বইমেলার খোলাচত্বর: কথোপকথন/ বদরুজ্জামান আলমগীর
অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে মন-মানচিত্র সাহিত্যকর্মের বার্তা সাহিত্যের পাঠকদের নিকট পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে কবি-সাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করছে। আমরা আজ কথা বলেছি আমেরিকায় বসবাসকারী কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক বদরুজ্জামান আলমগীর-এর সাথে।
মন-মানচিত্র: গ্রন্থ মূলত দীর্ঘ একটা সময়ের সাধনার ফসল। এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে আপনার কয়টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হওয়ায় আপনার অনুভূতি এবং বইটির ব্যাপারে জানতে চাই।
বদরুজ্জামান আলমগীর : এবার আমার কোন বই বেরোয়নি। দুটো বই হবার কথা ছিল : কবিতার বই- দূরত্বের সুফিয়ানা; এবং কবিতা, ব্যক্তিগত ছিন্নগদ্য, কিছু ভাষান্তরিত কবিতা আর প্যারাবল মিলে একটা কোলাজ ধরনের সংকলন- দরজা খুলেই দেখি জেব্রাক্রসিং। কিন্তু হয়নি। অবশ্য ফেব্রুয়ারি মেলাতেই বই করতে হবে- আমি এমন কোন ঋতুভিত্তিক তাগিদ ও উত্তেজনা কখনও বোধকরি না; দ্বিতীয়ত দেশের বাইরে থেকে বই করাটা একটু হার্ডলস দৌড়ের মত- বেশ একটু পেরেশানি আছে, কারো মুখের দিকে চেয়ে থাকার ব্যাপার আছে। দেশের বাইরে থেকে বই বের করাটা যেন ঠিক বাস্তবের ঘটনা নয়, মদনকুমারের ঘুমের ভিতর একটি স্বপ্নের ঘটনা- আমি স্বপ্নে দেখি মধুমালার মুখরে!
মন-মানচিত্র: আপনার পূর্বে প্রকাশিত সাহিত্যকর্মও কি পাঠকরা গ্রন্থমেলা থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন?
বদরুজ্জামান আলমগীর : আমার বই যারা বের করে তারা ঠিক প্রকাশক নয়, তারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়, আজিজ মার্কেটের মোড়ে হাওয়া খেয়ে জীবন নির্বাহ করে। তাদের একটা বই হরেদরে বিক্রি হোক- আমার মনে হয়, ওরা ঠিক এটা চায়ও না। আমরা সত্যিকারভাবে লিটলম্যাগ বলতে যা বুঝি, কী বলা ভালো- লিটলম্যাগ বলতে আদিতে আমরা যা বুঝতাম- ওরা সেইরকম লিটলম্যাগ করে। একটা সোজাসাপ্টা উদাহরণ দিই- আমি প্রকাশককে জিজ্ঞেস করি- মাঝেমধ্যে ভুলকরে কেউ কেউ আমার বই খোঁজে, তো কোন দোকানেও পায় না, আবার রকমারি.কমেও নাই; কিছু বই রকমারিতে রাখো না কেন? প্রকাশক বললো- ভাই, অভিজিৎ রায় খুন হবার পর রকমারি অভিজিতের বই তাদের স্টক থেকে নামিয়ে নেয়,অথচ এই চ্যালেঞ্জের সময় পরিবেশক হিসাবে তাদের দরকার ছিল অভিজিৎ রায়ের বই বেশিকরে প্রোমোট করা। আপনার বই কোনভাবেই রকমারিতে দিবো না! ঘটনা যদি আসলে তা-ই হয়ে থাকে- তাহলে আমি সত্যিই চাই না- আমার বই রকমারিতে পাওয়া যাক। সময়টা যা, তাতে আমরা নানাভাবে মাইনকার চিপায় তো আছিই। আমার ঘরের সামনে প্রায় প্রতিদিনই এমাজনের নানা কিসিমের বক্স আসে- আমার ছেলেমেয়ের, আমার নিজেরও। শুনি যে এমাজনের এই বিপুল টাকা ফিলিস্তিন নিধনে ঢালা হয়- এমাজনের প্রতিটা বক্স ঘরে তুলতে শরীরে কেমন ঝাঁকি লাগে- কিন্তু তুলি তো! ও হ্যাঁ, আমার কয়েকটি বই মেলায় লিটলম্যাগ চত্বরে দেশলাইয়ের স্টলে পাওয়া যাবার কথা।
মন-মানচিত্র: অমর একুশে গ্রন্থমেলা লেখক-পাঠকদের মধ্যে শুধু সেতুবন্ধনের কাজটিই যে করে তাই নয়, এইসময় গ্রন্থপ্রেমিকদের মধ্যে খুশির আমেজও পরিলক্ষিত হয়। গ্রন্থমেলাকে অর্থবহ করার ব্যাপারে আপনার অভিমত জানতে চাই।
বদরুজ্জামান আলমগীর : যে বইমেলাটা এখন হয়- তার ইতিবাচক ব্যাপারগুলো আঙুলের কড়াতে গোণা যায়, আর অবহেলা, অযত্ন, আর সংশোধনের দিক অগুণতি- কোনটা থুয়ে কোনটা বলবো? আমাদের যতোবড় দেশ- যতো মানুষ, সেই সাকল্য মানুষকে হিসাবে রেখে বললে বছরে ঢাকায় একটা য- এটা তো মেলা নয়, একটা মশকরা। বছরে একটা মেলা কেন হবে- সারাবছর জুড়ে সারাদেশে বইমেলা হতে হবে- প্রতিটি বিভাগে, জেলায়, উপজেলায়, ইউনিয়নে, প্রতিটি গ্রামে বইমেলা কেন হয় না! বই আর বইমেলা উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত এলিট ক্লাসের একটা মেলা হয়ে আছে- এটি পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। সবেধন নীলমণি বাংলা একাডেমির বইমেলা, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের বইমেলা কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু এতে রাজনীতি, বিশেষকরে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এতো মহড়া কেন এখানে? সামগ্রিকভাবে যে সমাজে, রাষ্ট্রে মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার চর্চা এতোটা আতঙ্কের মধ্যে থাকে- সেখানে একটি সফল, সুদূর প্রসারী বইমেলা হয়ে যাবে- তা একটি স্বপ্নকল্পনা ছাড়া আর কিছু না। বইমেলাকে অর্থবহ করে তুলতে পারে একটি গণতান্ত্রিক, বইবান্ধব সমাজ ও রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নির্ভয় পরিবেশ।সারাদেশের কথা বাদই দিই- এতোবড় ম্যাগা শহর ঢাকায় কয়টা পাবলিক লাইব্রেরি আছে বলুন? বাইরের দুনিয়ার সাথে ঢাকাকে এককাতারে আনতে হলে এখানে কমপক্ষে ৩০০ পাবলিক লাইব্রেরি থাকার কথা; সারাদেশের প্রতিটি পাড়ায় মহল্লায় গ্রন্থাগার তৈরি না করলে বইপড়ার রুচি কোত্থেকে গড়ে উঠবে? বইমেলা কেবল কতগুলো বইয়ের দোকানের সমাবেশ নয়- বইমেলা মত ও ভিন্নপথের লেনদেন, আনন্দদায়ক ও ঝুঁকিপ্রবণ চিন্তাদের স্বাগত জানানো- এটিই একটি বইমেলার সাফল্য ও ব্যর্থতা যাচাই করার ব্যারোমিটার।
তারপরও সব ঘাটতি আর খামতির পরও যখন দেখি- ফেব্রুয়ারির বইমেলা কেবল বইমেলা নয়, তার অধিক কিছু, বইমেলার ভিতর দিয়ে আমাদের বুলি ও ভাষাশহীদদের পরম স্মৃতি ঘরে ঘরে কালো কালো অক্ষরে আকুতিময় হয়ে ওঠে- বুঝিবা জাতি হিসাবেই আমরা মোচড় দিয়ে উঠি, ভাবি- যেতে হবে দূর ঘুমিয়ে পড়ার আগে।
মন-মানচিত্র : একুশে বইমেলাকেন্দ্রিক বইপ্রকাশনা এখন একটি প্রথা হয়ে গেছে। বিদেশে অবস্থানরত স্বভাষী লেখক হিসেবে আপনি বইমেলাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বদরুজ্জামান আলমগীর : দেখুন, ইমোশনালি আমাদের বইমেলা এক অনন্য ঘটনা। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এইমেলা আমাদের পুরো প্রকাশনা শিল্পকে একটি সরু গলিতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সারাবছর প্রকাশনা পাড়া স্থবির, আর ফেব্রুয়ারি সামনে নিয়ে এক হুড়োহুড়ি, গুঁতোগুঁতির কারণে বইয়ের মান পড়ে যায়, পেশাগত দক্ষতা, এমনকী একটি স্থিতিশীল বাজার সংস্কৃতিও গড়ে উঠছে না। শরীরে জ্বর যেমন অস্বাভাবিক, ফেব্রুয়ারি বইমেলাও আমাদের সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে তেমন একটি জ্বর। সারাবছর বই বেরুনো দরকার- যেমন আমরা সারাবছর ধরেই বেঁচেবর্তে থাকি, যেমন আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস একটি নিরবচ্ছিন্ন ঘটনা- বইমেলা, বই প্রকাশনাও একটি জাতির সৃজনশীলভাবে বেঁচে থাকার সাক্ষী- তা কখনই এমন আকস্মিক ঘটনা হতে পারে না।
মন-মানচিত্র: বিদেশে অবস্থানরত বাংলাভাষী কবি-সাহিত্যিকদের বাংলাদেশ সরকার “প্রবাসী” অ্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। ভাষার যদি কোন সীমা না থেকে থাকে, তাহলে এই অ্যাখ্যা দেয়া কি যৌক্তিক মনে করেন?
বদরুজ্জামান আলমগীর : আমরা সেই সরকারই পেয়েছি যে সরকার আমাদের ধাতের সঙ্গে খাপেখাপ আম্বিয়ার বাপ- একদম মিলে যায়। তারপরও সরকারের কিন্তু যারা দেশের বাইরে থেকে লেখেন- তাদের প্রবাসী লেখক বলবার ঠেকা পড়ে নাই; সরকার- তা সে যেই পদের সরকারই হোক, বাইরের লেখকদের প্রবাসী লেখক বলে বিমাতাসুলভ আচরণ করার কোন প্রয়োজন নাই, তার দরকার রেমিট্যান্স; আপনাকে প্রবাসী লেখক বলে দ্বিতীয় শ্রেণীর লেখক বানানোর অভিপ্রায় আপনার সহলেখকের- যিনি দেশে বসে লেখেন। এ-কথা সত্যি, দেশে থেকে লিখতে পারলে তার মধ্যে জৈবিকভাবে লিপ্ত থাকার উত্তাপ বেশিই থাকতে পারে, কিন্তু উত্তীর্ণ লেখার জন্য এটিই একমাত্র শর্ত নয়। শত লেখকের নাম বলতে পারি, কিন্তু ব্যাপারটা কেবল জীবন্তভাবে বোঝানোর জন্য কয়েকটি নাম বলি- মজনু শাহ ইটালিতে থাকেন, কুলদা রায়ের বাস নিউইয়র্ক, সাদ কামালী টরন্টোয় বসে লেখেন, মাসুদ খানও টরন্টোর কবি, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ অস্ট্রেলিয়া থাকেন, ওমর শামস নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাভাষার কবি- শামস আল মমীন নিউইয়র্ক, মুজিব ইরম ইংল্যান্ডের রাখালবন্ধু কবি। আল্লার কিড়া দিয়ে বলি- উপরের নামগুলো কেবলই নমুনা- আরও অনেকে অনেকে আছেন- কিন্তু ভোটার লিস্টের আকার বানাতে চাই না; এক্ষেত্রে আমার কথা একটাই- উপরের কবি ও লেখকদের তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার মত লেখক/ কবি দেশের তরফ থেকে দেখানো হোক, আমি তাহলে অবলীলায় প্রবাসী লেখকের দুরভিসন্ধিমূলক তকমা মেনে নেবো। কে কোথায় থাকে এটি বড় কথা নয়, কে কোথায় জীবিত- সেটিই আসল কথা। এমন লেখক দেশে আছেন, দেশের বাইরেও আছেন- যাঁরা লেখালেখি করেন- কিন্তু সৃজনশীলভাবে মৌলিক নন; তাঁরাও আমাদের ভালোবাসার ধন- একটি বড় নদীর গতিপথ নির্মাণের জন্য অনেক ছোট নদীকে অকালে শুকিয়ে যেতে হয়; তারা-ই সেই ঐশ্বর্যময় দুঃখী সম্প্রদায়- যাঁরা আনন্দ ও কল্যাণের পায়ের নিচে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন; ছোটবড় লেখক ও পাঠক, আর মরমী মানুষের সমর্থন রূঢ় দুনিয়ার সমান্তরালে একটি ন্যায়নিষ্ঠ ভাব ও বিজ্ঞানের দুনিয়া গড়ে তোলেন- যেখানে একটি সত্যিকার বইমেলা জমজমাট হয়ে ওঠে।
লেখকের প্রকাশিত বই:
আখ্যান নাট্য : নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে। আবের পাঙখা লৈয়া। প্যারাবল : হৃদপেয়ারার সুবাস। কবিতা : পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর। নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো। দূরত্বের সুফিয়ানা। ভাষান্তরিত কবিতা : ঢেউগুলো যমজ বোন। ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা। প্রকাশিতব্য নিবন্ধ : আশ্চর্য বতুয়া শাক ও কাঁচা দুধের ডিসকোর্স।