বাংলাভাষার প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও ভাষার প্রাণ
নুসরাত সুলতানা
“বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায় ।
পলাশের আর
রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়
দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন, যুগে যুগে সেই
শহীদের নাম
এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিলায়, তোমাদের নাম ।
তাই আমাদের
হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক
শপথের ভাস্কর ।”
— স্মৃতি স্তম্ভ (আলাউদ্দিন আল আজাদ)
এমন অসংখ্য কালোত্তীর্ণ কবিতা, প্রবন্ধ আর গল্প রচিত হয়েছে একুশের চেতনা নিয়ে। শিক্ষিত বাঙালি মাত্রই জানে ৫২ এর ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতিসত্তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। বুঝিয়ে দিয়েছিল ধর্ম একটা সম্প্রদায় কিন্তু জাতি তৈরি হয় সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উপাদান ভাষা দিয়ে। যদিও বাঙালি জাতি এবং বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছিল আরও কয়েক হাজার বছর আগে।
বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশঃ বাংলা ভাষার সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন “চর্যাপদ”। এগুলো ছিল মূলত বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের গান। চর্যাপদের বয়স পুরো এক হাজার বছর হয়েছে কিনা তা নিয়ে পন্ডিতদের ভেতর বিতর্ক রয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন যে, নেপালের রাজদরবার থেকে চর্যাপদ উদ্ধার হয় বিশ শতকের গোড়ার দিকে। তিনি চর্যাপদকে এক হাজার বছরের পুরোনো নিদর্শন বলে দাবী করেছিলেন। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, এগুলো রচিত হয়েছিল ৯৫০ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে। অন্যদিকে একেবারে ভিন্নমত পোষণ করেন ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর মতে, অষ্টম/নবম থেকে শুরু করে দ্বাদশ–ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে এই গানগুলো রচিত হয়েছিল।
যে সময়ে চর্যাপদ রচিত হয়েছিল, তখনো বাংলা ভাষা বলে কোনো ভাষা তৈরি হয়নি। এ ভাষা ছিল তারও আগেকার একই সঙ্গে বাংলা, অহমিয়া এবং ওড়িয়া ভাষার পূর্ব -পুরুষ। চর্যাপদের ভেতর যেমন কিছু বাংলা ভাষার শব্দ এবং বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই, তেমন অহমিয়া এবং ওড়িয়াভাষী লোকেরাও তাদের ভাষার কিছু শব্দ এবং বৈশিষ্ট্য দেখতে পান। বাঙালিদের মতো ওড়িয়া এবং অহমিয়া ভাষার লোকেরাও চর্যাপদকে তাদের প্রাচীন নিদর্শন মনে করে। তবে কোনো কোনো পন্ডিত মনে করেন, চর্যাপদের মধ্যে ওড়িয়া এবং অহমিয়ার চরিত্র থাকলেও পরবর্তী বাংলার সঙ্গে তার যোগাসাজশ বেশি।
আর্যদের ভাষা নানা ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে যে রূপ পরিগ্রহ করেছিল চর্যার ভাষা সেই ভাষা। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, আর্যদের মুখের ভাষা ছিল প্রাকৃত। প্রাকৃত আবার উত্তর ভারতের এক একটা অংশে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এক একটা নাম নিয়েছিল। পূর্ব ভারতে প্রচলিত ছিল মাগধী প্রাকৃত। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে বঙ্গ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল গৌড়ী
প্রাকৃত। গৌড়ী প্রাকৃত ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে রূপ নেয় তার নাম দেয়া হয় অপভ্রংশ। অপভ্রংশর পরের ধাপে তার নাম হয় অবহট্ট। চর্যাপদে মোটামুটি এই অবহট্টের নমুনা পাওয়া যায়।
ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯২৬ সনে “অরিজিন এন্ড ডেভেলপমেন্ট অফ বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ ” বইয়ে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশের স্বরূপ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে এ বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করে প্রামণ করে দিয়েছেন যে, চর্যার ভাষা বাংলা। তবুও চর্যার ভাষাকে ভাষাতত্ত্ববিদরা খাঁটি বাংলা বলে আখ্যায়িত করতে চান না।
বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে চতুর্দশ -পঞ্চদশ শতকে। তখনকার বাংলা ভাষার নিদর্শন বড়ু চণ্ডীদাস রচিত “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” বিশ্লেষণ করলেই সেটা স্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান হয়।
মধ্যযুগে বিভিন্ন কবিরা শাস্ত্রের বিধান অমান্য করে অনেকেই সে সময় রামায়ণ, মহাভারত এবং অন্যান্য পুরাণের অনুবাদ করেছিলেন অথবা বাংলা ভাষায় মঙ্গলকাব্যসহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কিন্তু কোনো কবিই তাদের ভাষাকে বাংলা ভাষা বলে উল্লেখ করেননি। বরঞ্চ সেকালের কবিরা এই ভাষাকে কেবল ” ভাষা”, “দেশী ভাষা অথবা “লৌকিক ভাষা” বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে মহাভারতের অনুবাদক শ্রীকর নন্দী একে বলেছেন দেশী ভাষাঃ
দেশি ভাষে এহি কথা করিয়া প্রচার
সঞ্চরউ কীর্তি মোর জগৎ ভিতর।
মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে আব্দুল হাকিম বাঙালির পরিচয় এবং বাংলা ভাষা নিয়ে সবচেয়ে বেশি গর্ববোধ করেছেন । কিন্তু তিনিও তখন এ ভাষাকে বলেছেন “বঙ্গবাণী” ” দেশী ভাষা”-
যেসব বঙ্গেত জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী
সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি
অষ্টাদশ শতকের সবচেয়ে বড় কবি ভারত চন্দ্র রায় গুনকর বৃহত্তর বঙ্গকে বারবার বাঙ্গালা নামে চিহ্নিত করেছেন এবং বাংলার অধিবাসীদের পরিষ্কার বাঙ্গালি বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু তিনিও বাঙ্গালা দেশের ভাষাকে কোথাও বাংলা ভাষা বলে উল্লেখ করেননি। ভারত চন্দ্র অন্নদামঙ্গল রচনার কাজ শেষ করেন ১৭৫২ সালে। তখনও তিনি বাংলা ভাষা না বলে শুধু ভাষা বলেছেন।
না রবে প্রসাদগুণ না হবে রসাল
অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল
সংস্কৃত অথবা ফারসি ভাষায় প্রকাশ না করে বাংলা ভাষায় ভাব প্রকাশের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, যে ভাষায় প্রসাদগুণ থাকবে না সে ভাষা রসালো হবে না কিন্তু সে ভাষায় থাকবে প্রচুর যবনের উপাদান অর্থাৎ আরবি-ফারসি শব্দ।
অষ্টাদশ শতক থেকেই বাংলা ভাষার নাম (বাঙ্গলা) হিসেবে পরিচিত হচ্ছিল। তার প্রমান মেলে পর্তুগীজ এবং ইংরেজদের রচনা থেকে। ১৭৪৩ সালে মনোয়েল দ্যা আসসুম্পসাঁও লিসবন শহর থেকে প্রকাশ করেন তার রচিত বাংলা ব্যকরণ ও শব্দকোষ। এই গ্রন্থে বাংলাকে মনোয়েল বেঙ্গালা বলেছেন। ১৭৭৮ সালে ন্যাথিনিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ রচনা করেন। তিনিই প্রথম বৈয়াকরণ যিনি বাংলা ব্যাকরণ রচনায় উদাহরণের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ ও বাংলা লিপি ব্যবহার করেন। তার ব্যাকরণেই সর্বপ্রথম বাংলা অক্ষরের প্রকাশ ঘটে।
১৭৮৪ সালে প্রকাশিত এবং জোনাথান ডাকানের অনুদিত আইনের বইয়ে বঙ্গদেশ অর্থে বলা হয়েছে “বাঙ্গালা” আর ভাষা অর্থে বলা হয়েছে “বাঙ্গলা”।
১৮০১ সাল থেকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের নেতৃত্বে যখন বাংলা বই লেখা চলতে থাকে এবং শ্রীরামপুর প্রেস থেকে বই প্রকাশিত হতে থাকে, তখন থেকে ভাষা বোঝাতে ” বাঙ্গালা” শব্দটাই প্রামাণ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।
ওপরের তথ্য প্রমাণ ও আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, অষ্টম -নবম শতাব্দী থেকে গৌড়ী প্রাকৃত -অপভ্রংশ- অবহট্ট থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি শুরু হয়। চতুর্দশ -পঞ্চদশ শতকে তার ব্যপক উন্নতি সাধন হয়। মধ্যযুগীয় কবিরা দেশী ভাষা, বঙ্গবাণী এবং লৌকিক ভাষা বলতে বাংলা ভাষাকেই বুঝিয়েছেন। অষ্টাদশ শতকে এসে বাংলা ভাষাভাষী ভূখণ্ড “বাঙ্গালা” এবং বাংলা ভাষা “বাঙ্গলা” নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বাংলা ভাষার সমৃদ্ধিঃ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পর পরবর্তী তিন শতাব্দী ধরে অর্থাৎ সুলতানী আমলে এবং মোঘল আমলে বাংলা সাহিত্য ফুলে-ফসলে ভরে ওঠে। এই প্রভূত উন্নতির মূল কারণ সুলতানদের উৎসাহ এবং পৃষ্ঠপোষকতা। বৈষ্ণব ধর্মের জনপ্রিয়তার ফলে হাজার হাজার বৈষ্ণব পদ রচিত হয়। এছাড়াও প্রচুর রচিত হয় মঙ্গলকাব্য, জীবনী সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য ইত্যাদি।
ব্যপক সাহিত্য চর্চার ফলে ভাষাতাত্ত্বিক পরিবর্তন সাধিত হয়। ভাষাতাত্ত্বিক পরিবর্তন ছাড়া, মধ্যযুগে শব্দসম্ভারে ব্যপক পরিবর্তন এসেছিল। এসময় তদ্ভব শব্দ এবং বিদেশি শব্দের ব্যবহার অনেক বৃদ্ধি পায়। শব্দ এবং ব্যকরণের পরিবর্তন ছাড়া সামগ্রিক ভাবে বাংলা ভাষার প্রকাশ ক্ষমতা এ সময়ে অনেক বৃদ্ধি পায় এবং তা যথেষ্ট সরলতা লাভ করে। কৃত্তিবাস, মুকুন্দরাম, আলাওল, ভারতচন্দ্রের রচনার প্রাঞ্জলতা এবং সাবলীল সৌন্দর্য বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়।
গদ্যের উন্মেষঃ
মধ্যযুগে কবিতার ভাষায় ব্যপক উন্নতি সাধিত হলেও গদ্যের তেমন কোনো নমুনা পাওয়া যায় না। ইংরেজ আমলে জীবনযাত্রা ও প্রযুক্তির বিকাশের ফলে বাংলা ভাষায় ব্যপক এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তন অর্জিত হয়। অই সময়ের চিঠিপত্র ও দলিল-দস্তাবেজে ঘাটলে দেখা যায় তার ভাষায় প্রচুর ইংরেজি শব্দের সমাগম ঘটেছে। যেমন কোম্পানি, এফন(এপ্রন), কেস(ক্যাশ) ইত্যাদি।
বাংলা গদ্যের উন্মেষ ঘটেছিল নতুন জীবন যাত্রার তাগিদে। ইংরেজরা নতুন চিন্তাভাবনা, নতুন ধারণা এবং নতুন কাজ নিয়ে এসেছিল। এগুলোর জন্য প্রয়োজন ছিল নতুন ভাষা এবং শব্দ। সমাজে, সরকারি কাজে, লেখাপড়া, সংবাদ পত্র এবং প্রত্যাহিক জীবনের তাগিদে অনিবার্য হয়ে উঠল নতুন গদ্য ভাষা। এর ফলে ১৭৮০ এর দশক থেকে শুরু করে ১৮৬৫ বাংলা গদ্যে একটা বিপ্লব ঘটে যায়। জোনাথান ডাকান থেকে বঙ্কিমচন্দ্র অব্দি সময়ের হিসেবে মাত্র আশি বছর। কিন্তু ভাষার চরিত্র বিচার করলে আলোক বর্ষ দূরের। এই পরিবর্তন ঘটেছিল ধাপে ধাপে। কিছু ঘটেছে ফরষ্টার আর কেরীর প্রয়াসের প্রচেষ্টায়, কিছু রামমোহন ও তাঁর সমসাময়িকদের হাতে, আর কিছু ঈশ্বর গুপ্ত, বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় দত্তের লেখায়। প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল , কালী প্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা এই প্রত্যেকটা প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে কিছু না কিছু নতুন ভাবনা চিন্তা এবং গদ্যের নতুন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। এভাবেই গদ্য বিকাশ লাভ করেছে সম্মিলিত সাধনার মধ্য দিয়ে।
১৮৪০ এর দশকে দুজন বড় গদ্যলেখক দেখা দিলেন
একজন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অন্যজন অক্ষয় দত্ত। তারা বাংলা গদ্যকে সাবলীল করে তুললেন। গদ্যের ভেতর যে ছন্দ থাকে, স্বাভাবিক যতি থাকে, স্বাভাবিক যতি থাকে তারা সেটা আবিষ্কার করে চমৎকারভাবে ব্যবহার করলেন। এর ফলশ্রুতিতে তাঁদের গদ্য পাঠযোগ্যতা লাভ করেছিল।
ইতিপূর্বে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলায় ব্যপকভাবে সংস্কৃতায়ন করেছিল। সেই তৎসম শব্দ প্রধান ভাষা সব বিষয়ের উপযোগী ছিল না। প্যারীচাঁদ মিত্র আলালের ঘরের দুলালে প্রয়োগ করেন সাধারণ লোক কিম্বা অল্পশিক্ষিত মহিলাদের উপযোগী মৌখিক ভাষা। উনিশ শতকে গুরুগম্ভীর এবং কথ্য ভাষার সংমিশ্রণে ভাষাকে একটা শৈল্পিক রূপ দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। উনিশ শতকে তিনি অত্যন্ত চমৎকার গদ্য লিখেছেন।
১৮৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে রবীন্দ্রনাথ গদ্যে সাহিত্য রচনা শুরু করেছিলেন। শুরুতে তিনি সাধু ভাষা গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু অচিরেই এই ভাষাকে তার কৃত্রিম মনে হয়েছে। ১৮৯০ সালে তিনি ইন্দিরা দেবীকে চলিত ভাষায় চিঠি লিখেছেন।
রবীন্দ্রনাথের পরে নানাজন বাংলা গদ্যে নিজস্ব রীতি প্রবর্তনের চেষ্টা করেছেন। প্রমথ চৌধুরী, রাজশেখর বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, সৈয়দ মুজতবা আলী, জসিমউদদীন এক রকমের বাংলা লেখেননি। আরও পরে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং প্রশাসনের জন্যও একরকম ভাষারীতি তৈরি হয়। শব্দ ব্যবহার এবং বাক্যগঠনে বহু লেখক মিলে নানারকম বৈচিত্র্য নিয়ে এসেছিলেন। এভাবে আঠারো শতকের শেষ দিক থেকে আরম্ভ করে পরবর্তী দেড়শো বছরের মধ্যে নানা লেখকের হাত দিয়ে বাংলা ভাষার বিশেষ করে বাংলা গদ্যের কালান্তর ঘটেছিল।
উনিশ শতকে ইংরেজি সাহিত্যের ভাবধারায় বাংলা কবিতায় আধুনিকতা নিয়ে এসেছিলেন মধুসূদন, রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র, বিহারীলাল চক্রবর্তী এবং শতাব্দীর শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বিংশ শতাব্দীঃ
বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বাংলা সাহিত্যের বিষ্ময়কর ঘটনাটি ঘটে যায়। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পান। প্রমথ চৌধুরী ১৯১৪ সালে চলিত রীতিতে শুরু করেন “সবুজপত্র” পত্রিকা। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই রবীন্দ্রনাথ কবি, সাহিত্যিক ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে নিজের আসন পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর অনুরোধে তিনি তখন চলিত রীতিতে লিখতে সম্মত হলেন, চলিত রীতি খুব ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়।
যে কথাসাহিত্য দিয়ে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সূচনা
বিশ শতকের গোড়াতে তাতেও রবীন্দ্রনাথই নতুনত্ব নিয়ে এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের চেয়ে মানব চরিত্রগুলো আরও সূক্ষভাবে আঁকতে পেরেছিলেন। এরপর উপন্যাস অসামান্য অবদান রেখেছিলেন শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর এবং মানিক বন্দোপাধ্যায়। এঁরা উপন্যাসে গ্রামীনজীবন এবং সাধারণ মানুষ নিয়ে এসেছিলেন। শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে ভাবালুতা এনেছিলেন যা বাঙালির সঙ্গে সামাঞ্জসপূর্ণ। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ অথবা শরৎচন্দ্রের উপন্যাস লেখকরা যৌনতাসহ জীবনের এমন সব দিক তুলে ধরতে পেরেছিলেন যা পূর্ববর্তীরা পারেনি। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় গ্রামবাংলার প্রকৃতি এবং মানুষের দিকে তাকান যা মানুষকে নষ্টালজিক করে তোলে।
নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায় বিষয় বস্তুতে আরও বৈচিত্র্য এনেছিলেন। মানিক বন্দোপাধ্যায় মার্কসীয় দর্শনে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি যে উপন্যাসে গ্রামের কর্মজীবী মানুষদের নিয়ে এসেছেন তা শ্রেনীদ্বন্দ্বের চেয়েও মানবিক প্রেম ভালোবাসার প্রবৃত্তিই প্রবল হয়ে দেখা দেয়।
বিংশ শতাব্দীতে কথাসাহিত্যের যথেষ্ট উৎকর্ষতা লাভ করলেও তার চেয়েও সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল কবিতা। বাংলা কবিতাকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবিতা ভাষা, ছন্দ, বিষয় নিয়ে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। প্রেম, প্রকৃতি, ঈশ্বর, সৌন্দর্য, মানবতা সবকিছুই তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। অই সময়ে রবীন্দ্র অনুসারী অনেক কবি তৈরি হয়।
অপরপক্ষে ১৯২০ এর দশক থেকে যারা কবিতা লেখেন তারা রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত হয়ে একটা স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করেন। কাজী নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মোহিত লাল মজুমদার, জীবনানন্দ দাস, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কবিদের লেখায় প্রেম যৌনতা, দারিদ্র্য, জীবন সংগ্রাম ব্যপকভাবে প্রতিফলিত হয়।
তিরিশের দশকের কবিরা কেবল বিষয়বস্তু এবং দৃষ্টিভঙ্গিতেই নতুনত্ব নিয়ে আসেননি। তাঁরা কবিতার ভাষা নিয়েও নিরীক্ষা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সহজ ভাষার পরিবর্তে তাঁরা ইংরেজি কবিতার আদলে একটা বিশেষ ধরণ প্রবর্তন করেন যাকে বলা হয় আধুনিক কবিতার ভাষা।
বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে দেশ, সমাজ, রাজনীতি ইত্যাদিও সাহিত্যের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। আর তাতে জোরালো ভূমিকা পালন করেন কাজী নজরুল ইসলাম। এর আগে মধুসূদন দত্ত বিদ্রোহের জোরালো বানী শুনিয়েছিলেন। থীম এবং আঙ্গিকের দিক দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠিত এবং পুরোনো নিয়ম কানুন ভেঙে ফেলেছিলেন। তিনি ধর্ম, রাজনীতি, সরকার, সমাজ যা কিছু ব্যক্তির মানবিক স্বাধীনতাকে খর্ব করে– তাকে ভেঙে তছনছ করার আহবান জানালেন। প্রেম আর মানবতার জয়গান গাইলেন উচ্চকিত কন্ঠে। বাংলা সাহিত্যে তাঁর চেয়ে উচ্চকন্ঠে আর কেউ মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেননি।
বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের এক নিভৃতচারী কবি জীবনানন্দ দাস। জীবদ্দশায় অসাধারণ কবি হিসেবে পরিচিতি থাকলেও তিনি খ্যাতি অর্জন করে উঠতে পারেননি। এর জন্য তার প্রচারবিমুখতাও দায়ী; তিনি ছিলেন বিবরবাসী মানুষ। তবে মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তিনি বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতার পথিকৃতদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
নজরুলের পরে জসিমউদদীন এর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি চিরায়ত গ্রাম বাংলার প্রকৃতি আর মানুষের দুঃখ দুর্দশা তুলে ধরেন। পঞ্চাশের দশকে উল্লেখযোগ্য কবি শামসুর রহমান, আলমাহমুদ,, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙখ ঘোষ, সুনীল গাঙ্গুলি প্রমুখ।
সেই মধ্যযুগ থেকে বিশ শতক অব্দি বাংলা ভাষা ছোট একটা ঝর্ণা থেকে মহাসমুদ্রের রূপ পরিগ্রহ করেছিল ঠিক তখনই আসে বাংলা ভাষার ওপর সবচেয়ে ঘৃণ্য ও জঘন্য আঘাত – সেটা হল উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার হীন প্রচেষ্টা।
ভাষা আন্দোলনঃ
১৯৪৭ সালে যখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছিল তার আগেই আসলে শুরু হয়েছিল ভাষা নিয়ে বিতর্ক।ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক তাদের ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য বইয়ে লিখেছেন, “প্রথম লড়াইটা প্রধানত ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ”।
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন নিশ্চিত হওয়ার পর উর্দু-বাংলা বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেসময়কার গুরুত্বপূর্ণ ‘মিল্লাত’ পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, “মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে বরণ করার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকিতে পারে না।”
ধীরে ধীরে অর্থনীতি ও রাজনীতিও সেই বিতর্কের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে দৈনিক আজাদি পত্রিকায় লেখক সাংবাদিক আবদুল হক লিখেছিলেন, “উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি উর্দু-শিক্ষিতই চাকুরীর যোগ্যতা লাভ করবেন, এবং প্রত্যেকটি বাংলা ভাষীই চাকুরীর অনুপযুক্ত হয়ে পড়বেন”।
১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেছিলেন। তখন ভাষা নিয়ে বিতর্ক আবারো জেগে উঠেছিলো। ততদিনে মুসলিম বাঙালীদের আত্ম-অন্বেষণ শুরু হয়ে গিয়েছিলো।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ডাকটিকেট, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড ইত্যাদি থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের এই ঘোষণায় পর ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
কমিশনের বাঙালী কর্মকর্তারা সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন। পাকিস্তান গঠনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, পরবর্তীতে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালে আইন পরিষদের অধিবেশনে বলেছিলেন, ভাষা সম্পর্কিত বিতর্ক শুরু হওয়ার আগেই এসব ছাপা হয়ে গেছে। যদিও তার এই বক্তব্য সবাই গ্রহণ করেনি।
সেসময় বুদ্ধিজীবীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে মাতৃভাষার পরিবর্তে উর্দু চাপিয়ে দিলে বাংলাভাষী পরবর্তী প্রজন্ম অশিক্ষিত হয়ে পড়বে, বাংলা ভাষার অস্তিত্ব ঝুঁকিতে পরবে। স্বাধীনভাবে মাতৃভাষার চর্চার ক্ষেত্রে এটিকে বড় আঘাত বলে মনে করা হয়েছে। এইসব বিষয়ে ক্ষোভ, অনিশ্চয়তা দানা বাঁধতে থাকে বাঙালির মন আর মননে। এই অনিশ্চয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে গঠিত হয় “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ “।
সেসময়কার একটি ইসলামি সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের নূরুল হক ভূঁইয়া, তৎকালীন সংসদ সদস্য সামসুল হক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের প্রতিষ্ঠাতা অলি আহাদ, পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ তোয়াহা সহ অনেকেই এর সদস্য ছিলেন যারা শুরুতে গোপনে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন।
তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাভাষীরা উর্দুভাষীদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তারপরও ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক সমাবেশে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’। সেই সমাবেশেই উপস্থিত অনেকেই সাথে সাথে প্রতিবাদ করে ওঠেন। এই ঘোষণাকে বলা যেতে পারে নতুন রাষ্ট্র সম্পর্কে বাঙালীর স্বপ্নভঙ্গের সূচনা। জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে শুরু থেকে অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ করেছেন। ইতিমধ্যে ভাষা ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য আরও জোরালোভাবে প্রতীয়মান হচ্ছিল। ধর্ম নয় বরং বাঙালী জাতিয়তাবাদের ধারনা স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল। অন্যদিকে তখনকার উর্দুভাষীরা বাঙালীর সংস্কৃতিকে ‘হিন্দুয়ানী’ বলে মনে করাটা বাংলা ভাষার প্রতি তাদের বিতৃষ্ণার আরেকটি কারণ।
রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবীতে থেমে থেমে আন্দোলন চলেছিল।তখন এই আন্দোলনে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অগ্নি স্ফুলিঙ্গের জন্ম হয় যখন বায়ান্নর ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের অ্যাসেম্বলিতে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। পূর্ব-বঙ্গের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় সফরে এসে খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনে এক সমাবেশে জিন্নাহ’র কথাই পুনরাবৃত্তি করেন। সেসময়ও একইভাবে জোরালো প্রতিবাদে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান ওঠে।
ভাসানীর নেতৃত্বে সম্মেলনে অংশ নেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সংস্কৃতিকর্মী এবং পেশাজীবী সম্প্রদায়ের মানুষজন। ২১শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়েছিল। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিলো। যা লঙ্ঘন করেই জন্ম হয়েছিল শহীদ দিবসের।
ভাষা আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছিলেন সেবিষয়ে সঠিক সংখ্যা এখনো পাওয়া যায় না। সেদিন এবং পরদিন পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং শফিউর ছাড়াও আরো অনেকে শহীদ হয়েছিলেন বলে ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন বইয়ে উল্লেখ আছে।
১৯৫২ সালের সেই দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র হিসেবে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কর্মরত ছিলেন মুহাম্মদ মাহফুজ হোসেন। বছর তিনেক আগে বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাতকারে তার বর্ণনায় ফুটে উঠেছে সেদিনকার চিত্র। তিনি বলছিলেন, “আমরা তখন বাইরে থেকে বহু আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমরা শুনেছিলাম বহু মানুষ গুলিতে আহত হয়েছে। মুহূর্তেই ইমারজেন্সি ওয়ার্ড পূর্ণ হয়ে যায়। আহতদের অনেকেই মুমূর্ষু, তাদের সঙ্গে আসা মানুষজন আর চিকিৎসকে ঠাসাঠাসি হয়ে যায় জরুরী বিভাগ।” তবে এই ঘটনার পরও দুই বছরের বেশি সময় পরে, ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান সংসদ বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি কার্যকর হতে লেগেছিল আরও দুই বছর।
এরপরে ৬২, ৬৬,৬৮, ৬৯ এবং সবশেষে ৭১ সব আন্দোলনে একুশের চেতনা পথ দেখিয়েছে বিপ্লবী ও যোদ্ধদের। আর ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র “বাংলাদেশ”।
৫২- ৭১ এর চেতনায় রচিত হয় অসংখ্য কালজয়ী সাহিত্য। সৈয়দ শামসুল হক, শওকত ওসমান, আহমদ ছফা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, শামসুর রাহমান, আলমাহমুদ, আবুল হাসান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শহীদুল্লাহ্ কায়সার এবং আরও অনেক কবি সাহিত্যিক সমৃদ্ধ করেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য।
একুশ শতকের প্রেক্ষাপটঃ বাংলা সার্বভৌম ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র। বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা তথা সরকারি ভাষা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামের বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের প্রধান কথ্য ভাষা বাংলা। এছাড়া ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, মেঘালয়, মিজোরাম, উড়িষ্যা রাজ্যগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাংলাভাষী জনগণ রয়েছে। ভারতে হিন্দির পরেই সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা বাংলা।
সারা পৃথিবী জুড়ে ২৬ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে।
বাংলাদেশ একমাত্র বাংলা ভাষার ভাষা ভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র। বাংলাদেশের শিক্ষা এবং সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বাংলা ভাষার ভূমিকা ও গুরুত্বের ওপর বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব অনেকাংশে নির্ভরশীল।
বর্তমানে দেশে চার ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। ২০১৫ সালের জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ৬৫,৫৯৩ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৫৩,৫৮৯ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৭৯৫৫ টি মাদ্রাসা, ১২ টি ক্যাডেট কলেজ আছে। দেশে মোট কলেজের সংখ্যা ৪৪৫১ টি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা অন্যান্য বিষয়ের সাথে বাংলা ও সুন্দর ভাবে শেখানো হয়। কিন্তু বাংলা মাধ্যমে সাধারণত অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ঘরের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করানো হয়। তাছাড়া গ্রামে-গঞ্জে শিক্ষার মান সন্দেহাতীত নয়।
ইংরেজি মাধ্যমে বাংলা একেবারেই গুরুত্ব পায় না। হাফেজি মাদ্রাসায় কোরান মুখস্থ করানো মূল বিষয়। কওমী মাদ্রাসায় আরবি ভাষা, সাহিত্য, কোরান -হাদীস এসবই গুরুত্বপূর্ণ। আলিয়া মাদ্রাসায় কোনোভাবে বাংলা পড়ানো হয়। ইংরেজি ভার্সনে কোনোরকম বাংলা শেখানো হয়। এভাবে একজন ছাত্র বা ছাত্রী বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে ওঠে আদৌ ভালোভাবে বাংলা না শিখেই।
এরপর আসি স্নাতক পর্যায়ের বিষয়ে। যারা ডাক্তারী, ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যবসায়, ফলিত বিজ্ঞান, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় নিয়ে স্নাতকে পড়াশোনা করে তাদের সাথে বাংলা ভাষার যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কারণ বাংলা ভাষার কোনো বই সহজে পাওয়া যায় না। উচ্চশিক্ষা বাংলায় কল্পনারও অতীত। ফলশ্রুতিতে না হয় জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ না হয় বাংলা ভাষার সঠিক চর্চা।
এরপর আসা যাক সাংস্কৃতিক ও বিনোদনের বিষয়ে। একসময় মানুষ প্রচুর বাংলা নাটক – সিনেমা দেখত। বাংলা গান শুনত। বর্তমানে বিশ্বায়ন আর আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে হিন্দি আর ইংলিশ চ্যানেলের ছড়াছড়ি। তাছাড়া মানসম্মত নাটক সিনেমাও তৈরি হয় না। আঞ্চলিক ভাষার নামে জগাখিচুড়ি সংলাপ। অশুদ্ধ উচ্চারণ আরও যে কত কত দৈন্যতা! সরকারি অফিস ছাড়া সব অফিসে চিঠি পত্রের মাধ্যম ইংরেজি। অর্থাৎ সমাজের উচ্চবিত্তের সাথে বাংলার যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক মানুষ বাংলা ভাষা শুধু টিকিয়ে রেখেছে মৌখিক ভাষা হিসেবে।
সেই মধ্যযুগে বাংলা ভাষার নিজ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল তারপর ইংরেজ আমলে পড়ালেখা, দলিল, আইন, সংবাদ পত্র সবকিছুর প্রয়োজনে বিকশিত হয়েছিল গদ্য, পরিভাষা, তারপর চলিত ভাষা। এই বিকাশের সাথে প্রাণের যেমন যোগাযোগ ছিল তেমনি ছিল প্রতিষ্ঠার যোগাযোগ। আবার ভাষা আন্দোলনেরও ছিল আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট। উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হলে কোনো বাঙালি চাকরি পেত না। ভাষা আন্দোলন হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে। কারণ মধ্যবিত্ত শ্রেনির চাকরির সঙ্কট দেখা দেবে উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হলে।কিন্তু আজ প্রতিষ্ঠা আর প্রাণ কোথাওই যেন বাংলা ভাষার শক্তিশালী বিচরণ নেই।
বাংলা ভাষার অস্তিত্ব টকিয়ে রাখতে হলে নিম্নলিখিত কিছু পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি বলে প্রতীয়মান হয়;
১. ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিশুদ্ধ বাংলা পড়া এবং লেখা শিখতে আগ্রহী হয়ে ওঠা এবং প্রজন্মকে শুদ্ধ বাংলা শেখানো।
২.যে যেখানেই পড়াশোনা করুক; মাদ্রাসা বা ইংরেজি মাধ্যম বাংলাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে পড়ানো বাধ্যতামূলক করা।
৩. উচ্চশিক্ষার পর্যায়ে অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা বইয়ের প্রাপ্যতা বাড়ানো। ইউজিসি এবং বাংলা একাডেমির সমন্বয়ে সেটা সম্পাদিত হতে পারে।
৪. স্নাতক পর্যায়ে বাংলা সাহিত্য -সংস্কৃতি – ইতিহাসের ওপর ২০০ নাম্বারের কোর্স চালু করা। বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি ও বাংলা একাডেমির সমন্বিত প্রচেষ্টায় করা যেতে পারে।
৫.আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ছাড়া সব অফিস আদালতে বাংলায় যোগাযোগ উৎসাহিত করা যেতে পারে।
১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ” এর মর্যাদা দিয়েছে। বিশ্বের দরবারে এ বাঙালির বিরল অর্জন। বাংলা ভাষার রয়েছে আরও উল্লেখযোগ্য সফল অর্জন।
ভারতে ভারতীয় সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত ২৩টি সরকারি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারি ভাষা হল বাংলা। খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস হতে বাংলা ভাষা ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা রূপে স্বীকৃত। পাকিস্তানের করাচী শহরের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা রূপে বাংলাকে গ্রহণ করা হয়েছে। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে সিয়েরা লিওনের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আহমাদ তেজন কাব্বাহ বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা প্রদান করেন। কিন্তু এইসব সাফল্য ছাড়িয়ে আজ অবজ্ঞা, উপেক্ষা আর অপমান বড়বেশি মূর্তিমান হয়ে ওঠে।
বিশ্বায়নের নামে চলছে নতুন সাম্রাজ্যবাদীতা আর তাতে সবচেয়ে হুমকির সম্মুখীন ভাষা এবং সংস্কৃতি। সুখী, সমৃদ্ধ বাঙালি হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে বিচরণ করতে চাইলে প্রতিষ্ঠা ও প্রাণের সাথে বাংলার শক্তিশালী যোগাযোগ স্থাপন অত্যন্ত জরুরি।
কবি ও কথাসাহিত্যিক
তথ্যসূত্রঃ সভ্যতার চেয়ে বড় — সিরাজুল ইসলাম। চৌধুরী
হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি — গোলাম মুরশিদ।
বাঙালি কাকে বলি– সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।