকে ধারণ করতে?
আমি বিখ্যাত হতে চাই!
— বিখ্যাত হওয়া যায় না, জেসমিন। বিখ্যাত হয়ে যায়।
মৃত্যুকে ভয় পাও?
— অপেক্ষায় আছি। মৃত্যু কি একটি স্বপ্নট্রেন? আপনার কাছে গেলে মরে যেতে ইচ্ছে হয়, জেসমিন!
সমাধিতে কিছু লিখবে না?
— জেসমিন, আমাদের পৃথিবী একটি সম্পূর্ণ গণকবর। সেই সত্য কেউ স্বীকার করেনি আজো।
একক কবর কোথাও কি নেই তবে?
— জেসমিন, আপনাতে লুকিয়ে রাখুন আমাকে। আর
কপালে সেঁটে দিন ফলক—
‘কামরুল নাজিমের একান্ত ব্যক্তিগত কবর!’