অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে মন-মানচিত্র সাহিত্যকর্মের বার্তা সাহিত্যের পাঠকদের নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য কবি-সাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ আমরা কথা বলেছি কথা বলেছি কবি-প্রাবন্ধিক তুষার দাশ-এর সাথে। সাক্ষাৎকার সমন্বয় করেছেন ধ্রুব সাদিক।
মন-মানচিত্র: গ্রন্থ মূলত দীর্ঘ একটা সময়ের সাধনার ফসল। এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে আপনার প্রকাশিত গ্রন্থের ব্যাপারে জানতে চাই। গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ায় আপনার অনুভূতিও যদি শেয়ার করতেন।
তুষার দাশ: সবার ক্ষেত্রে সঠিক নয়। আবার কী ধরনের বই এটাও বিবেচ্য। গত বছর নভেম্বরে আমার একটা বই বেরিয়েছে। বইটা বইমেলায় পাঠক সমাবেশের স্টলে পাওয়া যায়।
আমার বই নিয়ে আমার তেমন একটা উচ্চাকাঙ্খা নেই। বন্ধুদের দুয়েকজন আমাকে উজ্জীবিত করার জন্যে মৃদু ও মাঝারি ধরনের কিছু কথা সংক্ষেপে বলেছে। ওদের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়াই আমার অনুভূতি। তবে এই বইটির ব্যাপারে আমার এক ধরনের নিহিত উত্তেজনা ছিলো। মনে হয়েছে, কিছু কথা বলা গেছে, যা আমি আগাগোড়া বলতে চেয়েছি আমার তুচ্ছ লেখালেখির অতীব ক্ষুদ্র সময়ের ভেতর। পাঠক সমাবেশের পরিবেশনায় এই বই যেখানে যেখানে যাবার কথা, সেখানেই যাবে বলে প্রকাশক জানিয়েছে।
মন-মানচিত্র: আপনার পূর্বে প্রকাশিত সাহিত্যকর্মও কি পাঠকরা গ্রন্থমেলা থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন?
তুষার দাশ: আমার কবিতার বই সাতটি আর গদ্যের বই তিনটি। বইগুলো অন্যপ্রকাশ, পাঠক সমাবেশ আর অবসর প্রকাশনীতে পাওয়া যায়। এই মেলাতেও তাই। আমার কবিতা সমগ্র প্রথম খণ্ড আগামী বইমেলায় পাঠক সমাবেশ-এ পাওয়া যাবে আশা করি।
মন-মানচিত্র: অমর একুশে গ্রন্থমেলা লেখক-পাঠকদের মধ্যে শুধু সেতুবন্ধনের কাজটিই যে করে তাই নয়, এইসময় গ্রন্থপ্রেমিকদের মধ্যে খুশির আমেজও পরিলক্ষিত হয়। গ্রন্থমেলাটিকে প্রাণবন্ত করার ব্যাপারে আপনার অভিমত জানতে চাই।
তুষার দাশ: লেখক-পাঠক মেলবন্ধন অনেক বড়ো কথা। সেটা কদ্দূর কতোটুকু কীভাবে হয়, তা আমি জানিনা। আমার সে অর্থে কোনো পাঠক নেই ধরেই আমি আমার মতো এগুনোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। দেখা-সাক্ষাৎ হলেই প্রাণের যোগাযোগ ঘটে— তেমনটা আমি মনে করি না। লেখকদের বিশ্বাসের কারণে এবং আরও নানাবিধ পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কারণে আপন দলের ভেতরে একটা সাময়িক যোগাযোগ ঘটে। এই যোগাযোগ প্রতি দলের ভেতর আখ্ছার ঘটে সারা বছর জুড়েই। দলের বাইরে কারো কারো সংগে হাই-হ্যালো ঘটতে থাকে। ওটুকুই হয়তো আমাদের ভাবা সেতুবন্ধন। দেখা-সাক্ষাৎ হবার সম্ভাবনাটাই এক ধরনের আনন্দের বিষয় হয়তোবা। কারও কারও নতুন বা নতুনতর বই বেরোনোর আনন্দ তো রয়েছেই। লেখক আর পাঠকের বৃহত্তর সংযোগগুলির ভেতর প্রবাহিত প্রাণের স্পন্দনে, স্পন্দনের ঐক্যসূত্র মেলাতে না পারলে প্রাণবন্ততা কী করে আসবে মেলায়?
মন-মানচিত্র: গ্রন্থমেলার সাথে প্রকাশনার সাথে জড়িত মানুষের রুটিরুজির সংস্থানের ব্যাপারটিও জড়িত। এই ব্যাপারে আপনি যদি আপনার মতামত শেয়ার করতেন।
তুষার দাশ: এই মেলা আমার কাছে যে সব কারণে গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হলো, অনেকগুলো মূল্যবান মানুষ পেছন থেকে এই রথচক্র পরিচালনা করে। তাদের যৎসামান্য মূল্য তারা লাভ করে। মেশিনম্যান, ভাঁজাইকারী, বাইণ্ডার, মুটে— যাদের ঘাম, শ্রম আর দিনরাত জাগরণের ফসল ঠগবাজ, মধ্যস্বত্বভোগী মুষ্ঠিমেয়র পেটে যায়। যুগ যুগ ধরে এসবই হচ্ছে। সমাজ বদল না করতে পারলে এরকমই চলতে থাকবে। আমরাও বই বের করেই একটা মহাকাজ করে ফেলছি, ফেলবো— এমতই ভেবে চলেছি দীর্ঘকাল।
মন-মানচিত্র: বইমেলার পর প্রকাশিত বইয়ের আর খোঁজ বিশেষ থাকে না। আমাদের দেশে বইয়ের দোকানও স্বল্প। এই পরিস্থিতিতে বই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে আপনার ভাবনা যদি জানাতেন।
তুষার দাশ: বইমেলার লেখকদের একটি বড় অংশ হচ্ছে সিজনাল লেখক। প্রকৃত সৃজনশীল লেখক নয়। ওরা নামধাম, প্রচার, প্রসার ইত্যাদির জন্যে লেখে। আসল লেখকরা সারা বছর লিখতে থাকে। এদেরই একটা দল আবার এতই আত্মবিশ্বাসী আর আত্মপ্রেমী যে, কোনও লেখাই বাকি রাখে না। সব ছেপে ফেলতে চায়। আরেকদল অনেক সময় নিয়ে, অনেক ভেবেচিন্তে, অনেক পরিমার্জনার ভেতর দিয়ে একটা লেখাকে কুঁদে তোলে, সৃষ্টি ও নির্মাণের খেলা খেলে ভাস্করের ধরনে। আমাদের বইমেলা শুরুর আগের ও পরের সময়টার দিকে চোখ বোলালেই সব স্বচ্ছ হয়ে উঠবে।
আমাদের বই পরিবেশনায় খামতি আছে। বাটপাররা ঢুকে পড়েছে এর চক্রে। কারো কারো বই পাঁচ-দশ হাজারের মতো চলে। মার্কেটিং-এর ভাষায় পুল নয় ভয়াবহ পুশে। ব্যক্তিক পুশ, প্রাতিষ্ঠানিক পুশ, ক্ষমতাবলয়ের পুশ— এসব আর কি!! আসল কথা হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তর সমস্যা। সবাই তা জানেন। আর বই পড়ার প্রচুর বিকল্পের কারণে বই ব্যবসায়ী তথা প্রকাশকদেরও ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হবে। ওটা মুষ্ঠিমেয়র ভেতর আছে। বাকিরা সরকারের পাঠাগার আর স্কুল কলেজের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বই বেচে দিয়েই মহাখুশি। এটাকে প্রমোট করার কোনও কাজ তারা করবে না। প্রকৃত আড্ডা নেই, তরুণদের দিশা দেখানোর আস্থাযোগ্য কোন লেখক নেই। এটা জাতিগত সাংস্কৃতিক সংকট। টাকা বরাদ্দ দিয়ে সরকার এ দায় থেকে মুক্তি নিতে পারে না। একটা জাতি পুরোটাই শ্রমবিমুখ বিদ্যাবিমুখ পরমুখাপেক্ষী স্বর্ণলতায় পরিণত হয়েছে দুষ্টচক্রের কারণে। সবাই সব জানে। কিন্তু কেউই মুখ খুলবে না। সিজনাল লেখকদের বই পাঠকের কাছে না পৌঁছানোই মঙ্গল।
মন-মানচিত্র: কোভিড পরিস্থিতিতে বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, পাঠকদের প্রতি আপনার বার্তা যদি শেয়ার করতেন।
তুষার দাশ: বিশ্বজুড়ে কোভিডের ছোবল। আমরা অনেক মূল্যবান জীবন হারিয়েছি গত দুবছরে। যাঁরা মেলায় যাবেন, তাঁরা সর্বোচ্চ সতর্কতা মেনেই যাবেন। ভালো বই মূল্যবান নিঃসন্দেহে। কিন্তু জীবন তার চেয়েও বেশি মূল্যবান। অনাহূত ভোগান্তিইবা কে চায়?