You are currently viewing অঘ্রাণের গন্ধের মতন শাহিদ আনোয়ারের কবিতা/ জিললুর রহমান

অঘ্রাণের গন্ধের মতন শাহিদ আনোয়ারের কবিতা/ জিললুর রহমান

অঘ্রাণের গন্ধের মতন শাহিদ আনোয়ারের কবিতা

জিললুর রহমান

আমার কৈশোর যৌবনের বেড়ে ওঠা একটি স্বৈরাচারী সরকারের রুদ্ধশ্বাস কষ্টের ভেতরে। কবিতাপাড়ায় যখন হাঁটাহাঁটি শুরু করেছি আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে, তখন এক গুমোট হতাশার ভেতর দিয়ে চলেছিল সমাজ, কখনও প্রতিবাদ-প্রতিরোধে মুখর, আবার কখনওবা নিস্তেজ ঝিমিয়ে পড়ার ভেতর দিয়ে সমরতন্ত্রের একনায়কতান্ত্রিক গণতন্ত্রের লালা আমাদের নিঃশ্বাস তপ্ত করছিল। আমাদের এই হতাশাজনক পরিবেশে কবিদের কবিতার ভাষা, শব্দরাজি, এমনকি উপমাগুলিও বেশ উচকিত হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদী-প্রতিরোধী শব্দসঞ্চালনে। আশির দশকের অনেক কবির কবিতায় তাই উচ্চকন্ঠ শব্দমালার ঝংকারে পাঠক পেলব কবিতার সুরটিকে খুঁজে পান না বলে মৃদু অভিযোগও অনেকেই করেছেন। কিন্তু এই দুর্বহ সময়ের যন্ত্রণায় পিষ্ট হতে হতেও যে কবি তাঁর উচ্চারণে কাব্যিক আবহ এবং সময়ের ছাপ একসাথে ধরে রেখে নিবিষ্ট চিত্তে কেবল নিজের কাজটিই করে গিয়েছেন, ক্রান্তিকালের সেই প্রেমিক কবির নাম শাহিদ আনোয়ার। তাই তিনি দুর্যোগের ভেতরেও প্রণয়ের খবর রাখেন। তাই আমার দৃষ্টিতে শাহিদ আনোয়ার একটি বিষণ্ন প্রেমিকের নাম, যার কণ্ঠ দোল খায় প্রেম ও অস্থিরতার দোলাচলে। তাই আমরা শুনতে পাই তাঁর কণ্ঠে — “পুরনো প্রেমের ঘ্রাণ – অঘ্রাণের গন্ধের মতন”। (১২ বছর পর / দাঁড়াও আমার ক্ষতি/ ২০০৫)

‘১২ বছর পর’ কবিতায় যদিও সে-কোন ১২ বছর পরের কথা বলা হয়েছে তা আমরা বুঝতে পারি না, কিন্তু আমরা জানতে পাই “নূহের জাহাজে ছিল একখানা অদম্য প্রেম” এবং সে অদম্য প্রেম “গতরাতে খুলেছিল দুই চোখে স্বপ্ন ক্যাবারে”। এই কারণেই আমার দৃষ্টিতে কবি শাহিদ আনোয়ার ক্রান্তিকালের শব্দচয়ন করে থাকলেও মূলত রোমান্টিক ঘরানার কবি। এই রোমান্টিকতার ভুরিভুরি উদাহরণ মিলতে পারে তাঁর কবিতার ছত্রেছত্রে –

ক) “বাড়ন্ত চুম্বন কণা রমনীর ঠোঁটে

তৃষার দর্পনে নড়ে তার প্রার্থনা

মৌন অভিধান জুড়ে যে গোলাপ ফোটে

নখে কিছু লেগে থাকে কবিতার কণা” (মৌন অভিমান / দাঁড়াও আমার ক্ষতি/ ২০০৫)

খ) আমার দুঠোঁটে ওড়ে প্রেমপোড়া ধুলো

তোমার দু ঠোঁট জোড়া পেঁজা পেঁজা তুলো

আমার দুঠোঁটে নড়ে মৃদু আরাধনা

অস্তিত্বের অন্ধকার হিম আলপনা” (ঠোঁট / বৈদেহী এক ওষ্ঠ পোড়ে / ২০০৮)

গ) ফুলের মধ্যে নরক পোড়ে

পানির মধ্যে তৃষ্ণা

নষ্ট বাশি ফুঁ দিয়ে যায়

একবিংশের কৃষ্ণা” (একবিংশের কৃষ্ণা / বৈদেহী এক ওষ্ঠ পোড়ে / ২০০৮)

ঘ) আমায় এবার ঈশ্বরত্বে বরণ করো দেবী

আমায় এবার চন্দ্রপ্রভার উত্স করে নাও

হে অনন্ততমা তোমার অষ্টাদশী ঠোঁট

মনিষ্যি এক কবির কাব্যে আলতো ছুঁয়ে দাও” (দেবী / বৈদেহী এক ওষ্ঠ পোড়ে / ২০০৮)

তবে তাঁর এই রোমান্টিকতার স্বর, শব্দের গাঁথুনি, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং সাম্প্রতিকতা ও চিরন্তনতার এক অনন্য সম্মিলনের প্রতীক। যেমন ‘স্বপ্নে’ কবিতায় তিনি প্রিয়াকে জানাচ্ছেন যে, স্বপ্নে তিনি নীলাভ ক্ষরণ ঘটাবেন এবং এই ঘোষণাও দেন, পুরুষ আত্মরতিপ্রিয় হলেও তিনি স্বর্গীয় দূত, তাই তিনি আত্মরতিপ্রিয় নন।

“স্বপ্নে ঘটাবো প্রিয়া নীলাভ ক্ষরণ

প্রেমান্ধ মন্দাকিনী পাগল তোরণ

সোমক্ত প্রস্রবণে গোলাবি খাবার

ধারালো দন্তে কর এক্ষুণি সাবাড়

শুনেছি পুরুষ হয় আত্মরতিপ্রিয়

আমি তো পুরুষ নই – দূত স্বর্গীয়” (স্বপ্নে / দাঁড়াও আমার ক্ষতি/ ২০০৫)

তাঁর কবিতার ভেতর একই সাথে প্রেম, ক্রান্তিকালের দহন, মৃত্যুচিন্তা এবং কালচেতনা সব সংমিশ্রিত হয়ে আবির্ভূত হয়ে থাকে। ক্ষতিকে দাঁড়ানোর জন্যে বলার সাহস একমাত্র কবিরই থাকে।

“ও আমার প্রিয়তমা –

মৃত্যু আসে পায়ে তার রুপোলি খড়ম

আমাকে অচেনা লতা করে বেষ্টনী

পিপীলিকার দুঠোঁট পোড়ে

নিষিদ্ধ রৌদ্রের নুন” (হতাশা ও আশা / অগ্রন্থিত / শ্রেষ্ঠ কবিতা / ২০১৯)

এখানে এই-যে মৃত্যুর পায়ের ‘রুপোলি খড়ম’ এবং ‘নিষিদ্ধ রৌদ্রের নুন’ উপমাগুলো একটি শব্দের ভেতর যে অসামান্য চিত্ররূপ আমাদের মানসপটে ফুটিয়ে তোলে এবং এক অনন্ত ভাবনাজালে বন্দী করে রাখে, তা যে-কোনো পাঠককেই অনেকক্ষণ বুঁদ করে রাখবে। তারই পরম্পরায় আবার ধ্বনিত হয়

“আস্তে আস্তে আমি পুরনো হয়ে উঠি

আস্তে আস্তে আমার

সাদা পালক খসতে থাকে

আস্তে আস্তে আমি নোংরা হয়ে উঠি

আস্তে আস্তে ধুসর…” (হতাশা ও আশা / অগ্রন্থিত / শ্রেষ্ঠ কবিতা / ২০১৯)

কবির প্রেম এবং মৃত্যুচিন্তা মাঝেমাঝে কিংবা বলা যায় জীবনের শেষদিকে এসে একাকার হয়ে গিয়েছে। মৃত্যুক্রান্তা কবিতায় আমরা প্রেম এবং মৃত্যুকে যেন এক মহাসম্মিলনী বিন্দুতে উপনীত হতে দেখি।

“চোখেতে কে এঁকেছে এক উচ্ছল ময়ূর

কে এঁকেছে অনিন্দিতা কত্থকের সুর

ভেদকথা বোঝা দায় ময়ূরের গান

কবিকে সিজদা দেয় দেহাগত প্রাণ” (মৃত্যুক্রান্তা / অগ্রন্থিত / শ্রেষ্ঠ কবিতা / ২০১৯)

এখানে “ভেদকথা” শব্দের প্রয়োগ এবং কবির বাউল মনের পরিচায়ক যে চিন্তার বিকাশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার সাথে নতুন মাত্রা তৈরি হয়, যখন দেহাগত এই প্রাণ কবিকে সিজদা দেয়। শাহিদ আনোয়ারের এটা আরেক চমৎকার গুন যে তিনি অবলীলায় আরবী ফারসি শব্দকে বাংলার সাথে সম্পূর্ণ আত্মস্থ করে ব্যবহারের মুনশিয়ানা জানেন। মৃত্যুর সাথে প্রেমের সম্মিলনের আরেকটি চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে ‘মৃত্যু’ কবিতা।

“চুম্বনে চিবোই কিছু মল্লিকার হাড়

আয়ুকে জাপটে ধরে শার্টের কলার” (মৃত্যু / অগ্রন্থিত / শ্রেষ্ঠ কবিতা / ২০১৯)

সত্যিই চমকে উঠতে হয়, একদিকে ফনীমনসার গাছ হাই তুলছে দোতলার বারান্দায়, অন্যদিকে স্তনে কাব্যগ্রন্থ, চিবুকে চুমুর মাখন, আর ওষ্ঠে অগাধ সবুজ বিস্তীর্ণ গাঢ় সমর্পন, তার মধ্যে যখন মৃত্যু এসে হানা দেয় তখন “আয়ুকে জাপটে ধরে শার্টের কলার”। প্রেম ও মৃত্যুকে মুখোমুখি শাহিদ আনোয়ারই প্রথম দাঁড় করাননি। সুফিবাদী চিন্তার ভেতরেই এর বীজ নিহিত আছে, আর শাহিদ আনোয়ারও সেই সুফিচিন্তার সাথে অপরিচিত নন। আর আমরা তো জানি কালে কালান্তরে প্রেম ও মৃত্যু চির শ্বাশ্বত ব্যাপার। আমরা যা করি তার নতুন ভঙ্গিতে প্রকাশ নতুন শব্দের যোজনায় তাকে ধরার চেষ্টা। কালে কালে কবিরা এই শ্বাশ্বত প্রেম ও মৃত্যুকে শব্দের মুঠোয় ধারণ করার ধ্যান করে গিয়েছেন, শাহিদ আনোয়ারও তার ব্যতিক্রম নন, আর তাঁর সাফল্য হলো, তাঁর শব্দগুলো যেন কষ্টিপাথরের ঘর্ষণে ঝলসে ঝলসে উঠেছে বারবার।

তাঁর ‘চিতাদাহে প্রেম’ কবিতায় দেখি তাঁর শৈশবের বেড়ে ওঠা ‘শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবনের জন্যে নষ্টালজিয়া, কোনো আঁখি দাশ গুপ্তা’র জন্যে মৃত্যুর পঁচিশ বছর পরও স্মৃতি ধরে রাখার আকুতি সব একাকাক হয়ে এক টুকরো কবিতা হয়ে এইসব বাঁচিয়ে রাখার আকাঙক্ষা ভাস্বর হয়ে উঠেছে।

“যখন চিতায় গেলাম

জ্বলছে আগুন দাউ দাউ শিখায়…

বহুদিন পর

যখন বাসায় যাবো ভাবছি

তখন মনে পড়লো

বুলডোজারের ইস্পাতের দাঁতে

ধুলিসাৎ শ্রী শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবন।

যখন দিদিমনিদের কাছে গেলাম

তারা সবাই পরলোকে।

শুধু মনে পড়লো

এক জোড়া পায়ের পাতা

আগুনের শিখায় হটাৎ তুমি

পা গুটিয়ে নিয়েছিলে।

আঁখি দাশ গুপ্তা

মৃত্যুর পঁচিশ বছর পরেও

আমার স্মৃতিতে তুমি সেই প্রগাঢ় তরুণী

আগামী পঁচিশ বছর পর

আমিও থাকবো না

শুধু কবিতার খাতায়

একটুকরো কবিতা হয়ে তুমি বাঁচবে” (চিতাদাহে প্রেম / অগ্রন্থিত / শ্রেষ্ঠ কবিতা / ২০১৯)

এইযে আখ্যান, এইযে কবিতায় আঁখি দাশ গুপ্তা সহ হৃদয়ের আকুতিটাকে ধরে রাখার, বাঁচিয়ে রাখার আর্তি, এটাই তো মানুষের চিরন্তন আকাঙক্ষা, যা কবির কন্ঠে প্রশ্ন হয়ে ফুটে ওঠে “তোমাকে কি স্মরণ করবে দু-একজন পাঠক?” সেই রোমাণ্টিক চেতনা, যেমন রবিঠাকুর ভেবেছিলেন “আজি হতে শতবর্ষ পরে” কবিতায়। আর আমরা তো আজ জানি শতবর্ষ পরে আমরা ঠিকই রবি ঠাকুরকে পাঠ করি, তেমনি শাহিদ আনোয়ারও পঠিত হবেন অনাদিকালের সহস্র পাঠকের গভীর বোধের ভেতর।

আর আমরা তো জানি, শাহিদ আনোয়ার যতোই মৃত্যুচিন্তায় আকীর্ণ হন না কেন, তিনি গড়ে উঠেছেন সাম্যবাদী চিন্তাচেতনার রাজনীতির আবহের মধ্য দিয়ে। তাই তাঁর উচ্চারণ “স্বর্গকাতর নই আমি”। আর অবলীলায় তাঁকে উচ্চারণ করতে দেখি

“পৃথিবী নামের নীল গ্রহটায় স্বর্গের চেয়ে

কয়েকটি স্বাদ বেশি।

এখানে মায়ামমতায় শেকড়, কাণ্ড, ডালপালা

লতা, বৃক্ষরাজি, বন উপবন, বনস্থালীর আঁকশি জন্মায়।

আমার শিশুপুত্র এখন বড় হচ্ছে পৃথিবীতে

স্বর্গে কোনো শিশু জন্মায় না।

স্বর্গে শৈশবে ফেরার কোনো সিস্টেম নেই

আমার শিশুর হাত ধরে আমি আবার

যৌবনে ফিরে আসব

স্বর্গে সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেই।

আমার কবর ফুলে ফুলে ঢেকে দেবে

আমার পুত্র আমার স্ত্রী

স্বর্গে সেরকম কোনো ব্যব্যস্থা নেই”। (স্বর্গকাতর নই আমি / দাঁড়াও আমার ক্ষতি / ২০০৫)

তাই যে পৃথিবীতে সব সম্পর্কই রক্তের শিরাময়, ছায়াময়, মায়াময়, সব সম্পর্কই নিদারুণ স্বপ্নকাতর, সেই পৃথিবীর জন্যেই কবি বেশি কাতর। ভাষার ভিন্নতা, বাক্য ব্যবহারের ভিন্নতা, আবহের ভিন্নতা সবকিছু ছাপিয়েও সেই “মায়ামমতায় জড়াজড়ি করি, মোর গৃহখানি রহিয়াছে ভরি” কিংবা “ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি”, সেই রোমান্টিসিজম যেন ধ্বনিত হতে শুনি আমাদের একালের কবি শাহিদ আনোয়ারের কবিতায়ও। আর সেই রোমাণ্টিকতার চূড়ান্ত করেন তিনি যখন “অবজ্ঞা” কবিতায় প্রেমিকা এবং ঈশ্বরকে একই রকম ভূমিকায় উপস্থাপন করেন। এই কবিতায় কবি তাঁর হৃৎপিণ্ডটি লাল কাপড়ে ঢেকে পড়ার টেবিলে রেখে দিয়েছিলেন, আর একনজর দেখতে দিয়েছিলেন প্রেমিকাকে এবং ঈশ্বরকে। আর ঈশ্বর এবং প্রেমিকা দুজনেই ছেলেখেলা আরম্ভ করেছিল তাঁর সেই নিবেদিত হৃৎপিণ্ড নিয়ে।

“আজ বিশটি বছর তুমি পাশে নেই আমার

ঈশ্বর নক্ষত্রের মার্বেল ছুঁড়ে দিয়ে

ছেলেমানুষি খেলা খেলতে শুরু করলো

আমার সঙ্গে, তুমি করলে প্রণয়োপহাস।

তুমি আর ঈশ্বর এক সঙ্গে –

অবজ্ঞা করলে আমার হৃৎপিণ্ডকে

আর দু’জনে উড়ে চলে গেলে

অচেনা দেশে” (অবজ্ঞা / বৈদেহী এক ওষ্ঠ পোড়ে / ২০০৮)

শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলনটি পাঠ করতে করতে মনে হচ্ছে যেন কবির প্রেম, সংসার জীবন এবং সংসার যন্ত্রণার ছাপ সবচেয়ে ভালভাবে ফুটে উঠেছে ‘বৈদেহী এক ওষ্ঠ পোড়ে’ গ্রন্থে। তাই এই গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে কবি ভালবাসা কী তা বুঝার চেষ্টা করেছেন। তাঁর ধারণা হয়েছে, “মৃত ভালবাসা থেকে ঠিকরোয় রুপোলি কবিতা”। কেন যেন এই পর্বে এসে মনে হবে, কবি ভালোবাসার মধ্যে কবিতার ক্ষতি দেখতে পাচ্ছেন, এ যেন অবিরাম জীবনের ক্লেদ, কবিকে ছিন্ন করে যাচ্ছে।

“ভালোবাসা বলতে তুমি বোঝাও কি আদমের ফল

নাকি নেমেসিস কোনো, দেবতার অদম্য নিয়তি?

যতোটুকু ভালোবাসা, ততোটুকু কুমারীর ছল,

যতোটুকু লাভ, ঠিক ততোটুকু কবিতার ক্ষতি”। (ক্লেদ / বৈদেহী এক ওষ্ঠ পোড়ে / ২০০৮)

প্রেমিকার বচন আর খনার বচনের মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে তাঁর বেদনার উচ্চারণও রেখেছেন। হয়তো এটা ক্ষণিকের অনুভূতি সংসার যাতনায় কাতর কবির। হয়তো তা ছড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সকল সংসারে। হয়তো এর ভেতরেও বাস করে এক অনাবিল রহস্যময়তার প্রেম। খনার বচন বুঝা যায়, ফলেও যায়, সে সকলেরই জানা; কিন্তু প্রেয়সীর বচন হয় এলোমেলো, তার নিগূঢ় অর্থ, প্রবহমান কথার জোয়ার কখনও কি বিপুল কাঁটা হয়ে বেঁধে!

“তোমার কথা বুঝতে গেলে বিপুল বেঁধে কাঁটা

তোমার কথায় যাচ্ছে ভেঙ্গে নতুন জাগা চর

তোমার কথায় নষ্ট হলেম, ওষ্ঠে কুলুপ আঁটা।

তোমার বচন হত্যা করে মৃদু উষ্ণ প্রাণ

আত্মহনন লাগছে ভালো, শেকড় ছিঁড়ে নাও

কবির চামড়া বিক্রি করো, ছুরিতে দাও শান

মৃত্যু চোখে দেখবো তোমায়, কী সুখ তুমি পাও”। (বচন / বৈদেহী এক ওষ্ঠ পোড়ে / ২০০৮)

তবে কি শাহিদ আনোয়ার সমসাময়িকতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে নিবিষ্ট থাকেন প্রেম ও মৃত্যুচেতনায়? একজন রাজনীতিসচেতন কবি তো কখনও তেমনটি হতে পারেন না। সমাজ তাঁকেও প্রতিনিয়ত আকীর্ণ করেছে। তাঁর প্রথম দিকের কবিতায় সেইসব বেদনাগুচ্ছের মর্মরিত উচ্চারণ আমরা দেখতে পাই। ‘আটচল্লিশ ঘন্টা একটানা হরতালের পর ফিরে পাওয়া স্বাভাবিক জীবন’ কবিতায় একটি সুদীর্ঘ শিরোনামের সুদীর্ঘ কবিতা। এই ৬৯ লাইনের কবিতায় ৪৮ ঘন্টার হরতাল শেষে কবির একটি রেস্তঁরায় বসে যে অনুভূতি তৈরি হয় তার প্রকাশ আমরা দেখেছি।

“নাহ, বন্ধুরা কেউ আসছে না

শুধু কাটা পাহাড়ের গলি থেকে ফিরে আসে, টিং টিং ফিরে আসে

স্বাভাবিক জীবনাবস্থা।

… … …

আমি ঘৃণা করি… করি… করি এই

এই ফিরে পাওয়া স্বাভাবিক জীবনাবস্থা

আমার চা কাপে কাঁপে ওরাঁও মেয়ের ঘাম

জমাট রক্ত

বিধ্বস্ত চা বাগান, ডানকান

… … …

আই হেইট

এই রক্ত পুঁজময়, কালো, ফোসকাবৃত

ব্যথায় কঁকিয়ে কাতর এই স্বাভাবিক জীবনাবস্থা।

রক্তস্রাবের মতো, থুতু ও কফের মতো

কসাই দোকানে দেখা, কাটা মোষের মাথার মতো

ব্যথা ভারাতুর জোড়া নীলাভ চোখের মতো

এই বাতিল জীবন—

আমরা চাইনি ফেরত পেতে

চাই না ফেরত পেতে”

(আটচল্লিশ ঘন্টা একটানা হরতালের পর ফিরে পাওয়া স্বাভাবিক জীবন/

কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে/২০০২)

তাঁর ট্রেডমার্ক হিসেবে পরিচিত কবিতা যা বহুল আলোচিত, বহু উচ্চারণে মুখর, বহু বিশেষণে ভূষিত কবিতা ‘ধাত্রী’ যা “কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে” বলে পাঠকের মুখেমুখে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশান্তরে, কালে কালান্তরে। এই কবিতাটির প্রথম পাঠ আমার সেই আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এই নতুন উচ্চারণে চমকে উঠেছিলাম, শিউরে উঠেছিলাম, সেই শিহরণ আজও মনে পড়ে। আজও যতবার পাঠ করি এই কবিতা, মনে হয় “কবে আর হবে থাকিতে জীবন”; না আঁখিতে আঁখিতে মিলন নয়, মুক্তি। সেই যে অবরুদ্ধতা, আশির দশকে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের অবরুদ্ধ পরিবেশ, বা আজকের ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার যে একঘেঁয়ে জীবন, মানবাত্মার সেই মুক্তি-কামনা শ্বাশ্বত এবং নিয়ত চলমান। সেই আকুতি যেন আবহমানকালের উচ্চারণ হয়ে আমাদের আপ্লুত করে ধাত্রী কবিতায়। এই কবিতার ব্যাখ্যা তো এমনও করা যায়, যে এটি গর্ভের ভেতরে লুকিয়ে থাকা একটি শিশুর আকুল আর্তি, যে ধাত্রী কখন তাকে মুক্ত করবে? কখন সে সুন্দর পৃথিবীর রূপ দেখবে? আবার আমার মতন করে যারা ভাবেন যে এটা মানুষের অনাচার অত্যাচার শোষণ থেকে মুক্তির কথা বলছে, তাকেই বা উড়িয়ে দেবার কোনো সুযোগ কি আছে? সুযোগ কি থাকে যখন কোনো ভাববাদী পাঠক যখন ভাবেন যে, এটা আসলে মানবাত্মার মুক্তির বাণী। সর্বার্থেই এর প্রয়োগ সম্ভব বিধায় এই কবিতার বহুমাত্রিকতা কবিতাটিকে যুগে যুগান্তরে পাঠকমনে নানান ভাবনায় আবিষ্ট করে রাখবে।

“কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে

ধাত্রী আমায় মুক্ত কখন করবে?

শুনেছিলাম সূর্য দারুণ সুন্দর

শুনেছিলাম পৃথিবী দারুণ সুন্দর

শুনেছিলাম তোমার ও মুখ সুন্দর

শুনেছিলাম বিশ্ব দারুণ সুন্দর

বন্ধ চোখের রন্ধ্রে আলো ঝরবে

ধাত্রী আমায় মুক্ত কখন করবে?

জড়িয়ে আছি গর্ভে ফুলে ফুলে

মনোটোনাস রাত্রি ওঠে দুলে

উৎস থেকে আমায় ফেলো খুলে

মিথ্যা থেকে আমায় লহো তুলে

স্বপ্ন ছিঁড়ে দোলনা কাছে আনো

ধাত্রী আমায় দুহাত ধরে টানো। (ধাত্রী / কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে / ২০০২)

তাই এই কবিতার বহুমাত্রিকতা আমাকেও প্রায়শঃই বিভোর করে রাখে। যেমন, মাতৃগর্ভের অন্ধকার থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলে, ধাত্রীর সহযোগিতা শিশুকে মুক্ত করে পৃথিবীর সুন্দর আলোকময়তায় নিয়ে আসে, তেমনি করে আজ মানবমুক্তির সেই ধাত্রীর বড়ো প্রয়জন বোধ করছি, যে আমাদের দু’হাত ধরে টেনে এই মিথ্যা সমাজ থেকে কলুষ থেকে একঘেঁয়েমির যন্ত্রণা থেকে তুলে আনবে, শোনাবে মুক্তির বাণী।

উল্লেখযোগ্য যে স্বরবৃত্তের ছন্দে এমন একটি গভীর ভাবের কবিতা রচনাও একটা ভয়ানক দুঃসাহসী কাজ। তাঁর আরও অনেক কবিতায় স্বরবৃত্তের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।

শাহিদ আনোয়ারের আরেক ধরনের কিছু কবিতা সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের ভিন্ন বয়ানের এবং ভিন্ন মেজাজের। এখানে সেমেটিক বা মুসলিম মিথলজির ব্যবহার করে কবিতার নতুন ব্যঞ্জনা তৈরির প্রয়াস পেয়েছেন। ‘আল্লাহর রঙে’ কবিতায় কবি নিজেকে আল্লাহ-র রঙে রঞ্জিত কল্পনা করে বলছেন, আর কে আছে এমন সুন্দর? শুধু তাই নয়, তাঁর বয়ানে আল্লাহ-র দু’খানি চোখে ক্লান্তির ছাপও ধরা পড়েছে। তাঁর বর্ণনায় পরলোক যেন বালিকাবেশী। আর কালো নেকাবের ফাঁকে এই বালিকাবেশী পরলোক আত্মার চন্দনচর্চা সেরে নেয় এবং সমুদ্রস্নানও সারে।

“আমরা আল্লাহ-র রঙে রঞ্জিত হয়েছি

আর কে আছেন এমন সুন্দর?

… … ……

তরঙ্গিত রুপোলি বর্ণে নিতে দীক্ষা এখন দূরে

সার বেঁধে দাঁড়িয়েছে ভিক্ষু যতদিন

পরলোকে ঠোঁট রেখে আল্লাহ সবুজ বর্ণ তার চোখ

খোলে যেন অশালীন

প্রাণী এক, রক্তাভ ঠোঁট তার, খুলে নেবে বুভুক্ষু জোছনা চাদর

পরকাল ম্লান হেসে স্তনবৃন্ত থেকে ঢেলে দেয়

বাইকাল ছন্দের ম্রিয়মান গোলাবি আদর।

সিবগাতাল্লাহ ওয়ানমান, আহসান মিনাল্লাহে সিবগাতান

রুপোলি বর্ণ থেকে হয় মানব ও মানবীর নয়া খান্দান” (আল্লাহর রঙে/দাঁড়াও আমার ক্ষতি/২০০৫)

আরেকটি কবিতায় তিনি সংলাপের ব্যবহার করেছেন নমরুদ এবং আল্লাহর মধ্যে। এখানে অনেকটা প্যারাডাইস লস্টের মতো কিংবা মেঘনাদ বধ কাব্যের মতো নমরুদকে প্রতিনায়কের চরিত্রে দাঁড় করিয়ে উচ্চারিত হয় প্রেম ও কবিতার সপক্ষে কবির অবস্থান।

“সুরাহা!

আমি নমরুদ শুধু

ডুবে যাই বেশ্যা আঁচলে

বস্তুত

আমি এক মরুচারী বিষণ্ন দুঃখী আবরাহা।

আল্লাহঃ গিয়েছে আসল তোর

চিরকাল দিয়ে যাবি সুদ

‘দহন’ নরকে তুই পুড়ে চল

প্রেম—নমরুদ।

ন্মরুদ শুয়ে থাকে সিজ্জিনে

অনন্ত পাপ শয্যায়

তবুও দুহাতে তার

কবিতার নূর ঝলকায়”। (নমরুদ / দাঁড়াও আমার ক্ষতি / ২০০৫)

যারা কবি শাহিদ আনোয়ারকে চেনেন, তারা জানেন একটি দীর্ঘ কালখণ্ড তিনি অসুস্থতার ভেতর দিয়ে যাপন করেছেন, তার ভেতরেও নিজেকে নিরন্তর সৃজনশীল রাখা এবং কবিতায় এমন ধ্রুপদীঢঙ্গে নিমগ্ন থাকা ভয়ংকর রকমের কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এই যে প্রতিনিয়ত অস্তিত্ব এবং সুস্থতার সংগ্রামে লিপ্ত থাকার প্রভাব তাঁর কবিতায় আমরা দেখি “হতাশা ও আশা’ কবিতায়।

এ নিছক বেঁচে থাকা, সময়ের সাথে সংগম

অবিরাম দোল খায় শংখচূড় ইচ্ছের ফণা

আয়ুর স্ফটিক খেকো ঈশ্বরীও হলো বেরহম

কপালে লেপ্টে থাক পয়াংমুখ মৃত্যুর কণা” (হতাশা ও আশা / অগ্রন্থিত / শ্রেষ্ঠ কবিতা /২০১৯)

কিংবা দালি ও আমার দ্বিতীয় কান কবিতায় যখন কবি তাঁর “আসল সময়” খুঁজে পাবার জন্যে সালভাদর দালির কাছে ঘড়িগুলো পাঠানোর প্রস্তাবনা রাখছেন, কিংবা দা ভিঞ্চিকে প্রচুর প্রেমের চিঠি থেকে প্রকৃত প্রেমিকা খুঁজে দিতে বলবেন, তখন জীবনজুড়ে যে দাগ ও দগ্ধতা কবিকে পোড়াচ্ছে তার কিছু ইশারা পাওয়া যায়। আর আমরা তো জানি শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে কেবল মাতাল অন্ধকারই থাকে না, একটি গোলাপও ফুটে থাকে। আমাদের এই মাতাল অন্ধকার নয়, একটি সুন্দর রক্তিম গোলাপের ভীষণ প্রয়োজন।