You are currently viewing জেমস রাইট-এর সাক্ষাৎকার/ ভাষান্তরঃ ঋতো আহমেদ

জেমস রাইট-এর সাক্ষাৎকার/ ভাষান্তরঃ ঋতো আহমেদ

  জেমস রাইট-এর সাক্ষাৎকার

    ভাষান্তরঃ ঋতো আহমেদ

 সংক্ষিপ্ত কবি পরিচিতি

 জন্ম: আমেরিকার ওহাইও রাজ্যের মার্টিন্স ফেরিতে ১৯২৭ সালের ১৩ ই ডিসেম্বর জন্মেছিলেন জেমস রাইট।

প্রথম যৌবন: ওহাইও-তে তাঁর শৈশব ভালো কাটেনি। পরে, ১৯৪৬ সালে তিনি ইউএস আর্মিতে অন্তর্ভুক্ত হন আর জাপান অকুপেশনে অংশগ্রহণ করেন। সেখান থেকে অব্যাহতি পেয়ে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন।

শিক্ষা:তিনি কেনিয়ন কলেজে পড়েছেন। ১৯৫২ সালে গ্রাজুয়েশন শেষে ১ বছর ভিয়েনায় কাটিয়ে তারপর ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন।

কবিতা: ১৯৫৬ সালে তাঁর ‘দ্য গ্রিন ওয়াল’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ইয়েল ইয়োঙ্গার পোয়েটস পুরস্কার পেয়ে কাব্য জগতের নজরে আসেন প্রথম। এরপর বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ১৯৭২ সালে তাঁর কালেক্টেড পোয়েমস এর জন্য পান পুলিৎজার পুরস্কার। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  • দ্য গ্রিন ওয়াল
  • সেইন্ট জুদাস
  • দ্য ব্রাঞ্চ উইল নট ব্রেক
  • শ্যাল উই গেদার এট দ্য রিভার
  • কালেক্টেড পোয়েমস
  • টু সিটিজেনস
  • মোমেন্টস অব দ্য ইটালিয়ান সামার
  • টু এ ব্লুজুমিং পিয়ার ট্রি

মৃত্যু: ১৯৮০ সালের ২৫শে মার্চ নিউ ইয়র্কে মাত্র ৫২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই কবি।

অন্যান্য: জেমস রাইটের ছেলে ফ্রাঞ্জ রাইটও আমেরিকার একজন বিখ্যাত কবি। তিনিও কবিতার জন্য পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। এখনও পর্যন্ত ‌পুলিৎজার ইতিহাসে পিতাপুত্রের এটি এক অভূতপূর্ব উদাহরণ হয়ে আছে।

সাক্ষাৎকার

[প্যারিস রিভিউ এর পক্ষে এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন পিটার এ. স্টিট। ১৯৭৫ সালের সামার ৬২ সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়।]

সাক্ষাৎকারী : মি. রাইট, আপনি জন বেরিম্যানের সাথে মিনোসেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। প্রথমেই জানতে চাচ্ছি, কবি হিসেবে ওনার সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?

জেমস রাইট : জন বেরিম্যান একজন মহৎ কবি। তাঁর কাজ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবে বলে মনে হয় আমার। শুধুমাত্র তিনি একজন ভালো শিল্পী এইজন্য নয়, বরং তিনি তাঁর কবিতায় যেটা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন, হয়তো এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন না যদিও, বিষয়টি হচ্ছে কবিতা কেবলমাত্র একটি নির্মাণ বা সুন্দরভাবে গঠিত কিছু পংক্তি নয়, কবিতা বরং এমন কিছু যাকে বলা যায় চলমান সৃষ্টি। সে নিজে এমন স্তরে গিয়ে পৌঁছায় যেখান থেকে নিজেই নিজেকে পুনঃসৃষ্টি করতে পারে। বেরিম্যান তাঁর সৃষ্টির বিকাশ কখনো বন্ধ করেন নি। তিনি দেখাতে চেয়েছেন মানুষের কল্পনায় কবিতা হচ্ছে বসন্তদিনের মতোই পুনঃসৃষ্টিময়। এক‌ই কারণে ড. উইলিয়ামস‌ও একজন বড়ো কবি।

এইরকম একটা প্রশ্নে একবার টলস্টয়‌ও চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। শান্তিবাদী একটি দল একবার চিঠি লিখে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলো যদি তিনি জানাতেন ধর্মের সংজ্ঞা কি, যদি তিনি জানান, একটু ব্যাখ্যা করে তাদের বলেন যে, মানুষের যে ধর্ম-বিশ্বাস, এর সাথে নশ্বরতার সম্পর্ক কি, মানে হচ্ছে, বিশ্বাস অনুযায়ী যেভাবে সে চলে আর যেভাবে তার চলা উচিত। চিঠিটা পড়ে চিন্তায় ছিলেন কিছুদিন, তারপর, যদ্দূর মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন : “আমি শুধু নিজের কথাই বলতে পারি। যদি নিজের দিকে ফিরে তাকাই, দেখতে পাই, প্রতি বছর মানুষ নিজের জন্য বা অন্যের জন্য যা-ই করুক-না-কেন, বসন্তকাল সর্বদাই নিজেকে নবীন করে তোলে। এটা কোনো আধ্যাত্মিক মতবাদ নয়, প্রকৃত ঘটনা। প্রতিটি বসন্তে আমি খুব ভালো ভাবেই এটা বুঝতে পারি। বুঝতে পারি প্রতি বছর বসন্ত নতুন রূপে এসে হাজির হয় আর আমি হয়ে যাই এক বছরের পুরনো। যদি জানতে চাই: কি সম্পর্ক আছে, আমার এই বিশদ নশ্বর জীবনের সাথে প্রকৃতির ওই শক্তির যা নিজেকে চির নবীন করে তোলে? আমার মনে হয় সব মানুষের মধ্যে এই প্রশ্ন আছে। নিশ্চয়ই কেউ এড়াতে পারে না—মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়। আর তার কাছে এর উত্তর হচ্ছে তার ধর্ম। যদি সে বলে আমার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই, তাহলে তার ধর্ম ধ্বংসবাদ। নশ্বরতায়, কি করা উচিৎ আমার? যদি জানতাম।” দারুণ একটা উত্তর ছিল এটা।

বড়ো কবি হ‌ওয়ার পেছনে ভাষার নৈপুণ্যগত দক্ষতা নিশ্চয়ই ছিল বেরিম্যানের। কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি সবসময়ই বলে গেছেন কবিতা কেবল অলঙ্কার নয়, জীবনের সাথে, যেভাবে আমরা যাপন করি এই জীবন, তার সাথে, কবিতা  গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে নিজেই।

সাক্ষাৎকারী : ‘কবি হ‌ওয়া’ ব্যাপারটা কি?

জেমস রাইট : আমি শুধু আমার কথা বলতে পারি। এক হোরেইশিয়ানের মতো, প্রাথমিক ভাবে নিজেকে শিল্পকার হিসেবে পরিচয় দিই আমি। আমার প্রিয় কবি এড‌ওয়ার্ড থমাস, আর যাকে আমার গুরু বলে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই তিনি হোরেইস—হোরেইস, যিনি খুব নিঃখুঁতভাবে অমায়িক, হাস্যরসাত্মক কবিতা লিখতে পারতেন।

হ্যাঁ, অবশ্যই অন্য আরও কবিরা আছেন প্রিয় তালিকায়। উদাহরণ হিসেবে জ্যাক ফিনেগানের কথা বলা যায়। আমার বন্ধু জ্যাক ফিনেগান। একজন শিক্ষিত মার্জিত ভদ্রলোক। জ্যাক লোফাসের বার-এ মাঝেমধ্যে দেখা হয় আমাদের। আইরিশ কাব্যজগতে একটি ঐতিহ্য আছে, যে কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর কবিতার নিজের মধ্যেই নিহিত থাকে। যেমন ধরুন, বার-এ উপস্থিত কোনো ব্যক্তিকে কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করলো: এই ডাইস নিয়ে কি করো তুমি? ঘুরে দাঁড়িয়ে লোকটি বললো:

ঈশ্বর ঐ ইহুদি মহিলাকে উঠিয়ে নাও,

রানী জেযেবেল, কুত্তি একটা

ঘার থেকে ঢলে দিয়েছে আঁচল

একেবারে স্তনবৃন্ত পর্যন্ত

জানালা গলে যেন তাকে টেনে আনা হয়েছে

জেরেনিয়ামদের মধ্যখানে, যেখানে

সে হাসছিল আর বিদ্রুপ ছুঁড়ে দিচ্ছিলো

তাঁর রঙিন চুল ফিটফাট করতে করতে—

রাজা জেহু গেলেন তার কাছে,আর

সে তাকে এক অভিনব সংকেত দিলো; কিন্তু

তিনি চাকার নিপুণ পাখি দিয়ে বললেন,

‘কে ভাঙতে চাও ঐ শিশিরাবৃত ঘার?’

এভাবেই জানালা থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয় ওকে;

পড়ে গেল সে লুসিফারের মতোই

ঘোড়ার খুরের নিচে, ব্যথা পেল খুব

আর জেযেবেল থেকে সরে গেল আলো।

ক্লোভারে বুনা নয় ওসব শস্য;

আহ্, আর খুঁজে পাওয়া যায় নি তাকে

রক্ষা করো ওই ধূসর হাড় ওই খরগোশ-পা মাইক

মধুর আওয়াজ শুনতে দাও আমায়;

চাঁদের আলোয় একবার যখন নাচছিলো

ওই দেহ, ভিজে গিয়েছিলো রাজকুমারী,

তাই শুধু দেব আমি তালি: যদিও তার ভূত পেছনে খালি

এখনও সুর আছে ঐ প্রাচীন দেহে।

 

এভাবেই বলতে হয়, “তুমি তোমার চরকায় তেল দাও, আমি আমার।” কবিতাটি আইরিশ কবি এফ আর হিগিন্সের “সঙ ফ দ্য ক্লেইটার-বোউন্স”।

আসলে, ভেবেছিলাম ওটা একটা সাহিত্য সভা মাত্র, আর হয়তোবা বিশ্বাস হবে না তোমার, কিন্তু ঈশ্বরের দিব্যি করে বলছি সত্যি কথা। আরেকদিন গেলাম লোফাসে, ফিনেগানের সাথে দেখা হলো। বললাম, “জ্যাক, কেমন আছো?” “ভালো আছি, প্রফেসর,” সে বললো, “তোমার খবর কি?” আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম—আর ঈশ্বরের নামে বলছি ভীষণ প্রাণময় উত্তর এলো। তাঁর তো জানার কথা নয় কী প্রশ্ন করবো আমি। বললাম, “জ্যাক, নিক্সনের চীন সফর নিয়ে কী ভাবছো তুমি?” আমার দিকে ফিরে চমৎকার ভাবে গাইলো:

সুন্দর শহর পিকিং

মেয়েরা সব চিচিং

সেখানে দেখি সে-কী

মিস মলি অং অং।

বড়ো চ‌ওড়া রাস্তায়

চালাচ্ছেন ঠেলাগাড়ি

গাইছে সেচুয়ান, পিকিং,

জীবন্ত লং ডং।

জীবন্ত লং ডং

জীবন্ত লং ডং

কাঁদছে সেচুয়ান, পিকিং,

জীবন্ত লং ডং।

 

অন-দ্যা-স্পট গানটি গাইলো সে। কী বলবো তাকে? জ্যাক, এখন‌ই বাঁধলে গানটা? হ্যাঁ, উপস্থিত মুহূর্তেই গান বাঁধলো সে। আমি তার চাক্ষুষ প্রমাণ।

আরেকটি আইরিশ ট্র্যাডিশন বলছি। নিছক অহংকার আর বেঁচে থাকার সংকল্পের উপর যার ভিত্তি। এখানে কবিতা নিজেই জীবনকে প্রাণময় রাখতে পারে। যতক্ষণ সুর আছে—গাইতে পারবে যতোক্ষণ,—ততোক্ষণ যেকোনো কিছুই স‌ইতে পারবে তুমি। রাফতেরী-কে চেনো? আঠারো শতকের এন্থোনি রাফতেরী, অন্ধ এবং শিক্ষিত, যার হাতে বীণা থাকতো সবসময়। একবার সে এক বার-এ দাঁড়িয়ে ছিল, আর এক লোক এসে জিজ্ঞেস করল, আহা কে ওই বেচারা অন্ধ, বীণা হাতে নত হয়ে কর্ণারে দাঁড়ানো বুড়োটা কে? রাফতেরী ঘুরে দাঁড়ালেন, বললেন: “আমি রাফতেরী, কবি, আশা ও ভালোবাসায় পূর্ণ, আলোহীন চোখ আমার, অক্লেশ নম্রতায়, হদয়ের আলোয় হেঁটে যাচ্ছি পশ্চিমে, যদিও পথের শেষে কিছুটা দুর্বল ও ক্লান্ত এখন, দ্যাখো আমায়, দেয়ালের দিকে আমার পিঠের দিকে তাকাও, শূন্য পকেটে গান করছি আমি।”

সাক্ষাৎকারী :কবি-জীবন কি কষ্টের? কী মনে করেন আপনি? এই যেমন বলছিলেন, দ্যাখো আমায়, দেয়ালের দিকে আমার পিঠের দিকে তাকাও, শূন্য পকেটে গান করছি আমি?

জেমস রাইট : হ্যাঁ, আপনি হয়তো জানেন, আমিও একজন অধ্যাপক। কাব্যগ্রন্থ লিখেছি কিছু, তবে আমি তো অধ্যাপক। আর আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, শিক্ষকতা এমন‌ই এক শিল্প যেটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়। নিজেকে কবি বলছি না, আমি যা বোঝাতে চাইছি তাই বলছি। মানে হচ্ছে, ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ, ব‌ই পাঠ করা, নিজের ভাবনা চিন্তা ওদের সাথে শেয়ার করা, আমাকে বেশি আনন্দ দেয়, আর আমার মনে হয় এটাই উচ্চতর শিল্প। সেইসব শিক্ষকদের কথা স্মরণ করুন যেমন যীশু, সক্রেটিস, সিদ্ধার্থ, মেইজতার একহার্দ। সংক্ষেপে বলতে গেলে, হ্যাঁ।

সাক্ষাৎকারী : কবিতা কি এমন কোনো বিষয় যার থেকে মুক্তি নেই আপনার?

জেমস রাইট : হুম, আমাকে স্বীকার করতে হবে আমি এর থেকে পালাতে পারিনি, এমনকি বলতে গেলে আমার কাছে একরকম অভিশাপ মনে হয় একে। অনেক ভেবেছি। কেন আমি কাঠমিস্ত্রি হলাম না, কেনইবা হ্যান্ডিম্যান হলাম না?

সাক্ষাৎকারী : এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? কবি জীবন মানে কি অনেক বেশি বিষয়ে সচেতন হওয়া বুঝায়?

জেমস রাইট : না, ওরকম এতো কিছু আমার মনে হয় না। অনেক বিষয়ে সচেতন আমি। কিন্তু কেবল যখন অদ্ভুত ঘটনা ঘটে আমার সাথে, সম্পূর্ণ বিস্ময়কর কোনো ঘটনা। আর যদিও বলছি হোরাইসিয়ান আমার আদর্শ, আমার ধারণা হোরাইসও এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন। কখনো কখনো জীবনের এমন শক্তি আছে যেমন বসন্তকাল কিছু না জানিয়েই যে রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয় অকস্মাৎ, সত্যি ভিতিকর, ভীষণ আৎকে দেয় আমাকে। এরকম বেশ কয়েকবার হয়েছে আমার—যখন কোনো কবিতা লিখে শেষ করেছি প্রায় আর বাকি নেই তেমন, তখন‌ই ঘটেছে।

সাক্ষাৎকারী : কোন কবিতার কথা বলছেন? মনে করে বলুন তো কোনটা?

জেমস রাইট : “ফাদার” নামে একটি কবিতা আছে। আর আছে “অ্যা ব্লেসিং”। যদি তুমি আমাকে প্রশ্ন করো, কীভাবে এলো ঐ কবিতা গুলো? আমার হয়তো বলতে হবে, আমি কীভাবে জানবো? কবি জীবন কখনো কখনো তোমাকে জীবনের করুণায় নিয়ে দাঁড় করাবে, আবার জীবন কিন্তু সবসময় করুণাময়ও নয়।

সাক্ষাৎকারী : আপনি কি কখনো সৃজনশীল লেখন পদ্ধতি শিখেছিলেন?

জেমস রাইট : একবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। কারণ, ক্লাসে গিয়ে শুধু বসে থাকতাম আর গল্প করতাম। আর যদি কেউ জিজ্ঞেস করতো, আমার শিক্ষা কেমন চলছে, তেমন কিছু বলতে পারতাম না, কেবল ঘোৎ ঘোৎ শব্দ করতাম কিছুটা। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এটি অকাজের। চাইলে চৌকসভাবেও করা যায়। যেমন আমরা জানি থিওডোর রোথেকের কথা। খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন তিনি।

সাক্ষাৎকারী : তিনি আপনার শিক্ষক ছিলেন?

জেমস রাইট : হুম, চার বছর তিনি আমার বন্ধুও ছিলেন।

ওহ্ প্রিয় পিতা,

সমুদ্রের দাঁড়ানো জাহাজগুলোর

পা কি আছে, নিচে?

অবশ্যই আছে,

আরে বোকা,

নয়তো ওরা চলবে কি করে?

এইভাবে রোথেক ছাত্রদের দিকে পংক্তি ছুঁড়ে দিতেন।

সাক্ষাৎকারী :আপনাকে তিনি কী শিখিয়েছেন?

জেমস রাইট : শিল্প-নৈপুণ্য শিখিয়েছেন, আর তিনি, ব্যারিম্যান আর লোয়েলের মতো, সম্পূর্ণ সচেতন এক শিল্পকার ছিলেন। তিনি ভালো করেই বুঝতেন শিল্পের সাথে ওই রহস্যময় কল্পনার সম্পর্ক আসলে তেমন কিছুই না যা আমরা সচরাচর ভেবে থাকি। কেউ কেউ ভাবেন, সতর্ক আর সচেতন শিল্প-নৈপুণ্য আমাদের হৃদয়ের ভাবনাকে রুদ্ধ করে দেবে। আর রোথেক বুঝতে পারেন আসলে সতর্ক আর সচেতন শিল্প-নৈপুণ্য আমাদের হৃদয়ের ভাবনাকে মুক্ত করে, মুক্ত করে আমাদের কল্পনার শক্তিকে।

সাক্ষাৎকারী : আমরা জেনেছি আপনি সৃজনশীল সাহিত্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। আসলে আনুষ্ঠানিক ভাবে ক’জন কবি যে সৃজনশীল সাহিত্যে পড়েছেন আমাদের তেমন জানা নেই। সত্যি কি শেখার কিছু আছে ওখানে, নাকি প্রয়োজনীয় শিক্ষা এখনও নিজে নিজেই শিখে নিতে হবে কবিদের?

জেমস রাইট : ব্যাপারটা বুঝে অতিক্রম করে যাওয়ার জন্যেই সৃজনশীল সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছি। তোমার কি মনে হয় না যে প্রয়োজনীয় শিক্ষা তোমাকে নিজের থেকেই শিখে নিতে হবে? স্ট্যানলি ক্যুনিৎস একবার আমাকে বলেছিলেন: “তোমাকে নিজের গভীরে নামতে হবে, সত্যিকারের গভীরতায়, আর তারপর সেখান থেকে তোমার নিজস্ব পথ খুঁজে নিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা অন্য কারো দেখানো পথ হলে হবে না। শুধুমাত্র তোমারই হতে হবে।”

আমি কি তোমাকে বলবো কেন এম‌.এ. করেছি কবিতার বই লিখে? আমি শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম। এম.এ. করেছিলাম যেন পরবর্তী সময়ে ডক্টরেট করতে পারি। এবং করেছিলাম‌ও। আমি ডিকেন্সকে নিয়ে লিখেছি। বলতে গেলে, একজন শিক্ষক হিসেবে আমার বিষয়, আমার প্রধান বিষয় ছিল ইংরেজি উপন্যাসের ইতিহাস।

সাক্ষাৎকারী : একজন কবি হয়ে?

জেমস রাইট : ওহো, বহু কবিতা আছে ওখানে। “আর সেই প্রাচীন ও পুরনো সেই করুণ ও প্রাচীন সেই করুণ ও ক্লান্ত আমি ফিরে যাই তোমার কাছে, নিথর পিতা আমার, নিথর উন্মাদ পিতা, নিথর উন্মাদ ও ভীতিকর পিতা আমার, যতক্ষণ না তাকে দেখতে পাই একদম কাছে, ..ছুটে যাই, আমার একমাত্র, তোমার কাছে।” ফিনেগান ওয়েক। আর একটা শুনতে চান? ত্রিস্ত্রাম শ্যাণ্ডি থেকে শোনাচ্ছি। ত্রিস্ত্রাম, সেই কথক, যিনি চাইছিলেন আপন জন্মস্থানে ফিরে যেতে। নবম পর্বের অষ্টম অধ্যায় শেষে তার মনে হয় এইবার তবে বলা যায় তার সেই জন্ম-রাতের গল্প, কিন্তু বলতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে তার কাকা তবি একবার বলেছিলেন সেই জন্মের রাতে তার বাবা, ওয়াল্টার শ্যাণ্ডি, আর তার মা ঝগড়া করছিলেন। ঝগড়া হচ্ছিলো কে কাজ করে আর কে সময়ে গা ভাসিয়ে চলে এইরকম কিছু নিয়ে। এইখানে হঠাৎ করে লরেন্স স্টার্ন নিজেই কথকের ভূমিকায় নামেন, ঝগড়ার মাঝখানে, তিনি এইভাবে এসে বলেন। উপন্যাসের ভেতর এ এক গদ্য:

এ নিয়ে তর্ক করবো না: সময় নষ্ট হয় দ্রুত: যে কটা অক্ষর আমি পড়েছি কতো দ্রুত-ই-না জীবন কেটে যায় এ-ই-তো লিখেছি; প্রতিটি দিন আর প্রহর, খুব মূল্যবান, প্রিয় জেনী! তোমার গলার ঐ হারের চেয়েও মূল্যবান হলো সময়, মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, ঝড়ো দিনের হালকা মেঘের মতো, আর ফিরে আসবে না—সবকিছু বিষণ্ণ করে তোলে—যখন তুমি শিল্প পেঁচিয়ে ধরছো—দ্যাখো! বিমর্ষ হয়ে গেছে; প্রতিবার বিদায় বেলায় যখন চুমু খাই তোমার হাতে, তারপর ফিরে ফিরে মনে পড়ে, এ তো আসলে অচিরেই ঘটতে যাওয়া আমাদের শাশ্বত মুক্তির শুরু—আমরা দু’জন‌ই স্বর্গের আশীর্বাদ পুষ্ট! আর পুরো নবম অধ্যায় হলো: “একটা কানাকড়িও দিবো না—তবু, কেন যে সবার এতো উল্লাস।” একটু পরে আবার ঐ উপন্যাসের আরেক পাতায় এর ব্যঘাত ঘটিয়ে বলেন: “তুমি নিশ্চই জানো, জেনী কে? তাহলে এবার, নিজের কাজে মন দাও আর গল্পে ফিরে আসো।”

সাক্ষাৎকারী : কোন কোন কবির নাম বলতে চান যারা শুরুতে আপনাকে প্রভাবিত করেছিল? ওদের থেকে কী শিখতে পেরেছিলেন আপনি?

জেমস রাইট :

আচমকা বাতাস বয়ে এলো মৃদু,

বসন্ত এসেছে আবার;

সবুজে সবুজে কুঁড়িতে জীবন্ত হলো হাওথর্ন,

আর ব্যথার কুঁড়িতে আমার হৃদয়।

সমগ্র শীতে অসাড় আমার হৃদয়,

যেন মৃত এবং জমাটবদ্ধ পৃথিবী,

ভাবিনি বসন্ত আসবে আবার,

এমনকি জাগবে হৃদয় আমার।

তবু ভেঙে গেছে শীত, পৃথিবী জেগেছে

কেঁদে উঠছে ছোট্ট পাখিরা;

হাওথার্ন সীমায় ছড়িয়ে পড়েছে এর কুঁড়ি,

আর আমার হৃদয় ছড়িয়ে দিচ্ছে তার বেদনা।

 

বলতে পারেন কে লিখেছেন?

সাক্ষাৎকারী : রবিনসন?

জেমস রাইট : উঁহু, পারবেন না, পারবেন? রুপার্ট ব্রুক। মাত্র ষোল বছর বয়সেই তিনি খুব ভালো একজন লেখক হয়ে উঠেছিলেন। “পৃথিবীতে এই নীলাভ রাতের আকাশের নিচে অফুরন্ত চাপে..” আমরা তাকে যথার্থ সম্মান দিতে পারি নি, অথচ খুব ভালো লিখতেন তিনি। মারা গেছেন।

সাক্ষাৎকারী : গ্রিন ওয়ালের সাথে সংযুক্ত টীকায় আপনি রবিনসন আর ফ্রস্টের প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছিলেন।

জেমস রাইট : হ্যাঁ, তখন কতো আর বয়স ছিল আমার। ঐ ব‌ইটা লিখেছি সাতাশ বছর বয়সে। আমার মনের মধ্যে কী চলছিল তখন বলছি তোমাকে। “সেইন্ট জুদাস” নামে একটা সনেট লিখেছি তখন। ওই সনেটে কৌশলগতভাবে দু’টো ব্যাপার করতে চেয়েছি: এক‌ই সাথে প্রকৃত পেত্রার্কীয় সনেট  আর নাটকীয় স্বগতোক্তি লিখতে চেয়েছি। রবিনসনের কাছে এরকম ধারণা পেয়েছিলাম। তাঁর একটা সনেট আছে, “হাউ অন্নাদাল ওয়েন্ট আউট।” “ওয়েন্ট আউট” মানে কী জানো এখানে? আসলে, এটা হাসপাতালের ভাষা। মরে যাওয়া বুঝতে। তিনি এবং তিনি চলে গেলেন গতরাতে। অন্নাদাল চরিত্রটি আগে কোথাও লিখেছিলেন রবিনসন। কিন্তু এই সনেটটিতে ডাক্তার কথা বলছেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই, নাটকীয় স্বগতোক্তিতে কথা বলছেন অন্য একজনের সাথে। এর মানে তুমি কী করছো, তুমি কান পেতে শুনছো, সেই কথোপকথনে একজন বলছে আর অন্যজন শুনছে। ডাক্তার ছিলেন জর্জ অন্নাদালের বন্ধু। জর্জ অন্নাদাল মদ্যপ ছিলেন। ভয়ানকভাবে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলেন তিনি। তাই ডাক্তার তাকে ইনজেকশন দিয়েছিলেন। এইটাই বুঝাতে চেয়ে “ইঞ্জিন” শব্দের ব্যবহার করেছেন কবিতায়। ডাক্তার তাকে ইনজেকশন দিয়েছিলেন যেন তিনি মারা যান; যন্ত্রণাহীন সহজ মৃত্যু। এরপর মদ খেয়ে জর্জ অন্নাদাল এর অন্য এক বন্ধুর সাথে কথা বলছিলেন। কী করতে চাইছিলেন তিনি? এবং রবিনসন—দারুণ রবিনসন!—ঠিক ওইখানে ছেড়ে দিচ্ছেন তোমাকে, হ্যাঁ, কী করতে চাইছিলেন? সনেটটি শোনো:

“তারা ডাকলো অন্নাদালে—আর আমি ছিলাম ওখানে

সাড়ম্বরে, ওই ডাকের উৎসে সারা দিয়ে, উপস্থিত হতে:

মিথ্যুক, চিকিৎসক, ভণ্ড, এবং বন্ধু,

লক্ষ্য করেছি তাকে: খুব একটা দূরে থেকে নয়

দু’একবার অন্যকোথাও-ও দেখেছি:

সারাতে পারিনা আমি, এমন‌ই যন্ত্র এক—

তার ও সমাপ্তির মাঝে, যেন এক ধ্বংস,

রয়ে গেছে অন্নাদালে; আর আমি ছিলাম সেখানে।

“জানতাম সর্বনাশ হবে, কারণ তাকে আমি চিনি;

যদি পারো তো, একসাথে করো দু’জনকে,

আমার সবচেয়ে বাজে যা জানো স্মরণ করো।

এখন দ্যাখো, যেন আমি‌ই তুমি, ওইখানে—

সামান্য, দুর্বল শরীর আমার। দেখতে পাও?

এইভাবে…শেষ করে দেবে না নিশ্চই? কিছুতেই না।”

এখন আসো আমার কবিতা জুডাস বিষয়ে, কে এই জুডাস, বলা যায়, সর্বস্ব হারানো এক বিশ্বাসঘাতক। এটা একটা—আর হ্যাঁ, আমি একে রবিনসনের অনুকরণ বলবো না, তবে যদি আমি রবিনসনের সনেট না পড়তাম তাহলে হয়তো এই কবিতাটা লিখতে চেষ্টা করতাম না।

সাক্ষাৎকারী : ফ্রস্ট পড়ে কী শিখেছেন আপনি?

জেমস রাইট : হুম, এ বিষয়ে প্রথমেই আমি তার এই মহাবিশ্ব নিয়ে গভীর, ভয়ানক আর ভীষণ করুণ এক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলবো, যা আমার কাছেও সত্য মনে হয়। জীবন অর্থহীন এ কথা কখনো বলিনি, বলেছি করুণ। অত্যন্ত মূল্যবান। ঈশ্বরকে, মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি এতো আনন্দিত যে কী করবো বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু এটা আবার নরকের মতো যন্ত্রণাও দেয়। এইটাই, কিন্তু আবার কৌশলগতভাবেও ফ্রস্টে কিছু আছে। বিশেষণ-কে কীভাবে উন্মোচিত করতে হয় তা ভালো জানেন। উদাহরণ হিসেবে তার “লজ্ড” কবিতাটির কথা বলা যায়। খুব ছোট্ট কবিতা। একটি ক্রিয়া-বিশেষণ আছে এতে— “প্রকৃতপক্ষে”—আর এই একটি ক্রিয়া-বিশেষণ‌-ই, আমার কাছে মনে হয়েছে, বন্দুকের গুলির মতো আঘাত করার সামর্থ্য রাখে।

সাক্ষাৎকারী : ফ্রস্ট—আমেরিকার এক বড়ো মাপের প্রকৃতির কবি। আপনিও কি নিজেকে প্রকৃতির কবি মনে করেন?

জেমস রাইট : হ্যাঁ, কিছুটা তো বটে।

সাক্ষাৎকারী : যে কারণে এই প্রশ্ন আমাদের তা হলো, আপনার প্রথম দিকের কবিতাগুলো অনেকটা প্রকৃতির কবিতা, কিন্তু আবার অনেক কবিতা আছে মানুষকে নিয়ে। দি ব্রাঞ্চ উইল নট ব্রেক তো প্রায় সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির ব‌ই। শ্যাল উই গেদার এট দ্য রিভার একটু অন্য ধাঁচের। অনেকটা ব্যক্তিগত। আর নতুন কবিতাগুলো, সম্ভবত এই নিউ ইয়র্কে রচিত কবিতাগুলো, ঠিক যেন নাগরিক কবিতার মতো। বলতে চাচ্ছি আগের মিনোসেতা ও ওহিও ল্যান্ডস্কেপের কবিতাগুলোর বিপরীত রকম যেন এক নাগরিক ভূচিত্র-ই ফুটে উঠেছে এগুলোয়।

জেমস রাইট : মানুষ দুর্ভাগ্যবশত প্রকৃতির অংশ। হয়তো প্রকৃতি এই বিষয়ে সচেতন। ওহ্, যদি আমি পাখি হতাম! কিন্তু পারিনা পাখি হতে। যা পারি তা হচ্ছে আমি-ই। প্রকৃতিকে ভালবাসি এবং এর অন্তর্গত বেদনাকে ধারণ করতে পারি। তাই বলতে পারো আমি এক প্রকৃতির কবি যে প্রকৃতির মধ্যকার মানুষকে নিয়ে লেখে। আমি নিৎসে পছন্দ করি। তিনি মানুষকে বলেছেন “অসুস্থ প্রাণী”।

সাক্ষাৎকারী : ঠিক হবে কি, যদি জিজ্ঞেস করি আপনার কাছে আপনার কোন ব‌ইটা প্রিয়? কোনটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন?

জেমস রাইট : হ্যাঁ, ঠিক আছে। সেইন্ট জুদাস আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমার জীবনের অনুভূত সেইসব অভিজ্ঞতা লব্ধ সত্য ওই ব‌ইয়ে তুলে ধরতে চেয়েছি। চেয়েছি সেই মানুষটির কথা বলতে যে সুখী হতে চায়। কিন্তু কে সুখী নয়। সুখী হতে যে প্রতিভা প্রয়োজন তা আমার নেই। তবে কিছু মানুষ আছেন যাদের আছে। এক বন্ধু আছে আমার, ছাত্রী, তুমি হয়তো কাল ফোনে ওকে বলতে শুনেছো নিউ ইয়র্কের কোনো এক সুউচ্চ ভবনে একটা বেশ্যালয় আছে। হাসতে হাসতে বলেছিল সেখানে একদিন পুরো একদিন তাকে সেট করে নেবে। এমন সৌভাগ্য আমার হয়নি; ইস যদি হতো। সেইন্ট জুদাস এ এই বিষয়টি তুলে ধরতে চেয়েছি আমার সুখে থাকার প্রতিভা নাই। কখনো কখনো খুব সুখে থাকি ঠিকই, কিন্তু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আমি বিষণ্ণ এক কুত্তার বাচ্চা। এ ব্যাপারে সবসময়ই চেয়েছি পরিষ্কার এবং অনেকটা হিংস্র ভাবেই ওই বিষয়ে যথার্থ খোলাসা করতে। অন্ততঃ যতটা অনুধাবন করতে পেরেছি। সর্ব অর্থেই তা প্রকাশ করতে চেয়েছি। কিছুটা আত্মরক্ষামূলক‌ও ছিল, কারণ খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম তখন। ওই ব‌ইটা শেষ করে মনে হয়েছিল কবিতায় আমার কাজ শেষ হয়েছে একেবারে। সত্যি সত্যি মনে করি কবিতায় যা বলার ছিল তা সরাসরি এবং পুরোপুরি বলে ফেলেছি যতটুকু আমার পক্ষে সম্ভব, এই বিষয়ে আর কিছু করার নেই আমার।

সাক্ষাৎকারী : আপনি আগে একবার বলেছিলেন আমাদের। কিন্তু কী ঘটেছিল, আর কেন-ই-বা আবার এলেন এই পথে?

জেমস রাইট : তখন কবিতায় এসছিলাম ব্যাক্তিগত কারণে আর শিল্পের জন্যেও, অনেকটা অন্ধ গলিতেই ঢুকে পড়েছিলাম। হতাশ হয়েছিলাম। শব্দ‌ই আমাকে সান্তনা দিয়েছে—নিজেকে সবসময় শব্দের কাছে সমর্পিত করতে পারতাম। কিন্তু হঠাৎ, আমার কাছে মনে হল শব্দেরা মারা গেছে। আমার ভেতরে ওরা মৃত। কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সেই সময়, তখন রবার্ট ব্লায়ের ম্যাগাজিন ‘দ্য ফিফটিজ’ বেরুলো। আমি তাকে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখলাম, কারণ ঐ সংখ্যায় জর্জ ট্রাকল-এর একটা কবিতার অনুবাদ ছাপা হয়েছিল। এর কয়েক বছর আগে, ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমি জার্মান ভাষায় ট্রাকল-এর কবিতা পড়ি। বুঝতে পারছিলাম না কী করা উচিত কিন্তু এটা বুঝে ছিলাম ওঁর কবিতার গভীরে দারুণ এক জীবনবোধ রয়েছে যেটাকে ভালোভাবে জানা প্রয়োজন। ট্রাকল হলেন সেই কবি যিনি উপমায় ভর করে লিখেন, একটি দৃশ্যকল্পের সাথে আরেকটির যে যোগসূত্র তা কেবল তিনিই দারুণ শৈল্পিকতার সাথে মধ্যবর্তী ও যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেন। আমার মনে হয় অন্য যে কারোর চেয়ে ট্রাকলের প্রভাব আমার উপর বেশি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যখন আমি রবার্ট ব্লায়ের ম্যাগাজিন পড়ি, তাকে আমি একটি চিঠি লিখে পাঠাই। মাত্র একবার বিরতি দেওয়া ষোল পৃষ্ঠার চিঠি ছিল ওটা। উত্তরে শুধু লিখলেন, “ফার্মে এসে দ্যাখা করো”। গিয়েছিলাম দেখা করতে। আর দেখা হ‌ওয়া মাত্র আমরা ট্রাকলের কবিতার অনুবাদ নিয়ে কাজ শুরু করলাম।

আপনি হয়তো আমাদের একসাথে কাজ করতে দেখে থাকবেন। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে কারো দিকে না তাকিয়েই কাজ শুরু করতাম। আমরা আগ-পিছ করে কাজ করছিলাম। কখনো হয়তো আমার দিকে না তাকিয়ে তার স্ত্রী, ক্যারলকে বললেন, “হ্যাঁ, তিনি জে. ভি. কানিংহাম পছন্দ করেন”। তখন হয়তো আমি উঠে গিয়ে কানিংহামের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতাম। কখনোবা মুখোমুখি বসে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এমন কিছু বলতাম যা এখন এই প্যারিস রিভিউ সাক্ষাৎকারেও প্রকাশ করবো না আমি। আর হ্যাঁ, আমিও তাঁর পরিবারের সদস্য হয়ে গেছিলাম। মেরী’র ধর্মপিতা। আমাকে ভালোবেসে বাঁচিয়ে তোলেন তারা। শুধুমাত্র আমার কবিতা-জীবনের কথাই বলছি না। ক্যারল ব্লায় কে ভেবে আমার হতাশা দূর হয়ে যেত। কিছু মনে করবেন না, আমার ক্ষুদ্র জীবনের অভিজ্ঞতায় ক্যারল হচ্ছে মহৎ এক ব্যক্তিত্ব, আমার দেখা সেরা।

সাক্ষাৎকারী : সেই সময়ের আপনার লেখাগুলোতে ওনার কি কোনো গভীর প্রভাব রয়েছে? তাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন এইরকম?

জেমস রাইট : হ্যাঁ, আছে। তিনি আমার কাছে পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরেছেন আমি যে পথ দিয়ে হেঁটে অন্ধগলির শেষে পৌঁছেছি, কবিতার যে প্রচলিত কৌশল আয়ত্ত করতে চেয়েছি, সেটাই একমাত্র পথ নয়। তিনি আমায় মনে করিয়ে দিয়েছেন, কবিতা হচ্ছে অপার সম্ভাবনাময়। যদিও সব কবিতাই গঠনবদ্ধ, কিন্তু আসলে বহু ধরনের‌ই গঠন‌ রয়েছে, যেমন রয়েছে আমাদের অসংখ্য অনুভূতি। সেইরকম‌ই।

সাক্ষাৎকারী : পরবর্তী ব‌ই, হ্যাঁ, দ্য ব্রাঞ্চ উইল নট ব্রেক। এখানে ওই বিষয়টি কীভাবে এসছে?

জেমস রাইট : ওই ব‌ইয়ের মূলে রয়েছে শরীরের উচ্ছ্বোসিত আনন্দের পুনঃউপলব্ধি যা আসলে ভুলে গিয়েছিলাম আমি। প্রতি শুক্রবার বিকেলে ব্লায়ের ফার্মে যেতাম। সেখানে অনেক পশুপাখি ছিল। ওখানে একটা শিকারী কুকুর ছিল যার নাম ছিল সাইমন। আকারে ও ছিল প্রকাণ্ড। আর‌ও ছিল ডেভিড নামের একটি ঘোরা, আমার প্রিয়, সুন্দর ডেভিড, সুইব্যাক্ড পালোমীনো। সাইমন আর ডেভিড সাধারণত ফার্মের বাইরে ঘুরতে যেতো। ডেভিড দাঁড়িয়ে শস্য ক্ষেতের উপর দিয়ে দূরে সাউথ ডাকোটার প্রেইরির দিকে তাকিয়ে থাকতো আর সাইমন তার পাশে বসে থাকতো। ঘন্টার পর ঘন্টা ওখানে থাকতো ওরা। কখনোবা, আমি সামনের বারান্দায় গিয়ে বসে ওদের লক্ষ্য করতাম, কিংবা সাইমনের পাশে গিয়ে বসতাম। কিন্তু সাইমন বা ডেভিড কেউই আমার দিকে তাকাতো না। নিজেকে ধন্য মনে হতো। কারণ ওরা আমাকে গ্রহণ করেছে, ওদের সাথে থাকতে পারি আমি। আমাকে পছন্দ করেছে। আমি ভুলতে পারি না—ওরা আমাকে পছন্দ করেছে। সাইমন আমাকে কামড়ায় নি আর ডেভিড লাথি দেয় নি। ওরা কেবল ওদের নিজেদের মতোই ওখানে ছিল। আর আমার মোটা পাছা রেখে ওখানে বসি আমি, আর দূরে মাঠের উপর দিয়ে ঐ প্রেইরির দিকে তাকাই ওদের সাথে। এভাবেই কাটে আমাদের কোনো কোনো দিন। একবার এক বিকেলে একটি মেঠো ইঁদুর তার গর্ত থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকে তাকায়। সাইমন ভেউ ভেউ করে না, ডেভিড ওকে লাথি মারে না আর আমিও ওকে গুলি করি না। এভাবেই ছিলাম আমরা চার প্রাণী। আমি শুধু ভাবছিলাম আমি ভুলে গেছি আমিও সুখ পেতে পারি কখনো কখনো। ওই প্রাণীদের মধ্যে থেকে আবারো বোধগম্য হলো আমার সুখি হ‌ওয়া সম্ভব। আর এটাই হচ্ছে ওই ব‌ইয়ের মর্মকথা, পুনঃ আবিষ্কার। নিজেকে ঘৃণা করিনি একটুও। বরং অনেক ভালোবাসি। সাইমন হারিয়ে গেছে। রবার্ট তার সুন্দর, আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলেছেন, ডেভিড কে দিয়ে দিয়েছেন জীর্ণ-ঘোড়ার আস্তাবলে। যদি জানতাম, কীভাবে বলবো আপনাকে। আমার ছেলে মার্শ, সুরকার, প্রাণীদের সে খুব ভালোবাসে।

সাক্ষাৎকারী : আপনি ব্লায়ের সাথে অনুবাদের কাজ করেছেন—আপনি কী মনে করেন—আপনার মৌলিক কবিতায় এর কী রকম প্রভাব পড়েছে?

জেমস রাইট : শুরুতে যা লিখতে চেয়েছি, এটা আমাকে সেই সম্ভাবনার দিকে নিয়ে গেছে। আর, নিজেকে জঘন্য ভেবে, মনে হয়েছে হয় লিখবো নয়তো মরে যাবো। পৃথিবীতে যারা বেঁচে আছে এ মুহূর্তে তাদের বেশির ভাগ মানুষই অসুখি। আমি চাই না মানুষ অসুখি হোক, দুঃখ বোধ হয় এজন্য। ইচ্ছে করে কিছু করি। আর শেষে এসে বুঝতে পারছি মানুষকে সাহায্য করার আমার তেমন কিছু নেই। শুরু থেকে এটাই লিখতে চেয়েছি আমি। আমার ব‌ইগুলোর বিষয়বস্তু এটাই।

সাক্ষাৎকারী : আপনার দ্য ব্রাঞ্চ উইল নট ব্রেক এর কবিতাগুলো পরাবাস্তব—এ কথা শুনে কী বলবেন আপনি?

জেমস রাইট : ওগুলো পরাবাস্তব নয়। ওগুলো হোরাইসিয়ান এবং ধ্রুপদী। যদি আপনাদের কাছে পরাবাস্তব মনে হয়, তবে বুঝতে হবে আমার সকল প্রচেষ্টা বিফলে গেছে। ওগুলো মোটেই পরাবাস্তব কবিতা না আর আমিও পরাবাস্তব কবি ন‌ই। পরাবাস্তবতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রথাগত বা গাঠনিক নয়, এটা হাস্যকর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত, ইউরোপে আদর্শ ছিল সন্মান, সততা, মা, আপেল পাই আর পতাকা। তারপর যে ছেলেটা যুদ্ধে গেল, দেখলো যে এগুলো আসলে মিথ্যে। আসলে যা হচ্ছিলো একজনকে আরেক জনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে একে অপরকে হত্যা করানো। ফরাসি পরাবাস্তববাদীরা কৌতুক নিয়ে এসেছিল এতে, আর কেবলমাত্র আমেরিকার পরাবাস্তববাদীরা যারা এটা ভালো বুঝতে পারলেন তারা—না, আমাদের মধ্যে দুটি ভাগ আছে। একদল হচ্ছে এক্সাইল রিটার্নের লেখক ম্যালকম কাউলে। না, আমাদের তিনটি দল—ই ই কামিংস-ও এটা ভালো বুঝেছিলেন। আপনি হয়তো জানেন, তিনি একবার হিসু করতে ধরেছিলেন প্যারিসের এক বনে। হঠাৎ, পুলিশ এসে তাকে পাকড়াও করলো। তিনি লক্ষ্য করলেন বেশ কিছু ফরাসি লোক এসে হাজির। যুদ্ধ শেষ হবার পরপরই এই ঘটনা। তারা চিৎকার করে পুলিশকে বলতে লাগলো, “রিপ্রিভ লে পিসার আমেরিকান!” মানে আমেরিকান হিসুকারীকে ছেড়ে দাও।

আরেকটি ঘটনার কথা বলি, কাউলে যেটা লিখেছিলেন তাঁর ব‌ইয়ে, একটি ক্যাফেতে তখন বসে ছিলেন তিনি, ওয়েটার এসে তাকে ধাক্কা দিলো। তিনিও ধাক্কা দিলেন ওয়েটারকে। ভাবলেন এখানেই শেষ। কিন্তু কি জানেন, মিনিট খানেকের মধ্যেই লে জেন্ডারমেরী এসে হাজির হবেন ওখানে। আর তাই তিনি হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন। তারপর হঠাৎ করেই খেয়াল করেন ক্যাফের মানুষগুলো তাঁকে কাঁধে তুলে গান গাইতে গাইতে রাস্তায় নেমে এলো। এছাড়া আরো একজন আমেরিকান কবি ফরাসি পরাবাস্তববাদের সারকথা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি হলেন—কোথাকার আর—ওহিও’র সুন্দর কবি ক্যানেথ প্যাচেন।

সাক্ষাৎকারী : আপনার লেখা আমার প্রিয় ব‌ই ‘শেল উই গেদার এট দা রিভার’। কারণ এর মধ্যে আমি সততা আর দারুণ সঙ্গতি পেয়েছি। অন্যভাবে বলতে গেলে, এগুলো কেবল আলাদা বর্ণনামূলক কবিতা নয়, আবার আলাদা কিছু লিরিকের কোনো সংগ্রহ‌ও নয় এটা। এ ব্যাপারে ওই ব‌ইটা নিয়ে আপনার মতামত জানান চাই?

জেমস রাইট : ওইরকম হয়ে ওঠার জন্য খুব সতর্কভাবে লিখেছি ওটা। হয়েছে কি হয়নি সে আলাদা কথা। অন্ততঃ আমার বিচার্য বিষয় নয়। ঠিক নরকের মতো, জানি আমি ওই ব‌ই জঘন্য রকম ভালো আর যথার্থ ভাবেই গঠিত হয়েছে। আমি ভালো করেই জানতাম কী লিখতে যাচ্ছি, একেবারে প্রথম অক্ষর থেকে শেষ অক্ষরটি পর্যন্ত।

সাক্ষাৎকারী : সেটা কী? আপনি আসলে কী করছিলেন?

জেমস রাইট : আমি চেষ্টা করেছি মৃত অবস্থা থেকে উত্তরণের দিকে যেতে, পুনরুজ্জীবনের দিকে এবং তারপর আবার মৃত্যুর দিকে। আর শেষে মৃত্যুকে মোকাবেলা করতে চেয়েছি। হ্যাঁ, যদি আপনাকে বলি আমি এক মেয়ের কথা লিখেছি যাকে খুব ভালোবাসাতাম, বহু আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। আমি তার সাথে গান গাইতে চেয়েছি ওই ব‌ইয়ে। তাকে পুনঃসৃষ্টি করতে নয়; আপনি কাউকে পুনঃসৃষ্টি করতে পারবেন না, অন্তত আমি পারি না। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম হয়তো আমার ভেতরে ওর জন্য যে অনুভূতি এদ্দিন জমাট বেঁধে আছে তাকে তো বাইরে আনতে পারবো। ব‌ইটি অসাধারণ কারণ খুব নিপুণভাবেই স্বপ্ন দেখেছি ওটা নিয়ে।

সাক্ষাৎকারী :মনের মধ্যে আগেই ধারণা গেঁথে রেখে পরবর্তী সময়ে আপনি আপনার ব‌ইগুলো গড়ে তোলেন?

জেমস রাইট : প্রতিবার। আমি কি রবার্ট ফ্রস্টের মন্তব্যের কথা বলেছি আপনাকে—ভীষণরকম হোরাইসিয়ান মন্তব্য ওগুলো—যেমন যদি আপনার ব‌ইটি চব্বিশটি কবিতা সম্বলিত হয়, তবে ব‌ই নিজেকে নিয়ে কবিতা হয় মোট পঁচিশটি। আর আমি সবসময় এরকমই করতে চেয়েছি।

সাক্ষাৎকারী : ঠিক আছে, আরও কিছু উদাহরণ নিয়ে কথা বলি আসুন। দ্য গ্রিন ওয়াল-এর মূল উদ্দেশ্য কী ছিল আপনার? কোন ধরনের কাঠামোগত মৌলিক কাজ করেছিলেন ওতে?

জেমস রাইট : মানুষের স্খলন নিয়ে লিখতে চেয়েছি ওতে। বুঝতে চেয়েছি স্খলন ব্যাপারটা কাজের। মানুষের জন্য ভালো। প্রদোষ। আনন্দময় অপরাধ। আর তাই আমার কবিতার পথ বাঁকিয়ে দিয়েছি প্রকৃতির দিকে। মানুষ ছিল সচেতন তাই প্রকৃতির বেদনার ভেতর কষ্টে ছিল। এই হচ্ছে মূল কথা। আমার মনে হয় না এ ব‌ইটা কাঠামোগত ভাবে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু ওটাই ছিল ঐ ব‌ইয়ের আইডিয়া। জানেন হয়তো, প্রায় চল্লিশটি কবিতা বাদ দিয়েছি ঐ ব‌ই থেকে।

সাক্ষাৎকারী : তাই নাকি?

জেমস রাইট : কবি অডেন এই ব‌ইটি নিয়ে একটি চিঠি লেখেন আমাকে। লিখেছিলেন, “আমার মনে হয় কিছু কবিতা বাদ দেয়া উচিৎ আপনার। তবে কোন কোন কবিতা সেটা আপনার উপর নির্ভর করছে”। বাদ দিতে দিতে শেষে চল্লিশটি হয়ে গেছে। একটু ঘুরিয়ে বলতে গেলে আমি লিখি অবারিত। এরপর চেষ্টা করি অলঙ্কার খসিয়ে ফেলতে, কমিয়ে ফেলতে—ব‌ইটির সংস্কার করা যাকে বলে, যেমন কোনো গাছের ডালপালা ছাঁটাই করা হয় আরো ভালো করে বেড়ে ওঠার জন্য, সেই রকম। ব‌ই করতে আমার আইডিয়া এইরকম‌ই।

সাক্ষাৎকারী : স্বতন্ত্র কোনো কবিতার ক্ষেত্রেও তাই করেন আপনি—পুনর্লিখন আর কাটছাঁট?

জেমস রাইট : হ্যাঁ, প্রায়শই এই কাজ করি। এমনকি মাঝে মাঝে তো গোলমাল লেগে যায় কোন ভার্সনটি ছাপা শেষ পর্যন্ত এই ভেবে। কোনো কবিতা আমার মনের মত যতক্ষণ না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত ছাড়ি না। কাটছাঁট ও পুনর্লিখন চলতে থাকে। এ কারণে মাঝে মাঝে অদ্ভুত সমস্যায় পড়তে হয়। ওভাররাইট করা একটা সমস্যা। আপনাকে জানতে হবে কোথায় থামতে হয়। বাখ হচ্ছেন সবচেয়ে ভালো মানুষ-সুরকার। কিন্তু আমার মতে মোজার্ট এক দেবদূত। তাঁর একটি বিষয় সবচেয়ে বিস্ময়কর, তিনি জানেন কখন থামতে হয়। জানেন কখন শেষ করতে হয়। এভাবেই তিনি আপনাকে আপনার একেবারে আপনার নিজের গানটিই উপহার দেন। আমার মতে তিনি সর্বকালের সেরা… তিনিই বসন্ত কাল। একজন দেবদূত। যিনি নেমে এসেছেন পৃথিবীতে। তিনি জানেন কখন থামতে হবে—এ জন্য‌ই তিনি দেবদূত তুল্য। এটা জেনে, এই যে বসে আছেন আপনি ওখানে, আপনার নিজের গানটিই জেগে উঠছে আপনার ভেতর সংগীতের ভেতর। তিনি আপনাকে আপনার নিজস্ব গান উপহার দিতে পারেন। ভেবে দেখুন। কী বিস্ময়কর, আক্ষরিক অর্থেই কী বিস্ময়কর ব্যাপার।

সাক্ষাৎকারী : আপনি বলেছিলেন একজন ভালো শিল্পকার হ‌ওয়ায় কবি হিসেবে এটা আপনার জন্য সমস্যা। কিন্তু কীভাবে, একটু খুলে বলবেন?

জেমস রাইট : কবিতায় আমার প্রধান সমস্যা অনর্গলতা। পারিবারিক ভাবে আমি কিছুটা আইরিশ। এর মানে অনেক কিছুই বোঝায়। কিন্তু বাচনিক প্রকাশ এর ক্ষেত্রে এর মানে হলো কথা বলা বা বক্তৃতা বিষয়টা আমার জন্য একেবারে মামুলি। আমি সর্বদা হোরাইসের আইডিয়া নিয়ে ভেবেছি যেমন বাইরন তাঁর এক চিঠিতে মুরে-কে লিখেছিলেন, “সহজ লেখাই হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন পাঠ”। অনর্গলতায় ভুগেছি আমি। খুব সাবলীলভাবে লিখতে আর বলতে পারি। আমার গুরু স্ট্যানলি ক্যুনিৎস। তিনিও একই সমস্যায় ভোগেন। আমার ব‌ইয়ের মতো তাঁর ব‌ই‌ও খুব ছোট। কাটছাঁট করে ছোট করে তোলার চেষ্টায় তিনি অনেক কষ্টের পর কষ্ট করে গেছেন। এই কষ্টের বিষয়টা, কোনো সন্দেহ নেই, এমন কিছু কবি আছেন যারা প্রকৃতিগতভাবেই পেয়ে যান। কবিতা আর যাই হোক, এক ধরনের সংগ্রাম, আর এর চিরশত্রু হলো অনর্গলতা। এইজন্যই আমার কবিতা গুলো ছেঁটে ছোট করতে হয়েছে।

সাক্ষাৎকারী : যখন কবিতা লিখতে বসেন, তখন কী ঘটে? আপনি কি কোনো আইডিয়া নিয়ে শুরু করেন, নাকি কোনো বিষয় অথবা বিশেষ কোনো ছন্দ নিয়ে?

জেমস রাইট : নিজের ক্ষেত্রে আমি সাধারণত শুরু করি ছন্দ থেকে, আইডিয়া থেকে নয়। জানা থাকে না কী লিখতে যাচ্ছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লিখে শেষ করার পরও বুঝতে পারি না কী বলতে চেয়েছি। আমি বলছি না যে আমি একজন হতাশ সংগীত শিল্পী, তবে সংগীত ভালোবাসি আর এজন্যই বোধহয় আমার কবিতার শুরুটা ওইভাবে হয়। সংগীত আমাকে বড়ো এক চেতনায় উজ্জীবিত করে, প্রচুর কবিতার সম্ভাবনা জাগায় আমার মধ্যে।

সাক্ষাৎকারী : সত্যিই করতে পারেন এটা? সংগীতিয় গুণ সৃষ্টি করে কবিতার শব্দের ভেতর তাকে বাজিয়ে তোলা কি সম্ভব?

জেমস রাইট : এলিজাবেথীয়রা অবশ্যই দারুণ ভাবে করে দেখিয়েছেন। তাদের মাথায় যখন পংক্তি ঘোরে তখন তারা এক‌ই সাথে কথা বলা আর গান গাওয়ার এই পদ্ধতি আয়ত্ত করে নেন। তবে তাদের উপর একে সম্পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে দেন না। প্রায় দশ হাজার উদাহরণ আছে—সেক্সপিয়র তাঁর নাটকে গানের অভিনিবেশ ঘটিয়েছিলেন। বেন জনসন দারুণ সব গান লিখেছেন। স্যার জন ডাওল্যান্ড, পৃথিবীর বিখ্যাত এক সংগীত শিল্পী তাঁর সময়ে সবার উপরে ছিল তাঁর অবস্থান। স্যার জন হ্যারিংটন, স্যার জন ডেভিস আর তাঁর “নোসে তেসাম”, জর্জ পীলি। এঁরা সবাই তো ওইরকম ছিলেন।

ওয়াল্ট হুইটম্যান‌ও এটা আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন। যদিও তিনি বুঝতে পারেন নি, কিন্তু পারতেন। তাঁর কবিতা থেকে একটিমাত্র উদাহরণ দিচ্ছি আপনাকে, “শুনেছি তোমার ওই দারুণ মিষ্টি গলা”। এই লাইনটা পড়ার পর আপনাকে পরবর্তী লাইনটি পড়ে পড়ে শুনতে একদমই বেগ পেতে হবে না: “ওঃ শরতের বাতাস, বনের ভেতরে অন্ধকারে হেঁটে যাই আর শুনতে পাই সব ছাপিয়ে তোমার শোক-বিহ্বল দীর্ঘশ্বাস”।

সাক্ষাৎকারী : আমরা ব‌ইয়ের ভেতর কবিতাগুলোর অন্তঃসম্পর্ক নিয়ে কথা বলছিলাম। আপনার কি মনে আছে, যখন আপনার কবিতা সংগ্রহের জন্য কবিতা খোঁজা হচ্ছিলো তখন, এক ধরনের সামঞ্জস্যপূর্ণতা? আপনার আগের সব ব‌ই ঘেঁটে একজন সমালোচক একবার সেই রকম এক খোঁজ পেয়ে ওই অংশের নাম দিলেন “নতুন কবিতা”।

জেমস রাইট : আমার নতুন ব‌ই দেখার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। কবিতা সংগ্রহ প্রকাশ করেছিলাম কারণ আমি নতুন ব‌ই লিখছি তখন। কিন্তু পুরনো ব‌ইগুলো বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঘার থেকে নামানোর ওটাই উৎকৃষ্ট উপায় মনে হয়েছিল। কোনো কিছু একেবারে শেষ করার পর‌ই এর থেকে মুক্ত হ‌ই আমি। আর অন্য একটি কারণেও ওটা প্রকাশ করেছিলাম, মনে হচ্ছিল আমেরিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে আমার।

সাক্ষাৎকারী : নতুন ব‌ইটির নাম ‘টু সিটিজেন’। এই নামের মাহাত্ম্য কী?

জেমস রাইট : আমার স্ত্রী, এ্যানি, আমার কাছে অনেক গুরুত্ব বহন করে, কারণ সে আমাকে ইউরোপের সাথে পরিচয় করায়, যা আমরা দু’জনই খুব পছন্দ করি। এমনকি আমরা এও জানি আমরা আমেরিকা ভালোবাসি। আমরা জানি এ মুহূর্তে আমেরিকার মানুষরা ভালো মানুষ কিন্তু আত্মহারা আর খুব মনোকষ্টে ভুগছে। এই দেশে দারুণ সব জীবনীশক্তি রয়েছে। অনেক ভালো মানুষ, ভালো, বিনয়ী, বুদ্ধিমান মানুষ রয়েছেন এখানে। তাহলে সমস্যা কোথায়? মেকেন থেকে উদ্ধৃতি দিই?“এই দেশে বহু মানুষ রয়েছন, এদের কেউ কেউ সুপুরুষ, এদের অনেকেই জ্ঞানী, আর ক্যালভিন কোলীজ এই ইউনাইটেড স্টেটস-এর প্রেসিডেন্ট। তবু যদি কোনো মানুষ, কোনো সমৃদ্ধ ভোজে বসেন, একটু ঘুরে বসেন তিনি, আর মাছি খেয়েও ভাব দেখান রাজকীয়”।

তাই এ্যানি আমাকে ফ্রান্স আর ইতালির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সে রোমের একটি ওভারসিজ স্কুলে আর প্যারিসের আমেরিকার স্কুলে পড়াশোনা করেছে। আমি নিজে তো ভিয়েনীয়। তাই জার্মান ভাষায় পারদর্শী। এ্যানি কিছু কিছু ফরাসি আর ইতালির ভাষায় বলতে পারে। তবে, আমরা কিন্তু ইউরোপের নাগরিক‌ও।

‘টু সিটিজেন’এর শুরু আমেরিকার প্রতি শাপ থেকে। কিছু দ্রোহের কবিতা ওহিও নিয়ে, যেখানে আমার বাড়ি, ও ব‌ইয়ে কিছু কবিতা আছে এ্যানির সাথে পরিচয় না হলে হয়তো লিখা হতো না। সে-ই আমাকে সামর্থ্য পেতে উজ্জীবিত করেছে যেন যেসব বিষয়ে এক‌ই সাথে প্রেম ও ঘৃণা অনুভব করি তা নিয়ে লিখতে। এই ব‌ইয়ের মাঝ বরাবর, অভিশাপ আর বেদনার চুড়ান্ত প্রকাশের মাঝামাঝি, সম্পূর্ণ দীর্ঘ একটি পর্ব আছে প্রেমের কবিতার। এতো ঘৃণা ভর্তি লিখা এমন ব‌ই এর আগে লিখিনি আমি। কে কী ভাবলো কিচ্ছু আসে যায় না, আমার কাছে ওটাই চুড়ান্ত। ওঃ ঈশ্বর! আর যদি এমন ব‌ই লিখি!

যদিও ব‌ইটি তেমন পছন্দ নয় আমার, কিন্তু পছন্দ করি ওর ভেতরে লিখা কথাগুলো। কারণ ওগুলো সরাসরি বেরিয়ে এসেছে আমার নতুন জীবনের থেকে। এ্য‌ানির সাথে আমার ওই জীবন। ইউরোপ ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছিলাম আমরা। কিন্তু তখন বসন্ত শেষ হয়ে আসছে আর আমিও ব্যস্ত ছিলাম আমার কবিতা সংগ্রহ নিয়ে। নিঃস্ব মনে হচ্ছিল। তখন এ্যানি আমাকে উজ্জীবিত করে। সে-ই সমস্ত টাইপের কাজগুলো করে দেয়। আমরা ব‌ইটা শেষ করি। চুক্তি সই শেষ, পান্ডুলিপি পাঠানো হয়ে গেছে, এভাবে সব শেষ করে আমরা গেলাম ইউরোপ। এবং জীবনে দ্বিতীয় বারের মতো মনে হলো শেষ, কবিতায় আমার কাজ এবার চিরতরে শেষ হয়েছে। সবসময় ভাবি কবিতায় আমার কাজ শেষ। বেশকিছু দিন প্যারিসে ছিলাম। সকালে দু’জনে হাঁটতে বেরুতাম, তারপর বাজারে যেতাম, এরপর প্রধান গীর্জায় গিয়ে দেখতাম শহরে কী চলছে। আমাদের পনির, পিঠা, ওয়াইন এর পর লাঞ্চ সারতাম। তারপর বিছানায় বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বেড়াতে গিয়ে কিছু এপারেটিফ পান করতাম। আর আমার উচ্চারিত, সেই অলৌকিক আশ্চর্য, আমি আবারও লিখতে শুরু করি কবিতা। ওগুলো হয়ে উঠলো প্রেমের কবিতা। কৃতজ্ঞতা বোধের প্রেমের কবিতা। পুরো গ্রীষ্ম জুড়ে এইরকম চললো। প্যারিস থেকে দক্ষিণ ফ্রান্স, আর তারপর ইতালি পর্যন্ত চললো।

আগে হয়তো বলেছি আপনাকে, ‘সেইন্ট জুদাস’ ব‌ইটি খুব পছন্দ করি কারণ ওখানে আমার স্বকীয় অন্তঃস্থ বেদনা ফিরে ফিরে আসে। কিন্তু নতুন ব‌ই—সেইন্ট জুদাসের যেন পুনরুজ্জীবন। এমনকি, হয়তোবা আমার উচিৎ ছিল ডন হল যে নাম সুপারিশ করেছিলেন সেটাই রাখা। চমৎকার লোক তিনি। সুন্দর নাম রাখতে পছন্দ করেন। একটা নাম বলেছিলেন ‘সন অব সেইন্ট জুদাস’। আরেকটি ছিল ‘সেইন্ট জুদাস মিট্স দ্য উল্ফম্যান’। দারুণ মানুষ। ভীষণ ভালো একজন কবি, নির্দিষ্ট করে বললে কবিতার বুদ্ধিমান সমালোচক। যা আমাদের খুব কম খুবই অল্প আছে। এই একটি জিনিসের অভাব রয়েছে আমাদের, প্রকৃত কবিতা প্রকৃত সমালোচনার মাধ্যমেই বেরিয়ে আসে।

সাক্ষাৎকারী : আপনার কবিতা “আর্স পোয়েটিকা: সাম রিসেন্ট ক্রিটিসিজম” কি সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ক?

জেমস রাইট :না, এটা আমার চাচি এ্য‌গনেস কে নিয়ে। তাঁর জীবন খুব কষ্টের ছিল। বহু বছর ধরে ধীরে ধীরে মরেছেন তিনি। আমার খুব রাগ হয়েছিল জানেন, বাস্তব জীবনের সাথে সাহিত্যের সমালোচনার পার্থক্য দেখে এই দেশে। তাই ভেবেছিলাম এমন একটি কবিতা লিখবো। আমার একান্ত আর্স পোয়েটিকা। যেখানে এই দেশের বাস্তবতাটুকুই কবিতায় উঠে আসবে।

সাক্ষাৎকারী : আদর্শ সমালোচনা বলতে কী বোঝেন আপনি?

জেমস রাইট : তরুণ কবিদের শেখাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কল্পনা আর শিল্প নৈপুণ্যের মধ্যে সম্পর্ক। কেননা শিল্প নৈপুণ্য ছাড়া, মানে হচ্ছে বুদ্ধির কার্যকর নিয়োগ, কল্পনা, ওই রহস্যময় অদ্ভুত ব্যাপার, এমনি এমনি আসে না। আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। স্বশিক্ষা। আর আপনাদের, আজকের তরুণ কবিদের সৌভাগ্য আপনারা চোখের সামনে পেয়ে গেছেন মারভীন, ডিকে, ব্লায়, কীনেল, স্ট্যাফোর্ড আর মেরী ওলিভার তাঁদের আপন শুদ্ধতায়, আমি বলতে চাচ্ছি, আপনার সামনে আমেরিকায় সম্ভাবনা রয়েছে অপার, আমরা যা শিখিয়েছি এর চেয়ে বেশি চমৎকার সম্ভাবনা রয়েছে।

সাক্ষাৎকারী : এতোক্ষণ আপনার সাথে কথোপকথনে আপনি অনেকের নাম উল্লেখ করেছেন কিন্তু কয়েকজনের কথা বলেন নি—তারা হলেন এড‌ওয়ার্ড থমাস, রুপার্ট ব্রুক, এবং আরো কয়েকজন। অবশ্য আপনি এন্ডা ভিনসেন্ট মিলায়-কে নিবেদন করে একটি কবিতা লিখেছেন। এদের মতো ভালো কবিদের কেন আমরা ভুলে যাচ্ছি?

জেমস রাইট : এর কোনো উত্তর নেই আমার কাছে। আপনি কীভাবে নির্ণয় করবেন কয়েক শতাব্দীর মধ্যে জন ডান-কে মানুষ কেন ভুলে গেছে? এ মুহূর্তে হঠাৎ করেই সব কিছু স্মরণ করতে পারি না আমরা। যন্ত্রণা আর মৃত্যুর মুখোমুখি আমরা খুব কম মানুষকেই পাই যারা জীবনের গভীরতা আর সত্যিকারের জীয়ন সৌন্দর্য কে বুঝতে পারেন। ভালোবাসা ছাড়া আর কীইবা আছে আমাদের? ভালোবাসাটুকু নিজের করে পেয়েছি কারণ এছাড়া আর আছে কেবল যন্ত্রণা আর মরণ। এর মানে হলো ভালোবাসাই ঈশ্বর। পুরো ব্যাপারটার সার কথা এটাই। এখন আমরা তো প্রায় শেষ পর্যায়ে; শুনুন, দুটি গল্প বলি। প্রথমটি পশ্চিম পোল্যান্ডের হাসিদিম-এর গল্প।

এক গোঁড়া ইহুদি দর্জি ছিলেন। তিনি জানতেন প্রায়শ্চিত্তের দিন তাকে উপস্থিত হতে হবে সিনাগগে। কিন্তু তিনি যান নি। পরদিন তিনি তার রাব্বির সাথে দেখা করেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কেন আসোনি, বলো?”

দর্জি বললেন, “প্রভু, ভেবেছিলাম, গতকাল দোকানে ফিরে গিয়ে সরাসরি কথা বলবো ঈশ্বরের সাথে”।

“বুঝলাম,” রাব্বি বললেন, “তা কী বললে তুমি তাঁকে?”

“হ্যাঁ, আমি বললাম, ‘ঈশ্বর, আপনি তো সব‌ই জানেন, আমার সমস্ত কৃত পাপ আপনার জানা। আপনার সুবিধার জন্য স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি আবার। ছোটবেলায় একবার এক বাচ্চার গালে থাপ্পড় কষিয়েছিলাম। আর দর্জি হয়ে একবার এক লোকের প্যান্ট তৈরির পর অতিরিক্ত কাপড় আর তাকে ফেরত দিই নি। এবং হয়তো আরো কিছু অপরাধ করেছি আমি। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। কিন্তু ঈশ্বর আপনি তো জানেন সব, সব‌ই মনে আছে আপনার। যদ্দূর জানি, এটুকুই আমার পাপের পরিধি”।

“বলে যাও”, বললেন রাব্বি।

“এরপর আমি ঈশ্বর কে বললাম, ‘ঈশ্বর, আপনি তো চোখ বিহীন বাচ্চা জন্মের‌ও অনুমোদন দিয়েছেন। আপনার সৃষ্টি, মানব জাতিকে একে অপরকে হত্যা করতে দিচ্ছেন। আপনি সর্বোময় ক্ষমতার অধিকারী। সব-ই জানেন”।

আবারো রাব্বি বললেন, “বলে যাও”।

দর্জি বললেন, “আমি তাঁকে বললাম, ‘ঈশ্বর, আসুন আমাদের পাপ তুলনা করে দেখি। যদি আপনি আমারটা মাফ করেন তো আমিও মাফ করে দেবো আপনারটা”।

রাব্বি এবার তাকে থামালেন আর ধমক দিয়ে বললেন, “ওহে নির্বোধ! এতো সহজে ছেড়ে দিলি? গতকাল প্রায়শ্চিত্তের দিন ছিল। মসীহকে পাঠাতে জোড় করতে পারতি বোকা!”

সাক্ষাৎকারী : দারুণ গল্প।

জেমস রাইট : হ্যাঁ, আমাদের বাস্তব জীবনের গল্প অসাধারণ হয়। রাব্বি হেসেল মারা গেছেন। হায়! মিনোপোলিসে থাকার সময় একবার কিছু মুসলমান বন্ধু হয় আমার। তারা আমাকে রোজার সময় ইফতারের দাওয়াত দিয়েছিলেন। রমজান হচ্ছে আধ্যাত্মিক সাধনার মাস। এই মাসে মুসলমানরা নিজেদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে পৃথিবীতে অসংখ্য গরীব মানুষ আছে খেতে পায় না। আর তাদেরকে স্মরণ করে ওঁরা সন্ধ্যা পর্যন্ত না-খেয়ে থাকেন। খাবার বা পানীয় কিছু খান না। তবে তাদের মাঝেও গোঁড়ামি রয়েছে। তাদের আত্ম-প্রতিষ্ঠা।

আঠারো শতকে, মনসুর আল-হালাজ নামের এক লোক বাগদাদে গেলেন। তিনি ছিলেন সুফি। সুফি মুসলিমদের একটি সম্প্রদায়। এরা যীশুর কথা জানেন। বিশ্বাস করেন। এরকম অনেক আছেন। কিন্তু আমার আল-হালাজ কে বেশি ভালো লাগে। তিনি কী করেছিলেন শুনুন। তিনি সরাসরি বাগদাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধরের কাছে চলে গেলেন। বললেন, “যীশু যেভাবে বেঁচেছিলেন আমিও সেভাবে থাকবো এখানে। আমি জানি তার কী হয়েছিল শেষে”—আঠারো শতক, মনে আছে তো— “আমি জানি তার কপালে কী ঘটেছিল, আর আমি জানি যদি ওনার মতো থাকতে চাই, তোমরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠবে। তারপর কী করবে সে-ও জানি। তবু তোমাদের বলতে চাই তোমাদেরকে ঘৃণা করি না”।

এরপর তারা ওনাকে সন্দেহ করে বললো, “নতুন পাগলের আমদানি”।

তিনি বাইরে এলেন, মানুষের সাথে কথা বললেন, “চলো আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি”।

শেষ পর্যন্ত তাকে পাকড়াও করে ক্রুশবিদ্ধ করা হলো। তাঁর ডান হাত আর বাঁ পা কেটে উল্টো করে ক্রুশবিদ্ধ করা হলো। তখনো বেঁচেছিলেন। উজির—আহ্, হেনরি কিসিঞ্জার— বেরিয়ে এলেন আর বললেন, “গতরাতেও কি মহাবিশ্বে উড়ে এখানে অবতীর্ণ হয়েছো তুমি?”

আর তিনি মরতে মরতে বললেন, “না, আমি তো কেবল এখানে ঝুলে ছিলাম, একা, একান্ত তারাদের সাথে”।

আরো আছে। এবারে একটি কৌতুক বলি। মুসলমানদের কৌতুক। আপনার ভালো লাগবে। আমার সেরা বন্ধুদের মধ্যে একজন হলেন গাজি গালানি। তাঁর বাড়ি ইরাকের বাগদাদে। সেন্ট পলে ওঁর সাথে সবসময় দেখা হয় আমার। ওখানে একটা পিয়ানো বার ছিল। নাম ‘দ্য হাউজ অফ মিং’। আর আমি হয়তো একটা ফোনকল পাবো, “হ্যালো, জিম?”

“গাজি! কোথায় তুমি?”

“আমি হাউজ অফ মিং-এ। নেমে আসো, মদ খাই চলো।”

এরপর আমি নেমে আসি। সেখানে হয়তো সেই নব্বই বছরের মহিলা গান গাইছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গান। গাজি সেখানে বসে আছেন। তাকে ডেনি থমাসের মতো দেখাচ্ছে। বললাম, “কেমন আছো, গাজি?” ইংরেজি ভাষায় যদি কাউকে জিজ্ঞেস করো কেমন আছেন, যদি সে আলস্য বোধ করে, বলবে, “অলস লাগছে।”

কিন্তু গাজি প্রার্থনার ভঙ্গিতে আরবিতে বলবে, “আমার পরিবার যদি কাফনের ব্যবসা ধরে, মানুষ মরে যাওয়া ছেড়ে দেবে।”

যদি আমার ছেলেবেলার স্বপ্ন সত্যি হয় তবে, এই দেশ আর মরবে না।

 

ঋতো আহমেদ: কবি, গদ্যকার এবং অনুবাদক। প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থ ভাঙনের মুখ”, “উন্নয়নের গণতন্ত্র”, “জলের পাতালহে অনন্ত অগ্নিঅনুবাদ কাব্যগ্রন্থ ওয়াকিং টু মার্থাস ভিনিয়ার্ড/ফ্রাঞ্জ রাইট” ও “আদিরসাত্মক সংস্কৃত কবিতা