You are currently viewing মহাকালের খাঁড়াঃ এক বিধ্বস্ত রাজনৈতিক বাস্তবতা/ মোস্তফা অভি

মহাকালের খাঁড়াঃ এক বিধ্বস্ত রাজনৈতিক বাস্তবতা/ মোস্তফা অভি

মহাকালের খাঁড়াঃ এক বিধ্বস্ত রাজনৈতিক বাস্তবতা

মোস্তফা অভি

শেকড় ছেঁড়ার যন্ত্রণা যে মানুষকে কতটা ব্যথিত করে, দেশভাগের পরবর্তী সময় প্রিয়ভূমের সম্পর্কছিন্ন মানুষগুলো তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। পশ্চিমবাংলার হুগলি জেলায় জন্মগ্রহণ করেন কায়েস আহমেদ। ১৯৫০ সালে পিতার সঙ্গে ঢাকায় এসে সেই যে থিঁতু হলেন, আর ফেরা হয়নি। ফেরা আর না ফেরার যন্ত্রণা তাকে এমনভাবে দগ্ধ করেছে, বেদনাগুলো কলমের ডগায় নেমেছে বেদনার অশ্রু হয়ে। কায়েস আহমেদের সেই বেদনার ওজনও কম নয়।

বলা যায় তিনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন সত্তরের দশকে। তবে আশির দশকেও তাঁর সাহিত্য মহলে বিচরণ লক্ষ করা যায়। চাকরি করতেন ঢাকার কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে। ছোটবেলা দস্যিপনাও কম ছিল না তাঁর। বাল্যবন্ধু ও স্কুল সহপাঠীদের লেখায় সেসব তথ্য পাওয়া যায়।

কায়েস আহমেদ প্রত্যক্ষ করেছেন সময়ের তীব্রস্রোত। তুমুল গতিতে ছুটে চলছিল ইংরেজদের ক্ষমতার পালাবদল। সেইসঙ্গে দেশভাগের মত মানুষের বিচ্ছেদ আর যন্ত্রণার দগ্ধ কাতরানি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, একাত্তর যেন একই সূত্রে গাঁথা। যেন বিরামহীন গতিতে চলা ট্রেনের মত একটার পর একটা ঘটনা আছড়ে পড়ছে বাংলার মানুষের ওপর। ছিল বন্যা, দুর্ভিক্ষ আর মানুষের হতাশার যন্ত্রণা। এইসব নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। আর সেসব কারণে হয়ত কলমও তুলে নিয়েছিলেন হাতে। গতানুগতিক ধারাকে পাশ কাটিয়ে ন্যারেটিভ প্রফুল্লতার বাইরে বাংলা গল্পে নিয়ে এলেন নতুন চমক। তবে তাঁর গল্পের ভাষা মোটেও ঝরঝরে নয়। সময়ের ঘটে যাওয়া বহুবর্ণিল ঘটনার মত তাঁর গদ্যেরও চলার গতি উঁচু-নিচু টিলার মতন। কিন্তু সেই গদ্যটা পাঠককে চুম্বকের মত টেনে নেয়। তিনি জীবনের বাস্তবতাকে সাহিত্যে প্রতিফলিত করেছেন দক্ষ জহুরীর মতন। চোখে দেখা জীবনাভিজ্ঞতা, রহস্যময় মানবজীবনের না বলা কথা তাঁর লেখার বিচিত্র সুর। তাঁর চরিত্রগুলো লুকোচুরি খেলার মত ধরা দিয়ে আবার যেন রহস্যময় হয়ে যায়। আবার একথাও সত্য যে, আমরা সেইসব চরিত্রকে চিনতে পারি। কারণ আমরা চরিত্রগুলোকে সমাজের চারপাশে দেখি। ব্যক্তিজীবনে কায়েস আহমেদ ছিলেন শান্ত, বিষন্ন এবং অন্তর্মুখী মানুষ। শৈশব থেকেই জনবিচ্ছিন্ন আর শরীরটাও ছিল পলকা। মানসিক স্থিরতা ছিলনা মোটেও। জীবনের প্রতিটি বাঁকে না পাওয়ার বেদনা আর জীবনের প্রতি চরম উদাসীনতা ইত্যাদি জেঁকে বসেছিল তাঁর  মনের ভেতর। সেইসব না বলা কথাগুলোই বলে গেছেন তাঁর জীবনঘনিষ্ট গদ্যে। তবুও জীবনের গূঢ় রহস্যের সন্ধানে লেখক যখন ভারাক্রান্ত তখন আত্মহুতি দিয়ে চিরতরে চলে গেলেন অনন্ত পথের সন্ধানে। কিন্তু জীবনের প্রতি কেন এত বীতশ্রদ্ধ ছিলেন তিনি! তাঁর বন্ধু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সেজন্য আক্ষেপ করে বলেছিলেন,-আত্মহত্যার মধ্যে কায়েস কী জানাতে চাইলেন? মানুষের জীবনের রহস্য খুঁজতে খুঁজতে নিজের জীবনভর অনুসন্ধানের চরম জবাবটি পাওয়ার জন্যই কী মরিবার হল তার সাধ? লেখকের সাধ আর সাধ থাকেনা। জীবন রহস্য রূপ নেয় সন্ধানে। অভিমানী লেখক জীবনের মায়া কোন গোপন ব্যথায় ত্যাগ করলেন কে জানে!

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দেশের বিরাজমান অবস্থা যে অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, সেসবের উজ্জ্বল আলোকরশ্মি পড়েছে তাঁর অন্ধ তীরন্দাজ গল্পগ্রন্থে। রাজনৈতিক পালাবদল, অবিশ্বাস, উৎপাদনহীন কৃষকের সংসার, বেকার সমস্যার বিরাট এক আবহ দেখা যায় তাঁর গল্পগুলিতে।

যদিও তাঁকে নিয়ে বহু বিজ্ঞজন বহু আলোচনা করেছেন ইতোপূর্বে। আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে তাঁর মত গুরুত্বপূর্ণ লেখকের লেখা নিয়ে কিছু বলা ধৃষ্টতা বলা যায়। তবুও একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দু’চার কথা বলার মত সাহস করছি বলা যায়। অন্তর্মুখী হলেও কায়েস আহমেদ ছিলেন রুচিশীল লেখক। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলির নাম দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় কেমন এক কবিভাবাপন্ন মানসিকতা ছিল তাঁর। অন্ধ তীরন্দাজ, লাশকাটা ঘর, নির্বাসিত একজন ইত্যাদি নামসমুহ সেসব ইংগিত বহন করে। এছাড়াও তাঁর গল্পগুলোর নামও আধুনিক, রুচিসম্পন্ন ও শ্রীমান। কোথায় যেন এক অপার্থিব গোপন সুর লেগে আছে। মহাকালের খাড়া, গোপাল কামারের তলোয়ার, প্রতীক্ষিত লণ্ঠন, নিয়াতম আলীর জাগরণ ইত্যাদি শিরোনামেই চমকের ঝিলিক ছুঁড়ে দেয়। তাঁর একটি গল্প নিয়ে দু’চারটা কথা বলার চেষ্টা করা যাক–

“মহাকালের খাঁড়া” গল্প দিয়েই কায়েস আহমেদের অসাধারণ গল্পের ভুবনে আমার সন্তর্পণ প্রবেশ। গল্পটির অচেনা এক দুরন্ত ভাষা, সংলাপে নিঁখুত আঞ্চলিকতার ব্যবহার- এ যেন এক বাস্তব জীবনের দুর্বিসহ ছবি। কবিতার মত গদ্যেরও একটা ছন্দ আছে, বাক্যের নিপুণ মাপ আছে আর পরিচ্ছদ শেষে থামারও আছে  শৈল্পিক কুশলতা-কায়েস আহমেদের গদ্যে সেসব স্পষ্ট প্রতীয়মান। মহাকালের খাড়া রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের গল্প। গল্পটি সমাজে হর হামেশা দেখা যায় এমন এক ধনপতির। সে অবৈধ উপায়ে রেলের ওয়াগন ভাঙা দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জীবনের ঝুঁকি নেয়। উদ্দেশ্য একমাত্র অর্থ উপার্জন। কিছু বছরের ব্যবধানে ভরত কোলে সাধারণ মানুষ থেকে গ্রাম্য ধনপতি হয়ে ওঠে। অর্থ যে মানুষের লজ্জাশরম কেড়ে নেয়, নেশায় বুঁদ করে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য করে দেয়, এই গল্পটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

গল্পের বয়ান মতে-” নিজের মদের কারবার, মদ বিক্রি করে হাজারও লোককে মাতাল করে, নিজে মাতাল হয়নি কোনোদিন। মেয়েমানুষের নেশাও নেই তার। নেশার কথাই যদি বল, তাহলে মানুষের বড় নেশাটাই আছে ভরতের। টাকা করা, সম্পত্তি করা। পরিশ্রম করে, ফন্দি ফিকির করে, কৌশল করে ভরত টাকা করেছে।”

টাকার নেশাই মানুষকে অনিবার্য ধ্বংসের অতল গহ্বরের দিকে ঠেলে দেয়। নির্লজ্জের মত দাঁত কেলিয়ে সে সভ্যতাকে পায়ে ঠেলে দিতে পারে। সমাজে পয়সার দাপটে মাথা উঁচিয়ে চলতে চলতে নিজেকে ঈশ্বরজ্ঞান করতেও অস্বীকার করে না।

“ওদিকে সমাজতন্ত্রীরা এসব ধনপতিদের খুঁজে নাজেহাল করে। মাঝেমধ্যে ভরতের কানে সেসব খবর আসে বৈকি। রাতে তার ঘুম আসে না।”

এই যে অর্থের মোহের মানসিক দ্বন্দ্ব, মানুষকে চির অশান্তির ভেতর ফেলে দেয়। দিকশূন্য মানুষের মত সে অস্তিত্বের সংকটে পড়ে। পাগলা ঘোড়ার মত পেছন থেকে অনিশ্চয়তা দাপিয়ে বেড়ায়। তবু মানুষ মোহে অন্ধ হয়ে অর্থের পেছনে ছোটে।

গল্পটির আগাগোড়া নিবিড়পাঠে উপলব্ধি হয়, ভরত কোলের নিষ্ঠুর পরিনতি নিয়তির হাতে ছেড়ে দেয়া কোনো পরিণতি নয়। যেন ভরতের প্রাপ্যই ছিল এটা। পরিণতির দিকে তাকালে পাঠকের নিশ্চিত মনে হবে- কোনো অভুক্ত শিকারীর পেটে ধীরে ধীরে শিকার বস্তুটি যেভাবে এগিয়ে যায়, ভরত কোলের নিষ্পাপ ছেলেটির করুণ মৃত্যুও যেন শিকারীর নিষ্ঠুর ভোজনের দৃশ্য।

ভরত কোলের একমাত্র ছেলে সুরেন। সমাজতন্ত্রীদের ভয়ে ভরতের যখন ঘুম আসেনা, সুরেন বাবাকে তিরস্কার করে। বাস্তবে সময়ের বিধ্বংসী হাওয়া সুরেন আন্দাজ করতে পারে না। অথচ, পাপে ডুবে স্নান করা ভরতের জীনব যদিও বেঁচে যায় কিন্তু তার পাপের সমস্ত ভার গিয়ে পড়ে পুত্র সুরেনের ওপর। শেষ পর্যন্ত পিতার পাপকার্যের বিচারে সুরেনকেই নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়।

লাল বেহারীর ভাই পরিমলের খণ্ডিত মস্তক যখন বস্তাবন্দি করে সমাজতন্ত্রীরা ভরতের বাড়ি পাঠায়, সুরেনের তখনও টনক নড়ে না। যেন সমাজতন্ত্রীরা শুধুমাত্র পরিমলকেই চেনে। ভরতের ভয়ার্ত চেহারা দেখে সুরেন এমন এক ভাব করে যেন ঊর্ধলোক থেকে জীবনকে বাঁধাই করে এনেছে সে। অথচ, কে জানত পিতার কর্মদোষে শেষ পর্যন্ত তাকেই বলি হতে হবে!

সুরেন গোপী দত্তের মেয়ে সবিতাকে ভালোবেসে ফিরিয়ে দিয়েছে। তবে সে যে অন্যায় করেছে সেটি উপলব্ধি করে অনুতপ্ত হয়। সবিতাকে আবার ফিরিয়ে আনার কথা ভাবে। হয়ত তার অন্তহীন মনলোকের অতল গহ্বরে জেগে ওঠে অনন্ত মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা। সুরেন সবিতাকে তার ইচ্ছের কথা জানাতে যায়।

গল্পের অন্তে দেখা যায়, ভরত কোলের অর্থলিপ্সা, নির্লজ্জতা আর ধনতান্ত্রিক মনোভাব যেন কালসাপ হয়ে ছুটে আসে পুত্র সুরেনের দিকে। যেন আকাশের দেবতা ভরত কোলের চোখের ইশারা ঝাপসা করে দেয়। সবিতাকে মনের কথা বলতে গেলে সমাজতন্ত্রীরা সুরেনের পেছনে লাগে। তারা সুরেনকে ধরাশায়ী করে অন্ধকারে বাজি ফোটায়। সুরেনের কুঁচকে থাকা শিশ্ন কেটে বাঁশের কঞ্চিতে গেঁথে ঝুলিয়ে রাখে। যখন মৃত্যু আসন্ন, সুরেন বউয়ের বাচ্চা হবার দোহাই দিলেও বন্ধু হরি বলে, তাহলে তো শালার যন্তরটাই আগে সাবড়াতে হয়।

ড্যাগারের ঘাই খেয়ে সুরেন মাটিতে তড়পায়।

“ঝন্টুর ডেগারেই তার পিষ্ঠদেশ বিদ্ধ করে প্রথম। সুরেন আ-আ-আ করে বিকট শব্দে মাটির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে। সুদীপ, অনাদি তাকে ঘিরে ধরে “খবরদার” চ্যাচাবিনা শালা।”

চটের ব্যাগের ভেতর থেকে সুদীপ পটকা বের করে ফাটায়। ছুরির ঘাইটা তেমন জমেনি পিঠে। সুরেন থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে কান্না ভাঙা গলায় বলে- আমায় মারিস নি, প্লিজ, তোদের পায়ে পড়ি। আমার বউয়ের বাচ্চা হবে।

লেখকের এখানে সন্দেহ কিংবা সংশয়ের বক্তব্য–তাকে না মারার যুক্তি হিসেবে সুরেন কেন যে তার বউয়ের বাচ্চা হওয়ার কথা নিয়ে এল কে জানে!

গল্পের বাস্তবতা অন্তর্জগত আর বহিঃজগত দুটোই। নিজের পাপের অনাগত প্রায়শ্চিত্ত ভরত কোলেকে স্বস্তি দেয়না বরং চেতনার দ্বন্দ্বের পুরো গল্পজুড়ে অবিমিশ্রিত হাহাকার। ভরত কোলের মনে ভয়ের রাজত্ব বাসা বাঁধে।অবৈধ উপায় অর্থ উপার্জন করে সেটা রক্ষা করার যন্ত্রণা তার অস্তিত্বকে নড়বড়ে করে দেয়। এ তো গেলো গল্পের ভেতরের কথা। কিন্তু নিজের পাপ যে তার প্রজন্মকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে তা কে জানত! হয়ত নিজের জীবন নিয়ে সংশয় ছিল তার কিন্তু একমাত্র সন্তানের করুণ পরিণতি ঘুনাক্ষরেও কি মনে হয়েছে একবার!

সুরেন গলার দুপাশের শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করে কিন্তু তার টাকরা পর্যন্ত ঠাসা রুমাল। আওয়াজ বেরোয় না। খুব ক্ষীণ হাওয়া বেরোবার অদ্ভুত একটা আওয়াজ হতে থাকে। ক্রমাগত সে মাথা এপাশ ওপাশ করে। ঝন্টু উরুর ওপর আরো চেপেচুপে বসতে বসতে বলে, হা হা শালা, চিৎ হয়ে মনে মনে বউকে ঠাপা। বামহাতে সে সুরেনের কুকড়ে যাওয়া শিশ্ন মুঠো করে ধরে ইলাস্টিকের মত টেনে লম্বা করে। তারপর ডান হাতের ডেগার দিয়ে পোচ দেয়।

অন্তর্গত রাজনীতি সেটাই যা ক্রমান্বয়ে ফিরে আসে পিতা থেকে পুত্রের দিকে। গল্পের এমনই নিষ্ঠুর বাস্তবতা।

কায়েস আহমেদ জীবন বাস্তবতার শিল্পী। জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা তাঁর গল্প বলার সম্বল। পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার পরিণতি এমন এক বাস্তবতা তা কলমের আখরে লেখক নিজের মত করে লিখেছেন। আমি বিশ্বাস করি বহু বহু বছর তিনি পাঠকের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।