You are currently viewing চোখ/ মাসুম আহমদ

চোখ/ মাসুম আহমদ

চোখ/ মাসুম আহমদ

আমার বাবা এবং মায়ের বিয়ের গল্পটা একটু আলাদা। একটু আলাদা বললে ভুল হবে, অনেক বেশি আলাদা। ইংরেজিতে বললে হয়ত বলা যায় এক্সট্রা অর্ডিনারী। আমার বাবা একজন ধনীর দুলাল, তাও আবার একমাত্র দুলাল। দেখতে শুনতেও অনেক সুদর্শন। ভালো চারিত্রিক গুনাবলির অধিকারী। পড়াশুনায় অনেক ভালো। জীবনে কোনদিনও ক্লাসে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয়  হননি। মেট্রিক ইন্টারে দুইটাতেই বোর্ড স্ট্যান্ড করেছেন। যাকে বলে কম্পলিট প্যাকেজ, একের ভিতর অনেক।

আমার দাদা যে কতো টাকার মালিক ছিলেন সেটা উনি নিজেই বলতে পারতেন না। সারাজীবন ব্যবসা বানিজ্যের পিছনে দৌড়ে দৌড়ে টাকার পাহাড় গড়েছেন। শিল্পপতি বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে আমার বাবা পৈত্রিক সুত্রেই ধনী ছিলেন। দাদা মারা যাওয়ার পর উনার সব সম্পত্তি, ব্যবসা বানিজ্যের  মালিক একমাত্র সন্তান হিসাবে আমার বাবা হয়ে যান। গল্পটা যেহেতু আমার বাবা এবং মায়ের বিয়ের গল্প সেহেতু আমার দাদার টাকার গল্পের দিকে না গিয়ে বাবা মায়ের গল্পের দিকে যাই।

আমার বাবা একটু একরোখা টাইপ মানুষ। জীবনে যখনই যেটা চেয়েছেন সেটা পেয়েছেন, যেটা করতে চেয়েছেন সেটাই করেছেন। উনি জীবনে কখনই পাছের লোকে কি বললো বা কি বলবে সে দিকে কখনই খেয়াল দেননি। উনি উনার ইচ্ছাকে, উনার চাওয়া পাওয়াটাকেই প্রধান্য দিয়েছেন।  আমার দাদাও আমার বাবাকে তার ইচ্ছেমতো চলাফেরা করার সুযোগ দিতেন। এজন্য আমার দাদী সবসময় আমার দাদাকে বলতেন, দেখবো তোমার আস্কারায় ছেলেটা একদিন গোল্লায় যাবে।

তরুণ বয়সে একবার আমার বাবা’র ইচ্ছা হলো উনি পিয়ানো শিখবেন। শুরু হলো পিয়ানো শিখানোর ওস্তাদ  খোঁজা। অনেক খোঁজাখোজির পর একজন উস্তাদ পাওয়া গেলো। কিন্তু পাওয়া যাওয়ার পর সেখানে একটা সমস্যা দেখা দিলো। বাবা চাচ্ছিলেন তাকে যেনো বাসায় এসে পিয়ানো শিখানো হউক। এমনকি ডাবল পয়সার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু পিয়ানোর ওস্তাদ যিনি ছিলেন উনি কোনভাবেই বাসায় এসে শিখাতে রাজি হলেন না। উনি ক্লিয়ারলি বলে দিলেন, পিয়ানো শিখতে চাইলে উনার বাসায় গিয়েই শিখতে হবে। অবশেষে বাবা কোন উপায় না দেখে ওস্তাদের বাসায় গিয়েই পিয়ানো শিখা শুরু করলেন।

আমার বাবা’কে যিনি পিয়ানো শিখান উনি বয়স্ক একজন মানুষ। পরিবারে উনার একমাত্র একটা মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। ছোটখাট টিনসেডের একটা বাসায় মেয়েকে নিয়ে থাকেন। তাদের আর্থিক অবস্থা অনেকটা দিনে আনি দিনে খাই। তিনি প্রথম জীবনে বাদ্যযন্ত্র বাদক হিসাবে রেডিওতে কাজ করতেন। অবসরের পর বাসায় ছাত্রদের বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্র শিখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।

ঠিকই ধরেছেন, পিয়ানো শিখানোর ওস্তাদের একমাত্র মেয়েই হলেন আমার মা। এখন হয়ত ভাবছেন, গুরুতে বললাম আমার বাবা এবং মায়ের বিয়ের গল্পটা এক্সট্রা অর্ডিনারি গল্প। কিন্তু এখন তো দেখছি একদম সিম্পল। ট্যাপিক্যাল বাংলা সিনেমার নাটকের গল্পের মতো। প্রাইভেট টিউশনি পড়তে গিয়ে শিক্ষকের মেয়ের সাথে প্রেম। এরকম গল্প তো আমাদের চারপাশে খুবই কমন। তাদের বিয়ের মেইন থিমটা কমন হলেও টোটাল ব্যাপারটি কিন্তু কমন ছিলো না। সেটা কেমনে তা বুঝতে হলে পুরা গল্পটা পড়তে হবে,  পড়া শেষে হয়ত সেটা বুঝতে পারবেন।

আমার মা হলেন একজন অন্ধ মানুষ। জন্মান্ধ হওয়ার কারণে এই পৃথিবীটা দেখার সুযোগ উনার কখনই হয়নি। তারপর উনি আমার বাবার চেয়ে বয়সে পাঁচ বছরের বড় ছিলেন। দেখতেও আমার মা খুব একটা সুন্দর না। গায়ের রঙ কালো। অন্ধ, গায়ের রঙ কালো , গরীব বা বয়সে বড় হওয়াটা হয়ত আমার বাবার জন্য খুব একটা সমস্যা ছিলো না। আসল সমস্যা ছিলো আমার মা ছিলেন হিন্দু, আর আমার বাবা হলেন মুসলমান।

তখনকার সময়ে একটা বনেদি মুসলিম  ঘরের কোন ছেলে কোন হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করবে সেটা তো কেউ কল্পনাও করতে পারতো না। আমার বাবা শুধু কল্পনা না সেটাকে বাস্তবেও রূপ দিয়েছেন। সেজন্য তাকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে। সেই যুদ্ধটা ছিলো নিজের বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে, পরিবার-পরিজন আত্মিয় স্বজনদের  বিরুদ্ধে, আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এখন কি কিছুটা আন্দাজ করতে বা বুঝতে পারছেন, কেন আমি আমার বাবা এবং মায়ের বিয়েটাকে এক্সটা অর্ডিনারী বলেছি?

ধনীর একমাত্র দুলাল, সুদর্শন, পড়াশুনা জানা একটা ছেলে যখন বিয়ে করে অন্ধ, কালো, গরীব, অশিক্ষিত, হিন্দু একটা মেয়েকে, তাও আবার বয়সে বড় একটা মেয়েকে, তখন খুব সহজেই বোঝা যায় তাদের দাম্পত্য  জীবনের শুরুটা খুব একটা সহজ ছিলো না। খুব সহজেই অনুমান করা যায় তারা কতোটা ঝড়ের ভিতর দিয়ে শুরু করতে হয়েছে তাদের দাম্পত্য জীবন।

একটা সময় আমার দাদা দাদি মারা গেলেন। আমার বাবা’র হাতে সব ক্ষমতা চলে আসলো। তখন থেকে আস্তে আস্তে সবকিছু বদলে যেতে শুরু করলো। অন্ধ হওয়ার কারণে আমার মা পড়াশুনা খুব একটা করতে পারেন নি। বাবা প্রথমেই মায়ের পড়াশুনার ব্যবস্থা করলেন। মা গান গাইতে জানতেন। বাবা মায়ের জন্য গানের মাস্টার রেখে গান শিখালেন।  সময় মতো খাওয়া দাওয়া, গোসল করা, বাহিরে যাওয়া, বই পড়ে শুনানো থেকে শুরু করে জীবনের যাবতীয় কিছু টেইক কেয়ার করা জন্য বাবা মায়ের জন্য আলাদা দুইজন মানুষ রেখেছিলেন। যারা মাকে সব সময় দেখাশুনা করতো। সব সময় মিন চব্বিশ ঘন্টা।

দাদা দাদি মারা যাওয়ার পর বাবা ইচ্ছে করেই নিজের আত্মিয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। কারণ বাবা কোনভাবেই চাননি মায়ের দিকে কেউ আড়চোখে তাকিয়ে কোন কথা বলুক। নানা মারা যাওয়ার পর আমার মায়ের দিক থেকেও কোন আত্মিয় স্বজন ছিলো না। তাই বলা যায় বাবা মায়ের জন্য পুরা একটা আলাদা দুনিয়া বানালেন যেখানে বাবা এবং মা তাদের সুখের রাজ্য গড়ে তুললেন। সে সুখের রাজ্যে এক সময় রাজপুত্র হিসাবে আমার আগমন ঘটে।

আমার জন্মের পর বাবা মা দুজন খুব খুশি হলেন। কিন্তু বাবা’র খুশিটা খুব বেশিক্ষণ টিকলো না। কারণ আমিও আমার মায়ের মতো জন্মান্ধ হয়ে জন্মালাম। আমার বাবা তার সারাজীবন আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন কিভাবে আমার মাকে সুখে শান্তিতে রাখা যায়। সব সময় চেস্টা করেছেন আমার মাকে যেনো কোনরকম দুঃখ কষ্ট ছুঁতে না পারে। তাই আমার জন্মের পর যখন দেখলেন আমি অন্ধ হয়ে জন্মেছি, তখন ঠিক করলেন আমার অন্ধত্বের বিষয়টি তিনি আমার মাকে কখনোই জানাবেন না।

শুরুতেই বলেছিলাম, আমার বাবা একটু একরোখা টাইপ মানুষ। জীবনে যখনই যেটা চেয়েছেন সেটাই করেছেন। আমার বয়স এখন আঠারো বছর। আমার মা এখনো জানেন না যে আমি অন্ধ। জানি এটা শোনার পর চিন্তা করছেন এটা কিভাবে সম্ভব! এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে সেটা আরেক বিশাল গল্প। সেই গল্প সংক্ষেপে করে বললে বলবো, আমার বাবা একজন সুপারম্যান। আর সুপারম্যানদের দ্বারা সবকিছুই সম্ভব।

আমি যখন আমার মায়ের সাথে গল্প করি তখন আমার মা আমাকে অনেক প্রশ্ন করেন। এই যেমন পুর্ণিমা রাতে আসমান দেখতে কেমন, পাখিরা যখন উড়াল দেয় তখন সেটা দেখতে কেমন লাগে, উত্তম কুমার কি তোর বাবার চেয়ে বেশি সুদর্শন ইত্যাদি ইত্যাদি। মা এসব প্রশ্নের শেষ করে প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, পৃথিবীটা দেখতে খুব সুন্দর, তাই না বাবা? আমি উত্তরে বলি, হ্যাঁ মা, পৃথিবীটা দেখতে খুব সুন্দর। তখন আমার মা আফসোস করে বলেন, ইস আমি যদি তোর মতো করে পৃথিবীর সুন্দরটা দেখতে পারতাম! তখন আমি জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, মা তুমি কিন্তু সুচিত্রা থেকেও সুন্দরী, আর বাবা উত্তম কুমারে চেয়েও সুদর্শন! সেটা শুনে আমার মা তখন হেসে উঠেন। আর আমি আমার মায়ের হাসি মুখটা কল্পনা করতে চেষ্টা করি।